রুপালি পর্দার কুহকিনী
পুরুষেরা সাবধান! পাপ নগরে আছে এক কুহকিনী। তার নাম ইভা গ্রিন। অবিশ্বস্ত খুনে এক ছলনাময়ী সে। তার মোহের মায়ায় জড়ালে মেরুর বরফও মেঘ হয়ে যায়। ‘সিন সিটি: আ ড্যামে টু কিল ফর’ সিনেমায় ইভা গ্রিনের চরিত্রটি এমনই। সিনেমায় তার নাম আভা লর্ড। কিন্তু তাকে ‘ফেমে ফ্যাটালে’ বা ‘মারাত্মক কুহকিনী’ বলেও ডাকা যেতে পারে! লক্ষ্য হাসিলে ছলনায় ভুলিয়ে পুরুষকে ঘায়েল করে সে। যেন ঠিক একইভাবে রুপালি পর্দার দর্শকদেরও ঘায়েল করতে পারে সিনেমার এই নারী চরিত্ররা! পশ্চিমা সিনে দুনিয়ার এই ‘কুহকিনী’ চরিত্রের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিবিসি অবলম্বনে এই প্রতিবেদন।
রুপালি পর্দার কুহকিনী
সিনেমায় এই ধাঁচের নারী চরিত্রের উপস্থিতির বিষয়টা খুবই স্পষ্ট। সুন্দর কোমল আঙুলে জশ ব্রোলিনের পুরো শরীর জড়িয়ে নিচ্ছেন ইভা গ্রিন...এই দৃশ্য কে-ই বা না দেখতে চাইবে! পুরুষ দর্শককেও সে এই মোহজালেই ভোলায়, কাছে টানে, কিন্তু সে নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ দেয় না। সিনেমার এই ‘কুহকিনী’ চরিত্র নিয়ে একটা গবেষণা সম্পাদনা করেছেন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর ক্যাথেরিন ও’রাওয়ে। গবেষণাটির শিরোনাম ‘ফিমে ফ্যাটালে: ইমেজেস, হিস্টোরিস, কনটেক্সটস’ বা ‘মারাত্মক কুহকিনী: প্রতিমূর্তি, ইতিহাস, পরিপ্রেক্ষিত’। ও’রাওয়ে মনে করেন, সিনেমায় এই ধাঁচের নারী চরিত্র আসলে ‘স্বাধীন নারী’র প্রতি সমাজের মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
ও’রাওয়ে বলছেন, ‘নারী প্ররোচকের এই চরিত্র নন্দনকাননে আদম-হাওয়ার কাহিনির মতোই আদি।’ তবে, ব্রিস্টলের এই গবেষক বলেন, ‘আজকে আমরা যে কুহকিনী নারীর চরিত্র দেখছি তার উত্থান ১৯ শতকের শেষ ভাগে। যে সময়টায় হেরোডের কন্যা সালোমে থেকে শুরু করে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের শি কিংবা ব্রাম স্টোকারের নারী ভ্যাম্পায়ারের মতো একের পর এক এমন চরিত্র সমকালীন গল্প-উপন্যাসে আসতে শুরু করল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমন এক সময়ে এসব চরিত্রের উত্থান ঘটতে থাকল যখন জনপরিসরে নারীর উপস্থিতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে।’
একই বিষয় লক্ষ্য করা যাবে রুপালি পর্দায় মারাত্মক কুহকিনীদের উত্থান পর্বেও। এ জাতীয় চলচ্চিত্রগুলোতে সব সময়ই নারীকে পাতক ও প্ররোচক হিসেবে হাজির করা হয়েছে। ১৯১৫ সালের নির্বাক সিনেমা ‘আ ফুল দেয়ার ওয়াজ’-এর মধ্য দিয়েই হলিউডের এমন চরিত্রের রূপায়ণ শুরু হয়। এতে দেখা যায় ওয়াল স্ট্রিটের এক সম্মানিত আইনজীবী ‘মারাত্মক কুহকিনী’ থেডা বারার আদিরসের মোহবাণে আবিষ্ট হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। তবে, হালের ‘মারাত্মক কুহকিনী’ চরিত্র ষোলকলা পূর্ণ করে পর্দায় হাজির হয় ১৯৪০-এর দিকে।
