গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা হোক by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী বছর
থেকে ভর্তি পরীক্ষার নতুন পদ্ধতি চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার
পক্ষে–বিপক্ষে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে কর্তৃপক্ষ
আসন খালি থাকার দোহাই দিচ্ছে। আর শিক্ষার্থীদের একাংশ সিদ্ধান্ত বাতিলের
দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি
কী হতে পারে, সে সম্পর্কে লিখেছেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আমি
নীতিগতভাবে বিশ্বাস করি, যেকোনো শিক্ষার্থীরই সবচেয়ে ভালো
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ থাকা উচিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই সে সুযোগ
আছে। আমাদের দেশেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ আছে। অনেক দিন ধরে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু এখন আমাদের বাস্তবতা, বিশেষ করে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা জটিল আকার ধারণ করেছে। বেশির ভাগ অভিভাবকই
চান, সন্তান এখানে পড়ুক। তাই এক আসনের জন্য ৪০-৫০ জন প্রতিযোগিতা করে।
এটা ভয়ানক চাপ। সেই চাপ কমাতে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ রহিত করা
হয়েছে।
পরিসংখ্যান বললে সমস্যার রূপটা বোঝা যাবে। প্রতিবছর ৫০ শতাংশ ভর্তি-ইচ্ছুক থাকে, যারা আগের বছরে পাস করেছে। এ বছর যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তাতে নতুন ৫০ শতাংশ, পুরোনো ৫০ শতাংশ। অনেকে প্রথমবার তাদের পছন্দমতো ভালো বিভাগ না পেলে যা পেয়েছে তাতে ভর্তি হয়ে থেকে পরের বছরে আবার সুযোগ নিতে চায়। যারা সুযোগই পায়নি, তারা অন্য জায়গায় ভর্তি হয়ে থেকে পরের বছর আবার চেষ্টা করে। এতে করে দুটি সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয়।
প্রথমত, নতুন ও পুরোনোদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হয়। যেমন এবার যারা পাস করে ভর্তি পরীক্ষায় বসেছে, তারা সময় পেয়েছে দুই মাসেরও কম। কিন্তু আগের বছরের যারা, তারা কিন্তু প্রস্তুতির জন্য পেয়েছে এক বছরের বেশি সময়। এই দুই গ্রুপের ভর্তি-ইচ্ছুকদের প্রতিযোগিতা অসম।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো আসনশূন্যতা। গতবার ভর্তি হয়ে এবার পছন্দের বিভাগে সুযোগ পেয়ে অনেকে যখন চলে যায়, তখন আসনশূন্যতা দেখা দেয়। এ রকম আসনস্বল্পতার মধ্যে সাড়ে তিন শ আসন মাস্টার্স পর্যন্ত শূন্য থাকা বিরাট অপচয়। এই আসনগুলো যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নতুন বছরের আসনের ওপর পুরোনো বছরের ভর্তি-ইচ্ছুকেরা ভাগ বসাচ্ছে।
তৃতীয়ত, দেখা গেছে যে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতি তথা মোবাইল ফোনে প্রশ্ন বলে দেওয়া, নকল ইত্যাদি যারা করে, তাদের বেশির ভাগই গত বছরে পাস করেছে। সারা বছর ধরে কোচিং করার জন্য কোচিং-বাণিজ্যও রমরমা হয়। এবার যে কোচিং-বাণিজ্য কম হয়েছে, তার কারণ পরীক্ষার আগে সময় কম ছিল। এ ছাড়া একটি শ্রেণিতে সিনিয়রের সঙ্গে জুনিয়রদের ক্লাস করার ক্ষেত্রেও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পাস-ফেলের বিষয় নয়। ভর্তি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নটা বড়। এসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছর থেকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। তবে আমি মনে করি, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটি দাবি মানা যায় যে সিদ্ধান্তটা আগামীবারের পরেরবার অর্থাৎ ২০১৬ থেকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু একসময় না একসময় এটা করতেই হবে। আমাদের বরং মনোযোগ দেওয়া উচিত সব বিশ্ববিদ্যালয়কে মানসম্পন্ন করার দিকে; যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি মানসম্পন্ন করা যায়, তাহলে সিলেটের ছাত্র সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই খুশি থাকবে, পটুয়াখালীর শিক্ষার্থী পটুয়াখালীতে পড়বে। ভালো শিক্ষকেরা যাতে ঢাকার বাইরে থাকতে রাজি হন, সে জন্য তাঁদের বিশেষ বোনাস ও অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোকে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে উন্নীত করি, সবগুলো না হলেও সেখানে যদি কিছু বিষয়ে মাস্টার্স
করার সুযোগ থাকে, তাহলে উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকে বিশেষ উচ্চতায়। বাকিগুলো সব এক স্তরে। আমাদের এখানেও তেমনটা হতে অসুবিধা কোথায়? আমি মেডিকেলের মতো গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি-প্রক্রিয়ার পক্ষে। সারা দেশের পরীক্ষার্থীরা যদি এক দিনে পরীক্ষা দেয় এবং মেধাক্রম অনুসারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে একজনকে সাত-আট জায়গায় পরীক্ষার দুর্ভোগে পড়তে হয় না, নকলের সুযোগও কমে। হতে পারে যে একেকটি অনুষদের জন্য একেক গুচ্ছপরীক্ষা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিসংখ্যান বললে সমস্যার রূপটা বোঝা যাবে। প্রতিবছর ৫০ শতাংশ ভর্তি-ইচ্ছুক থাকে, যারা আগের বছরে পাস করেছে। এ বছর যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তাতে নতুন ৫০ শতাংশ, পুরোনো ৫০ শতাংশ। অনেকে প্রথমবার তাদের পছন্দমতো ভালো বিভাগ না পেলে যা পেয়েছে তাতে ভর্তি হয়ে থেকে পরের বছরে আবার সুযোগ নিতে চায়। যারা সুযোগই পায়নি, তারা অন্য জায়গায় ভর্তি হয়ে থেকে পরের বছর আবার চেষ্টা করে। এতে করে দুটি সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয়।
প্রথমত, নতুন ও পুরোনোদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হয়। যেমন এবার যারা পাস করে ভর্তি পরীক্ষায় বসেছে, তারা সময় পেয়েছে দুই মাসেরও কম। কিন্তু আগের বছরের যারা, তারা কিন্তু প্রস্তুতির জন্য পেয়েছে এক বছরের বেশি সময়। এই দুই গ্রুপের ভর্তি-ইচ্ছুকদের প্রতিযোগিতা অসম।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো আসনশূন্যতা। গতবার ভর্তি হয়ে এবার পছন্দের বিভাগে সুযোগ পেয়ে অনেকে যখন চলে যায়, তখন আসনশূন্যতা দেখা দেয়। এ রকম আসনস্বল্পতার মধ্যে সাড়ে তিন শ আসন মাস্টার্স পর্যন্ত শূন্য থাকা বিরাট অপচয়। এই আসনগুলো যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নতুন বছরের আসনের ওপর পুরোনো বছরের ভর্তি-ইচ্ছুকেরা ভাগ বসাচ্ছে।
তৃতীয়ত, দেখা গেছে যে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতি তথা মোবাইল ফোনে প্রশ্ন বলে দেওয়া, নকল ইত্যাদি যারা করে, তাদের বেশির ভাগই গত বছরে পাস করেছে। সারা বছর ধরে কোচিং করার জন্য কোচিং-বাণিজ্যও রমরমা হয়। এবার যে কোচিং-বাণিজ্য কম হয়েছে, তার কারণ পরীক্ষার আগে সময় কম ছিল। এ ছাড়া একটি শ্রেণিতে সিনিয়রের সঙ্গে জুনিয়রদের ক্লাস করার ক্ষেত্রেও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পাস-ফেলের বিষয় নয়। ভর্তি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নটা বড়। এসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী বছর থেকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। তবে আমি মনে করি, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটি দাবি মানা যায় যে সিদ্ধান্তটা আগামীবারের পরেরবার অর্থাৎ ২০১৬ থেকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু একসময় না একসময় এটা করতেই হবে। আমাদের বরং মনোযোগ দেওয়া উচিত সব বিশ্ববিদ্যালয়কে মানসম্পন্ন করার দিকে; যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি মানসম্পন্ন করা যায়, তাহলে সিলেটের ছাত্র সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই খুশি থাকবে, পটুয়াখালীর শিক্ষার্থী পটুয়াখালীতে পড়বে। ভালো শিক্ষকেরা যাতে ঢাকার বাইরে থাকতে রাজি হন, সে জন্য তাঁদের বিশেষ বোনাস ও অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোকে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে উন্নীত করি, সবগুলো না হলেও সেখানে যদি কিছু বিষয়ে মাস্টার্স
করার সুযোগ থাকে, তাহলে উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকে বিশেষ উচ্চতায়। বাকিগুলো সব এক স্তরে। আমাদের এখানেও তেমনটা হতে অসুবিধা কোথায়? আমি মেডিকেলের মতো গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি-প্রক্রিয়ার পক্ষে। সারা দেশের পরীক্ষার্থীরা যদি এক দিনে পরীক্ষা দেয় এবং মেধাক্রম অনুসারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে একজনকে সাত-আট জায়গায় পরীক্ষার দুর্ভোগে পড়তে হয় না, নকলের সুযোগও কমে। হতে পারে যে একেকটি অনুষদের জন্য একেক গুচ্ছপরীক্ষা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments