সুইস ব্যাংক, ভোগবিলাস, দারিদ্র্য ও একটি কল্পকাহিনী by মাহবুব কামাল

২০০২ সাল থেকে অর্থ পাচার রোধে বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হয়। তখন থেকে সুইস ব্যাংক তাদের কাছে গচ্ছিত পাচার করা অর্থের দায় বহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে গ্রাহকদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রকাশ করে চলেছে। এখন যে কল্পকাহিনীটি পাঠক পড়বেন, তা ২০০২ সালের আগে প্রচলিত ছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের ক্রাউন প্রিন্স ঢুকেছেন সুইস ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর রুমে। চেয়ারে বসেই তিনি বলতে শুরু করেন- আমার বাবা বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। আর তাই আমিও প্রিন্স থেকে কিং হতে পারছি না। আমি আর কতদিন অপেক্ষা করব?
প্রধান নির্বাহী বললেন, কিন্তু আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
-হ্যাঁ, আপনিই পারেন আমাকে রাজা বানাতে।
-কীভাবে?
-আমার বাবা আপনার ব্যাংকে যে টাকা রেখেছেন, তার একটা স্টেটমেন্ট দরকার আমার। ওই ব্যাংক-হিসাব কৌশলে ছড়িয়ে দিয়ে বাবার ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেব আমি। তখন তিনি বাধ্য হয়ে অবসরে যাবেন। আর আমি তার স্থলাভিষিক্ত হব।
-কিন্তু আমি তো এটা করতে পারব না। ব্যাংক-হিসাব গোপন রাখাই আমাদের পলিসি।
-আমি আপনাকে ফাইভ মিলিয়ন ডলার দেব।
-সরি, আমি এটা পারব না।
-টেন মিলিয়ন ডলার।
-প্লিজ, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ক্রাউন প্রিন্স এবার পকেট থেকে একটি রিভলবার বের করলেন। পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে সেটা তাক করলেন প্রধান নির্বাহীর দিকে। বললেন, আমি এখন এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা উচ্চারণ করব। এর মধ্যে আপনি যদি রাজি না হন, আই উইল জাস্ট শুট ইউ।
ক্রাউন প্রিন্স ওয়ান, টু, থ্রি- এভাবে দশ পর্যন্ত উচ্চারণ করার পরও প্রধান নির্বাহী নিশ্চুপ রইলেন।
ক্রাউন প্রিন্স এবার রিভলবার নামিয়ে খুললেন তার ব্রিফকেস। সেটা ডলার দিয়ে ঠাসা।
তিনি হাসিমুখে বললেন, আমার একটা অ্যাকাউন্ট খুলুন, প্লিজ।
বলাবাহুল্য, এই কল্পকাহিনী সেকেলে হয়ে গেছে। এখন ঘুষের প্রলোভন কিংবা মৃত্যুর ভয় দেখানো দূরের কথা, সাধারণ অনুরোধেরও প্রয়োজন পড়ে না। সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নিয়মেই ফি-বছর তাদের গ্রাহকদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রকাশ করে চলেছে। তো এ বছর প্রকাশিত স্টেটমেন্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে সুইস ব্যাংকে। দুঃসংবাদটি হচ্ছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। ২০১২ সালে যা ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি। ওদিকে বাংলাদেশী ধনাঢ্য শ্রেণীর টাকা যে শুধু সুইস ব্যাংকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা নয়; ব্রিটেন, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যাংকেও ক্রমাগত পাচার হচ্ছে টাকা। আবার সাদা চোখে দেখা যায়, পাচারকৃত এমন টাকার হিসাব মেলানোও ভার। কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রজেক্টসহ বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় বিলাসী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন অনেকেই।
এই যে কাঁড়ি কাঁড়ি, রাশি রাশি টাকা- এসব আসে কোত্থেকে, এ এক প্রশ্ন বটে। গার্মেন্ট মালিকদের টাকার রহস্য না হয় বোধগম্য। কার্ল মার্কসের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বে’ এর ব্যাখ্যা রয়েছে। একজন পুঁজিপতি ১০০ টাকায় যে পণ্য বিক্রি করছেন, তা উৎপাদনে তার খরচ হয়েছে কত? কাঁচামাল ১০ টাকা, মেশিনারিজ খরচ ১০ টাকা আর শ্রমিককে দিয়েছেন ১০ টাকা। অর্থাৎ ৩০ টাকা উৎপাদন খরচের পণ্যে তিনি লাভ করেছেন ৭০ টাকা। এই অস্বাভাবিক লাভ তার হতো না, যদি তিনি শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিতেন। তিনি আসলে শ্রম শোষণ করেই টাকার মালিক হয়েছেন। শ্রমিকের ন্যায্য ৬০ টাকা তাকে বুঝিয়ে দিলে তার লাভ থাকত ২০ টাকা এবং সেটাই হতো ন্যায়সঙ্গত। অনেক গার্মেন্ট মালিক এই ন্যায়সঙ্গত কাজটি না করে তাদের শ্রমিক শ্রেণীকে বস্তিতে ঠেলে দিয়ে কানাডার বেগমপাড়ায় গড়ে তুলছেন প্রাসাদ।
