নেপথ্যে গোপন বিয়ে by মহিউদ্দীন জুয়েল
নওগাঁয় এক স্ত্রী রয়েছে। সেখানে আছে দুই সন্তান। পরিবারের লোকজন জানতেন সেটিই সুখের সংসার। কিন্তু মৃত্যুর পর বেরিয়ে এসেছে আরেক নতুন তথ্য। মিশু নামের এক মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক ছিল তার। গত জুন মাসে গোপনে বিয়ে হয় তাদের। এরপর থেকে আলাদা বাসা নিয়ে প্রথম স্ত্রীর অগোচরে থাকতেন তিনি। আর এ নিয়ে অশান্তি শুরু। সেখান থেকেই হত্যা। চট্টগ্রামে কাজী আবদুল হাসিব মোহাম্মদ সাঈদ (৪৭) নামের এক বিচারকের মৃত্যুর ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে স্ত্রী বলে দাবি করা সানজিদা আক্তার মিশু ও শাশুড়ি লাকি আক্তার নামে দুই নারীকে। গতকাল বুধবার সকালে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে।
গত মঙ্গলবার রাতে নগরীর হালিশহরের মোল্লাপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে কাজী আবদুল হাসিবকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান গ্রেপ্তার হওয়া এ দুই নারী। ওই সময় তারা দাবি করেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরে তাদের কথাবার্তায় সন্দেহ হয় মেডিকেল পুলিশের। এরপর দু’জনকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (পশ্চিম) এস এম তানভির আরাফাত এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, ‘কথিত স্ত্রী মিশুর সঙ্গে নিহত বিচারকের সম্পর্ক ছিল এ বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে তারা বিয়ে করেছেন কিনা তা জানা যাবে কাবিন হাতে পাওয়ার পর। মিশুকে নিয়ে আমরা যেসব তথ্য পেয়েছি তা চমকে ওঠার মতো। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে পারছি না।
গতকাল সকালে এ বিষয়ে জানতে যাওয়া হয় নগরীর হালিশহর এলাকার সেই মোল্লাপাড়ায়। সেখানে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া যায় নানা তথ্য। তারা জানান, প্রায় সময় বিচারক সাঈদকে কথিত স্ত্রী সানজিদা আক্তার মিশুর বাসায় আসা-যাওয়া করতে দেখতেন সেখানকার বাসিন্দারা।
এরপর গত জুন মাসে ওই নারী তাকে বিয়ে করেছেন বলে আশপাশের লোকজনকে জানান। বিষয়টি সত্য বলে ধরে নেন লোকজন। কেননা বিয়ের খবর চাউর হওয়ার পরই নওগাঁ থেকে ঘন ঘন চট্টগ্রামে আসতেন এই অতিরিক্ত জেলা জজ।
পুলিশের ধারণা, নওগাঁয় বদলি হওয়ার আগ থেকে মিশুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে বিচারক সাঈদের। বিষয়টি তার প্রথম স্ত্রী জানতেন না। নওগাঁয় প্রথম স্ত্রী থাকার বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি দ্বিতীয় স্ত্রী মিশু। আর তা নিয়ে সংসারে টানাপড়েন শুরু হয়।
তাকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপাচাপি করলে এ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন বিচারক সাঈদ। একপর্যায়ে বাসার ভেতর ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটলে কেউ একজন পেছন থেকে ধারালো লোহা দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়ে মারা যান।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের একটি সূত্র জানায়, নিহত বিচারক সাঈদের মাথার পেছনে ও মাঝে বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বিশেষ করে মাঝখানে একটি গর্ত দেখা গেছে, যা থেকে বোঝা যায় তিনি আত্মহত্যা করেননি। তাকে কেউ একজন আঘাত করেছে।
গত মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে তার মৃত্যুর পেছনে আত্মহত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এ কাজটি খুবই কৌশলে করার চেষ্টা করেন স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়া মিশু ও শাশুড়ি লাকী আক্তার। সাঈদের মাথার খুলিতে গর্ত দেখা যায়। মাথার খুলি থেকে মৃত্যুর সময় তাজা রক্ত বের হচ্ছিল। নিহতের গলায় কালো দাগ দেখা যায়। হাত-পা ছিল স্বাভাবিক।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ঘটনাটিকে প্রাথমিক দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে না। কেননা গলায় ফাঁস দিলে মুখ দিয়ে ফেনা বের হতো।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, নওগাঁয় নিহত বিচারক সাঈদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সেখানে অবস্থান করা তার স্ত্রীর নাম মনিকা। আর দুই সন্তান অনিন্দ্য (১২) ও মেয়ে রোসাবা (১০)। ১৮তম বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী জজ হিসেবে চাকরি শুরু করেন তিনি।
ঘটনার ৪ দিন আগে গত শুক্রবার সকালে বিচারক সাঈদ মিশুর হালিশহরের বাসায় আসেন। মঙ্গলবার বিকালে চিৎকার শুনতে পেয়ে আশপাশের লোকজন সেখানে গিয়ে দেখতে পান ওই বিচারক গলায় কাপড় পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছেন। পরে এ ঘটনায় কথিত স্ত্রী মিশু ও তার মা লাকী আক্তার পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা দেন দাম্পত্য কলহের জের ধরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আর মাথায় নিজেই ধারালো কাঁচি দিয়ে আঘাত করে রক্ত বের করেছেন। বিচারক সাঈদকে মিশু নিজের স্ত্রী বলে দাবি করলেও তার পরিবারের অনেক কিছুই তিনি জানেন না বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্ত্রী দাবি করা মিশুর এর আগে আরও একবার বিয়ে হয়েছিল। সেখানে তার একটি পুত্রসন্তানও রয়েছে। তবে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর ওই সংসারের কারও সঙ্গে মিশুর কোন সম্পর্ক নেই। মিশুর পিতা একজন ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী। তার নাম নাছির আহমেদ। তিনিও হালিশহরের ওই বাসায় বসবাস করতেন।
এ বিষয়ে হালিশহর থানার ওসি (তদন্ত) সাইফুদ্দিন আনোয়ার বলেন, মিশুর আচরণ বেশ রহস্যজনক। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। ওই বিচারকের মৃত্যুর পরও সে বেশ স্বাভাবিক। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে এ বিষয়ে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মনে হচ্ছে কৌশলে জজ সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে। মিশু ধরা পড়ার পর থেকেই বলছেন তাকে বিয়ে করেছেন। অথচ সাঈদের প্রথম স্ত্রী এ নিয়ে কিছুই জানেন না। তার মানে যদি বিয়ে হয়ে থাকে তবে তা গোপনে। আর না হলে কোন ধরনের ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে তাদের সম্পর্ক আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি দু’-একদিনের মধ্যে সব কিছু বের হয়ে আসবে।
No comments