স্বাগত সুষমা স্বরাজ by সাযযাদ কাদির
৫ই জানুয়ারির ‘নির্বাচন’ সম্পর্কে ভারতের
মতামত যেন খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য। ওই মতামত যে একেবারে আমরা
জানি না তা-ও নয়। ওই সময়ে ভারতে ক্ষমতাসীন ইউপিএ (পড়ুন কংগ্রেস) সরকার
সমর্থন দিয়েছে এতে, ভারতের মিডিয়া-ও ‘বিকল্প কি?’ প্রশ্ন তুলে সমর্থন
যুগিয়েছে প্রকারান্তরে। বর্তমান এনডিএ (পড়ুন আরএসএস) সরকার এখনও বলে নি
কিছু, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে তাঁরা কি বলে থাকেন তা তো আর অজানা
নয় আমাদের। সে সব কথা শুনে তো কখনও মনে হয় নি যে কোনও ভাবে বিএনপি-জামায়াত
ক্ষমতায় যাক তা তাঁরা চাইতে পারেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত আরএসএস-এর মুখপত্র
সাপ্তাহিক স্বস্তিকা’র ভাষা তো আগের মতোই আছে এখনও। তারপর এটাও ঐতিহাসিক
সত্য যে ক্ষমতার হাতবদলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আছর পড়ে না তেমন। সাউথ
ব্লকের আমলারাই ও সব দেখেশুনে যা কিছু করার করে থাকেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে।
এনডিএ সরকারের আমলে এর অন্যথা কিছু ঘটবে বলে মনে করার কোনও কারণ দেখি না। এ
সরকার প্রশাসনে ‘পরিবর্তন কম, ধারাবাহিকতা অব্যাহত’ - এই নীতি নিয়েই চলছে
আপাতত। এজন্যই পূর্বতন ইউপিএ সরকারের নিয়োগকৃত রাজ্য গভর্নর ও জাতীয়
কমিশনের চেয়ারম্যানদের সরাবার উদ্যোগ নিলেও অন্য কোথাও নড়চড়ের আভাস মিলছে
না তেমন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের দপ্তর পছন্দের ব্যক্তি ও আমলা
দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছেন এরই মধ্যে। তবে সবাই যে তাঁর নিজের পছন্দের তা নয়,
আরএসএস-এর পরামর্শেও নিয়োগ হয়েছে কয়েকজনের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এ
কাজ এখনও করেন নি বলেই জানা যায়। তাঁর মন্ত্রণালয়ের সুজাতা সিং থেকে পঙ্কজ
সরণ পর্যন্ত বহাল আছেন সবাই। এর কারণ একটি হতে পারে, সুষমা স্বরাজের জন্য
পররাষ্ট্র নতুন মন্ত্রণালয়। তিনি মনে করেন, এখানে এই অভিজ্ঞ কূটনীতিকদেরই
বেশি প্রয়োজন তাঁর। অন্য কারণ নর্থ ও সাউথ উভয় ব্লকের সঙ্গে সুষমার সম্পর্ক
নতুন নয়, বলতে গেলে ৩৭ বছরের পুরনো। নয়া দিল্লির আমলা পরিম-লে বিশেষ
গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে তাঁর। সেই ১৯৭৭ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিয়ানা
রাজ্যের চার বারের মুখ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বংশীলালকে
তিনি হারিয়েছিলেন ৬৩% ভোট পেয়ে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির শীর্ষ
পর্যায়ে ভূমিকা রেখে চলেছেন বিভিন্ন সময়ে সাংসদ ও মন্ত্রী হিসেবে।
মন্ত্রিত্বের শুরু হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে, তারপর কেন্দ্রীয় তথ্য,
সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী (কয়েকবার), দিল্লি’র প্রথম নারী
মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ ও পারলামেন্ট বিষয়ক মন্ত্রী, আর
এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মাঝে দায়িত্ব পালন করেছেন লোকসভায় বিরোধী দলের
নেত্রী হিসেবে। এছাড়া তাঁর স্বামী স্বরাজ কৌশল ছিলেন মিজোরামের গভর্নর। এ
সব সূত্র তাঁকে দিয়েছে আমলা-প্রশাসনের সদরে অন্দরে সহজ প্রবেশ-সুবিধা।
