দ্বিতীয় তিস্তা সেতুতে রেলপথ by নাহিদ হাসান
আসাম ও পূর্ববঙ্গের, কখনো কামরূপ ও বরেন্দ্র অঞ্চলের গেট হিসেবে যে জেলাটি হাজার হাজার বছর ধরে ভূমিকা পালন করছে, সেই জেলাটি কীভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হলো, তার দায় ইতিহাসের। যে অঞ্চলে চিলমারী নদীবন্দর, ভূরুঙ্গামারী হয়ে লালমনিরহাট-ধুবড়ী রেলপথ থাকে, তা প্রমাণ করে অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত বিমানবন্দর, চিলমারীর যুদ্ধ, মুক্তাঞ্চল রৌমারী সাক্ষ্য দেয় সামরিক গুরুত্বের আর ভারতের নৌবন্দরসমূহের ইতিহাস গ্রন্থ হাজির করে চিলমারীতে জাহাজ কারখানার ইতিহাস। যে ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ বলা হচ্ছে, যে অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবরা পণ্য নিয়ে যেত; তখন তো বিস্মিত হতে হয় কী করে এই অঞ্চলটি মঙ্গা আক্রান্ত এলাকায় পরিণত হলো! সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতিটি সমাজের বিকাশের বীজ তার গর্ভেই থাকে। তাহলে কুড়িগ্রাম তথা উত্তরের মঙ্গাপ্রবণ এই অঞ্চলের বিকাশের চিহ্নগুলো কোথায় বর্তমান? কোন সেই গিঁট, যা না খুললে উন্নয়নের সম্ভাবনার আসুরিক শক্তি দৃশ্যমান হবে না?
এই অঞ্চল এখন একদিকে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর নানা নদ-নদীর ভাঙনকবলিত কৃষিনির্ভর এলাকা। কৃষিক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও শ্রম বেচার সুযোগ না থাকায় জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে এই জেলা থেকেই সর্বাধিকসংখ্যক শ্রমিক দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। ফলে আগুনে পুড়ে, ভবনধসে ও সড়ক দুর্ঘটনায় এরাই বেশি নিহত হয়। শত শত ধরনের বেসরকারি-সরকারি কার্যক্রম ও গবেষণায় সয়লাব, তবু জনগণের দারিদ্র্য কমল না! তার মানে কি এই অঞ্চলের দারিদ্র্যসচেতনতার ফল? তার মানে এই পথে এই অঞ্চলের ক্রমমুক্তি যেমন হবে না, তেমনি অপেক্ষমাণ বধূর ঘাড়ের গামছা আঁকড়ে ধরেও কান্না থামবে না!
বিপ্লবী মার্ক্স রেলপথকে ভারতে আধুনিকতার যাত্রাবিন্দু বলে মনে করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় পৃথিবীতে এক স্বতন্ত্র স্লোগান হাজির করা হয়—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। অর্থাৎ রেলপথ যেখানে ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের নির্ধারক আর নদী যে দেশের লড়াইয়ের ঠিকানা, সেই দেশের নীতিনির্ধারকেরা যেন এই চিহ্নসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মুনাফা থাকলে যেন বাপকেও বেচে দিতে রাজি। এসকাপ ও ইউএনডিপির যৌথ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, টন-কিলোমিটারে তেল খরচের ক্ষেত্রে সড়কপথে যেখানে লাগে ২১৭ টাকা, রেলপথে সেখানে মাত্র ৮৫ টাকা, নৌপথে ২৫ টাকা। সে জন্য সারা পৃথিবীতে রেল যোগাযোগ দিনের পর দিন উন্নত হচ্ছে। চীন রেলযাত্রায় আমাদের চেয়ে এক শ বছরের বেশি সময় পরে যোগ দিয়ে বিমানগতির ট্রেন আবিষ্কার করেছে। আমরা সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ দুটিকে ফেলে রেখে সহযাত্রী ভারত থেকে ট্রেন আমদানি করি। জাহাজশিল্পের দেশ হয়েও দ্রুত জাহাজ আমদানি করি। সড়কপথের মোহে নদ-নদীর ওপর এমনভাবে সেতু নির্মাণ করেছি, যেখানে জলযান চলতে পারে