এখন কথা হচ্ছে, টাকা পাচারকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবাই তো আর এই শ্রেণীর গার্মেন্ট মালিক নন। তারা কারা এবং তাদের বিপুলাকার টাকার উৎস কী? তারা আসলে একক সত্তার ব্যবসায়ী নন। তাদের সত্তার সঙ্গে লেপ্টে আছে রাজনীতিক ও আমলার সত্তা। ত্রি-চক্রের এই সিন্ডিকেট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসার কমিশনবাজি করে থাকে। মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে ফাঁকি ইত্যাদি তো আছেই। আবার রাজনীতিক ও আমলাদের টাকা বানানোর মেশিনটি অপারেট করা সবচেয়ে সহজ। শুধু নিয়োগ বাণিজ্যেই তারা যা বাগাতে পারেন, তা দিয়ে আলাদা একটি ব্যাংকে বিগ সাইজের অ্যাকাউন্ট নির্বাহ করা যায়। যা হোক, এই প্যারার উপসংহারে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকার যে খবর আমরা পাই কিংবা বিত্তশালীদের যে চাকচিক্যময় বাহারি জীবন দেখতে পাই-সেগুলোর অন্তত ৯০ শতাংশের পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো ফর্মের দুর্নীতি।
২.
সুইস ব্যাংক গ্রাহকদের ব্যাংক-হিসাব প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা রীতির সংস্কার করেছে। ভবিষ্যতে হয়তো এই ব্যাংকে টাকা রাখার পূর্বশর্ত হিসেবে সেই টাকার বৈধতা নিশ্চিত করার সংস্কারও করবে তারা। কিন্তু এ দেশের দুর্নীতিবাজদের মানসিকতার সংস্কার কবে হবে, তা অনিশ্চিত। তবে এটুকু অন্তত বুঝতে পারি, নিছক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দ্বারা এ সংস্কার অসম্ভব। অর্থের প্রতি মোহ এক বড় কঠিন অসুখ। একটা বিষয় আমার কাছে এখনও রহস্যময়। বুড়োদের শারীরিক অসুস্থতা হয়, তা হতে পারে অবশ্যই। কিন্তু অর্থলোভের অসুখ কেন হয়? যৌবনে, এমনকি মধ্যবয়সেও অর্থের প্রতি মোহ থাকার একটা যুক্তি থাকতে পারে; উপভোগ করার মতো সময় পড়ে আছে তাদের সামনে। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ওয়ান লেগ ইন দ্য গ্রেভ’- তারা কেন অর্থ-সম্পদের জন্য এত লালায়িত হয়ে থাকে? শেষ বয়সে মির্জা গোলাম হাফিজের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তখন এক কলামে লিখেছিলাম- তিনি চোখে দেখেন না, কানেও শোনেন না, পারেন শুধু টাকা গুনতে। বুড়ো হাবড়া মন্ত্রী-এমপিদের বেশিরভাগেরই যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ রয়েছে। কিন্তু তাতে তাদের চলে না। বড়জোর দু’চার-পাঁচ বছর বাঁচবেন জেনেও নতুন টাকার গন্ধ তাদের খুব পছন্দ। সেই টাকা কী কাজে লাগবে, আল্লাহ মালুম। সন্তান-সন্ততিরা ভোগ করবে? মরণকালে সন্তানদের জন্য জীবনাদর্শ না রেখে, রেখে যাব দুর্নীতির টাকা? তবে যেসব প্রবীণ ব্যবসায়ী দুর্নীতিমুক্ত অবস্থায় নতুন নতুন ভেঞ্চার ও প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছেন, তাদের ভোগ-বিলাসের ব্যাপারে কোনো কমপ্লেইন নেই এই লেখকের। বরং তারা শ্রদ্ধার পাত্রই।
এ এক ভয়াবহ বৈষম্যমূলক সমাজে বাস করছি আমরা। এখানে একটি শ্রেণী উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে লন্ডন-প্যারিস-জেনেভা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর জয়পুরহাটের মর্জিনা বিবিরা কিডনি বিক্রি করে আহার জোগাচ্ছেন। এর নাম সিভিলাইজেশন! তবে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডিটা বুঝি এই যে, সাধারণভাবে দেশের দরিদ্র-শোষিত শ্রেণীটি কারও বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেইন করে না। বরং দরিদ্র বেকার যুবক কবিতা আওড়ায়- দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান! আর মর্জিনা বিবিরা বলেন, হাতের পাঁচ আঙুল কি সমান? ধনী-গরিব তো আল্লাহই বানিয়েছে।
৩.
