মাদক ও বাংলাদেশের নারী সমাজ by মোঃ আবু তালেব
বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে মাদক ব্যবহার বা
মাদকাসক্তির গতিপ্রকৃতির চালচিত্রের বলতে গেলে এখনও কিছুই আমরা জানি না।
পত্রিকার সংবাদ বা ব্যক্তিগত সূত্র থেকে মাঝেমধ্যেই জানা যায় মাদকাসক্ত
নারীদের গোপনে কোনো মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার সংবাদ। আশির দশক থেকে
শুরু করে গত প্রায় ৩৫ বছর ধরে একটু একটু করে দেশের প্রায় সব নাগরিক জনপদে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সরকারি-বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী মিলিয়ে তিন শতাধিক
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও তিন-চার বছরের আগে এসব স্থানে নারীরা
একেবারেই অনুপস্থিত। সম্প্রতি দু-তিনটি স্থানে নারীদের জন্য মাদকাসক্তির
চিকিৎসাসেবা চালু করা হলেও মাদকাসক্তিবিষয়ক তথ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
নারীসমাজ এখনও ঐরফফবহ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ। কেননা এরা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
থাকলেও এদের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমান নয়। আমরা এদের অনুভব করি
কিন্তু গণনায় পাই না। আমরা এদের নীরব উপস্থিতি অনুমান করি। কিন্তু বাস্তবে
এরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিভিন্ন বেসরকারি ও অসমর্থিত তথ্য সূত্রে বাংলাদেশের মাদকাসক্তদের এক-তৃতীয়াংশ নারী বলে উল্লেখ করা হলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ডাটাবেইজে এরা প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। তবে বাংলাদেশের নারী সমাজে মাদকের উপস্থিতি বা মাদক সাম্রাজ্যে নারীদের বিচরণের নানা রকম সূচক বা ইঙ্গিতবাহী নির্দেশক রয়েছে। যেমন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবার নেশা করছে বলে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহরে ঐশী নামের এক স্কুলছাত্রী সম্প্রতি মাদক নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজ হাতে তার পিতা-মাতাকে হত্যা করে গণমাধ্যমে ও সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই মাদক সম্রাজ্ঞী, ইয়াবা সুন্দরী, ফেন্সি কুইন ইত্যাদি বিভিন্ন চমকপ্রদ অভিধায় যেসব নারী মাদক ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া যায়, তাদের অধিকাংশই কেবল মাদক চোরাকারবারিই নয়, তারা রীতিমতো মাদকাসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রকাশিত ২০১২ সালের স্যুভেনিরে মাদকাসক্ত শিশুদের ওপর প্রকাশিত একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে দেখা যায়, যেসব পথশিশু মাদক সেবন করে তাদের প্রায় অর্ধেক কিশোরী। ওই প্রবন্ধে আরও দেখা যায়, মাদকসেবী এসব শিশুর ৫১ শতাংশের মা মাদক সেবন করেন। সিনেমা, মডেলিং ও সঙ্গীতসহ সংস্কৃতি জগতের অনেক বিখ্যাত নারী ব্যক্তিত্বের মাদক সেবনের কথা মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়। ২০০৯ সালে আইসিডিডিআরবি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরের প্রায় ৩৪ লাখ বস্তিবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নারী এবং এদের মধ্যে প্রায় ১ শতাংশ কোনো না কোনো মাদক সেবন করে।
বাংলাদেশে মাদকাসক্ত নারীরা কেবল মাদকাসক্তির চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত নয়, তারা সাধারণ চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত। এদের মধ্যে ৪২.৬ শতাংশ সাধারণ হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলে লাঞ্ছনা ও অবহেলার শিকার হয়েছে। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে বাংলাদেশে মাদকাসক্ত চিকিৎসাসেবার যাবতীয় আয়োজন পুরুষকে ঘিরে। নারী মাদকাসক্তরা অবহেলিত তো আছেই, উপরন্তু পুরুষ মাদকাসক্তদের নারী যৌনসঙ্গীরা তাদের সংসর্গে থেকে মাদকাসক্ত ও এইচআইভি/এইডসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তাদের কথা কেউ ভাবেও না। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তি একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হলেও তাদের যৎসামান্য যেটুকু চিকিৎসা সুবিধা আছে, তাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অধিকাংশেরই নাগালের বাইরে।
