সিরিয়া সংকট- শত্রু কীভাবে মিত্র হয় by রবার্ট ফিস্ক
এত মিথ্যা বলে তাঁরা কীভাবে পার পেয়ে যান?
এদিকে টনি ব্লেয়ার বলছেন, সিরিয়া সংকটের সময় পশ্চিমা ‘নিষ্ক্রিয়তা’র কারণে
ইরাকের চলমান সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সিরিয়ায় বোমা বর্ষণ
হলে দামেস্কে তো এই ইসলামপন্থীরাই ক্ষমতায় আসত—যাদের কারণে বাগদাদ এখন
হুমকির মুখে। ফলে বারাক ওবামা যে টনি ব্লেয়ারের মতো মানুষের কথায় কান
দেননি, তাতে আমরা একরকম বেঁচেই গেছি। গত কয়েক দিনে সিরিয়ায় তিনটি শহর চষে
বেরিয়ে আমার মনে এ ধারণা জন্মেছে যে সিরিয়ায় ব্লেয়ার সাহেবের বন্ধুরা যা
ঘটাচ্ছেন, সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলে বহু কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে। এর জন্য
শুধু পাঁচ মাইল লম্বা আলেপ্পো বিমানবন্দর সড়ক ধরে এগোন।
সরকারি বাহিনী সম্প্রতিই সেখানে ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু এই শহরের আশপাশে ইসলামপন্থীরা এত এলাকা নিজেদের দখলে নিয়েছে যে সেখানে যেতে হলে রাতের আঁধারে ১৬ মাইল রাস্তা খুব দ্রুত পার হয়ে যেতে হবে। সে সড়কের ধারে শুধু বালু আর অপরিশোধিত ময়লার ভাগাড়। তার নিচে রয়েছে একটি অব্যবহৃত রেললাইন৷ আর এদিক-ওদিক থেকে ছোড়া লাল-ট্রেসার-গুলি কান ঘেঁষে চলে যাবে। ব্লেয়ার সাহেব চান, আমরা এই গুলিবর্ষণকারীদের সমর্থন করি। এই সড়কে ভ্রমণ করা সাপ-লুডু খেলার মতোই। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালায়। কখনো কখনো দেখা যাবে, ইসলামপন্থীরা মাত্র ২০০ মিটার দূরে।
আজকের আলেপ্পো শহরের ক্ষণিক চিত্রটি এ রকম—ব্লেয়ারের বন্ধুরা জিতলে এই শহরটি আরেকটি মসুলে পরিণত হতো, আর আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিম ‘সক্রিয়’ হলে তো একদম পোয়াবারো হতো। রাস্তায় দেখলাম, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও বেসামরিক মানুষজন ২০ ফুট গভীর পরিখা খুঁড়ছে। নুসরা ও আইসিস বাহিনী সেখানে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে, যেখান থেকে তারা প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করে। পরিখা খুঁড়ে তারা সেই সুড়ঙ্গ খুঁজছে। এদিকে আলেপ্পো শহরে সরকারনিয়ন্ত্রিত ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। একদিকে আসাদের হেলিকপ্টার থেকে উত্তর আলেপ্পোয় বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে বোমা ফেলা হচ্ছে, এই বোমাবর্ষণ থেকে বেসামরিক এলাকাও বাদ যাচ্ছে না। আর এই সশস্ত্র বিদ্রোহীরা শহরের খ্রিষ্টান মহল্লায় মর্টার হামলা চালাচ্ছেন। আমরা ফ্রন্ট লাইনে ঘোরাঘুরি করলাম, দেখলাম শিশুরা খেলছে, এক বৃদ্ধ ময়লার ভাগাড়ের ওপর বসে সিগারেট ফুঁকছেন। আর মাত্র এক মাইল দূরেই একের পর এক মর্টারের গোলা পড়ছে। এক সিরীয় সেনা পুরোনো একটি পাথরের দেয়াল থেকে একখণ্ড পাথর খুলে নিলেন, সেকেন্ডের জন্য আমি ভ্রু কুঁচকে সেই ফুটো দিয়ে তাকালাম। জায়গাটা ছিল শহরের পুরোনো অংশের একটা প্রান্তে। এক ফুট দূরেই একটি পচা বালুর বস্তা ও ভাঙা কড়িকাঠের পেছনে আরেকটি ফুটো দেখলাম। সম্ভবত বিদ্রোহী সেনারা সেখান দিয়ে আমার ওপর নজর রাখছেন।
সিরীয় বাহিনীর মেজর সোমার পুরোনো শহরের নিচে অবস্থিত এই সুড়ঙ্গ সম্পর্কে বলছিলেন। বিদ্রোহীরা সেই সুড়ঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আব্বাসীয় আমলে নির্মিত মহান উমাইয়া মসজিদ ধসিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদটি যখন ভেঙে পড়ে, তখন মনে হলো, এক হাজার ৫০০ বছরের সভ্যতা ধসে পড়ল। আমি রাস্তায়ই ছিলাম, মসজিদটি মড়মড় করে ভেঙে পড়ল—সে শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। ভূমিকম্পের মতো মাটি কেঁপে উঠল। পুরো অালেপ্পো শহরের নিচেই বিদ্রোহীরা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে। তারা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, আমাদের অবকাঠামো ভেঙে দিতে চেয়েছে৷ মুসলমানরা কেন এসব করে? কারণ, তারা মুসলমান নয়।’
