মাইনাস থ্রি by সাজেদুল হক

উপমহাদেশের রাজনীতিতে এ প্রবণতা নতুন কিছু নয়। রাজনীতিবিদরা মাইনাস হয়েছেন। আবার অনেকে ফিরেও এসেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। বাংলাদেশে মাইনাস থিওরি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় জরুরি জমানায়। দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রকল্প অবশ্য সে সময় ব্যর্থ হয়। দুই বছরের জরুরি শাসন শেষে আবারও ফিরে আসেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে শেখ হাসিনা। বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। এরপর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। তবে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল মাইনাসের থিওরি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর থেকেই অবশ্য এ প্রকল্প কাজ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনটি দলই ঘুরে-ফিরে দেশ শাসন করেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এর বাইরে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীই চতুর্থ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য এ দলটিকে নিয়ে বরাবরই বিতর্ক চলে আসছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে শুরুতে সরকারের মধ্যে দ্বিধা কাজ করলেও সরকার এক পর্যায়ে এ ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যায়। জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক আক্রমণে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয় দলটিকে। কাগজে-কলমে নয়, তবে কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে যায় দলটি। দলটির কেন্দ্রীয় থেকে মহানগর- সব কার্যালয়ই তালাবদ্ধ। জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। দলটির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। অন্য নেতারা কেউ কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তা জামায়াতের ঘোরতর কোন সমর্থকও বিশ্বাস করেন না। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে দুর্যোগের মধ্যে থাকা জামায়াতের মধ্যে পুনর্গঠনের কোন প্রক্রিয়াও নেই। বাইরে নানা কথা শোনা গেলেও দলটির ভেতরে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত সংস্কার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। রাজনীতি থেকে জামায়াতকে মাইনাসের প্রকল্প বহুলাংশে সফলতা লাভ করেছে। সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই এক কৌশলী খেলোয়াড়। পতনের পরও দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিজের গুরুত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন তিনি। তবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন তাকে নতুন বাস্তবতার জমিনে নিয়ে আসে। নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্র জমা দেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তবে এক পর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন এরশাদ। দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন তিনি। তবে ভেতরে ভেতরে এরশাদকে মাইনাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতীয় পার্টির একটি অংশই এরশাদের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে। তারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান। এ অংশের প্রকাশ্য নেতৃত্বে চলে আসেন এরশাদেরই সহধর্মিণী রওশন এরশাদ। প্রত্যাহার করলেও এরশাদের মনোনয়নপত্র বহাল থেকে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে নির্বাচনেও জিতে যান তিনি। যদিও এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদেরকে নির্বাচনে পরাজিত দেখানো হয়। বস্তুত এরশাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনেরই মূল্য দিতে হয় তাকে। নির্বাচনের পরও এরশাদ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে ওই প্রচেষ্টা অনেকটাই ব্যর্থ হয়। এরশাদকে অন্ধকারে রেখেই জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করেন। নয়া কিসিমের গণতন্ত্রে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে যোগ দেয়। জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে কাছে টেনে এরশাদ পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। বস্তুত জাতীয় পার্টির একটি বড় অংশই এখন এরশাদের নিয়ন্ত্রণহীন। ক’দিন আগেও এরশাদের কথা জাতীয় পার্টিতে শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত হলেও খোদ রংপুরেই এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি। মশিউর রহমান রাঙ্গার সমর্থকরা বস্তুত চ্যালেঞ্জই করেছেন তাকে। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবি দলটির দুরবস্থার ইঙ্গিতই দেয়। গণতান্ত্রিক যুগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। মূলত এই দুটি দলের নেতৃত্বাধীন জোটকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে রাজনীতি। তবে ওয়ান ইলেভেনের ধাক্কা বিএনপির জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসে। সেনাসমর্থিত সরকার দুই নেত্রীর সঙ্গেই সমঝোতার চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন সমঝোতা হয়নি। নবম সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য স্মরণকালের বিপর্যয় নিয়ে আসে। ওই নির্বাচনে নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম আসনে জয় পায় বিএনপি। এরপর গত ছয় বছরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। একের পর এক আঘাত এসেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে হাজার হাজার মামলা। বিএনপিতে ভাঙন তৈরির চেষ্টা সফল না হলেও সে চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। বিএনপি নেতাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার অভিযোগও রয়েছে। ক্রমশ বিপর্যস্ত বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা এখনও সফলতা লাভ করেনি। মাইনাস থ্রি পলিটিক্স বাংলাদেশের রাজনীতিতে একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করছে। দি ইকোনমিস্টের ভাষায় ওয়ান অ্যান্ড ওনলি।


No comments

Powered by Blogger.