‘ফিল্ম নোয়া’ হিসেবে অভিহিত সিনেমার এ ঘরানা বিকশিত হয়ে ওঠে ‘গিল্ডা’, ‘দ্য কিলারস’, ‘মার্ডার’, ‘মাই সুইট’ এবং ‘ডাবল ইনডেমনিটি’র মতো চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমেই। এ সময় নিজেদের আদিরসাত্মক সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে রিটা হেওয়ার্থ, আভা গার্ডনার ও বারবারা স্ট্যানউইকের মতো অভিনেত্রীরা হয়ে ওঠেন রুপালি পর্দার ধ্রুপদী ‘কুহকিনী’। সিনেমায় দেখা যায় এই নারীরা যা চান, তা পাওয়ার জন্য তাঁরা সবকিছুই করতে প্রস্তুত। প্রতারণা হোক কিংবা প্ররোচনা যেকোনো মূল্যে খলনায়ককে বশে আনছে, এমনকি প্রয়োজনে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। তবে, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট আঙ্গিলার ‘ফিল্ম নোয়া’ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যালেন রাইট মনে করেন সিনেমার এমন চরিত্র কল্পনার জগতের মনে হলেও বাস্তব সমাজের সঙ্গে বিষয়গুলোকে মিলিয়ে দেখা জরুরি।
‘ঘরের নারী’ না ‘বাইরের নারী’
ডক্টর অ্যালেন রাইট মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে যে শ্রম ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণের জন্য অনেক নারীকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের কাজ করতে হয়। এমনকি যেসব কাজকে একসময় ‘পুরুষালি’ কাজ বলে নারীদের দূরে রাখা হয়েছিল, সেসব কাজও করতে হয় নারীকেই। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নারীরা তখন অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান। নিজের উপার্জনে ঘরের বাইরে নারীর এ উপস্থিতি নিয়ে সমাজে আলোচনার ঝড় ওঠে। যুদ্ধকালীন আমেরিকায় আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয় বাইরে কাজ করা, নারীর অবসর যাপন এবং তাঁর যৌনতার বিষয়টি। অ্যালেন রাইটের ধারণা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন সামাজিক পরিস্থিতিতেই সিনেমায় এই ‘কুহকিনী’ চরিত্রের জন্ম এবং ঘর থেকে বেরোনো নারীকে আক্রমণ করা এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এমন বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন অধ্যাপক মার্ক জাঙ্কোভিচ। ‘ডিফাইনিং কাল্ট মুভিস’ বইয়ের সহ-লেখক এবং চলচ্চিত্র গবেষক জাঙ্কোভিচ বলেন, ‘একটা নারীবাদী আলোচনা আছে যে, যুদ্ধের দিনগুলোতে স্বাধীন কর্মজীবী নারীর চরিত্র হনন করতেই কুহকিনী চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।’ কিন্তু এ ধারণার সঙ্গে একমত নন জাঙ্কোভিচ। তিনি বলেন, ‘মনে করা হয় নারীকে বাইরে থেকে হটিয়ে আবারও ঘরে ফেরত পাঠানোর প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেই এসব চরিত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি এর ঠিক উল্টোটাই বলব। এই সিনেমাগুলো বরং যে নারীরা যুদ্ধের সময়েও কাজের জন্য ঘর থেকে বেরোয়নি তাঁদেরই সমালোচনা করে। কল-কারখানায় কাজ করে খেটে খাওয়া, দৃঢ় প্রত্যয়ী আধুনিক নারীরা কুহকিনী চরিত্রের বিষয় নয়; বরং জনপরিসরে এসে কোনো সামাজিক দায়িত্ব না নেওয়া, আলস্যে জীবন পার করা, স্বামীর টাকায় সেজেগুজে স্বল্প-বসনে ঘরে বসে থাকা নারীরাই মারাত্মক কুহকিনী।’