আমাদের আশপাশে মুহুর্মুহু বোমা ও গুলিবর্ষণ হচ্ছিল। গুলি-বোমায় কারও মাথা উড়ে যাচ্ছে, আবার কেউ নিজের মাথা বাঁচাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। সেনাবাহিনী আলেপ্পোর অবরোধ ভেঙে দেওয়ার পর শহরে খাবার এসেছে অনেক। সীমান্তের উত্তরে তুর্কিরা পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় শহরে ছয় দিন ধরে পানি নেই। সরকারি ট্যাংক থেকে শিশু ও বৃদ্ধারা বালতিতে পানি নিয়ে আসছে। সেনাবাহিনী পুরোনো শহর কেন পুনরুদ্ধার করতে পারল না, সে প্রশ্ন করে লাভ নেই।
‘পর্যাপ্ত সেনা নেই’, একজন সিরীয় সাংবাদিক খোলাখুলি বললেন। সে কারণেই সরকার হোমস শহরের অবরোধ নিয়ে সৃষ্ট সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে। সরকার বিদ্রোহীদের বিনা বাধায় উত্তরের দিকে যেতে দিয়েছে। বিদ্রোহীরা হোমস শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের আলেপ্পোর বাহিনীকে সহায়তা করতে চেয়েছিল। ২০০ মাইল দূরে আমি হামাস শহরে গেলাম। শহরময় ধ্বংসস্তূপের পাহাড়। মাইলের পর মাইলজুড়ে পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গ পড়ে আছে। কয়েকজন খ্রিষ্টান নাগরিক আমাকে একটি গির্জার ভেতরে বাগানের মধ্যে নিয়ে গেলেন। দেখলাম, একটি গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার পড়ে আছে। একজন বললেন, ‘এখানেই ওরা ফাদার ফ্রান্সিসকে হত্যা করেছে। এই চেয়ারে ফাদারকে বসিয়ে তাঁর বাঁ চোখের ঠিক ওপরে ওরা গুলিটি করে।’
ফাদার ফ্রান্সিস ভ্যান ডার লাগট এই হোমস শহরের একজন শহীদ। বছরজুড়ে অবরোধের সময়ও তিনি তাঁর খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ও মুসলিম বন্ধুদের ফেলে শহর ছাড়তে চাননি। উল্টো তিনি এই শহরের অভুক্ত ও নির্দোষ মানুষদের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নুসরা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে হত্যা করেছে। আসাদ সরকার এদের সন্ত্রাসী হিসেবেই চিহ্নিত করে। আসাদ সরকারের বিরোধীরা বলছেন, আসাদ যদি হোমস শহর অবরোধ না করতেন, তাহলে এই ৭২ বছর বয়সী ক্যাথলিক যাজক মারা পড়তেন না। যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তার খানিকটা দূরেই ফাদারের সমাধি। কবরের ওপর সস্তা কাঠের ক্রুশ পোঁতা আছে। গির্জায় তাঁর একটা ছবি আছে, ছবিতে তাঁর চশমা পরিহিত মুখটা যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পোপ তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেছেন।
আমার মনে হয়, পশ্চিম যদি গত বছর দামেস্কে বোমাবর্ষণ করত, তাহলে ফাদার ফ্রান্সিস হয়তো বেঁচে যেতেন, ব্লেয়ার সাহেব যেমন ২০০৩ সালে বাগদাদে বোমাবর্ষণ করেছিলেন। আবার তার আগেও তিনি ইসলামপন্থীদের হাতে মারা যেতে পারতেন। ইরাকি বাহিনী যেখানে প্রাথমিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সে রেখাটি এখন আসাদের বাহিনীর দখলেই আছে। নুসরা ও আল-কায়েদা হচ্ছে আসাদের শত্রু, ব্লেয়ার সাহেবের কথামতো দামেস্কে বোমাবর্ষণ করা হলে এরাই লাভবান হতো। এখন ইরান কি সেনা পাঠিয়ে শিয়াদের রক্ষা করবে, নাকি ইরাককে?
সামরিক বিমানে আলেপ্পো থেকে দামেস্কে যাওয়ার পথে এ চিন্তাই করছিলাম, স্থান-কালের বিবেচনায় এটি চিন্তার খোরাক হিসেবে খারাপ না। বিমানে প্রায় ৬০ জন সিরীয় সেনা ছিলেন। অনেকেই আহত ছিলেন। ২৫ বছর বয়সী দুজন গুলিবিদ্ধ সেনাও সেখানে ছিলেন, তাঁদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হয়েছিল। গত রাতে স্নাইপারের গুলিতে তাঁরা আহত হয়েছেন। অন্ধকারে আমাদের বিমানের নিচ দিয়ে মেশিনগানের গুলির ঝাঁক উড়ে গেল। দামেস্ক বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের উল্টোদিকে পাঁচজন সিরীয় ফারসি ভাষায় কোনো দোয়া পড়লেন। তাঁরা বললেন, জাতীয়তায় তাঁরা আফগান, হাজারা গোষ্ঠীভুক্ত শিয়া। তাঁরা সিরীয় সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত ছিলেন, তাঁদের হাতে ছিল রাইফেল। আর পাশে ছিলেন একজন ইরানি। পরদিন তাঁদের তেহরানে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তার মানে, আফগান শিয়ারা এখন আসাদের পক্ষে লড়াই করছেন, আর আফগান সুন্নিরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়ছেন। আহা! ব্লেয়ার সাহেব, এ সময় আপনার আমাদের সঙ্গে থাকা মোটেও উচিত হবে না।
ইংল্যান্ডের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা।
No comments