রুচিশীল প্রকাশনার পথিকৃৎ by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রকাশক ও মুদ্রাকর সৈয়দ মোহাম্মদ শফী অনেক দিন রোগভোগের পর সম্প্রতি পরলোকগমন করেছেন। এখনকার প্রকাশনাজগতের অনেক তরুণ হয়তো তাঁকে চেনেন না। তাই তাঁর অবদানও খুব প্রচারিত হয় না। তা ছাড়া, তাঁর কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প স্বাধীনতার আগেই যাঁদের হাতে পেশাদারত্ব অর্জন করেছিল, সৈয়দ শফী তাঁদের একজন। তাঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘বইঘর’ ষাটের দশকেই একটি সম্ভ্রান্ত ও আধুনিক প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলায় পরিচিত ছিল। বইঘরের বই মানেই নির্বাচিত বই। বইয়ের গুণে, প্রচ্ছদে, মুদ্রণ সৌকর্যে বইঘরের বই ছিল এক নম্বর। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সেকালে শ্রেষ্ঠ বুক প্রোডাকশন ও প্রচ্ছদের জন্য পুরস্কার দিত। প্রায় প্রতিবছরই বেশির ভাগ পুরস্কার নিয়ে যেত বইঘরের বই। বইঘরের সোনালি সময় ছিল ষাট ও সত্তরের দশক। স্বাধীনতার আগে ঢাকা এত একচেটিয়া ছিল না। চট্টগ্রাম ছিল তখন পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। সেই চট্টগ্রামে বসে সৈয়দ শফী প্রকাশনা ব্যবসায় প্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকায়ও তখন কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা সুনামের সঙ্গে বই প্রকাশ করেছে। যেমন: নওরোজ কিতাবিস্তান, ওসমানিয়া বুক ডিপো, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, খান ব্রাদার্স ইত্যাদি। কিন্তু চট্টগ্রামের বইঘর ছিল শীর্ষে।
এ রকম একটি রুচিশীল ও মননশীল প্রকাশনা সংস্থা পরিচালনা করা কম কৃতিত্বের বিষয় নয়। এখনকার মতো কম্পিউটার কম্পোজ, ফটোশপ, গ্রাফিকস, ইন্টারনেট ইত্যাদি কিছুই ছিল না। আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে ছিল শুধু অফসেট মেশিন। বাকি সব সেকেলে ও প্রাচীন। এত সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই সৈয়দ শফী তাঁর আর্ট প্রেসে এমন সব দৃষ্টিনন্দন বই প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য বই প্রকাশনায় তাঁর ডান হাত ছিলেন দুজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি। শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দীন আহমদ ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বলাবাহুল্য, এই দুজন গুণী ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া সৈয়দ শফীর পক্ষে ‘বইঘর’ গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। আমার ধারণা, কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো হয়েছে ষাট ও সত্তর দশকে বইঘরের মাধ্যমে। শুধু প্রথাগত বই নয়, বইয়ের সাইজ পরিবর্তন করে, প্যাকেটের ভেতরে বই দিয়ে ব্যতিক্রর্মী প্রকাশনাও বইঘরের অবদান। শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা, সৈয়দ আলী আহসানের সহসা সচকিত ও আল মাহমুদের কালের কলস-এর সেই ব্যতিক্রর্মী প্রকাশনা কি সহজে ভোলা যায়? কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, ইতিহাস, শিশুসাহিত্য, কী না প্রকাশ করেছে বইঘর। শিশুসাহিত্যের প্রসারের জন্য তিনি ‘শিশুসাহিত্য বিতান’ নামে একটি পৃথক প্রকাশনা সংস্থা গঠন করেছিলেন। সেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অনেক শিশু-কিশোর সাহিত্য। তবে শিশুসাহিত্য বিতানের সবচেয়ে বড় অবদান হলো: ষাটের দশকে কিশোর মাসিক টাপুর টুপুর-এর প্রকাশনা। এর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ শফী আর সম্পাদক ছিলেন এখলাসউদ্দীন আহমদ। শিশু-কিশোরদের উপযোগী এত সুন্দর পত্রিকা সেকালে খুব বেশি ছিল না। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) সম্পাদিত কচি ও কাঁচা ছিল আরেকটি সুন্দর পত্রিকা। এই দুটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ দেশে বহুদিন উন্নত মানের শিশু-কিশোর পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। বহু বছর পর প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত ‘কিআ’ শিশু-কিশোরদের একটা বড় অভাব পূরণ করতে পেরেছে। টাপুর টুপুর সেকালের শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবিকতা, সুরুচি, সাহিত্যবোধ, ইতিহাসবোধ তৈরি করতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল।
সৈয়দ শফী প্রকাশ করেছিলেন একটি বিনোদন পত্রিকা—অন্তরঙ্গ। মূল সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।
