ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে প্রস্তাবটি বিবেচনা করুন by ড. ইকবাল হোসেন

বর্তমানে ফরমালিন এক অতি পরিচিত শব্দ, যা নিয়ে অনেকেই রয়েছেন এক ধরনের আতংকে। আবার কেউবা শব্দটিকে ব্যবহার করে চলেছেন রাজনীতিতে। মজার এক প্রয়োগ বটে! টেকনিক্যালি কী এই ফরমালিন? সংক্ষিপ্তভাবে, ৩৭ শতাংশ ‘ফর্মালডিহাইডে’র জলীয় দ্রবণই হল এ ফরমালিন। এক বাক্যে, ফর্মালডিহাইড একটি রাসায়নিক যা কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত। ফর্মালডিহাইডে রয়েছে হাইলি রিয়েক্টিভ, এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং প্রিজার্ভেটিভ গুণাগুণ। ফর্মালডিহাইড সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৫৯ সালে। আর এর শিল্প উৎপাদন শুরু হয় সর্বপ্রথম ১৮৮০ সালে জার্মানিতে। ফর্মালডিহাইড সাধারণ তাপমাত্রায় বায়বীয়। তবে বাণিজ্যিক সুবিধার্থে মূলত ৩৭ শতাংশ জলীয় দ্রবণ (যা ফরমালিন নামে পরিচিত) হিসেবে তরলাকারে সংরক্ষণ, পরিবহন ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা ব্যবহৃত হয় বস্ত্র, প্লাস্টিক, পেপার, পেইন্ট এবং কনস্ট্রাকশন শিল্পে। কিছু কিছু ভ্যাক্সিনে ফর্মালডিহাইড/ফরমালিনের ব্যবহার অপরিহার্য। পচননাশক হিসেবে মৃতদেহ সংরক্ষণে রয়েছে এর ব্যাপক ব্যবহার।

নরমাল মেটাবলিজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে যেমন ফলমূল, শাকসবজি, মাছ এবং মাংস ইত্যাদিতে কিছু কিছু পরিমাণে ফর্মালডিহাইড তৈরি হয়ে থাকে প্রাকৃতিকভাবেই। আপেল, কলা, ফুলকপি, নাশপাতি, ব্যাঙের ছাতা/ছত্রাক ও গরু-খাসি-পর্ক-পোলট্রির মাংসসহ আরও সামুদ্রিক খাদ্যেও থাকে এটা। তবে ‘লাইফ-টাইম’ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফরমালিন আকারে কৃত্রিমভাবে ফর্মালডিহাইড ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে। খাদ্যদ্রব্যে ফর্মালডিহাইড ব্যবহারের সূচনা হয় বহু আগে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ফর্মালডিহাইড ব্যবহৃত হয় আমেরিকান মিল্ক প্লান্টে। ২০০৫-এ ইন্দোনেশিয়ায় এবং ২০০৭-এ ভিয়েতনামে দেখা যায় খাদ্যদ্রব্যে ফর্মালডিহাইড/ফরমালিনের ব্যবহার। এদেশেও চলছে ফর্মালডিহাইডের অবাধ ব্যবহার। সুতরাং এর ভয়াবহতা ও প্রতিরোধের উপায় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার এক বিষয়।
ফরমালিনে বিদ্যমান ফর্মালডিহাইড আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। যেমন- চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ফরমালিন/ফর্মালডিহাইড কিডনি, লিভার ও লাং-এ নানা রকম সমস্যা তৈরি করতে পারে। পারে ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগের জজন্ম দিতে। ফর্মালডিহাইড মানবদেহে ঘটাতে পারে আরও ছোটো-বড় অনেক সমস্যা। তবে এটাও প্রমাণিত যে, ফর্মালডিহাইড কিছু পরিমাণে মানবদেহের জন্য সহনশীল বা অক্ষতিকর। তবে কী সেই সহনশীল মাত্রা/পরিমাণ? সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যের যথেষ্ট ঘাটতি এখনও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ৩০ মিলিলিটার পরিমাণের ফরমালিন সেবন/গ্রহণ আমাদের জন্য প্রাণঘাতী। অর্থাৎ ফরমালিনযুক্ত খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে কেউ যদি ৩০ মিলিলিটার পরিমাণের ফরমালিন একসঙ্গে গ্রহণ করে, তাহলে তার মৃত্যুর আশংকা থাকে।
আমাদের কেউ কেউ খাদ্যদ্রব্য থেকে ফরমালিন দূরীকরণের একটা চেষ্টা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট একটি পন্থা হল- খাদ্যদ্রব্য সম্পূণরূপে পানি দিয়ে ধুইয়ে পানিতে ৮০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৫-১০ মিনিট ধরে সিদ্ধ করে নেয়া। এতে করে খাদ্যদ্রব্য থেকে ক্ষতিকর ফর্মালডিহাইড বের হয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে। তবে গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে, খাদ্যদ্রব্যে একবার ফরমালিন মিশ্রণের পর তা থেকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিকর ফর্মালডিহাইড বের করে আনা অসম্ভব। সুতরাং খাদ্যদ্রব্য থেকে মিশ্রিত ফর্মালডিহাইড দূরীকরণের চেয়ে খাদ্যে ফরমালিন মিশ্রণ প্রতিরোধ করাই শ্রেয়।