মোদি সরকারে সুষমা’র স্থান পাওয়া ছিল জল্পনার বিষয়। কারণ গুজরাট-দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য দলে তিনি মোদি’র সমালোচনা করে থাকেন, বিরোধিতা করেছেন তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেরও। কিন্তু দলের অভিভাবক অটল বিহারী বাজপেয়ী’র আশীর্বাদপুষ্ট সুষমাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ ছিল না মোদি’র পক্ষে। বাজপেয়ীর আরেক আশীর্বাদধন্য লালকৃষ্ণ আদবানিকেও আপাতত এড়ানো গেলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে হয়তো প্রেসিডেন্টই করতে হবে। আর সঙ্ঘ পরিবারের ব্যাপারটা না বললেই নয়। সুষমা’র পিতা ছিলেন আরএসএস-এর একজন খ্যাতনামা সদস্য। সুষমা’র রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও শুরু আরএসএস-এর সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ-এর সদস্য হিসেবে। তিনি প্রচারকও ছিলেন আরএসএস-এর। সংস্কৃত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও আইনে স্নাতকোত্তর সুষমা এক অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে বিবেচিত সঙ্ঘ পরিবারে। তাই বারাক ওবামা যে চিন্তা থেকে হিলারি ক্লিনটনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন তেমন চিন্তা থেকে যে সুষমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় নি তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারও। তবে তাঁর এই সমালোচককে মোদি কতখানি কি কাজের সুযোগ দেন তা দেখার বিষয়, বিশেষ করে তিনি যেখানে গোটা মন্ত্রিসভাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। সার্ক দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনকে নরমে গরমে মোকাবেলার নীতি নিয়ে মোদির বিদেশনীতি আপাতত যাত্রা শুরু করলেও জাপান, ইসরাইল ও মারকিন সম্পর্ক যে ক্রমে গভীরভাবে যুক্ত হবে তা তাঁর গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ইতিহাস থেকেই বোঝা যায়। আর এই মুহূর্তে ইরাকে সুন্নি জঙ্গিদের হাতে আটক ৪০ ভারতীয় শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়ে পড়েছে সুষমা’র জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ বিশেষভাবে জটিল হয়ে পড়েছে কড়া ভাষায় ওই সুন্নি জঙ্গিদের সমালোচনা করে নুরি আল-মালিকি সরকারকে সমর্থন দিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করায়। ওদিকে ইরাক থেকেই বেশির ভাগ তেল আমদানি করে ভারত। সেখানে দেখা দিয়েছে আরেক পরিস্থিতি। এই সময়ে আসছেন সুষমা স্বরাজ। তিনি জানেন ৫ই জানুয়ারির ‘নির্বাচন’ ও কংগ্রেস নেতৃত্বের সমর্থন সম্পর্কে। ওই জ্ঞানকে কোন কাজে লাগাবেন তিনি? প্রতিপক্ষের দুর্বলতা থেকে ফায়দা লোটার সুযোগটি? না, অন্য আর কিছু? সে আর কিছুই বা কি? নিজের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা করে বিশ্ব চ্যামপিয়ন হলেও অন্য দেশের চর্চা নিয়ে তো কখনও মাথাব্যথা দেখায় নি ভারত। এরপরও যাঁরা কোনও বার্তা পেতে চান তাঁরা এই একটি ঘটনা থেকেই যেটুকু খুঁজে নিতে পারেন তা হলো- প্রধানমন্ত্রী ভুটান গেলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন এখানে। তাঁর এ সফর থেকে আমাদের দেখা শোনা জানা বোঝার আছে অনেক কিছু। তাই তাঁকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন, শুভেচ্ছা স্বাগতম্।
No comments