লেজ এখন কুকুরকে নাড়াচ্ছে by মশিউল আলম
বিশ্বমোড়লেরা এটাকে যুদ্ধবিরতি বলছে কেন?
৭ জুলাই থেকে গাজায় যা চলছে, তা কি যুদ্ধ? যুদ্ধে তো মানুষ হতাহত হয় দুই
পক্ষেই। উভয় পক্ষেই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। গাজায় গত শনিবার পর্যন্ত নিহত হয়েছে এক
হাজার ৬৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি, এর বিপরীতে কজন ইসরায়েলি মারা গেছে?
ইসরায়েলের নিজের দাবি অনুযায়ী মাত্র তিনজন বেসামরিক নাগরিক আর ৬৩ জন সৈন্য।
ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস
হয়েছে শত শত; ইসরায়েলিদের একটি ঘরও কি ভেঙেছে? তাহলে এটাকে যুদ্ধ বলা হচ্ছে
কেন? কেন ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’র জন্য ইসরায়েলের হাতে-পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি
করছে তথাকথিত আন্তর্জাতিক মহল?
গাজায় যা চলছে, তা যুদ্ধ নয়। এটা একতরফা গণহত্যা। শুধু গণহত্যাই নয়, কেবল মানুষ মারতে এমন শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপের দরকার হয় না, যেসব বোমায় কংক্রিটের তৈরি শত শত ভবন ভেঙে চুরমার হয়ে মাটিতে বিশাল বিশাল গর্ত তৈরি হয়। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমি দখল করার উদ্দেশ্যে। ইসরায়েলিরা গাজার ভূমি পুরোটা চায়; শুধু গাজার নয়, ফিলিস্তিনের সমস্ত ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নেওয়াই ইসরায়েলিদের চূড়ান্ত মতলব। কারণ, তারা দাবি করে, এই ভূমি তাদেরকে দান করেছে তাদের ঈশ্বর!
ইসরায়েল এবার নেমেছে সর্বোচ্চসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার মতলব নিয়ে, পারলে তারা গাজার ১৭ লাখ ফিলিস্তিনির সবাইকেই হত্যা করে। ফিলিস্তিনিদের ঝাড়েবংশে নিশ্চিহ্ন করার ‘ম্যাক্সিমাম টার্গেট’ নিয়ে তারা এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। কিন্তু পশ্চিমা মোড়লেরা এটাকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলছে না। বস্তুত, ইসরায়েলকে থামাতে তারা কার্যকর কিছুই করছে না।
অথচ আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে অজস্রবার সামরিক হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটোর যৌথ বাহিনী ১৯৯০–এর দশকে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় হাজার হাজার টন বোমা ফেলেছে, প্রায় আড়াই হাজার মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। কসোভো থেকে তারা দুই লাখ সার্বকে বিতাড়িত করেছে ক্লাস্টার বোমা আর ইউরেনিয়াম ডিপ্লিটেড বোমা মেরে। ১৯৯৯ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত কসভোতে তারা দুই হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৮৮ জন ছিল শিশু। ন্যাটোর বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে তিন শতাধিক বিদ্যালয় ও পাঠাগার, ২০টি হাসপাতাল। ৪০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস বা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে ৯০টি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সে সময় এসব করেছিল মানবতার দোহাই দিয়ে। মিলেসোভিচ সরকার ও উগ্র জাত্যাভিমানী সার্বীয় বাহিনীর বর্বরতা থেকে বসনীয় ও কসোভোর মুসলমানদের রক্ষা করার নামে তারা এসব বর্বরতা চালিয়েছিল।
এখন তারা লেগেছে রাশিয়ার পেছনে। ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মদদ দিয়ে তারা দেশটিতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে ইউক্রেনের রুশভাষী নাগরিকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদ আর রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদের মধ্যকার বিরোধে ইন্ধন জুগিয়ে আমেরিকার ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের যে দুরভিসন্ধি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে, তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে। কারণ, ওই অঞ্চলে রাশিয়া তার আধিপত্য অটুট রাখতে সামরিক শক্তি প্রয়োগে মোটেও দ্বিধান্বিত নয়। এসব তৎপরতার মধ্যে ইউক্রেনের আকাশসীমায় মালয়েশীয় এয়ারলাইনসের যাত্রীবাহী বিমান মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যে বিরাট ট্র্যাজেডি ঘটে, সেটার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নানা ধরনের অবরোধ আরোপ করে চলেছে। এখন বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মালয়েশীয় বিমানটিতে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মিসাইল নিক্ষেপ করেনি; এটা করেছে ইউক্রেনেরই সামরিক বাহিনী। কেউ কেউ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নৃশংসতা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার মতলবে এবং এই সুযোগে রাশিয়াকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ ও কোণঠাসা করতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে দিয়ে এই ট্র্যাজেডি ঘটিয়েছে।
অথচ ইসরায়েলের সীমাহীন বর্বরতার বিরুদ্ধে তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। প্রায় এক মাস ধরে ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তার ভগ্নাংশও যদি অন্য কোনো দেশ করত, তাহলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে বসত। অথচ ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ তারা চেয়ে চেয়ে দেখছে আর শুধু মুখে মুখে মাঝেমধ্যে উহু-আহা করছে।
