সঙ্কটটা আসলে কোথায়? by মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন
নতুন নতুন শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক আসছেন, নতুন নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে ছবি নির্মাণ বেড়ে গেছে। তারপরও দর্শক প্রেক্ষাগৃহে প্রত্যাশা অনুযায়ী আসছেন না। এর সঠিক কারণও কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না। কেউ বলেন, গল্পের সঙ্কট, কেউ বলেন শিল্পী সঙ্কট, কেউ কেউ আবার বলেন মেধার সঙ্কট। নতুন যারা এখন সিনেমা বানাচ্ছেন তারা নাকি সিনেমার ভাষাটা বোঝেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত পুরনো যারা ছবি বানাচ্ছেন তাদের কি হলো? তারা কি সিনেমার ভাষাটা ভুলে গেলেন? তাদের পরিচালিত ছবি কেন দর্শক দেখতে আসেন না? পরিচালক সমিতিতে বসে যারা বড় বড় কথা বলেন, তাদের ছবিগুলোও পর্দায় খুব একটা ঝড় তুলতে পারছে না। ‘একটি ডিজিটাল সিনেমা’ স্লোগান দিয়ে এখন সবাই ছবি বানাচ্ছেন। সঙ্গে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে একটা দৃষ্টিকটু উদ্দাম নৃত্যের আইটেম গানের তকমা লাগিয়ে দিচ্ছেন। তারা প্রত্যেকেই এখন ব্যর্থ হচ্ছেন দর্শক মনোরঞ্জনে। ’৭০-৮০ দশকে দর্শক একটি ছবিতে যা দেখতে পেতেন এখন তার কিছুই পাচ্ছেন না। সরজমিন দেখা গেছে, সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের বিস্তর অভিযোগ। প্রধান অভিযোগ ছবিতে কোন গল্প খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। তাদের অভিযোগ, সবই নকল গল্প। সিনেমার ভাষায় ‘কাট টু কাট’ নকল। দ্বিতীয় অভিযোগ, ডিজিটাল বলা হলেও চিত্রগ্রহণের মান খুবই দুর্বল। সিনেপ্লেক্সগুলো বাদ দিলে বাকি সব প্রেক্ষাগৃহেই থাকে অন্ধকার। ছবি যেন আলো-আঁধারের খেলা। রঙিন ছবিতে রঙের বালাই নেই। প্রেক্ষাগৃহে বসেই দর্শকের প্রশ্ন, ছবিটি সাদাকালো নাকি? ছবির গানগুলো কানে বাজে না। গানের কথা, সুর কিছুই হৃদয় স্পর্শ করে না। আইটেম গানের নামে চলছে নগ্ন দেহের অবাধ প্রদর্শন। রয়েছে অপ্রয়োজনে মারামারি। এমন কি গোলাগুলির মাঝখানে ঢুকে পড়ছে রোমান্টিক গান। বিদেশে শুটিংয়েও একই অবস্থা। যে উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড যাওয়া হয়, দর্শক সেই উদ্দেশ্যের আগা-মাথা বুঝতে পারেন না। আলো স্বল্পতার কারণে কোন দৃশ্যই ঠিকমতো দেখা যায় না। এসব কিছুর সঙ্গে রয়েছে ডিজিটালের নামে প্রজেক্টরে ছবি প্রদর্শন। নিম্নমানের প্রজেক্টর এবং এর প্রদর্শনের যথাযথ পদ্ধতি না জানার কারণে দর্শক প্রদর্শিত ছবি দেখে বিরক্ত হচ্ছেন। তাদের চোখ কষ্ট পায় বলে তারা প্রতিনিয়তই প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ হচ্ছেন। এবারের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ৪টি ছবিই কাঙ্ক্ষিত দর্শক পায়নি। ঢাকার একজন আলোচিত প্রেক্ষাগৃহ মালিক হতাশার সুরে বললেন, নতুন ছবি তো চালাচ্ছি। কিন্তু দর্শক তো পাচ্ছি না। মনে হয় দর্শকদের বাসা থেকে ডেকে আনতে হবে। সঙ্কটটা কোথায়- এ বিষয়ে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, সমস্যা তো অনেক। ছবি যা হচ্ছে তাতে আমি নিজেও হতাশ। কে কি বানাচ্ছেন, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, যদি কখনও দু-একটা ছবি ব্যবসা করে তাহলে সেটা দ্রুত পাইরেসি হয়ে যায়। আমার মনে হয় সঙ্কটটা সবখানেই এবং এর সমাধানে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সব সরকারের আমলে বলা হয়, সরকার চলচ্চিত্রের বিষয়ে আন্তরিক। কিন্তু কাজকর্মে সরকারের আন্তরিকতার প্রতিফলন দেখা যায় না তাদের নিয়োজিত ব্যক্তিদের কারণে। নকল ছবি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে। ভিডিও পাইরেসি বন্ধ হচ্ছে না। প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। সরকার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও সেই অর্থ যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না, এসব তদারকি করার জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ থাকেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সিনেমার নামে যেমন খুশি তেমন সাজাতে ব্যস্ত সবাই। দোষ দেয়া হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতিকে। ভারতীয় ছবিকে। অথচ কেউ নিজেদের অক্ষমতা কিংবা দুর্বলতাকে দেখতে চাইছে না। ফলে দিনে দিনে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে চলচ্চিত্র শিল্প। চলচ্চিত্রের পুরনো প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, বোদ্ধা সবাই জানেন সঙ্কটটা কোথায়? তারপরও তারা না জানার ভান করে থাকেন। যারা জেগে ঘুমান, তাদের জাগানো যে সম্ভব নয়, সেটা চলচ্চিত্রের বর্তমান পরিস্থিতি দেখেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।
No comments