মাইলামের আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক by আলী ইমাম মজুমদার

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের একটি নিবন্ধের অনুবাদ কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে মাইলাম বলেছেন, গত সংসদ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। অনেকটা একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতার ভিত জোরদার করেছে সরকার। পাশাপাশি মূল বিরোধী দলের প্রতি করছে অসহিষ্ণু আচরণ। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে করেছে সম্প্রচার নীতিমালা। এ ধরনের বিশ্লেষণ থেকে তিনি মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উইলিয়াম বি মাইলাম একজন পেশাদার কূটনীতিক। ২০০১ সালের জুলাই মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে তিনি এ দেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৯০-এর আগস্ট থেকে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। গণতন্ত্রায়ণের পথে দেশটির নতুন অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন একজন সচেতন পর্যবেক্ষক। দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকা সম্পর্কে তাঁর হয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। অবসর গ্রহণের পরে দুবার তাঁকে রাষ্ট্রীয় কাজে ডেকে আনা হয়। প্রথমত, নয়-এগারোর পর আফগানিস্তানে বহুপক্ষীয় পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে নয় মাসের জন্য। এরপর আবার ২০০৭-০৮ সালে কয়েক মাসের জন্য লাইবেরিয়ায় রাষ্ট্রদূতের পদে। উল্লেখ্য, ১৯৯৫-৯৮ সালে তিনি সেখানকার মিশনপ্রধান থাকাকালে সাত বছর চলমান গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। অনুষ্ঠিত হয় একটি স্বচ্ছ নির্বাচন। এখন তিনি কাজ করছেন উড্রো উইলসন সেন্টারে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র পলিসি স্কলার হিসেবে।

বহুদর্শী এ কূটনীতিকের অভিজ্ঞতালব্ধ মতামতকে তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগ নেই। এটি আমাদের জন্য সুখবর নয় বটে। তবে তাঁর বিশ্লেষণকে অসংগত বলা যাবে না। আমাদের গত জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তিনি কেন, পাশ্চাত্যের সব দেশই প্রায় এক সুরে কথা বলেছে। নির্বাচনের পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অসন্তোষ প্রকাশ করে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সচিব নিশা দেশাই বিসওয়াল ও আমাদের দেশে নিয়োগ-প্রক্রিয়াধীন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে একই ভাষায় বলেছেন, নির্বাচনটি ছিল অনস্বীকার্য ত্রুটিপূর্ণ। এ বক্তব্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতির অংশ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত
ড্যান মজীনা। তাঁদের মতে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিত। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দিকে দেশটি চলমান বলে মাইলামের বক্তব্যও কিছু যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের উচিত বার্তাটি নিয়ে নিজেদের সংশোধন করে তাঁর বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণ করা। তা না করে সেটাকে আরও জোরদার করতে উঠেপড়ে লাগেন কেউ কেউ। এর দায়ভার চাপে সরকার ও দেশের ওপর। সরকারি দলের নেতাদের একটি অংশ মেঘনাদবধ কাব্য-এর প্রমীলার মতোই যেন বলছেন—
‘দানব-নন্দিনী আমি রক্ষঃ কুলবধূ
রাবণ শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী,
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?’