‘ঘরে থাকা নারী’ কিংবা ‘বাইরে বেরোনো’ বা ‘স্বাধীন কর্মজীবী নারী’ যাকেই ‘কুহকিনী’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়ে থাকুক না কেন বাস্তবতা হলো—সিনেমার এই নারীরা ঘৃণা নয় ভালোবাসাই পেয়েছেন। আর তা কেবল মোহগ্রস্ত পুরুষ দর্শকদের কাছ থেকেই নয়; বরং অনেক নারীর কাছ থেকেও। ডক্টর অ্যালেন রাইট বলেন, ‘একজন নারী দর্শক হিসেবে আমি এমন চরিত্রকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দক্ষ চরিত্র হিসেবে মনে করি। যে শুধু আখ্যানকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, সেজেগুজে টুমটুমা হয়ে নিজের যৌনতাকে মুক্ত করে ঘুরে বেড়ায় না; বরং শেষ পর্যন্ত সামাজিক ব্যবস্থায় নিজের অসম্মানজনক অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে। কৃতকর্মের জন্য কপালে যে শাস্তিই জুটুক, এই নারী তার পরোয়া করে না। আমার এখনো মনে হয়, সে প্রবলভাবেই শক্তিমান ও উদ্দীপনামূলক একটা বার্তাই দেয়।’
কুহকিনী রমণী! না কুহক পুরুষ!
১৯৫০ সালের দিকে আমেরিকা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করলে কুহকিনী চরিত্রটা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পর্দা থেকে কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি সে। ১৯৯০ সালের দিকে শ্যারন স্টোনের ‘বেসিক ইন্সটিঙ্কট’, ম্যাডোনার ‘বডি অব এভিডেন্স’ ডেমি মুরের ‘ডিসক্লোজার’ এবং নিকোল কিডম্যানের ‘টু ডাই ফর’-এর মতো সিনেমার মধ্য দিয়ে রুপালি পর্দায় আবারও জাঁকিয়ে বসে কুহকিনী চরিত্র।
নব্বইয়ের দশকে এ চরিত্রের পুনরুত্থানের সময়ও দেখা গেছে, সমকালীন সামাজিক উদ্বেগের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই স্পষ্ট। রোনাল্ড রিগান এবং সিনিয়র বুশের শাসনামলে রক্ষণশীল যুক্তরাষ্ট্রে সতর্কভাবে স্বাধীন নারীর গল্প তুলে ধরতে পেরে আনন্দিতই ছিল হলিউড। ডক্টর ক্যাথেরিন ও’রাওয়ের ভাষায় এ সময়ে এমন সিনেমায় গল্পের আবশ্যক শর্ত ছিল ‘সামাজিক সীমা পেরোনো নারীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’ হলিউডের বাস্তবতা যা-ই হোক আজকাল আর আগের মতো কুহকিনী রমণীদের দেখা যাচ্ছে না। তবে, ‘সিন সিটি: আ ড্যামে টু কিল ফর’ সিনেমায় ইভা গ্রিনের চরিত্রটির ‘আভা লর্ড’ নামের সঙ্গে ধ্রুপদী যুগের কুহকিনী ‘দ্য কিলার’-এর ‘আভা গার্ডনারের’ নামের মিল কাকতালীয় বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। এই নতুন সিনেমাটিও হালের অন্যান্য সিনেমার মতোই সমকালীন বিষয় নিয়ে তেমন কিছুই বলছে না। বরং পুরোনো যুগের আবহে নিয়ে গিয়ে দর্শকদের কাছে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ জোগাচ্ছে।
সাবেক কালের কুহকিনীদের আর দেখা যাচ্ছে না বলে ভাবার কোনো কারণ নেই যে, অনুরাগীদের তৃষ্ণা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া রহস্যময় আর খুনে প্ররোচকের আকাল পড়েছে সিনেমায়। কুহকিনী রমণীর জায়গায় আমরা ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’তে ক্রিশ্চিয়ান গ্রে এবং ‘টোয়াইলাইট’-এর এডওয়ার্ড কালেনের মতো প্ররোচক পুরুষের চরিত্র পাচ্ছি, যে কিনা আক্ষরিক অর্থেই একজন ড্রাকুলা। নারীরা সাবধান! এখানে হাজির ‘হোমে ফ্যাটালে’ বা ‘কুহক পুরুষ!’
