ঘরের কথা অপরের মুখে by আলী ইমাম মজুমদার
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গত ৫ জানুয়ারি
হয়ে গেছে। গঠিত হয়েছে সরকার। বসেছে সংসদের একাধিক অধিবেশন। তবু এ সংসদের
রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। মাঝেমধ্যেই তা জোরালো হয়ে
ওঠে। দেশে তো আছেই, এ বিষয়ে হামেশাই কথাবার্তা বলেন বিদেশি দূত, এমনকি
সময়ে সময়ে রাষ্ট্রনায়কেরাও। স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
নিয়ে অন্য কোনো দেশের নাক গলানোর কথা নয়। তা সত্ত্বেও বরাবরই হয়। বরং
বলা চলে, আমরাই ডেকে আনি। আর তা করে সব পক্ষই। যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন,
তাঁরা কোনো একটি বিষয়ে সরকারের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারলে বিদেশিদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন। তাঁরা আন্তরিকভাবে চান বিদেশি রাষ্ট্র এ বিষয়ে
তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো সমর্থন দিক। অন্যদিকে সরকারে যাঁরা
থাকেন, তাঁরাও তাঁদের কার্যক্রমের বৈধতার জন্য সেসব দেশের সমর্থনপ্রত্যাশী
থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর বক্তব্য অনুকূলে রাখতে উভয়
পক্ষের ব্যাপক প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে দীর্ঘকাল। শুধু বক্তব্যটি নিজদের
বিপক্ষে গেলেই নাখোশ হন। তাও বলেন না আমাদের ঘরের বিষয়, আমরাই মেটাব। আর
সে সদিচ্ছা কোনো পক্ষের রয়েছে, এমনটাও বলা যাবে না।
বিগত নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর একটি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। সে মনোভাব অনেকটা প্রকাশ্যেই তারা ব্যক্ত করেছে। উল্লেখ্য, ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আর এরশাদের নেতৃত্ব থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ছিটকে বেরিয়ে আসা জাতীয় পার্টিই (জেপি) সেই নির্বাচনী মাঠে ছিল। নির্বাচনে জনগণের উৎসাহ ও অংশগ্রহণের মাত্রা ছিল খুবই কম। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে একজন করে প্রার্থী থাকায় ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ যেগুলোতে হয়েছে, সেগুলোও অনেকটা লোক দেখানো। ভোটারের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। কেউ বিষয়টিকে অস্বীকার করলেও এটাই বাস্তব। সংবিধান ও আইনে কত ভোটারের অংশগ্রহণ নির্বাচনকে সিদ্ধ করবে, এমন বিধান নেই। তাই এটা আইনত অসিদ্ধ বলা যাবে না। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেছে। যেমনটা ছিল ১৯৮৬, ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচিত সংসদ। তাই আলোচিত নির্বাচনটি ঘিরে সময়ে সময়ে পুরোনো কথাই নতুনভাবে বলা হয় বিভিন্ন পক্ষ থেকে।
অতি সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন ব্রিটেনে। মূলত গার্ল সামিট নামের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়াই ছিল এ সফরের লক্ষ্য। পাশাপাশি সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ নেতার সঙ্গে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি হতাশা ব্যক্ত করেছেন আলোচ্য নির্বাচন নিয়ে। এগুলো ব্রিটিশ সরকারি সূত্র থেকেই জানা গেছে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ব্রিটেন বিষয়টি নিয়ে পেছনে তাকাতে চায় না। এর সহজ অর্থ, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সবাই মিলেমিশে নতুন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে ব্রিটেন বর্তমান সরকারকে মেনে নিয়েছে।ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্যদৃষ্টে এর ভিন্নতা লক্ষণীয় হয় না। তবে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে চায় দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, এমনটা মনে করলে ভুল করা হবে না। তাদের মতামত নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ চলছে। কিন্তু কেউ বলছে না এসব বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের কথা বলার আবশ্যকতা থাকবে কেন? বরং নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে সরকার স্পষ্ট অনীহা ব্যক্ত করছে। তাদের বক্তব্য, গত নির্বাচনের আগে ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ করেও বিএনপিকে সংলাপ বা নির্বাচনে আনা যায়নি। বক্তব্যটি অংশত সত্য। সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন বিএনপির প্রধানকে। সে ফোনালাপ নিষ্ফল হয়েছে। এর জন্য অনেকটাই দায়ী বিএনপি। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তেও তারা অবিচল থেকেছে। এর দায় তাদেরই নিতে হবে। তবে এটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে সংলাপ বা নির্বাচনে বিএনপিকে আনার জন্য আওয়ামী লীগের কথিত ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ ছিল না। বরং তাদের বাদ রেখেই যেনতেন একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি ছিল সে দলটির। অবস্থাদৃষ্টে এমনটাই মনে হয়েছে। পাশাপাশি সেই ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি নিজেরা পর্যুদস্ত হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থানকে করেছে দুর্বল।