১০ দস্যুদলের নিয়ন্ত্রণে সুন্দরবন by এ, কে আজাদ
মুক্তিপণ আর লুটপাটের নেশায় অন্তত ১০টি বনদস্যু বাহিনী চষে বেড়াচ্ছে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন গোটা সুন্দরবন উপকূল। জেলেদের জিম্মি করে আদায় করছে মোটা অংকের অর্থ। লুটে নিচ্ছে মাছ ও নৌকাসহ অন্যান্য মালামাল। অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও দস্যুদের দমনে হিমশিম খাচ্ছে। কখনও আঁতাত করে আবার কখনও দস্যুদের অস্ত্রের মুখে জীবনবাজি রেখে মাছ শিকার করছে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মৎস্যজীবী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিবছর দু’দফায় সাগরে মাছ শিকারে যান এ অঞ্চলের জেলেরা। শীত মওসুমে শুঁটকি আর বর্ষা মওসুমে ইলিশ আহরণকে কেন্দ্র করে সাগর উপকূলে জেলেদের ঢল নামে। চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কয়েক লাখ জেলে অস্থায়ী বাসা বাঁধে সুন্দরবন উপকূলের সাগর চরে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে তারা মাছ শিকার করেন। কিন্তু বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও জেলেদের কাছে বড় আতংক দস্যুবাহিনী। চলতি ইলিশ মওসুমকে ঘিরে সাগর উপকূলে চলছে দস্যুবাহিনীর রামরাজত্ব। ছোট বড় অন্তত ১০টি দস্যুবাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা সাগর উপকূল। একের পর এক ঘটছে অপহরণ আর লুটপাটের ঘটনা। জেলেদেরকে শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও মহাজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও হাঁপিয়ে উঠছে দস্যু দমনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মংলার একজন আড়ৎদার জানান, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে রাজু বাহিনী, জুলফু বাহিনী, রাংগা বাহিনী, আউয়াল বাহিনী, বেলাল বাহিনী, ফরহাদ বাহিনী, রবিউল বাহিনী ও জিয়া বাহিনী বেশী বেপরোয়া। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব দস্যু বাহিনী উপকূল থেকে দু’শতাধিক জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করেছে। নিরস্ত্র জেলেদের ওপর হামলা করে এরা লুটে নিয়েছে জাল, নৌকা, মাছ ও জেলেদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সর্বশেষ গত শুক্র ও শনিবার সুন্দরবনের নারিকেল বাড়িয়ায় বেলাল বাহিনী ও চরাপুটিয়া থেকে রাংগা বাহিনী অন্তত ৮০ জন জেলেকে অপহরণ করেছে। মংলার একাধিক মৎস্য আড়ৎদার জানান, দস্যুরা নৌকা প্রতি একজন কিংবা দু’জন জেলেকে উঠিয়ে নিয়ে আড়ৎদারের কাছ থেকে আদায় করছে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। টাকা না দিলে জিম্মি জেলেদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। কখনো আবার গুলি করে জেলেদের লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ব্যবসা চালানোর স্বার্থেই জেলে মহাজনরা দস্যুদের এসব নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করছেন। দস্যুদের সঙ্গে একরকম আঁতাত করেই ব্যবসা চালাচ্ছেন সাগরভিত্তিক এসব মৎস্য ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, প্রতিটি বনদস্যু বাহিনীকে জেলে প্রতি ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা করে নিয়মিত মাসিক চাঁদা দিতে হয়। তারপরেও মাঝে মধ্যে তারা চড়াও হয় জেলেদের ওপর। এক গ্রুপকে চাঁদা দিয়ে শান্ত করলে আরেকটি গ্রুপ এসে জেলে বহরে হামলা করে। সুন্দরবন উপকূলে এরকম ছোট বড় অন্তত ১০টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নদীতে নিয়মিত টহল দিলেও দস্যুরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে শুরু করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে দস্যুদের একাধিক আস্তানা রয়েছে। এর মধ্যে মেহের আলীর চর, আলোর কোল, কটকা, আম বাড়িয়া, ডিমের চর, নারকেল বাড়িয়া, সোনার চর, ভদ্রা, চরাপুটিয়া, হারবাড়িয়া, বলেশ্বর নদীর মোহনা ও চান্দেরশ্বর সহ আশপাশের এলাকায় রয়েছে দস্যুদের অবাধ বিচরণ। দস্যুবৃত্তির খবর পাবার পর আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে অভিযান চালালেও দস্যুরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সময়ের ব্যবধানে তারা চলে যায় তাদের নিরাপদ আস্তানায়। মাঝে মধ্যে দু’চারজন দস্যু ধরা পরলেও তাতে বাহিনীর তেমন কোন ক্ষতি হয় না। মাছ শিকারের জন্য বন বিভাগকে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব দেন জেলে মহাজনরা। কিন্তু বনরক্ষীরা জেলেদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। একের পর এক দস্যুদের হামলা ও গণহারে লুটপাটের ঘটনায় ইলিশ জেলেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। জাল নৌকা আর পুঁজি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন জেলে মহাজনরা। দস্যুদের কাছে বনরক্ষীরাও নাকি অসহায়। তারা দস্যুদের সঙ্গে বিরোধে জড়ায় না, এমন অভিযোগ জেলেদের। অভিযোগ মতে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরের অনেক ফরেস্ট ক্যাম্পেই নির্ভয়ে রাত কাটায় দস্যুরা। দস্যুদের হামলার কথা স্বীকার করে দুবলা ফরেস্ট ক্যাম্পের ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ডাকাতির খবর পেলেই আমরা ঘটনাস্থলে যাই, জেলেদের খোঁজ খবর নিই, কিন্তু দস্যুদের নাগাল পাওয়া যায় না। বিশাল সাগর উপকূল আর অসংখ্য নদ-নদীতে গুটি কয়েক বনরক্ষী দিয়ে জেলেদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়।” কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন (মংলা) অপারেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার আলাউদ্দিন বলেন, ‘সুন্দরবনসহ সাগর উপকূলে কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল ছাড়াও বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
No comments