খাদ্যে ফরমালিন মিশ্রণ বন্ধের লক্ষ্যে সম্প্র্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসি অনুষদ থেকে ফরমালিন কটু গন্ধযুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ গুরুত্বের দাবিদার। তবে এখানে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় থাকতে হবে। ফরমালিন ইতিবাচকভাবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। কটু গন্ধযুক্ত ফরমালিন সেসব ক্ষেত্রে কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় ব্যবহার উপযোগী বা গ্রহণযোগ্য হবে কি-না, তা ভাবতে হবে।
খাদ্যে ফরমালিনসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধের করণীয় সম্পর্কে মে-২০১৪ তে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণ করেন বহু জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় অংশগ্রহণ করি আমি নিজে। সভায় সংক্ষিপ্ত একটি প্রস্তাব করি যা ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে ফলপ্রসূ হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। প্রস্তাবটি হল- এদেশে ফরমালিনের অবৈধ প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে বৈধ ‘ইম্পোর্ট অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন’ কাঠামোতে একটি নীতি সংযোজন ও প্রয়োগ করা। যেমন- নিবন্ধনকৃত আমদানিকারকদের মাধ্যমে ফরমালিনের আমদানি হতে হবে পূর্বনির্ধারিত মোট পরিমাণের সাপেক্ষে। পূর্বনির্ধারিত মোট পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণে ফরমালিন কোনোভাবেই এদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি কমিটি বা টিম তৈরি করা, যার দায়িত্ব হবে এদেশে ফরমালিনের ইতিবাচক সব প্রয়োগ/ব্যবহার সঠিকভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে বছরের শেষের দিকে একটি মোট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া। আর পরবর্তী বছরে এ পূর্বনির্ধারিত মোট পরিমাণের সাপেক্ষে ফরমালিনের সব আমদানি হয়ে থাকবে নিবন্ধনকৃত আমদানিকারকদের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণে। এক্ষেত্রে কোনো একটি আমদানির অনুমতি প্রদানের আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ওই আমদানিকারক কর্তৃক আগের আমদানিকৃত ফরমালিনের যথাযথ ব্যবহার সংক্রান্ত সব নথি এবং বর্তমান (আবেদনকৃত) আমদানি থেকে আগত ফরমালিনের যথাযথ ব্যবহারের পূর্বপরিকল্পনা সঠিকভাবে যাচাই করে নিতে হবে। পাশাপাশি আমদানিকারকদের দাখিলকৃত নথিপত্রের ভিত্তিতে ফরমালিনের ইম্পোর্ট অ্যান্ড সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন পয়েন্টে র‌্যান্ডম অডিট করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বলা হয়, ইতিবাচকভাবে বছরে এদেশে ফরমালিন ব্যবহƒত হয়ে থাকে ১০০ টনেরও কম, কিন্তু বছরপ্রতি বর্তমানে আমদানি হয়ে থাকে প্রায় ৫০০ টন ফরমালিন। অতিরিক্ত এ আমদানিই ফরমালিনের অপব্যবহারে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং প্রস্তাবিত নীতিটি প্রয়োগ করা গেলে খাদ্যে মিশ্রণসহ সব অপব্যবহারের জন্য ফরমালিনের প্রাপ্যতা দুষ্কর হয়ে উঠবে।
ফরমালিন আমদানিতে এ ধরনের নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তেমন কোনো আইনি সমস্যা রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা এ ধরনের নীতি এরই মধ্যে গৃহীতও হয়েছে। স্থানীয় এক প্রতিষ্ঠানের ইথিলিন অক্সাইড (যা একটি তীব্র দাহ্য রাসায়নিক) বাল্ক আকারে আমদানির অনুমতি চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনার জন্য গত ২৩-১২-২০১৩ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বুয়েটের প্রতিনিধি হিসেবে আমিই অংশ নেই সেই সভায়। আলোচনা করা হয় বিভিন্ন দিক নিয়ে। অবশেষে সবার সম্মতিতে অনুমতি দেয়া হয় আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে। তবে শর্ত হিসেবে বেঁধে দেয়া হয়, ইথিলিন অক্সাইডের আমদানি কোনোক্রমেই পূর্বনির্ধারিত মোট পরিমাণের চেয়ে বেশি হতে পারবে না। আর এ পূর্বনির্ধারিত মোট পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দেয়ার দায়িত্ব যৌথভাবে দেয়া হয় বুয়েট কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টকে।
খাদ্যে ফরমালিন মিশ্রণ বন্ধের লক্ষ্যে বহুমাত্রিক উদ্যোগের একটি অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত নীতিটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট
iqbal1982m@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.