কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর নিয়ে বিভ্রান্তি
জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ কার্যকরের প্রক্রিয়া নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তার ওই সব বক্তব্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মককর্তা, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের প্রধান এবং আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। সর্বশেষ শনিবার সন্ধ্যায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি কারাগারে না পৌঁছাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে না।
গত বছরের ৯ মে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে পরে তিনি সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিমকোর্ট তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন গত ৩ নভেম্বর। ৪ নভেম্বর এ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এরপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। রিভিউ আবেদন দায়ের, জেল কোডে (কারাবিধিতে) প্রদত্ত বিধানের অনুসরণ নিয়ে আবারও ওঠে নানা বিতর্ক।
রায় ঘোষণার দিনেই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এ জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে কারাবিধি অনুসরণ করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান। এরপর ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গুলশানে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে কারা কর্তৃ?পক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কামারুজ্জামানকে আপিল বিভাগের রায় জানানো হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সেদিন আনিসুল হক বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি আইজি প্রিজন সাহেবকে করি নাই, কিন্তু আমি যতটুকু জানি তাকে (কামারুজ্জামান) জানানো হয়েছে, আপিল বিভাগে খারিজ হয়েছে এবং তার মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে।
তিনি আরও জানান, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার জন্য ৭ দিন সময় পাবেন। যে মুহূর্ত থেকে তিনি ফাঁসির খবর জেনেছেন সে মুহূর্ত থেকে ওই সাত দিন গণনা শুরু হয়েছে। কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার সময় রোববার শেষ হচ্ছে, এখন কী হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শনিবার দুপুরে মন্ত্রী বলেন, “প্রকাশিত যে রায় আছে তার ওপরই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারাটি দেখেন, যখন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয় তখন লেখা ছিল হাইকোর্ট এখন আপিল বিভাগ। তাকে এটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সাত দিন সময় দিতে হয়। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাকে মার্সি চাওয়ার জন্য সেই সময় দেয়া হয়েছে।”
কারাবিধি ৯৯১ ধারায় আসামিকে অবহিতকরণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আনিসুল হক বলেন, ওই ধারাটি যদি পড়েন তাহলে দেখবেন অবহিতকরণের কথা বলা আছে। তার মানে আনুষ্ঠানিকভাবে কাগজপত্রে জানাতে হবে তা নেই। কথা হচ্ছে সে বিষয়টি তাকে জানানো হয়েছে। আদেশ যায়নি।
এ সময় কীভাবে কামারুজ্জামানকে বিষয়টি জানানো হল সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান। তিনি বলেন, আদেশ যায়নি মানে কী? তাকে জানানো হয়েছে। ব্যাপারটি হল- আমি যত দূর জেনেছি, প্রিজন অফিসিয়ালস হ্যাভ টোল্ড হিম দ্যাট আপনার আপিল ডিসমিসড হয়েছে। আপনার মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। কিসের ভিত্তিতে জানানো হয়েছে- জানতে চাইলে মন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে খবরের কাগজ কি মিথ্যা? এ সময় সাংবাদিকরা কালকের পর কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে কিনা জানতে চান। উত্তরে মন্ত্রী বলেন, তিনি জানেন না। সুপ্রিমকোর্ট মিলনায়তনে একটি সেমিনারের উদ্বোধন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর সোনাগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌঁছাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে না।
রায়ের পর গত বৃহস্পতিবার নিজ কার্যলয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর এটা সরকার যেদিন ঠিক করবে, সেদিন দণ্ড কার্যকর হবে। আর সংক্ষিপ্ত আদেশ নাকি পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাঠানো হবে সেটা আপিল বিভাগের বিষয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দিয়েই তার সাজা কার্যকর করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। আপিল আদালত যে রায় দেন, সেটা ট্রায়াল কোর্টে (ট্রাইব্যুনালে) যায়। ট্রায়াল কোর্ট সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। তিনি আরও বলেন, এ রায় তো উনারা আগেই পেয়ে গেছেন। এখন এটা কার্যকর সময়ের ব্যাপার মাত্র। সময়ের ব্যাপারের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এটা এক সপ্তাহ হতে পারে, তিন দিনও হতে পারে। এটা সুপ্রিমকোর্টের আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে একমাসও হয়ে যেতে পারে। তবে রায় রিভিউর এবং জেল কোডে প্রদত্ত সুযোগ কামারুজ্জামান পাবেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে রায় ঘোষণার দিনেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের প্রধান গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। এরপর সরকারের আদেশে তা কার্যকর করা হবে।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে, আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য সঠিক নয়। যুক্তি হিসেবে তিনি বলছেন, প্রাণভিক্ষার সুযোগ জেল কোডে আছে। কামারুজ্জামানকে এ সুযোগ দিতে হলে জেল কোড অনুযায়ীই দিতে হবে। আর জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির পরে আদেশের কপি হাতে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কামারুজ্জামানকে জানাবে। এই জানানোর পর থেকে তাকে প্রাণভিক্ষার সাত দিনের সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমার জানামতে, আপিল বিভাগের আদেশের কপি এখনও ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়নি এবং ট্রাইব্যুনাল তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেননি। তাই প্রাণভিক্ষার সাত দিনের সুযোগ শেষ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(৩) ধারা অনুযায়ী আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর সরকার যখন ইচ্ছা তখন ফাঁসি কার্যকর করতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ একটি বিশেষ আইন। এ আইনে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে সংবিধানে পদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত রয়েছে। এ আইনের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে প্রদত্ত দণ্ড কার্যকর করবে সরকার। অন্যদিকে কারাবিধির ৯৯১(১) উপবিধিতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় ও আদেশ পাওয়ার পর বিচারিক আদালত সাজাপ্রাপ্ত আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। ওই পরোয়ানা কারা কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পড়ে শোনাবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারার ৩ উপবিধিতে বলা হয়েছে, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তবে সাত দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কারা কর্তৃপক্ষ। সঙ্গে পৃথক পত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ এবং আসামির দণ্ডের বিষয়ও উল্লেখ থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। জবাব দেয়ার সময়সীমা কারাবিধিতে নেই। তবে ১৪ দিনেও জবাব না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি আবেদন মঞ্জুর করেননি বলে বিবেচিত হবে। এটা কারা কর্তৃপক্ষকে জানাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির দিন থেকে ২১ দিনের পর এবং ২৮ দিনের মধ্যে রায় কার্যকর করতে হবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারার ৫ উপবিধিতে বলা হয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলেও মৃত্যু পরোয়ানা জারির ২১ দিন আগে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে না।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে জেল কোড প্রযোজ্য হবে না। যেমনটি হয়নি আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। ৫ ডিসেম্বর তার মামলার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল সে দিনেই কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে তখন জেল কোড অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ না করেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য জেল কোডে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে চেম্বার জজ ১০ ডিসেম্বরে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন।
কাদের মোল্লার পক্ষে দুটি রিভিউ আবেদন করা হয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে পুনর্বিবেচনার আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুনানি হয়। ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি শুধু ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড। কিন্তু তাতে কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়নি। রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ করে খারিজ করেছেন নাকি রিভিউ গ্রহণের আগেই খারিজ হয়েছে সেটি স্পষ্ট করেননি আপিল বিভাগ। এমনকি সেই রায়টি এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাই রিভিউ করা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে আইনি তর্কের মীমাংসা হয়নি। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ক্ষেত্রে জেল কোডের বিধান অনুসরণ করা হয়নি। কামারুজ্জামানের মামলার ক্ষেত্রেও জেল কোডের বিধান অনুসরণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। বিষয়টি অনেকটা সরকারের ওপর নির্ভর করছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রিভিউর আবেদন করবে বলে জানিয়েছে। আর এ আবেদন দায়েরের জন্য আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপিটি প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গত বছরের ৯ মে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে পরে তিনি সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিমকোর্ট তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন গত ৩ নভেম্বর। ৪ নভেম্বর এ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এরপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। রিভিউ আবেদন দায়ের, জেল কোডে (কারাবিধিতে) প্রদত্ত বিধানের অনুসরণ নিয়ে আবারও ওঠে নানা বিতর্ক।
রায় ঘোষণার দিনেই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এ জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে কারাবিধি অনুসরণ করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান। এরপর ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গুলশানে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে কারা কর্তৃ?পক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কামারুজ্জামানকে আপিল বিভাগের রায় জানানো হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সেদিন আনিসুল হক বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি আইজি প্রিজন সাহেবকে করি নাই, কিন্তু আমি যতটুকু জানি তাকে (কামারুজ্জামান) জানানো হয়েছে, আপিল বিভাগে খারিজ হয়েছে এবং তার মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে।
তিনি আরও জানান, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার জন্য ৭ দিন সময় পাবেন। যে মুহূর্ত থেকে তিনি ফাঁসির খবর জেনেছেন সে মুহূর্ত থেকে ওই সাত দিন গণনা শুরু হয়েছে। কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার সময় রোববার শেষ হচ্ছে, এখন কী হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শনিবার দুপুরে মন্ত্রী বলেন, “প্রকাশিত যে রায় আছে তার ওপরই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারাটি দেখেন, যখন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয় তখন লেখা ছিল হাইকোর্ট এখন আপিল বিভাগ। তাকে এটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সাত দিন সময় দিতে হয়। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাকে মার্সি চাওয়ার জন্য সেই সময় দেয়া হয়েছে।”
কারাবিধি ৯৯১ ধারায় আসামিকে অবহিতকরণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আনিসুল হক বলেন, ওই ধারাটি যদি পড়েন তাহলে দেখবেন অবহিতকরণের কথা বলা আছে। তার মানে আনুষ্ঠানিকভাবে কাগজপত্রে জানাতে হবে তা নেই। কথা হচ্ছে সে বিষয়টি তাকে জানানো হয়েছে। আদেশ যায়নি।