রাঘব যে মেঘনাদবধ কাব্য-এর মতোই ভিখারি নয়, তা তাঁরা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল। আরও বিস্ময়কর হলো, যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা নিজেদের দলীয় স্বার্থের প্রতিকূল যেকোনো দেশি-বিদেশি পরামর্শ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাকচ করেন। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
সাংবিধানিক পদে আসীন সব পদের অপসারণ-প্রক্রিয়া সংসদের হাতে নিতে সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা হলো। এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসন সংস্কৃতির অনুকরণেই করা হয়েছে, এমনটাই সরকারি ভাষ্য। এর পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক মতামত আছে। তবে এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই রইল উপেক্ষিত। যাদের নজির টানা হচ্ছে, তাদের অনুকরণে অন্তত একটি অংশগ্রহণমূলক পক্ষপাতহীন নির্বাচনও তো হওয়া দরকার।
রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার অনেক ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। বিষয়টি নতুন নয়। তবে ক্রমবর্ধমান। ধারাবাহিকভাবে সব সরকার এমনটা করে চলছে। কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে তো বিরতি দিতে হবে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে যেনতেন কারণে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে শত শত মামলা। রাস্তাঘাটে গাড়ি ভাঙচুর মামলায় অশীতিপর নেতারাও আসামি হন। তাঁরাও ক্ষমতায় থাকতে করেছেন একই ধরনের কাজ। আর সে জন্যই তো জনগণ তাঁদের বর্জন করেছে। এটা এখনকার সরকার কখন বুঝতে পারবে? গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে জেদ একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এটা সরকারকে কোনো সুফল দিয়েছে—এমন দাবি সরকারি দলের অনেক নেতা-কর্মীই করেন না। বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। কিন্তু তা করতে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ইত্যাদি কেন্দ্র দীর্ঘকাল চালু রাখার ফলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তার পরও এ কাজ করতে আইন করে দায়মুক্তি দিতে হবে কেন,
এটা দুর্বোধ্য। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তো কাজ করার জন্য দায়মুক্তি আইন করা আবশ্যক হয়নি। এসব ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা পর্যবেক্ষণ করে ক্রমান্বয়ে আরও কর্তৃত্ববাদী শাসনের আশঙ্কা করাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না।
গত সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। এমনকি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পরও। অনেক বিজ্ঞজন এগুলো পর্যালোচনা করে মতামতও দিয়েছেন। কিন্তু তা হোক, এটা সরকার চায় না বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। পাশাপাশি বিএনপি এ ফাঁদে পা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উভয় দল। সরকার আগের মেয়াদে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিল। এখন তাদের সে গৌরববোধ মলিন হয়ে গেছে। পাশাপাশি বিএনপি অন্তত এখনকার মতো ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ হারিয়েছে। চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। সরকার অধিকতর হারে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ ধরনের সরকারের অসহিষ্ণু আর কর্তৃত্ববাদী হওয়ার দিকেই প্রবণতা থাকার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও অকারণ কিছু সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে। র্যাব গঠনের পর যখন বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়, তখন থেকেই আতঙ্কিত ছিল সচেতন মহল। তবে শুরুর দিকে নিহত ব্যক্তিরা ছিল চিহ্নিত সন্ত্রাসী, খুনি, ডাকাত ইত্যাদি। আইনের আওতার বাইরেই ছিল তাদের বিচরণ। সে পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে ছিল উল্লসিত। তার পরও জঙ্গি দমনে বাহিনীটি বিস্ময়কর সাফল্যের ছাপ রাখে। সেখানে আবশ্যক হয়নি কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যা। অথচ এরপর? উপযুক্ত তদারকি না থাকায় এ বাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য খুনির পর্যায়ে নেমে যান। নারায়ণগঞ্জ ঘটনায় গোটা সংস্থাটির ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছুটা স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে সংস্থায়। অবশ্য এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। সংস্কারের প্রয়োজন থাকলেও এদের আবশ্যকতা রয়েছে। তবে র্যাবসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় নিতে হবে জিরো টলারেন্স নীতি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর মূল আসামিদের গ্রেপ্তারে হাইকোর্টের আদেশ আবশ্যক হয়। আর অপর প্রধান আসামি দিন দুই দেশে অবস্থান করে টেলিফোনে স্বজনদের নির্দেশনা নিয়ে সরে পড়েন পাশের দেশে। এ ক্ষেত্রে সূচনায় প্রশাসনের নৈরাশ্যজনক ভূমিকা সবাইকে বিস্মিত করেছে। মনে হতে পারে, সরকারি পদ-পদবিধারী ব্যক্তিরা ঘৃণ্য অপরাধ করলেও দায়মুক্ত। আর তা হলে শাসনযন্ত্রকে কর্তৃত্ববাদী আখ্যায়িত করলে দোষ দেওয়া যাবে না।
এত সব বিভ্রান্তির পরও আমরা আশাবাদী। উইলিয়াম বি মাইলাম বা যাঁরা তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন, তাঁরা একপর্যায়ে ভ্রান্ত প্রমাণিত হবেন। এ দেশে গণতন্ত্রকামী মানুষের দাবির মুখে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে আচরণে পরিবর্তন আনবে। পরিহার করবে কর্তৃত্বমূলক মনোভাব। জনগণের চিন্তা–চেতনাকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অগ্রযাত্রার কাফেলায় আমরাও তখন শরিক হতে পারব। এ দেশ সম্পর্কে ১৯৭৪ সালে তাচ্ছিল্যমূলক মন্তব্য করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। বলেছিলেন, দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি। সমকালীন সব সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে কৃষক, পোশাককর্মী আর প্রবাসী শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর বিশ্লেষণ ছিল ভ্রান্ত। তেমনি ভ্রান্ত প্রমাণ করা দরকার উইলিয়াম বি মাইলামের বিশ্লেষণ। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.