না। আর অন্যদিকে নদ-নদীকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছি সেতু দিয়েই। বাংলাদেশের নৌপথে কেউ যদি দেশ ভ্রমণে বের হন, তিনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশ যেন সেই প্রাচীন যুগেই রয়ে গেছে। আর যিনি রেলপথে বের হন তিনি টাইম মেশিনে ব্রিটিশ আমলে চলে যাবেন। এবং সড়কপথে বের হলে বুঝবেন নরকযাত্রী বাংলাদেশকে। অথচ প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়, নদ-নদী এখানকার রাজপথ।
সম্প্রতি সরকার কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর বাজেট একনেকে পাস করেছে, যা গাইবান্ধা অংশে পলাশবাড়ীতে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে যুক্ত হবে। এতে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার ও সময় এক ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। অর্থাৎ এটিও সেই পুরোনো চিন্তাকাঠামোরই বহিঃপ্রকাশ। অথচ সরকার ইতিমধ্যে গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা সেতুর তলদেশ দিয়ে বহুমুখী টানেলের ঘোষণা দিয়েছে। যা নদী, প্রকৃতি ও ভূ-সামরিক কৌশলবান্ধব, দ্বিতীয় তিস্তা সেতুতে রেলপথ যুক্ত করে যদি ফুলছড়ি-দেওয়ানগঞ্জ টানেলের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে ঢাকা থেকে চিলমারীর দূরত্ব ৪২৮ কিলোমিটার থেকে ২৩০ কিলোমিটারে ও রেলপথের দূরত্ব ৩৭৭ থেকে ২২৫ কিলোমিটারে নেমে আসবে এবং চিলমারী অংশে সংযোগ সড়কটি চিলমারীর মাটিকাটার উত্তর অংশের বদলে রমনা স্টেশনসংলগ্ন কেসি রোড থেকে শুরু হওয়ায় সংযোগ সড়কের দূরত্ব কমে আসবে তিন কিলোমিটার। সর্বোপরি লালমনিরহাট/পার্বতীপুর-কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা-জামালপুর-ঢাকা নামে একটি নতুন রুট তৈরি হবে। ফলে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে চাপ অর্ধেকে নেমে আসবে। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু সেতু সংস্কার বা অন্য কোনো কারণে বন্ধ থাকলে এই নতুন রুটটি ব্যবহার করা যাবে। আর এটি হলে কুড়িগ্রাম জেলায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিলমারী নদীবন্দর আন্তমহাদেশীয় বন্দরে উন্নীত হবে। সোনাহাট স্থলবন্দর সাবালকত্ব অর্জন করবে। আর কুড়িগ্রাম জেলা হয়ে উঠবে নতুন শিল্পাঞ্চল। কর্মসংস্থানের ফলে কেটে যাবে মঙ্গার পৌনে শতবর্ষ। ইতিহাস ও বিজ্ঞানমনস্কতাই আমাদের মুক্তি দেবে।
প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
nahiduttar@yahoo.com
এই অঞ্চল এখন একদিকে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর নানা নদ-নদীর ভাঙনকবলিত কৃষিনির্ভর এলাকা। কৃষিক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও শ্রম বেচার সুযোগ না থাকায় জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে এই জেলা থেকেই সর্বাধিকসংখ্যক শ্রমিক দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। ফলে আগুনে পুড়ে, ভবনধসে ও সড়ক দুর্ঘটনায় এরাই বেশি নিহত হয়। শত শত ধরনের বেসরকারি-সরকারি কার্যক্রম ও গবেষণায় সয়লাব, তবু জনগণের দারিদ্র্য কমল না! তার মানে কি এই অঞ্চলের দারিদ্র্যসচেতনতার ফল? তার মানে এই পথে এই অঞ্চলের ক্রমমুক্তি যেমন হবে না, তেমনি অপেক্ষমাণ বধূর ঘাড়ের গামছা আঁকড়ে ধরেও কান্না থামবে না!