রুপালি পর্দার কুহকিনী
সিনেমায় এই ধাঁচের নারী চরিত্রের উপস্থিতির বিষয়টা খুবই স্পষ্ট। সুন্দর কোমল আঙুলে জশ ব্রোলিনের পুরো শরীর জড়িয়ে নিচ্ছেন ইভা গ্রিন...এই দৃশ্য কে-ই বা না দেখতে চাইবে! পুরুষ দর্শককেও সে এই মোহজালেই ভোলায়, কাছে টানে, কিন্তু সে নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ দেয় না। সিনেমার এই ‘কুহকিনী’ চরিত্র নিয়ে একটা গবেষণা সম্পাদনা করেছেন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর ক্যাথেরিন ও’রাওয়ে। গবেষণাটির শিরোনাম ‘ফিমে ফ্যাটালে: ইমেজেস, হিস্টোরিস, কনটেক্সটস’ বা ‘মারাত্মক কুহকিনী: প্রতিমূর্তি, ইতিহাস, পরিপ্রেক্ষিত’। ও’রাওয়ে মনে করেন, সিনেমায় এই ধাঁচের নারী চরিত্র আসলে ‘স্বাধীন নারী’র প্রতি সমাজের মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
ও’রাওয়ে বলছেন, ‘নারী প্ররোচকের এই চরিত্র নন্দনকাননে আদম-হাওয়ার কাহিনির মতোই আদি।’ তবে, ব্রিস্টলের এই গবেষক বলেন, ‘আজকে আমরা যে কুহকিনী নারীর চরিত্র দেখছি তার উত্থান ১৯ শতকের শেষ ভাগে। যে সময়টায় হেরোডের কন্যা সালোমে থেকে শুরু করে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের শি কিংবা ব্রাম স্টোকারের নারী ভ্যাম্পায়ারের মতো একের পর এক এমন চরিত্র সমকালীন গল্প-উপন্যাসে আসতে শুরু করল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমন এক সময়ে এসব চরিত্রের উত্থান ঘটতে থাকল যখন জনপরিসরে নারীর উপস্থিতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে।’
একই বিষয় লক্ষ্য করা যাবে রুপালি পর্দায় মারাত্মক কুহকিনীদের উত্থান পর্বেও। এ জাতীয় চলচ্চিত্রগুলোতে সব সময়ই নারীকে পাতক ও প্ররোচক হিসেবে হাজির করা হয়েছে। ১৯১৫ সালের নির্বাক সিনেমা ‘আ ফুল দেয়ার ওয়াজ’-এর মধ্য দিয়েই হলিউডের এমন চরিত্রের রূপায়ণ শুরু হয়। এতে দেখা যায় ওয়াল স্ট্রিটের এক সম্মানিত আইনজীবী ‘মারাত্মক কুহকিনী’ থেডা বারার আদিরসের মোহবাণে আবিষ্ট হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। তবে, হালের ‘মারাত্মক কুহকিনী’ চরিত্র ষোলকলা পূর্ণ করে পর্দায় হাজির হয় ১৯৪০-এর দিকে।
‘ফিল্ম নোয়া’ হিসেবে অভিহিত সিনেমার এ ঘরানা বিকশিত হয়ে ওঠে ‘গিল্ডা’, ‘দ্য কিলারস’, ‘মার্ডার’, ‘মাই সুইট’ এবং ‘ডাবল ইনডেমনিটি’র মতো চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমেই। এ সময় নিজেদের আদিরসাত্মক সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে রিটা হেওয়ার্থ, আভা গার্ডনার ও বারবারা স্ট্যানউইকের মতো অভিনেত্রীরা হয়ে ওঠেন রুপালি পর্দার ধ্রুপদী ‘কুহকিনী’। সিনেমায় দেখা যায় এই নারীরা যা চান, তা পাওয়ার জন্য তাঁরা সবকিছুই করতে প্রস্তুত। প্রতারণা হোক কিংবা প্ররোচনা যেকোনো মূল্যে খলনায়ককে বশে আনছে, এমনকি প্রয়োজনে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। তবে, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট আঙ্গিলার ‘ফিল্ম নোয়া’ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যালেন রাইট মনে করেন সিনেমার এমন চরিত্র কল্পনার জগতের মনে হলেও বাস্তব সমাজের সঙ্গে বিষয়গুলোকে মিলিয়ে দেখা জরুরি।