দেশে মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য যেসব সেবা ও কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার সবই মূলত পুরুষ ইনজেকটিং ড্রাগ ব্যবহারকারীদের জন্য বলেও এ গবেষণা রিপোর্টে দেখানো হয়েছে। নারী মাদকাসক্তদের মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের যে বিশেষ আয়োজন দরকার, দেশের বর্তমান Drop in Center-গুলোতে তার কিছুই নেই বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে ঢাকার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন এক নারী মাদকাসক্তের জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে তাদের যথাযথ চিকিৎসা দূরে থাক, ন্যূনতম মানবিক ব্যবহারটুকু পর্যন্ত করা হয় না। রিপোর্টের বর্ণনা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারী মাদকাসক্তরা কেবল চিকিৎসাক্ষেত্রেই বঞ্চিত নয়, পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের কাছেও তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত, অবহেলিত ও ঘৃণিত। এক নারী মাদকাসক্ত বলেছেন, আপন বড় বোনের বাড়িতে তার কোনো জায়গা হয় না। যদি তিনি কখনও বড় বোনের বাড়িতে যান, তখন বড় বোন তার বাড়ির শুচিতা রক্ষার জন্য তাকে আগে গোসল করতে বাধ্য করে, তারপর অবহেলাভরে কিছু খেতে দেয় এবং খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করে। তিনি যখন তার কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে যান, তখন সবাই তাকে চোরের মতো দূর দূর করে। আরেকটি নিরাময় কেন্দ্রের এক নারী মাদকাসক্ত অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাদের কাছে মাঝেমধ্যে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে নানাভাবে হয়রানি ও মারধর করে। অতীতে তারা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করলেও বর্তমানে পুলিশের বর্ধিত দাবি মেটাতে না পেরে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে পুলিশ তাদের সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেয়।
বহু নারী মাদকাসক্ত না হয়েও বহু ক্ষেত্রে মাদকের নরক যন্ত্রণার শিকার। বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের যত ঘটনা ঘটে, তার সিংহভাগই ধর্ষণকারীর মাদকাচ্ছন্নতার কারণে কিংবা উধঃব জধঢ়রহম-এর ক্ষেত্রে ধর্ষিতার অজান্তে তার ওপর মাদক প্রয়োগের ফল। বউ পেটানো স্বামীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কিংবা নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য বউ পেটায়। নারীরা নেশাগ্রস্ত সন্তান, ভাই, দেবর কিংবা ছেলেবন্ধুর হাতে পিটুনির শিকার হচ্ছে এমন সংবাদ গণমাধ্যমে হরহামেশা দেখা যায়। স্বামীর মাদকাসক্তির কারণে নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সংসার ভাঙা বিশ্বের সব সমাজেই একটি চিরাচরিত ব্যাপার। কর্মস্থলে মাদকাসক্ত সহকর্মী থাকলে নারীরা ধর্ষণসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়। ইভটিজিং, অপহরণ, ছিনতাই- এসব ঘটনার বেশিরভাগের পেছনে রয়েছে মাদকের প্রভাব। বহু নারী শুধু এ কারণে মাদকাসক্ত হয় যে, তাদের স্বামীরা মাদকাসক্ত। ঢাকার এক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন এক নারী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামী নেশার জন্য প্রতিনিয়ত তার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে তাকে বেদম প্রহার করে। কখনও কখনও তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখায়।