বিপ্লবী মার্ক্স রেলপথকে ভারতে আধুনিকতার যাত্রাবিন্দু বলে মনে করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় পৃথিবীতে এক স্বতন্ত্র স্লোগান হাজির করা হয়—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। অর্থাৎ রেলপথ যেখানে ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের নির্ধারক আর নদী যে দেশের লড়াইয়ের ঠিকানা, সেই দেশের নীতিনির্ধারকেরা যেন এই চিহ্নসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মুনাফা থাকলে যেন বাপকেও বেচে দিতে রাজি। এসকাপ ও ইউএনডিপির যৌথ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, টন-কিলোমিটারে তেল খরচের ক্ষেত্রে সড়কপথে যেখানে লাগে ২১৭ টাকা, রেলপথে সেখানে মাত্র ৮৫ টাকা, নৌপথে ২৫ টাকা। সে জন্য সারা পৃথিবীতে রেল যোগাযোগ দিনের পর দিন উন্নত হচ্ছে। চীন রেলযাত্রায় আমাদের চেয়ে এক শ বছরের বেশি সময় পরে যোগ দিয়ে বিমানগতির ট্রেন আবিষ্কার করেছে। আমরা সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ দুটিকে ফেলে রেখে সহযাত্রী ভারত থেকে ট্রেন আমদানি করি। জাহাজশিল্পের দেশ হয়েও দ্রুত জাহাজ আমদানি করি। সড়কপথের মোহে নদ-নদীর ওপর এমনভাবে সেতু নির্মাণ করেছি, যেখানে জলযান চলতে পারে না। আর অন্যদিকে নদ-নদীকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছি সেতু দিয়েই। বাংলাদেশের নৌপথে কেউ যদি দেশ ভ্রমণে বের হন, তিনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশ যেন সেই প্রাচীন যুগেই রয়ে গেছে। আর যিনি রেলপথে বের হন তিনি টাইম মেশিনে ব্রিটিশ আমলে চলে যাবেন। এবং সড়কপথে বের হলে বুঝবেন নরকযাত্রী বাংলাদেশকে। অথচ প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়, নদ-নদী এখানকার রাজপথ।
সম্প্রতি সরকার কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর বাজেট একনেকে পাস করেছে, যা গাইবান্ধা অংশে পলাশবাড়ীতে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে যুক্ত হবে। এতে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার ও সময় এক ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। অর্থাৎ এটিও সেই পুরোনো চিন্তাকাঠামোরই বহিঃপ্রকাশ। অথচ সরকার ইতিমধ্যে গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা সেতুর তলদেশ দিয়ে বহুমুখী টানেলের ঘোষণা দিয়েছে। যা নদী, প্রকৃতি ও ভূ-সামরিক কৌশলবান্ধব, দ্বিতীয় তিস্তা সেতুতে রেলপথ যুক্ত করে যদি ফুলছড়ি-দেওয়ানগঞ্জ টানেলের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে ঢাকা থেকে চিলমারীর দূরত্ব ৪২৮ কিলোমিটার থেকে ২৩০ কিলোমিটারে ও রেলপথের দূরত্ব ৩৭৭ থেকে ২২৫ কিলোমিটারে নেমে আসবে এবং চিলমারী অংশে সংযোগ সড়কটি চিলমারীর মাটিকাটার উত্তর অংশের বদলে রমনা স্টেশনসংলগ্ন কেসি রোড থেকে শুরু হওয়ায় সংযোগ সড়কের দূরত্ব কমে আসবে তিন কিলোমিটার। সর্বোপরি লালমনিরহাট/পার্বতীপুর-কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা-জামালপুর-ঢাকা নামে একটি নতুন রুট তৈরি হবে। ফলে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে চাপ অর্ধেকে নেমে আসবে। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু সেতু সংস্কার বা অন্য কোনো কারণে বন্ধ থাকলে এই নতুন রুটটি ব্যবহার করা যাবে। আর এটি হলে কুড়িগ্রাম জেলায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিলমারী নদীবন্দর আন্তমহাদেশীয় বন্দরে উন্নীত হবে। সোনাহাট স্থলবন্দর সাবালকত্ব অর্জন করবে। আর কুড়িগ্রাম জেলা হয়ে উঠবে নতুন শিল্পাঞ্চল। কর্মসংস্থানের ফলে কেটে যাবে মঙ্গার পৌনে শতবর্ষ। ইতিহাস ও বিজ্ঞানমনস্কতাই আমাদের মুক্তি দেবে।
প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
nahiduttar@yahoo.com
No comments