চতুর্মুখী ঢিল ছুড়ছেন এরশাদ by সেলিম জাহিদ
নিজ দলে এখনো কোণঠাসা। প্রধানমন্ত্রীর
বিশেষ দূত হয়েও আস্থার সংকটের কারণে সরকারের কাছে উপেক্ষিত। মাথার ওপর
মামলার খড়্গ৷ এ কারণে সরকারকে চটাতেও পারছেন না, এড়াতেও পারছেন না।
সরকারকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেও সফল হচ্ছেন না। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে সংকটে
আছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে এরশাদের কোনো কৌশলই কাজে আসছে না। তার পরও তিনি চতুর্মুখী ঢিল ছুড়ছেন। কখনো নিজ দল, কখনো সরকার আবার কখনো বিএনপি ও জামায়াতের প্রতি ঢিল ছুড়ছেন। নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হয়েছেন। এখন একবার সে নির্বাচনের পক্ষে, আবার বিপক্ষেও কথা বলছেন। শপথ নেওয়ার পর বলেছিলেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নেননি। ইদানীং বলছেন, জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে বলেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
সর্বশেষ ২ আগস্ট এরশাদ সুর পাল্টে বলেছেন, যে সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাদের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। মানুষের নিরাপত্তা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনে নামতে হবে।
এ ভোল পাল্টানো স্বভাবের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল এরশাদকে দ্বিচারী বলেছিলেন। ২ আগস্ট সরকারে থেকে আন্দোলনে নামার হুমকি দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও তাঁকে দ্বিচারী বলে মন্তব্য করেছেন।
এ সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও জাপার নেতা গোলাম মসীহ্ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসলে উনি (এরশাদ) কখন কী বলেন, আমাদের মাথায় ধরে না।’
তবে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এরশাদ যা-ই করুন না কেন, সবই তাঁর নিজের ব্যক্তিস্বার্থে।
জাপার চারজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, এরশাদ জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীকে সর্বাত্মক সহযোগতিার আশ্বাস দিয়েও তুষ্ট করতে না পেরে সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকে স্বনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাতে বিএনপি-জামায়াতের প্রতিও ঢিল ছুড়েছেন।
এরশাদ এ লেখায় মূলত দুটি বিষয়ে বলতে চেয়েছেন। এক. আওয়ামী লীগের জন্য এতকিছু করার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সামরিক স্বৈরশাসক বলেন, কখনো কখনো তীর্যক টিপ্পনী কেটে কথাবার্তা বলেন। এসব তাঁর গায়ে লাগে। তাই তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর সমীপে’ লিখেছেন, ‘আমরা আপনাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছি, তা একটু স্মরণে রাখবেন। ইতিহাসের আলোকে কথা বলবেন।’
দুই. প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এরশাদের অনুরাগ বা অভিমানের প্রকাশ। তাই লেখায় হিসাব কষে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ যে তিনবার ক্ষমতায় এসেছে, তাতে জাতীয় পার্টির সহযোগিতা ছিল। অবশ্য জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ওই নিবন্ধ হচ্ছে ইতিহাসের সত্য তুলে ধরা এবং সরকারকে তা বুঝিয়ে দেওয়া।
এখন সরকারকে তুষ্ট রাখার চেষ্টার পাশাপাশি এরশাদ বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক খোঁচাখুঁচিতে জড়িয়ে আলোচনায় থাকতে চাইছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি সংসদে বাজেট বক্তৃতায় এবং সর্বশেষ তাঁর লেখায় জামায়াত-বিএনপিকে ‘বিষবৃক্ষ’ বলে অভিহিত করেন। এমনকি দল দুটির উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেন তিনি। তাই নিবন্ধে এরশাদ বিএনপিকে খোঁচাতে গিয়ে বলেন, বিএনপি জামায়াতের গহ্বরে বিলীন হতে যাচ্ছে। এখান থেকে বের হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই এরশাদেরই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের বক্তব্য ছিল সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমলোচনাপূর্ণ। অবশ্য, তখন রাজনৈতিক অঙনে এমন আলোচনাও ছিল যে এরশাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য ছিল সরকারের সঙ্গে সমঝোতা সাপেক্ষে ও লোক দেখানো। এখন তাঁর বক্তব্যে গুরুত্ব পাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের বিরোিধতা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরও এরশাদের বক্তব্য ছিল এখনকার চেয়ে ভিন্ন। নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়নি দাবি করে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন; এমনকি দলের সংরক্ষিত আসনে নারী সাংসদদের মনোনয়নের জন্য সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে এরশাদ ‘শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন হবে’ বলেও মন্তব্য করেন। সম্প্রতি বলেছেন, সরকার পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে। বিএনপি কিছুই করতে পারবে না।
সম্প্রতি আলাপকালে এই লেখকের কাছে জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুও স্বীকার করেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে জাপার চেয়ারম্যান এখন আগের মতো কথা বলছেন না।’
এরশাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা জানান, মূলত সরকারের শক্তিশালী অবস্থান দেখে এরশাদ ভোল পাল্টেছেন। এখন তিনি মনে করছেন, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বিতর্কে জড়ালেই সুবিধা। একদিকে জাপা আলোচনায় থাকবে, অপর দিকে সরকারও খুশি হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর পাল্টাপাল্টি বিবৃতিযুদ্ধ ছিল সে কৌশলেরই বর্ধিত রূপ।
জিয়াউদ্দিন বাবলু বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির জায়গায় যেতে চাই। রাজনীতিতে আলোচনায় থাকতে চাই। এটা সত্য।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দ্বিমুখী ভূমিকা রাখতে গিয়ে স্ত্রী রওশনের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েন এরশাদ। অন্যদিকে এরশাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন জেনারেল মঞ্জুর হত্যা ও রাডার ক্রয় মামলা দুটিও নতুন আঙ্গিকে সক্রিয় হয়েছে। তাই আপাতত এরশাদ চাইলেও সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে পারছেন না।
সেলিম জাহিদ: সাংবাদিক।
No comments