ইসরায়েল নামের আগ্রাসী রাষ্ট্রটির পয়দাকারী হলো ব্রিটেন। আর আমেরিকা সেই রাষ্ট্রটিকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা-সমর্থন দিয়ে পরিণত করেছে এক দানবে। এই দানব যেন নেমে এসেছে সোজাসুজি নরক থেকে। পৃথিবীর সব শয়তান রাষ্ট্র এই নারকীয় দানবকে পূজা করে, তাকে অর্ঘ্য দেয়।
পৃথিবীর আত্মস্বীকৃত পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো আর কাউকেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হতে দিতে চায় না। তারা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) করেছে।যেসব দেশের পারমাণবিক অস্ত্র নেই, কিন্তু যাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অন্যান্য বেসামরিক প্রয়োজনে পারমাণিক প্রকল্প আছে, তাদের এনপিটিতে স্বাক্ষর করার জন্য পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো চাপ দেয়। সেসব রাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রকল্পের ওপর তারা প্রকাশ্যে নিয়মিত নজরদারি করে, আর গোপনে গোয়েন্দাগিরি করে। তাদের পরমাণু বিজ্ঞানীদের তারা ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে হত্যাও করে।
একটা উদাহরণ ইরান। আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সন্দেহ যে দেশটি গোপনে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। কিন্তু ইরান ক্রমাগত বলে আসছে তারা তা করছে না, তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের জন্য তাদের পরমাণু প্রকল্পগুলো চালাচ্ছে। কিন্তু আমেরিকা ও তার মিত্ররা তা বিশ্বাস করে না। এ জন্য তারা তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের বিরুদ্ধে প্রায়-সর্বাত্মক অবরোধ চালিয়ে এসেছে। দেশটিকে বলতে গেলে একঘরে করে রেখেছে। এমনকি তাদের তেল রপ্তানিতে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে ওষুধপত্র এমনকি শিশুখাদ্য আমদানি করার ক্ষেত্রেও বাধা দিয়ে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, অবরোধ আরোপের আগে ইরান যেসব দেশের কাছে তেল বিক্রি করেছে, তাদের কাছ থেকে পাওনা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও তারা পরিশোধ করতে দেয়নি।
অথচ ইসরায়েল জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ভূমি জবরদখল চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে। তারা সেই পঞ্চাশের দশক থেকে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির তৎপরতা শুরু করে। আমেরিকা ও ব্রিটেন তখন থেকেই তা জানে। তারা ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার বদলে সহযোগিতা করেছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমেরিকান গোয়েন্দারা জেনে ফেলে যে ইসরায়েল গোপনে গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরির সামর্থ্য অর্জন করেছে। তারা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সেটা জানায়। তখন নিক্সন তাদের বলেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। ‘পারমাণবিক বোমার অধিকারী ইসরায়েলের সঙ্গে বাস করতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।’
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের দুই বিশেষজ্ঞ হ্যান্স ক্রিস্টেনসেন ও রবার্ট নরিসের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েল ২০০৪ সালের মধ্যেই ৮০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরি করে ফেলেছে। তারা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের মালিক। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল ভারত ও পাকিস্তানের প্রায়-সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারা এটা গোপন রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র রাষ্ট্র, যেটি অঘোষিতভাবে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের মালিক। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে, এটা তারা স্বীকারও করে না আবার অস্বীকারও করে না। কিন্তু এটা একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ যে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আছে।
আমেরিকা ও ব্রিটেনের কোনো সরকারও এ ব্যাপারে কিছু বলে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এক আমেরিকান সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল কি না। ওবামা জবাবে বলেছিলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছু ‘স্পেকুলেট’ করতে চান না, অর্থাৎ কোনো জল্পনা-কল্পনা করতে চান না। ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সরকারগুলোও ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে একই ধরনের ‘অনচ্ছতা’র নীতি অনুসরণ করে আসছে।
আমেরিকাসহ তথাকথিত বিশ্বমোড়লদের নৈতিকতার স্তর বিবেচনা করে যদি তাদের কুকুর বলে অভিহিত করি, তাহলে ইসরায়েলকে বলতে হয় সেই কুকুরের লেজ। কুকুরই সাধারণত লেজ নাড়ায়। কিন্তু এখন এই লেজই কুকুরকে নাড়াচ্ছে। এই লেজ ছেঁটে ফেলার জন্য একটা ক্ষুরধার অস্ত্র দরকার। কুকুরটি নিজে তা করবে না। পৃথিবীতে আরও কোনো শক্তি কি আছে?
এখন কি ইরানের অ্যাটম বোমা বানানো জায়েজ হয়নি?
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@prothom-alo.info
No comments