বই ও মননশীল সাময়িকী প্রকাশ লাভযোগ্য ব্যবসা বলে সেকালে বিবেচিত হতো না। তবু দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য সৈয়দ শফী মননশীল বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশে দ্বিধা করেননি। তাঁর মূল ব্যবসা ছিল মুদ্রণের ব্যবসা। তাঁদের ‘আর্ট প্রেস’ পূর্ব পাকিস্তানের একটি আধুনিক ও উল্লেখযোগ্য প্রেস বলে বিবেচিত হয়েছে। তখন ঢাকায়ও আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তির তেমন প্রসার ঘটেনি। সেই ষাটের দশকে আর্ট প্রেসে অপসেট মেশিনে ছাপা হতো। এখন ঢাকার অলিতে গলিতে অপসেট মুদ্রণ দেখা গেলেও ষাটের দশকের চিত্র তা ছিল না। সৈয়দ শফী এ দেশে আধুনিক মুদ্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পেছনেও বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজধানীর বাইরে থাকলে ও দল না করলে যা হয়, সৈয়দ শফীর অবদান তাই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। অতি সজ্জন, মিতভাষী, বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার প্রিয় ছিলেন। এ দেশের মুদ্রণ, বই প্রকাশনা, সাময়িকী প্রকাশনায় অনন্য অবদানের জন্য সৈয়দ মোহাম্মদ শফী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: গণমাধ্যমকর্মী।
এ রকম একটি রুচিশীল ও মননশীল প্রকাশনা সংস্থা পরিচালনা করা কম কৃতিত্বের বিষয় নয়। এখনকার মতো কম্পিউটার কম্পোজ, ফটোশপ, গ্রাফিকস, ইন্টারনেট ইত্যাদি কিছুই ছিল না। আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে ছিল শুধু অফসেট মেশিন। বাকি সব সেকেলে ও প্রাচীন। এত সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই সৈয়দ শফী তাঁর আর্ট প্রেসে এমন সব দৃষ্টিনন্দন বই প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য বই প্রকাশনায় তাঁর ডান হাত ছিলেন দুজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি। শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দীন আহমদ ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বলাবাহুল্য, এই দুজন গুণী ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া সৈয়দ শফীর পক্ষে ‘বইঘর’ গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। আমার ধারণা, কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো হয়েছে ষাট ও সত্তর দশকে বইঘরের মাধ্যমে। শুধু প্রথাগত বই নয়, বইয়ের সাইজ পরিবর্তন করে, প্যাকেটের ভেতরে বই দিয়ে ব্যতিক্রর্মী প্রকাশনাও বইঘরের অবদান। শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা, সৈয়দ আলী আহসানের সহসা সচকিত ও আল মাহমুদের কালের কলস-এর সেই ব্যতিক্রর্মী প্রকাশনা কি সহজে ভোলা যায়? কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, ইতিহাস, শিশুসাহিত্য, কী না প্রকাশ করেছে বইঘর। শিশুসাহিত্যের প্রসারের জন্য তিনি ‘শিশুসাহিত্য বিতান’ নামে একটি পৃথক প্রকাশনা সংস্থা গঠন করেছিলেন। সেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অনেক শিশু-কিশোর সাহিত্য। তবে শিশুসাহিত্য বিতানের সবচেয়ে বড় অবদান হলো: ষাটের দশকে কিশোর মাসিক টাপুর টুপুর-এর প্রকাশনা। এর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ শফী আর সম্পাদক ছিলেন এখলাসউদ্দীন আহমদ। শিশু-কিশোরদের উপযোগী এত সুন্দর পত্রিকা সেকালে খুব বেশি ছিল না। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) সম্পাদিত কচি ও কাঁচা ছিল আরেকটি সুন্দর পত্রিকা। এই দুটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ দেশে বহুদিন উন্নত মানের শিশু-কিশোর পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। বহু বছর পর প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত ‘কিআ’ শিশু-কিশোরদের একটা বড় অভাব পূরণ করতে পেরেছে। টাপুর টুপুর সেকালের শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবিকতা, সুরুচি, সাহিত্যবোধ, ইতিহাসবোধ তৈরি করতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল।
সৈয়দ শফী প্রকাশ করেছিলেন একটি বিনোদন পত্রিকা—অন্তরঙ্গ। মূল সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।
বই ও মননশীল সাময়িকী প্রকাশ লাভযোগ্য ব্যবসা বলে সেকালে বিবেচিত হতো না। তবু দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য সৈয়দ শফী মননশীল বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশে দ্বিধা করেননি। তাঁর মূল ব্যবসা ছিল মুদ্রণের ব্যবসা। তাঁদের ‘আর্ট প্রেস’ পূর্ব পাকিস্তানের একটি আধুনিক ও উল্লেখযোগ্য প্রেস বলে বিবেচিত হয়েছে। তখন ঢাকায়ও আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তির তেমন প্রসার ঘটেনি। সেই ষাটের দশকে আর্ট প্রেসে অপসেট মেশিনে ছাপা হতো। এখন ঢাকার অলিতে গলিতে অপসেট মুদ্রণ দেখা গেলেও ষাটের দশকের চিত্র তা ছিল না। সৈয়দ শফী এ দেশে আধুনিক মুদ্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পেছনেও বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজধানীর বাইরে থাকলে ও দল না করলে যা হয়, সৈয়দ শফীর অবদান তাই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। অতি সজ্জন, মিতভাষী, বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার প্রিয় ছিলেন। এ দেশের মুদ্রণ, বই প্রকাশনা, সাময়িকী প্রকাশনায় অনন্য অবদানের জন্য সৈয়দ মোহাম্মদ শফী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: গণমাধ্যমকর্মী।
No comments