গাজার সত্য খুব কঠিন by রবার্ট ফিস্ক
একসময় মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদ পরিবেশন ও
মন্তব্য করতে সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের একধরনের ভীতি ছিল, পাছে লোকে
তাঁদের সেমিটীয় বিরোধী বলে না বসে।
ইসরায়েলের একজন সৎ সমালোচকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বিদ্বেষপ্রসূত। ব্যাপারটা এমন যে ইসরায়েল-আরব যুদ্ধে উভয় শিবিরের হতাহতের সংখ্যা যে অসম, এ কথা উচ্চারণ করামাত্র আপনাকে নাৎসি অভিধা দেওয়া হবে অথবা ‘ফিলিস্তিনপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ হিসেবে আপনার উপনামকরণ হয়ে যাবে।
গাজার সাম্প্রতিক এই রক্তস্নানের আগ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমনই ছিল। এবারের পর্বের এত প্রচার হয়েছে যে আমাদের কর্তা ও সংবাদমাধ্যম এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে—না, এবার আর সেমিটীয় বিরোধী হিসেবে আখ্যা পাওয়ার ভয় নয়, এবার দর্শক ও পাঠকেরই ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গাজার নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা দেখে তারা এতটাই ক্ষুব্ধ যে তারা জানতে চায়, টেলিভিশন মোগল ও রাজনীতিবিদেরা কেন জনগণের নৈতিকতা, ভদ্রতা ও বুদ্ধি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন।
তারপরও টিভির পর্দায় রক্তস্নাত একেকটি শিশুর ছবি ভেসে উঠছে আর উপস্থাপক ইসরায়েল ও হামাসের পারস্পরিক দোষারোপের খবর পরিবেশন করছেন। এখনো সেটা চলছে। তাঁরা কী মনে করেন, এটা কি কোনো ফুটবল খেলা? অথবা রক্তস্নাত বিয়োগান্ত নাটক? ব্যাপারটা এভাবেই চলছে। বেসামরিক লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। প্রতিবেদকেরা বলছেন, ‘ট্যাংকের গোলাগুলি’ (হামাসের কোনো ট্যাংক নেই)। ইসরায়েল বলছে, এটা হামাসের লক্ষ্যভ্রষ্ট গোলা। হামাস বলছে, এটা ইসরায়েলের কাজ। মানে পুরো ব্যাপারটাই একটা দোষারোপের খেলা। আসলে কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না, এ কথা বলে আমরা আমাদের দায় সারতে পারি।
আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে ত্রিপোলিতে ১৯৮৬ সালে মার্কিন বোমার আঘাতে বেসামরিক মানুষ নিহত হলে আমরা একই কথা বলেছিলাম (আমার মনে আছে, একটি ‘লিবীয় লক্ষ্যভ্রষ্ট বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের’ ওপর দোষ চাপানো হয়েছিল)। বাগদাদের শুয়ালায় ন্যাটোর আক্রমণে বেসামরিক মানুষ নিহত হলেও একই কাজ করা হয়েছিল (অবশ্যই ‘ইরাকি লক্ষ্যভ্রষ্ট বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের’ ওপর দোষ চাপানো হয়েছিল)। অনেক মার্কিনই আমাকে এ বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য বলে মন্তব্য করেন, মার্কিন সিনেটে ইসরায়েলের পক্ষে শতভাগ ভোট পড়া আর আরব স্বৈরশাসকদের ৯৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তবে আরবদের পরিসংখ্যানটা সত্য, মার্কিনরা জানে না তারা কাকে নির্বাচিত করে।
হ্যাঁ, সন্দেহ নেই যে হামাস একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, নৈরাশ্যবাদী ও নির্দয় সংগঠন। সংগঠনটির অধিকাংশ মুখপাত্র নির্বোধ, তাদের কথার মধ্যেও কোনো মিল থাকে না। তারা উঁচু গলায় এমনভাবে চেঁচায় যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলে দুনিয়ায় সংগঠনটিকে যতটুকু অজনপ্রিয় করে তুলেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি এরা নিজেরাই নিজেদের করেছে। কিন্তু দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রীরা যেমনটা বলছেন (যদিও খুব মৃদুস্বরে)। দুনিয়া রাজনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যমের কর্তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, জনগণের সঙ্গে এদের আচরণ অবজ্ঞাপূর্ণ।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস একটি দুর্বল সম্পাদকীয় ছেপেছে। পত্রিকাটি আর কত দিন প্রত্যাশা করে তার পাঠকেরা এসব সহ্য করবে? পাঠকদের বলা হচ্ছে, গাজায় ‘মারাত্মক আক্রমণ’ হচ্ছে। তার পরই লেখা হচ্ছে, ইসরায়েল ও হামাস পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করছে, এখন ‘এমন একটা উপায় বের করতে হবে, যাতে এই ধ্বংসলীলা বন্ধ হয়– বা বেশ বেশ, প্রথমে দোষারোপের বহর, তারপর কারও কোনো দোষই নেই।
ফরাসি সরকার গাজায় ইসরায়েলের স্থল সেনা অভিযানের ব্যাপারে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তার প্রতি জনগণ বিদ্রূপ করেছে। ফ্রাঙ্কইস হল্যান্ড চান, ইসরায়েল তার লক্ষ্যে ‘সামান্য’ কিছু ‘সংশোধন’ আনুক। তিনি হামাসের আগ্রাসন ও ইসরায়েলের প্রতিশোধের বিরোধিতা করেছেন। তার পরই ক্রোধান্বিত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আগমন ঘটে আর সবার সুরও পাল্টে যায়। হল্যান্ড তার চিরাচরিত মন্ত্র পাঠ করে, ‘ইসরায়েল তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য সব রকম পদক্ষেপই নিতে পারে।’ অতঃপর ফ্রান্সের এমপিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপানো ইসরায়েলের ‘সামষ্টিক শাস্তি’র বিষয়ে এতটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন যে হল্যান্ড তখন দোয়া করার ঢঙে বলে, এ ‘সহিংসতা’ যেন আর না বাড়ে। লক্ষণীয়, তিনি এ সহিংসতা বন্ধের দোয়া করেননি।
আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস প্রথাগতভাবে ফিলিস্তিনপন্থী হলেও তারা নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। ইসরায়েল যেদিন জাতিসংঘের বিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ১৯ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করল, তার পরের দিন পত্রিকাটি প্রথম পাতায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এটা শুরু হয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে, এরপর এ-সংক্রান্ত কিছু বিবরণ দেওয়া হয় এবং হামাস এতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, সেটাও বলা হয়। আর শেষ হয় ১৯ জনের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে। একজন পাঠক এই ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়াসের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, প্রতিবেদকেরা ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের একই কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। ‘এ রকম নৈর্ব্যক্তিকতা একপ্রকার নৈতিক অনীহা’—কথাটা তিনি ভালোই বলেছেন। গাজায় অবস্থানরত সাংবাদিকদের দুনিয়াবাসী ধন্যবাদ দিতেই পারেন, যদিও তাঁদের কর্তারা দৌড়ের ওপর আছেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক
No comments