ছবির হাট ও বাপের জায়গা
পিকাসোর মৃত্যুর পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে সাংবাদিকেরা তাঁর মন্তব্য জানতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি একবার পিকাসোর দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্যানের ভালোরিজের বাড়িতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে তাজ্জব কাণ্ড! গ্রামের সড়কপথে যাচ্ছিলাম। দুই পাশের গাছে দেখি ছবি টাঙানো। লোকে বলল, এগুলো পিকাসোর আঁকা পোস্টার। অন্যান্য শিল্পীর আঁকা ছবিও রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে প্রদর্শিত হয় ফরাসি দেশ, জার্মানি প্রভৃতি দেশে।’ পিকাসোকে আবেদিন দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন, কোনো কথা হয়নি। পিকাসোর যে চোখ, তাকানো যায় না। তাঁর চলাফেরার যে গতি, তাঁর সঙ্গে তাল দিয়ে হাঁটা যায় না। যাহোক, ওসব দেশে শিল্পীরা রাস্তাঘাট বা যেখানে খুশি সেখানে বসে শিল্পচর্চা করতে পারেন, কেউ বলে না—এখান থেকে ওঠো, এটা তোমার বাপের জায়গা না। চারুকলা অনুষদ ও নজরুলের সমাধির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একচিলতে জায়গায় তরুণ শিল্পীরা বসে ছবি আঁকেন। তার নাম ছবির হাট। সেখানে তাঁরা আড্ডা দেন। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন। কেউ কবিতা লেখেন, কেউ গান বাঁধেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের তা সইছে না। তাঁরা দারোগা-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সেখানে গেছেন তাঁদের তাড়িয়ে দিতে। নতুন টিভি চ্যানেল যমুনার প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট কর্তাকে টেলিফোনে জানতে চান তাঁদের উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে। নির্বাহী প্রকৌশলী সাংবাদিককে সীমাহীন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন, ছবির হাটকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের আওতায় ফেলা হয়েছে। ওটা কারও বাপের জায়গা না। প্রায় এক যুগ ধরে ছবির হাট ওখানে বসছে।
ওখানে যাঁরা বসেন ও যাতায়াত করেন, তাঁরা জানেন, ওটা আসলেই কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, মায়ের জায়গাও নয়। রাষ্ট্রের জায়গা, জনগণের জায়গা। বৃষ্টি-বাদলার ঝাপটা থেকে বাঁচতে একটুখানি ছাউনির মতো করা হয়েছিল। তা না থাকারই শামিল। ওখানে বৈধ বা অবৈধ কোনো রকম স্থাপনারই অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই, তা উচ্ছেদের অভিযান পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। তবে তা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর চপেটাঘাত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। ছবির হাট নামটির মধ্যেই আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আভাস রয়েছে। হাট একটি গ্রামীণ ব্যাপার। মহানগরে হাট কোথায়? এখানে তো সুপার মার্কেট এবং শপিং মল। ওখানে যদি রানা প্লাজার মতো আলিশান ইমারত তুলে পেইন্টিং গ্যালারি করতেন কেউ, তা হতো অন্য জিনিস। অবৈধ স্থাপনা৷ যদি কেউ ‘ছবির মজলিশ’ নামে কিছু করতেন, তাহলে বোঝা যেত ওটা মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের কাজ। ছবির হাট একেবারেই বাঙালির জিনিস। এ দেশের আদিবাসী সংখ্যালঘু জাতির মানুষও এর সঙ্গে যুক্ত। ছবির হাটের হাটুরেদের দোষ যদি থেকেই থাকে, তা হলো তাঁরা মূলধারার প্রসিদ্ধদের মতো প্রো-গভর্নমেন্ট নন। তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা সরকারবিরোধী। তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করেন। অসত্য, অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটে তাঁদের কাজে। তাঁরা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। ওই মুক্তচিন্তা জিনিসটিই কোনো সরকারের পছন্দ নয়। সরকার হোক, বহুজাতিক কোম্পানি হোক—কেউ তাঁদের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। তাঁদের কোনো স্পনসর নেই। তাঁরা তা চানও না। তাঁদের একটি নৈতিক অবস্থান আছে, যা স্বনামধন্যদের নেই। ছবির হাটের মানুষেরা সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাস করেন৷ যা কিছু বাঙালিত্ব, তাকে তাঁরা লালন করেন। তাঁরা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করেন। বর্ষার ছবি প্রদর্শন করেন। একুশেতে ছবির হাট বসান। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে আনন্দের হাট বসান। মে দিবসও উদ্যাপন করেন। রানা প্লাজার বিপর্যয় নিয়ে ছবি আঁকেন। মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাঁদের অংশগ্রহণ সাবলীল। শাহবাগের আন্দোলনে তাঁরাই সবার আগে এগিয়ে আসেন। তাঁদের তাড়িয়ে দিতে মালকেঁাচা মেরে নেমে পড়া কতটা সমীচীন?
গোটা দেশটাই দখল করে ফেলেছে সরকারি দলের ক্যাডাররা। দেশে বৈধ স্থাপনা বেশি না অবৈধ স্থাপনা বেশি, তা বলা কঠিন। খাল-বিল, বনভূমি, নদীর তীর, খাসজমি—সব বেদখল। কোনো জায়গাজমি দখল করতে গেলে পেশিশক্তি, পিস্তল, রামদা, চাপাতি, কিরিচের দরকার। ছবির হাটের মানুষেরা ওগুলো এস্তেমাল করা তো দূরের কথা; পিস্তল, চাপাতি, রামদার ছবি পর্যন্ত আঁকার রুচি তাঁদের নেই। মহাজোট সরকার নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরে যা-ই করুক, তাদের সংস্কৃতিনীতি প্রশংসনীয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে ‘সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয়’ তৈরি হবে। আমাদের আশা ও দাবি, সেই সাংস্কৃতিক বলয়ে ছবির হাটের জন্যও জায়গা বরাদ্দ থাকবে। শিল্প-সংস্কৃতির বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। যেমন তাঁদের কাজে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নাক গলান না। চায়ের দোকান আর ছবির হাট এক জিনিস নয়। স্বাধীনভাবে মনের আনন্দে শিল্পীদের কাজ করতে না দিলে প্রতিভার বিকাশ ঘটে না। একজন সুলতানকে পাওয়া যায় না। সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে যাঁরা শোষণমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, মৌলবাদবিহীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চান, রাষ্ট্রের কর্তব্য তাঁদের আনুকূল্য দেওয়া। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সাময়িক পরিচয়, তাঁর স্থায়ী পরিচয় তিনি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যশিল্পী। বাংলাদেশের প্রায় কোনো সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ছিল না। জনাব নূর ব্যতিক্রম। ছবির হাটের শিল্পী, কবি ও কর্মীরা যাতে নিরুপদ্রবে তাঁদের শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে পারেন, সে ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করি। আমি শুনেছি, বিষয়টি তাঁর বিবেচনায় আছে। এখন দরকার তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments