সম্প্রচারনীতি যেভাবে কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হয় by কামাল আহমেদ
গত বছরের জুন মাসে শিল্পোন্নত দেশগুলোর
জোট জি এইট-এর শীর্ষ সম্মেলনের আগে জুন মাসের গোড়ার দিকে ব্রিটেনের
গার্ডিয়ান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস আরও কয়েকটি প্রভাবশালী
পত্রিকার সঙ্গে একযোগে সামরিক ও বেসামরিক গুপ্তচরবৃত্তির ভুবনজোড়া
ইঙ্গ-মার্কিন কার্যক্রমের বিবরণ প্রকাশ করে দিলে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে
যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অতীব গোপনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি
এজেন্সির (এনএসএ) একজন চুক্তিভিত্তিক পরামর্শক বা ঠিকাদার এডওয়ার্ড
স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে এসব কাগজ ধারাবাহিকভাবে
বেআইনি গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করে দেয়।
জি এইট শীর্ষ বৈঠকের প্রাক্কালে যখন খবর বেরোল যে যুক্তরাষ্ট্র তার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর মিত্র নেতাদের টেলিফোন এবং কারও কারও অফিসে আড়ি পেতে নজরদারি করছিল, তখন ওবামা প্রশাসন কী ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা হয়তো তাঁর ভবিষ্যৎ আত্মজীবনীতে জানা যাবে। তবে তাঁর দপ্তর তখন জানিয়েছিল যে বিষয়টি সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁকে কিছু জানায়নি। যার মানে দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের অতি ক্ষমতাধর সামরিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় নিরাপত্তার নামে দেশ-বিদেশে নানা ধরনের বেআইনি কাজে জড়িত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের টেলিফোনে বেআইনিভাবে আড়ি পাতার অভিযোগগুলো তদন্তে তাই দেশটির সিনেট কমিটি তদন্তও শুরু করে।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে কথিত এবং স্পর্শকাতর তথ্য, যা চুরি হয়ে সংবাদমাধ্যমের হাতে গেছে, তা ছাপানোর জন্য কোথাও কোনো সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার কোনো নজির এখনো তৈরি হয়নি। বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার অজুহাতে গণমাধ্যমের ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার মতো কোনো আইন প্রয়োগের কথা কারও কল্পনাতেও আসেনি। তার কারণ, এসব তথ্য কথিত নিরাপত্তার জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হচ্ছে নাগরিকদের স্বার্থ।
২০১৩ সালের জুন থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এসব অবৈধ কার্যক্রমের খবর প্রকাশ পেয়েছে ওই সব পত্রিকায়, যেগুলোর মধ্যে আছে দুনিয়াব্যাপী টেলিফোনে আড়ি পাতা, ইন্টারনেটে নজরদারি, গুগল, ফেসবুক ও টুইটারের মতো মাধ্যমগুলোর কাছ থেকে ব্যবহারকারীদের বিষয়ে ব্যক্তিগত তথ্য বেআইনিভাবে হস্তগত করা, দেশে দেশে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠনের ওপর নানা ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের এখনো দেশে দেশে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। গত শনিবার নয়াদিল্লি সফরের সময় প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনেই জন কেরিকে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার ওপর নজরদারির বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে তাঁদের অসন্তোষের কথা খোলামেলাই জানিয়ে দেন।
বছর কয়েক আগে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা পার্লামেন্টের হিসাব বিভাগ থেকে চুরি করা তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে বহুসংখ্যক এমপির বিভিন্ন ধরনের ভাতা আদায়ে অসাধুতা ও জালিয়াতির বিবরণ প্রকাশ করে দেয়। ওই সব হিসাবের প্রকাশ বন্ধে দু-চারজন রাজনীতিকের আদালতের আশ্রয় গ্রহণের চেষ্টাও ভেস্তে যায়। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনসহ পরিচিত রাজনীতিকদের অনেকে অতিরিক্ত ভাতা গ্রহণের ভুল স্বীকার করে অর্থ ফেরত দিয়ে পার পেয়ে যান। তবে একাধিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও এমপিকে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। বেআইনি পন্থায় হাতে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা মর্যাদা রক্ষার মতো কোনো ঠুনকো অজুহাত সেখানে গণমাধ্যমকে তার ‘জনস্বার্থমূলক তথ্য’ প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি ব্যবহার করে বিবিসি সাবেক মন্ত্রী স্টিফেন বায়ার্সসহ কয়েকজন রাজনীতিকের তদবিরের জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রচার করেছিল, সেটাও ওই ‘জনস্বার্থে’। টেলিগ্রাফ-এর এ রকম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্সকে।
বাংলাদেশে কিছুদিন আগে সংঘটিত নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় সেখানকার সাংসদের সঙ্গে প্রধান আসামির টেলিসংলাপের যে রেকর্ড প্রথম আলো ও বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে, সেটির ক্ষেত্রেও ওই জনস্বার্থই হচ্ছে একমাত্র যৌক্তিকতা। ওই হত্যাকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর তিন কর্মকর্তার জড়িত থাকার যে অভিযোগ নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়রা করেছিলেন, তা যদি দেশবাসীকে জানানোর অধিকার না থাকে, তাহলে সাংবাদিকতা পেশার যে অপমৃত্যু ঘটবে, আমাদের সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাজনীতিকেরা যে সেটা বোঝেন না, তা বিশ্বাস করা কঠিন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদিত হয়েছে, তা কার্যকর হলে বনের রাজা ওসমান গণির বাসায় তোশকভর্তি টাকার চিত্র কি দেশবাসী কোনো দিন দেখতে পাবেন? বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করলে বিদেশি প্রচারমাধ্যমে তা প্রচারিত হলেও দেশি সম্প্রচারমাধ্যমে শুধু সেই মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধির কথা প্রচার করতে হবে। সাংবাদিকদের সরকারের তথ্য কর্মকর্তার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করার এই প্রকল্পে অবশ্য আমি খুব একটা বিস্মিত নই। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইনের খসড়ার মধ্যেও এই আনুগত্য ক্রয়ের উদ্যোগ সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদিত হওয়ার পর তথ্যমন্ত্রীকে সরকার–সমর্থক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে যে বিষয়টিতে সোচ্চার হতে দেখেছি, তা হলো, ‘সরকার গোপনে কোনো কিছু করছে না।’ তিনি বলেছেন যে এই নীতির খসড়া প্রায় ছয় মাস ধরে ওয়েবসাইটে ছিল, যাতে আগ্রহীরা এ বিষয়ে মতামত দিতে পারেন। মন্ত্রীর সত্য ভাষণে সবার বিমোহিত হওয়ার কথা হলেও যাঁরা এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন, তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরামর্শ বা সুপারিশগুলো সরকার উপেক্ষা করেছে। স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের এই সুযোগ মন্ত্রী কেন হাতছাড়া করলেন, তা অবশ্য বোধগম্য নয়। তিনি যদি জমা পড়া মতামতগুলোও তাঁর মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতেন, তাহলে সম্ভবত বোঝা যেত যে ওই শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কি খামোখাই রাজনীতি করছেন, নাকি সত্যিই তাঁদের পরামর্শগুলো উপেক্ষিত হয়েছে?
সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে চ্যানেল-মালিকেরা এই নীতির বিষয়ে যতটা না মাথা ঘামাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি সোচ্চার সংবাদপত্রগুলো। তাঁদের এই পর্যবেক্ষণ হয়তো কিছুটা ঠিক। তবে এই সত্যও ভোলা যায় না যে দেশে যতগুলো চ্যানেল এখন চালু আছে, তার সংখ্যাগরিষ্ঠগুলোর লাইসেন্স দিয়েছে বর্তমান সরকার এবং তা দেওয়া হয়েছে কেবল দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায়। তার পরও পুঁজি ও সাংবাদিকতার যোগ্যতার অভাব মেটাতে লাইসেন্সধারীরা অনেকেই যেসব অংশীদারদের শরণাপন্ন হয়েছেন, তাঁদের জন্য সম্পাদকীয় নীতিমালার প্রশ্নে হয়তো কিছুটা ছাড় দিতে হয়েছে। যে কারণে নানা সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হতাশার সুর শোনা গেছে যে ‘লাইসেন্স দিলাম আমরা আর আমাদের সমালোচনাই তাদের একমাত্র কাজ।’ প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাবের মধ্যেই ইঙ্গিত মেলে যে তিনি নিয়ন্ত্রণের পথটিকেই তাঁর রাজনীতির জন্য সহায়ক বিবেচনা করছেন। সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সফল হলে সংবাদপত্রগুলোই যে পরবর্তী লক্ষ্য হবে, সেই আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক আনুগত্যের দূষণে প্রশাসনিক আমলাদের (প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইন সংশোধনে জেলা প্রশাসকদের সুপারিশমালা তৈরি) উদ্যোগ যখন দৃশ্যমান।
সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবিও করা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সম্প্রচার আইন ও নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশের এই সম্প্রচারনীতি তৈরি করা হয়েছে। আবার এমন কথাও বলা হয়েছে যে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিও নাকি এতে অনুসৃত হয়েছে। বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বিবিসিকে অনুসরণের শেখ হাসিনা সরকারের ছিয়ানব্বইয়ের অঙ্গীকারের অভিজ্ঞতা আমাদের যে সুখকর নয়, সে কথা নিশ্চয়ই সবাই বিস্মৃত হননি। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরির জন্য এগুলো বেশ ভালো যুক্তি। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নীতিতে যেমন ফারাক আছে, তেমনি গণতান্ত্রিক ওই সব দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার রয়েছে বিরাট পার্থক্য। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ, তাই সে দেশে জাতীয় পতাকা পোড়ানোর দৃশ্য সম্প্রচার করা হলেও তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। আমরা যে ততটা উদার হতে প্রস্তুত নই, তা আমাদের রাজনীতিকেরা ভালোই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ব্রিটেনের সম্প্রচার কার্যক্রমের তদারকি করে যে সংস্থা, তার সঙ্গে সরকারের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। অফকম নামের ওই প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে টেলিভিশনের লাইসেন্স দেয়, তাদের বিধিমালা তৈরি করে এবং বিধি লঙ্ঘিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং শাস্তি দেয়। ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বিবিসির ওপর অফকমের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, বিবিসি পরিচালিত হতো তার পরিচালকমণ্ডলী বা গভর্নরদের তদারকিতে। কিছুদিন হলো এখন বিবিসিও অফকমের আওতাধীন। ভারতের সম্প্রচার জগৎও কিছুটা আলাদা। টেলিভিশনে বেসরকারি খাতের নাটকীয় বিকাশ হলেও সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রচারমাধ্যম রেডিওতে বেসরকারি খাতের সংবাদ প্রচারের অধিকার এখনো নেই। আর টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ারও সরকারের। যে কারণে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ায় এখন শোর উঠেছে গণমাধ্যমের গেরুয়াকরণের। তবে মালয়েশিয়াকে দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুসরণ করলে ভিন্ন কথা। কেননা, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ওই মডেল মুক্ত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয় নয়। জনশ্রুতি আছে, আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০৪১-এর অনুপ্রেরণা নাকি মালয়েশিয়া। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খল আরোপের চেষ্টা কি তারই আলামত?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক৷
No comments