‘ঘরের নারী’ না ‘বাইরের নারী’
ডক্টর অ্যালেন রাইট মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে যে শ্রম ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণের জন্য অনেক নারীকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের কাজ করতে হয়। এমনকি যেসব কাজকে একসময় ‘পুরুষালি’ কাজ বলে নারীদের দূরে রাখা হয়েছিল, সেসব কাজও করতে হয় নারীকেই। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নারীরা তখন অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান। নিজের উপার্জনে ঘরের বাইরে নারীর এ উপস্থিতি নিয়ে সমাজে আলোচনার ঝড় ওঠে। যুদ্ধকালীন আমেরিকায় আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয় বাইরে কাজ করা, নারীর অবসর যাপন এবং তাঁর যৌনতার বিষয়টি। অ্যালেন রাইটের ধারণা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন সামাজিক পরিস্থিতিতেই সিনেমায় এই ‘কুহকিনী’ চরিত্রের জন্ম এবং ঘর থেকে বেরোনো নারীকে আক্রমণ করা এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এমন বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন অধ্যাপক মার্ক জাঙ্কোভিচ। ‘ডিফাইনিং কাল্ট মুভিস’ বইয়ের সহ-লেখক এবং চলচ্চিত্র গবেষক জাঙ্কোভিচ বলেন, ‘একটা নারীবাদী আলোচনা আছে যে, যুদ্ধের দিনগুলোতে স্বাধীন কর্মজীবী নারীর চরিত্র হনন করতেই কুহকিনী চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছে।’ কিন্তু এ ধারণার সঙ্গে একমত নন জাঙ্কোভিচ। তিনি বলেন, ‘মনে করা হয় নারীকে বাইরে থেকে হটিয়ে আবারও ঘরে ফেরত পাঠানোর প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেই এসব চরিত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি এর ঠিক উল্টোটাই বলব। এই সিনেমাগুলো বরং যে নারীরা যুদ্ধের সময়েও কাজের জন্য ঘর থেকে বেরোয়নি তাঁদেরই সমালোচনা করে। কল-কারখানায় কাজ করে খেটে খাওয়া, দৃঢ় প্রত্যয়ী আধুনিক নারীরা কুহকিনী চরিত্রের বিষয় নয়; বরং জনপরিসরে এসে কোনো সামাজিক দায়িত্ব না নেওয়া, আলস্যে জীবন পার করা, স্বামীর টাকায় সেজেগুজে স্বল্প-বসনে ঘরে বসে থাকা নারীরাই মারাত্মক কুহকিনী।’
‘ঘরে থাকা নারী’ কিংবা ‘বাইরে বেরোনো’ বা ‘স্বাধীন কর্মজীবী নারী’ যাকেই ‘কুহকিনী’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়ে থাকুক না কেন বাস্তবতা হলো—সিনেমার এই নারীরা ঘৃণা নয় ভালোবাসাই পেয়েছেন। আর তা কেবল মোহগ্রস্ত পুরুষ দর্শকদের কাছ থেকেই নয়; বরং অনেক নারীর কাছ থেকেও। ডক্টর অ্যালেন রাইট বলেন, ‘একজন নারী দর্শক হিসেবে আমি এমন চরিত্রকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দক্ষ চরিত্র হিসেবে মনে করি। যে শুধু আখ্যানকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, সেজেগুজে টুমটুমা হয়ে নিজের যৌনতাকে মুক্ত করে ঘুরে বেড়ায় না; বরং শেষ পর্যন্ত সামাজিক ব্যবস্থায় নিজের অসম্মানজনক অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে। কৃতকর্মের জন্য কপালে যে শাস্তিই জুটুক, এই নারী তার পরোয়া করে না। আমার এখনো মনে হয়, সে প্রবলভাবেই শক্তিমান ও উদ্দীপনামূলক একটা বার্তাই দেয়।’
কুহকিনী রমণী! না কুহক পুরুষ!