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের আগেও পাশ্চাত্যের বেশ কিছু দেশের অনুরূপ প্রতিক্রিয়া আমরা প্রকাশ্যেই জানতে পেরেছি। আর এ ধরনের প্রতিক্রিয়া তারা সুযোগ পেলেই ব্যক্ত করছে। এমনটাই অতি সম্প্রতি করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্তির চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় থাকা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট। নিয়োগ অনুমোদন-সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গত নির্বাচন ছিল ‘অনস্বীকার্যভাবে ত্রুটিপূর্ণ’। এ দেশে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ শুরুর বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন। এ বক্তব্যের ওপরও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, এটা মার্কিন সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়। বক্তব্যটি নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রাষ্ট্রদূতের নিজের। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা কিছুটা বিস্মিত। গত নির্বাচন সম্পর্কে বিভিন্ন মার্কিন মুখপাত্রের বক্তব্যের সঙ্গে বার্নিকাটের বক্তব্যের কোনো বড় ফারাক লক্ষণীয় হয় না। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য দেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কোনো পক্ষ। বরং একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী তাঁকে এ ধরনের বক্তব্য না দিয়ে খালেদা জিয়াকে জামায়াত-শিবিরের সংস্রব ত্যাগ করার পরামর্শ দিতে অনুরোধ করেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন অনেকটাই অন্য সবার বিষয় হয়ে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয়, আমরা নিজেরাই এখানে গৌণ।
নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক হানাহানি আর তা সালিস করতে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ আমাদের দেশে কোনো নতুন বিষয় নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালেও তা ঘটতে দেখেছি আমরা। এক-এগারোর আগে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে বেশ কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত উভয় পক্ষের কাছে ক্রমাগত ছোটাছুটি করেছেন। তাঁদের একই বক্তব্য, একটি অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি। দুই পক্ষই তাদের যুক্তিতে রয়ে গেছে অনড়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
আলোচিত নির্বাচনের আগেও পাশ্চাত্য বিশ্ব প্রায় এক সুরে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কংগ্রেস সরকার এখানে আওয়ামী লীগের সরকারের নির্বাচনসংক্রান্ত অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছে অনেকটা স্পষ্টতই। এ সমর্থনের বিষয়ে কতিপয় ভারতীয় গণমাধ্যমের বেশ কিছু বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। হিন্দুস্তান টাইমস এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে তির্যক সমালোচনা করেছে সরকারের। দ্য হিন্দু বলেছে, একটি অনিশ্চিত পথে দেশটির যাত্রায় সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিকার হিসেবে অতি দ্রুত অংশগ্রহণমূলক একটি নতুন নির্বাচন এ অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে পারে বলে পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। পতিত শাসক এরশাদ দাবি করেছেন, ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা স্মরণে থাকার কথা যে এরশাদ শেষ পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নিতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছিলেন। পরিণতিতে দলটিই তাঁর হাতছাড়া হয়।
ডেভিড ক্যামেরন আর মার্শিয়া বার্নিকাট যে কথাগুলো বলেছেন, তা বলার সুযোগ আমরাই করে দিয়েছি। এ সমস্যাগুলো আমরা নিজেরা সমাধান করে ফেললে তাঁরা তা বলতেন না। আর কথাগুলো অপ্রিয় হতে পারে। তবে সত্য। স্বাধীনতা আমরা ভালোবাসি। অনেক রক্তের বিনিময়ে তা অর্জনও করেছি। কিন্তু একটি স্বাধীন জাতির মর্যাদা ধরে রাখার জন্য আমরা সচেষ্ট এমন দাবি করার কোনো সুযোগ নেই।এ বিষয়ে প্রয়াত খ্যাতনামা লেখক নীরদ চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বাঙ্গালী বলিয়া গর্ব অনুভব করিলেও রবীন্দ্রনাথ কেন বঙ্গজননীকে দোষী করিয়াছেন, তাহা বুঝিতে আমাদের কোনো কষ্ট হইত না, কেননা বঙ্কিমচন্দ্র অল্প বয়সেই বাঙ্গালীর “মানুষ” না হইবার একটি লক্ষণের কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন। তিনি কপালকুণ্ডলাতে লিখিয়াছেন, “বাঙ্গালী অবস্থার বশীভূত, অবস্থা বাঙ্গালীর বশীভূত হয় না”।’ হয়তো বা এ জন্যই আমাদের ঘরের কথা অপরের মুখেই বেশি শোনা যায়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments