৩৫০০০ শিক্ষকের কান্না by নুর মোহাম্মদ
সারা জীবন তারা শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে অর্থকষ্টে হাবুডুবু খাচ্ছেন। চাকরি শেষে অবসর ভাতা পেতে
কান্না ঝরছে হাজারো বেসরকারি শিক্ষকের। ভাতা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা
করলেও কোন সুখবর পাচ্ছেন না। চাকরি ছাড়ার পর অর্থ-সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন
অনেক শিক্ষক। তারা ভাতা পেতে অবসর বোর্ডে এসে বারবার তাগাদা দিলেও অর্থ
সংস্থান না থাকায় তিন বছর আগের করা আবেদনও নিষ্পত্তি করতে পারছে না বোর্ড।
রাজধানীর নীলক্ষেতে অবস্থিত অবসর বোর্ডে অবস্থান করে জানা গেছে ভাতা
প্রত্যাশী শিক্ষকদের দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা। মঙ্গলবার অবসর বোর্ডে ঢুকতেই
দেখা গেল বস্তাভর্তি কাগজের মধ্যে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব হালিমা খাতুন। দুই
মাস আগে তার স্বামী ক্যানসারে মারা গেছেন। তিন সন্তান রেখে যাওয়া ওই শিক্ষক
অবসর সুবিধার টাকার আবেদন করেছিলেন ২০১১ সালের আগস্ট মাসে। হালিমা আক্ষেপ
করে বলেন, আমার স্বামী সারাজীবন মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। অথচ শেষ জীবনে
তিনি টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসা নিতে পারেননি। আমিও মনে হয় এখন সংসার চালাতে
পারবো না। যশোর আটলিয়া আলিমুল কোরআন দাখিল মাদরাসা শিক্ষক আবদুল হক। তিনি
২০১০ সালে জুলাই মাসে অবসরে যান। আর অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন ২০১২ সালের
জুন মাসে। আজ অবধি তার টাকা পাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে
বছরের পর বছর অপেক্ষা এই শিক্ষকদের চোখে ঝরছে কান্না। তাদের বোবা কান্নায়
নীলক্ষেত ব্যানবেইস ভবন ভারি হচ্ছে প্রতিদিন।
২৫ বছর শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে অবসর নিয়েছেন সাতক্ষীরা শিক্ষক হালিম উদ্দিন। ২০১১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন করে এখন পর্যন্ত এগারোবার ঢাকা এসেও এর কোন কিনারা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, তিন বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় আছি। কবে পাবো জানি না। আজ খোঁজ নিতে এসেছি। অফিস থেকে আমাকে বলা হয়েছে, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই শিক্ষক বলেন, যতদিন চাকরি ছিল বেতন পেয়েছি। আশা ছিল অবসর সুবিধার টাকা পেয়ে সংসারটা সামলানো যাবে। কিন্তু তিন বছর খুব খারাপ কাটছে। টাকা ঋণ নিয়ে সংসারের খরচ চালাচ্ছি। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এমন অপেক্ষা আর ভাল লাগে না। হালিম উদ্দিনের মতো একই অবস্থা সারা দেশে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর।
২৫ বছর শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে অবসর নিয়েছেন সাতক্ষীরা শিক্ষক হালিম উদ্দিন। ২০১১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন করে এখন পর্যন্ত এগারোবার ঢাকা এসেও এর কোন কিনারা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, তিন বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় আছি। কবে পাবো জানি না। আজ খোঁজ নিতে এসেছি। অফিস থেকে আমাকে বলা হয়েছে, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই শিক্ষক বলেন, যতদিন চাকরি ছিল বেতন পেয়েছি। আশা ছিল অবসর সুবিধার টাকা পেয়ে সংসারটা সামলানো যাবে। কিন্তু তিন বছর খুব খারাপ কাটছে। টাকা ঋণ নিয়ে সংসারের খরচ চালাচ্ছি। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এমন অপেক্ষা আর ভাল লাগে না। হালিম উদ্দিনের মতো একই অবস্থা সারা দেশে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর।
অবসর বোর্ডের সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী, ৩০শে জুলাই ২০১৪ পর্যন্ত অবসর বোর্ডে আবেদন জমা পড়েছে ৩৪ হাজার ৬৯৭টি- যা নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ১২২২ কোটি টাকার বেশি। প্রয়োজনীয় ঘাটতি পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বারবার চিঠি দিয়েও কোন সুফল পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে মূল সমস্যাই অর্থ। চলতি অর্থবছরে বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও সাড়া দেননি অর্থমন্ত্রী। বোর্ডের কর্মকর্তা বলছেন, সর্বশেষ ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন করা শিক্ষক-কর্মচারীদের চেক দেয়া হয়েছে। একই বছরের মার্চ মাসের আবেদন যাচাই-বাছাই হচ্ছে। মে-জুন-জুলাই মাসে টাকা বোর্ডের ৩৯তম সভায় অনুমোদন হয়েছে। টাকা পেলেই তা ছাড় করা হবে। তবে কবে লাগাদ ছাড়া করা হবে জানতে চাইলে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি অবসর বোর্ডের কর্মকর্তারা।
তীব্র অর্থ সঙ্কট: অবসর সুবিধা বোর্ডের সহকারী পরিচালক ড. আবু হানিফা বলেন, আমাদের মূল সমস্যা অর্থ সঙ্কট। প্রতি বছর শিক্ষকদের আবেদন বাড়ছে। এর সঙ্গে তাদের টাকার পরিমাণও বাড়ছে। সরকার গত আট বছর আর কোন টাকা দেয়নি। বোর্ডের হিসাবে, প্রতি মাসে গড়ে সারা দেশের এক হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান। এরাই সবাই অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন। আবেদন নিষ্পত্তি করতে মাসে প্রয়োজন ৫৬ কোটি টাকা। শিক্ষকদের কাছ থেকে আদায় করা ৪% হারে চাঁদা আর ব্যাংকের ডিপোজিটের সুদ থেকে বোর্ডের প্রতি মাসে আয় হয় ১৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে ঘাটতি ৩৮ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতি ৪৫৬ কোটি টাকা। এ কারণে শিক্ষকরা আবেদন করে বছরের পর বছর ঘুরছেন, টাকা পাচ্ছেন না। আবু হানিফ বলেন, সরকার যদি অন্য কোন উৎস থেকে এই ঘাটতি পূরণ করার উদ্যোগ নেয় তাহলে আমরা দুই মাসের মধ্যে সব আবেদন নিষ্পত্তি করে দেবো। এ মুহূর্তে সারা দেশের প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতার আবেদন করে অপেক্ষা করছেন। অবসর বোর্ডের সদস্য সচিব আসাদুল হক বলেন, আমাদের এই ঘাটতি পূরণ করতে হলে সরকারকে প্রতি বছর ৪৬৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হবে। ইতিমধ্যে তিন বছরের আবেদন জমা পড়ে আছে। সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা। এই টাকা দিলে প্রতি মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব। বর্তমানে সারা দেশের সাড়ে ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন থেকে ৪% হারে প্রতি মাসে ১৭ কোটি টাকা আয় হয় অবসর বোর্ডের। আর্থিক ঘাটতি মেটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় ২০১২ সালে। ওই কমিটি শিক্ষকদের বেতন থেকে ৮ শতাংশ হারে অর্থ কেটে রাখা অথবা দুই কোটি মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর স্কুলে ভর্তির সময় এ খাত বাবদ ৫০ টাকা করে আদায় করার প্রস্তাব করে। এ ব্যাপারে আজ অবধি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। গেল সংসদ অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী সংসদকে জানান, অবসর ভাতার জন্য ৩২ হাজার ৫৩টি আবেদন অবসর সুবিধা বোর্ডে জমা পড়েছে। এই আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ১ হাজার ১২২ কোটি ৫৭ হাজার ৩৬২ টাকা।
অবসর সুবিধা বোর্ডের বর্তমানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ৪ কর্মকর্তাসহ মোট ২৬ জন জনবল রয়েছে। এর মধ্যে একজন সদস্য সচিব ও একজন সহকারী পরিচালক। কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে আর ভাল লাগে না। বাবার বয়সের লোকজনকে হয়রানি আর সহ্য হয় না।
সুপারিশের ছড়াছড়ি: দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করে কোন কূল কিনার না পেয়ে শিক্ষকরা আসছেন প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে। অনেকেই মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রভাবশালী কর্মকর্তাদেরও সুপারিশ নিয়ে আসছেন। যশোরের বাঘারপাড়া সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক মনজিল মিয়া। তিনি সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকের সুপারিশ নিয়ে এসেছেন। সুপারিশের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই শিক্ষক বলেন, তিন বছর ধরে ঘুরতে ঘুরতে বাধ্য হয়ে আপার (মন্ত্রীর) সুপারিশ নিয়ে এসেছি। এবার আশা করি হয়ে যাবে। কুমিল্লায় বাতিশা উচ্চ বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক শামসুর নাহার রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের সুপারিশ নিয়ে আসেন।
হানিফ বলেন, এরকম হাজারো সুপারিশ জমা পড়ে আছে বোর্ডে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সিরিয়াল রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুপারিশ করে আগে টাকা পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সাধারণ উপায়ে কাজ না হওয়ায় এবং বছরের পর বছর আবেদন ঝুলে থাকায় অনেকে মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ নিয়েও ছুটে আসছেন। এই তদবির বন্ধ করতে নতুন নিয়ম করেছি। ইদানীং অনেক তদবির কমে এসেছে। মন্ত্রণালয়ে তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বোর্ড ২০০৫ সাল থেকে অবসরগ্রহণকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদানের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে মাসিক ৪ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয়। অবসর শেষে একজন শিক্ষককে এক বছরের জন্য মূল বেতনের তিনগুণ করে অবসর সুবিধা দেয়া হয়। সেই হিসাবে পূর্ণ মেয়াদ চাকরি শেষে একজন সহকারী অধ্যাপক ১৬ লাখ টাকা, প্রধান শিক্ষক ১২ লাখ টাকা এবং সহকারী শিক্ষক ৬ লাখ টাকা অবসর সুবিধা পান। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষকদের এই ভোগান্তি কমাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে বারবার চিঠি দিয়েও বাজেট বাড়াতে পারিনি। টাকা ছাড়া এই সমস্যা সমাধানে বিকল্প কোন পথও নেই বলে জানান মন্ত্রী। পদাধিকার বলে অবসর সুবিধা বোর্ডের চেয়ারম্যান শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, এই সঙ্কট দীর্ঘদিনে। শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি কমিয়ে দ্রুত সময়ে শেষ করার সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থ সঙ্কটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
No comments