কার্ল মার্কস শ্রেণীহীন, বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজের আউটলাইন দিয়েছিলেন। সেই আউটলাইন নিয়ে বিতর্ক আছে প্রচুর। কিন্তু শ্রেণী-বৈষম্য ও শ্রমশোষণের যে কারণগুলো দেখিয়েছেন তিনি, সেগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। মানবেতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে এসে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেছি যে, শুধুই গণতন্ত্র দিয়ে এই কারণগুলো দূর করা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হতো, তাহলে দীর্ঘ ৬৭ বছর গণতন্ত্র চর্চার পর ভারতে শ্রেণী-বৈষম্য এতটা প্রকট থাকত না। এটা একটা প্যারাডক্স বটে, মার্কস নির্দেশিত কমিউনিস্ট সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য দূর হলেও সেখানে থাকবে না গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকলেও দূর হবে না বৈষম্য। এমনকি ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলো ওয়েলফেয়ার স্টেটের রূপ ধারণ করলেও সেখানে শ্রেণী-বৈষম্যের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়নি।
আসলে আমাদের মতো একটি অনগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে দারিদ্র্যের মাত্রা ও ধনিক শ্রেণীর লুটপাট কমিয়ে আনতে প্রয়োজন অর্থনীতির ব্যাপক সংস্কার। বস্তুত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আইনগুলোই এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, সেগুলো এমন এক মাকড়শার জাল সৃষ্টি করে, যেখানে দরিদ্ররা কীট-পতঙ্গের মতো আটকা পড়ে। এই আইনগুলোর পরিবর্তন ছাড়া অর্থনীতির সংস্কার সম্ভব নয়। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রশ্নে অস্থির হয়ে আছি, মানুষ ভোটাধিকার ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারল কি-না, তা নিয়ে হুলস্থূল বাধিয়ে ফেলছি। যে নির্বাচন নির্বাচকমণ্ডলীর দারিদ্র্য ঘোচাতে ব্যর্থ হয়, সেই নির্বাচনের মাহাত্ম্য কী? তার চেয়ে অর্থনীতির সংস্কারের এজেন্ডাই কি প্রাইম কনসিডারেশন হতে পারে না? যদি হতে পারে, তাহলে এই সংস্কার এমনভাবে হতে হবে যে, কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে কেউ বিলিওনিয়ার-ট্রিলিওনিয়ার হতে পারলেও অসুবিধা নেই; কিন্তু দুর্নীতি করে কেউ যেন লাখ টাকারও মালিক হতে না পারে।
বিল গেটসের অজস্র টাকার ব্যাপারে আমেরিকানদের কোনো অভিযোগ নেই, ঈর্ষা নেই, এমনকি মাথাব্যথাও নেই। কারণ তার টাকা সৃজনশীলতার টাকা। দ্বিতীয়ত, একজন গড় আমেরিকান তার যাপিত জীবনে কোনো কষ্ট ভোগ করে না। তাই তাদের মেজাজও ঠাণ্ডা। কিন্তু এ দেশের মর্জিনারা তাদের নিয়তি মেনে নিলেও আমরা যারা শিক্ষিত দরিদ্র, দারিদ্র্য তাদের মেজাজ খিটখিটে করে রেখেছে। আমরা খিটখিট করবই। আমাদের সৌন্দর্যচেতনাও নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীর সবকিছুই আমরা অসুন্দর দেখি। দুর্নীতিবাজদের রকমারি ফ্যাশনেবল জীবনও আমাদের কুশ্রী লাগে। এটা কি অসুখ? যদি তা-ই হয়, তাহলে সুইস ব্যাংকের টাকাগুলো ফেরত এনে সেই টাকায় চিকিৎসা করান আমাদের।
পুনশ্চঃ ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত ভারতীয়দের টাকা ফেরত আনার অঙ্গীকার করেছেন।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.