দেশে মাদকাসক্ত স্বামীদের কারণে নারীরা সামাজিকভাবেও লাঞ্ছনা ও ধিক্কারের শিকার হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদকাসক্তদের স্ত্রীরা সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হয়। তাদের কেউ কাজ দিতে চায় না। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণে তারা অবহেলার শিকার হয়। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ক্রিয়া-এ চিকিৎসাধীন এক মাদকাসক্তের স্ত্রীর ভাষায়, সবাই তাদের এড়িয়ে চলে এবং সন্দেহের চোখে দেখে। তারা কারও কাছে গেলে তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তাদের পথে-ঘাটে সর্বত্র হিরোঞ্চির বউ নামে উপহাস করা হয়। স্বামীর মাদকাসক্তির কলংক নারীদের কেবল নিগ্রহের শিকার বানায় না, ভেতরে ভেতরে তাদের সব স্বপ্ন-সাধ, আশা-আকাক্সক্ষা ধূলিসাৎ করে দেয়। বহু নারী নিরূপায় হয়ে কেবল বিবাহ বিচ্ছেদের আশ্রয়ই নেয় না, অনেক সময় তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধ তাদের আত্মহননে প্ররোচিত করে। লাইট হাউজ-এ চিকিৎসারত এক মাদকাসক্তের স্ত্রীর অভিযোগ, তার স্বামী মাদকাসক্ত বলে তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। আপন-এ চিকিৎসাধীন এক মাদকাসক্তের স্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, স্বামীর মাদকাসক্তির কারণে তার নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছে। তারও ইচ্ছে করে স্বামীর মতো মাদক সেবন শুরু করে নিজেকে শেষ করে দিতে।
চিকিৎসা ও পুনর্বাসন
নারী মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ধারণাটি মাত্র গত ২ দশক ধরে গবেষক ও চিকিৎসকদের মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে। তৃতীয় বিশ্ব এ ব্যাপারে এখনও অন্ধকারে থাকলেও উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এসব গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে যে কয়েকটি বিষয় সুন্দরভাবে উঠে এসেছে তা হল- নারীদের মাদকে হাতেখড়ি, মাদক গ্রহণের অন্তর্নিহিত জৈব রাসায়নিক, মনস্তাত্ত্বিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ পুরুষের থেকে অনেক ক্ষেত্রে আলাদা। নারীদের মাদক গ্রহণের পথ-পদ্ধতি ও প্রবণতা এবং পছন্দ-অপছন্দ ও ঝোঁক, তাদের দেহের নারীভিত্তিক বিশেষ জীববৈশিষ্ট্য ও জৈবরসায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের মাদক গ্রহণজনিত মনোদৈহিক জটিলতা, বিকার ও বিপত্তিগুলোতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও নারীর আপন ভুবনে এক্ষেত্রে এমন কিছু ব্যাপার আছে যাকে কোনোভাবেই পুরুষের সমস্যার সঙ্গে সমীকরণ করা যায় না। নারী-পুরুষে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জৈব-রাসায়নিক এবং মনন ও চেতন এবং আচরণভিত্তিক পার্থক্যের কারণে নারীর ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মৌলিক বিষয়গুলো যথা- Motivation, Counseling, Admission, Screening, Diagnosis, Detoxification, Crisis Management, Nutrition, Other disease control, Life skill training, Psychotherapy, Medication, Abscess Management, Overdose Management, Family Therapy, Aftercare, Follow up, Relapse Management ইত্যাদি বিষয়কে একটু ভিন্নভাবে দেখা দরকার। পুনর্বাসন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ মাদকাসক্তের জন্য যা প্রয়োজন, নারী মাদকাসক্তের তা নাও প্রয়োজন হতে পারে। মাদকাসক্তি ছাড়াও অন্য যেসব শারীরিক সমস্যা থাকে তাতে নারী-পুরুষের বিস্তর ব্যবধান থাকায় এক্ষেত্রে চিকিৎসা কার্যক্রমে ভিন্ন আয়োজন দরকার হয়। বিশেষত নারীদের গাইনোকলজি সম্পৃক্ত সমস্যাগুলো মোকাবেলায় পুরুষ থেকে নারী মাদকাসক্তদের সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা থাকা দরকার। নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক নারীঘটিত বিষয় মোকাবেলা করার জন্য নারী চিকিৎসা কর্মীর প্রয়োজন হয়। নারীদের আবাসন, স্যানিটেশন (প্রস্রাবখানা, গোসলখানা ইত্যাদি), খেলাধুলা, বিনোদন ও সামাজিকীকরণ কার্যক্রম পুরুষ থেকে বহুলাংশে আলাদা বলে এর জন্য ভিন্ন আয়োজন দরকার।
মোঃ আবু তালেব : অতিরিক্ত পরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর
No comments