১৯৫০ সালের দিকে আমেরিকা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করলে কুহকিনী চরিত্রটা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পর্দা থেকে কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি সে। ১৯৯০ সালের দিকে শ্যারন স্টোনের ‘বেসিক ইন্সটিঙ্কট’, ম্যাডোনার ‘বডি অব এভিডেন্স’ ডেমি মুরের ‘ডিসক্লোজার’ এবং নিকোল কিডম্যানের ‘টু ডাই ফর’-এর মতো সিনেমার মধ্য দিয়ে রুপালি পর্দায় আবারও জাঁকিয়ে বসে কুহকিনী চরিত্র।
নব্বইয়ের দশকে এ চরিত্রের পুনরুত্থানের সময়ও দেখা গেছে, সমকালীন সামাজিক উদ্বেগের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই স্পষ্ট। রোনাল্ড রিগান এবং সিনিয়র বুশের শাসনামলে রক্ষণশীল যুক্তরাষ্ট্রে সতর্কভাবে স্বাধীন নারীর গল্প তুলে ধরতে পেরে আনন্দিতই ছিল হলিউড। ডক্টর ক্যাথেরিন ও’রাওয়ের ভাষায় এ সময়ে এমন সিনেমায় গল্পের আবশ্যক শর্ত ছিল ‘সামাজিক সীমা পেরোনো নারীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’ হলিউডের বাস্তবতা যা-ই হোক আজকাল আর আগের মতো কুহকিনী রমণীদের দেখা যাচ্ছে না। তবে, ‘সিন সিটি: আ ড্যামে টু কিল ফর’ সিনেমায় ইভা গ্রিনের চরিত্রটির ‘আভা লর্ড’ নামের সঙ্গে ধ্রুপদী যুগের কুহকিনী ‘দ্য কিলার’-এর ‘আভা গার্ডনারের’ নামের মিল কাকতালীয় বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। এই নতুন সিনেমাটিও হালের অন্যান্য সিনেমার মতোই সমকালীন বিষয় নিয়ে তেমন কিছুই বলছে না। বরং পুরোনো যুগের আবহে নিয়ে গিয়ে দর্শকদের কাছে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ জোগাচ্ছে।
সাবেক কালের কুহকিনীদের আর দেখা যাচ্ছে না বলে ভাবার কোনো কারণ নেই যে, অনুরাগীদের তৃষ্ণা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া রহস্যময় আর খুনে প্ররোচকের আকাল পড়েছে সিনেমায়। কুহকিনী রমণীর জায়গায় আমরা ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’তে ক্রিশ্চিয়ান গ্রে এবং ‘টোয়াইলাইট’-এর এডওয়ার্ড কালেনের মতো প্ররোচক পুরুষের চরিত্র পাচ্ছি, যে কিনা আক্ষরিক অর্থেই একজন ড্রাকুলা। নারীরা সাবধান! এখানে হাজির ‘হোমে ফ্যাটালে’ বা ‘কুহক পুরুষ!’
No comments