এ সময় কীভাবে কামারুজ্জামানকে বিষয়টি জানানো হল সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান। তিনি বলেন, আদেশ যায়নি মানে কী? তাকে জানানো হয়েছে। ব্যাপারটি হল- আমি যত দূর জেনেছি, প্রিজন অফিসিয়ালস হ্যাভ টোল্ড হিম দ্যাট আপনার আপিল ডিসমিসড হয়েছে। আপনার মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। কিসের ভিত্তিতে জানানো হয়েছে- জানতে চাইলে মন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে খবরের কাগজ কি মিথ্যা? এ সময় সাংবাদিকরা কালকের পর কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে কিনা জানতে চান। উত্তরে মন্ত্রী বলেন, তিনি জানেন না। সুপ্রিমকোর্ট মিলনায়তনে একটি সেমিনারের উদ্বোধন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর সোনাগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌঁছাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে না।
রায়ের পর গত বৃহস্পতিবার নিজ কার্যলয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর এটা সরকার যেদিন ঠিক করবে, সেদিন দণ্ড কার্যকর হবে। আর সংক্ষিপ্ত আদেশ নাকি পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাঠানো হবে সেটা আপিল বিভাগের বিষয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দিয়েই তার সাজা কার্যকর করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। আপিল আদালত যে রায় দেন, সেটা ট্রায়াল কোর্টে (ট্রাইব্যুনালে) যায়। ট্রায়াল কোর্ট সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। তিনি আরও বলেন, এ রায় তো উনারা আগেই পেয়ে গেছেন। এখন এটা কার্যকর সময়ের ব্যাপার মাত্র। সময়ের ব্যাপারের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এটা এক সপ্তাহ হতে পারে, তিন দিনও হতে পারে। এটা সুপ্রিমকোর্টের আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে একমাসও হয়ে যেতে পারে। তবে রায় রিভিউর এবং জেল কোডে প্রদত্ত সুযোগ কামারুজ্জামান পাবেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে রায় ঘোষণার দিনেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের প্রধান গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। এরপর সরকারের আদেশে তা কার্যকর করা হবে।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে, আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য সঠিক নয়। যুক্তি হিসেবে তিনি বলছেন, প্রাণভিক্ষার সুযোগ জেল কোডে আছে। কামারুজ্জামানকে এ সুযোগ দিতে হলে জেল কোড অনুযায়ীই দিতে হবে। আর জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির পরে আদেশের কপি হাতে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কামারুজ্জামানকে জানাবে। এই জানানোর পর থেকে তাকে প্রাণভিক্ষার সাত দিনের সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমার জানামতে, আপিল বিভাগের আদেশের কপি এখনও ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়নি এবং ট্রাইব্যুনাল তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেননি। তাই প্রাণভিক্ষার সাত দিনের সুযোগ শেষ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(৩) ধারা অনুযায়ী আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর সরকার যখন ইচ্ছা তখন ফাঁসি কার্যকর করতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ একটি বিশেষ আইন। এ আইনে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে সংবিধানে পদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত রয়েছে। এ আইনের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে প্রদত্ত দণ্ড কার্যকর করবে সরকার। অন্যদিকে কারাবিধির ৯৯১(১) উপবিধিতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় ও আদেশ পাওয়ার পর বিচারিক আদালত সাজাপ্রাপ্ত আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। ওই পরোয়ানা কারা কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পড়ে শোনাবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারার ৩ উপবিধিতে বলা হয়েছে, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তবে সাত দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কারা কর্তৃপক্ষ। সঙ্গে পৃথক পত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ এবং আসামির দণ্ডের বিষয়ও উল্লেখ থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। জবাব দেয়ার সময়সীমা কারাবিধিতে নেই। তবে ১৪ দিনেও জবাব না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি আবেদন মঞ্জুর করেননি বলে বিবেচিত হবে। এটা কারা কর্তৃপক্ষকে জানাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির দিন থেকে ২১ দিনের পর এবং ২৮ দিনের মধ্যে রায় কার্যকর করতে হবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারার ৫ উপবিধিতে বলা হয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলেও মৃত্যু পরোয়ানা জারির ২১ দিন আগে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে না।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে জেল কোড প্রযোজ্য হবে না। যেমনটি হয়নি আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। ৫ ডিসেম্বর তার মামলার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল সে দিনেই কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে তখন জেল কোড অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ না করেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য জেল কোডে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে চেম্বার জজ ১০ ডিসেম্বরে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন।
কাদের মোল্লার পক্ষে দুটি রিভিউ আবেদন করা হয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে পুনর্বিবেচনার আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুনানি হয়। ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি শুধু ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড। কিন্তু তাতে কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়নি। রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ করে খারিজ করেছেন নাকি রিভিউ গ্রহণের আগেই খারিজ হয়েছে সেটি স্পষ্ট করেননি আপিল বিভাগ। এমনকি সেই রায়টি এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাই রিভিউ করা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে আইনি তর্কের মীমাংসা হয়নি। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ক্ষেত্রে জেল কোডের বিধান অনুসরণ করা হয়নি। কামারুজ্জামানের মামলার ক্ষেত্রেও জেল কোডের বিধান অনুসরণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। বিষয়টি অনেকটা সরকারের ওপর নির্ভর করছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রিভিউর আবেদন করবে বলে জানিয়েছে। আর এ আবেদন দায়েরের জন্য আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপিটি প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
No comments