শান্তি ও কল্যাণে বিশ্ব ইজতেমা
বিশ্ব ইজতেমা মানুষের মধ্যে ব্যাপক ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যময় আবেগ তৈরি করে আধ্যাত্মিক প্রেরণার উন্মেষ ঘটায়। মূলত তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন হলেও সর্বস্তরের মুসলমান, যাঁরা বছরের অন্য কোনো সময় দাওয়াতের কাজে ও কাফেলায় অংশ নিতে পারেন না, তাঁরাও স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েতে শামিল হন। দ্বীনের দাওয়াত মানুষকে ঘোর অমানিশা থেকে উজ্জ্বল আলোর দিকে, প্রবৃত্তির অন্ধ অনুসরণ থেকে শৃঙ্খলার দিকে, সংকীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে ধাবিত করে। লাখো মুসলমানের মহাসমাবেশে এমন অনেক মুসল্লি আসেন, যাঁরা আল্লাহর পথে সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ ও আত্মসমর্পিত। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় কল্যাণের পথে মানুষকে আহ্বানের কাজে অনেকে সারা জীবনের জন্য ইসলাম প্রচারে বেরিয়ে পড়েছেন, যাঁরা স্রষ্টাপ্রেমে মশগুল থেকে ত্যাগ-সাধনার মাধ্যমে পুণ্যবানদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বিশ্ব ইজতেমায় প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে দোয়া ও আখেরি মোনাজাতে এসব পুণ্যবান ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে হাত ওঠান। সেসব অচেনা-অজানা নেককার মানুষের সঙ্গে এক জামাতে নামাজ আদায় এবং তাঁদের সঙ্গে পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা প্র্রার্থনার আশায় মুসলমানমাত্রই আবেগাপ্লুত বোধ করেন। আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইজতেমা ময়দানের দিকে ছুটে যান লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ। আখেরি মোনাজাতের দিন ইজতেমা ময়দান ছাপিয়ে টঙ্গীর রাজপথের অলিগলি, আনাচ-কানাচ—সবখানে এমনকি বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। আল্লাহর নামে মুসল্লিদের জিকিরে-ফিকিরে মুখরিত হয়ে ওঠে তুরাগের তীর। ইজতেমার দিন টঙ্গী পরিণত হয় মুসলমানদের বৃহত্তর জুমার নামাজের জামাত আদায়ের নগরে। নামাজ শেষে যে যেখানে পারেন বসে পড়েন এবং দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলিগ মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে সহায়তা করে এবং মানুষের চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বৃহত্তর জমায়েতের অধিকাংশ মানুষ মুসাফির আর মুসাফিরের দোয়া কবুল হয়। তা ছাড়া দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও মজমার সামগ্রিক বিবেচনায় দীর্ঘ আখেরি মোনাজাত করা হয়, যেখানে দেশ-জাতির সার্বিক কল্যাণ ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করা হয়। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়ায় ইজতেমার গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই বিশ্ব ইজতেমা যে প্রচণ্ড ধর্মীয় ভাবাবেগ তৈরির ক্ষেত্র এবং মুসলমানদের ত্যাগ-সাধনায় অতুলনীয় ও অনন্য, তা বলাই বাহুল্য। এক দিনের জন্য হলেও গোটা দেশকে ইজতেমা অভিমুখী করার একটি প্রতীকী মূল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তর সমবেত মুসল্লিদের ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকারে এক পুণ্যভূমির রূপ ধারণ করে। তাই অনেকে আবেগকে চেপে রাখতে না পেরে বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সঙ্গে তুলনা করে বসেন, যা কোনো মতেই শোভনীয় নয়। বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সঙ্গে তুলনা করা সম্পূর্ণ অন্যায়। কারণ, হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার একটির সঙ্গে অন্যটির কখনোই তুলনা করা চলে না।
লোকসমাগম হলেই সেটাকে দ্বিতীয় হজ বলা কোনোমতেই সমীচীন নয়। আদর্শ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমার একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। অন্যায়, অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কলহ-বিবাদ প্রতিনিয়ত সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যদিও চরিত্র, কর্মসূচি ও বক্তব্যের দিক থেকে তাবলিগ একটি নিছক অরাজনৈতিক ধর্মীয় আন্দোলন, তবু এর প্রভাবে সমাজে ইসলামি চিন্তা-চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইবাদত-বন্দেগির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে তাবলিগের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ধর্মের মৌলিক বিধিবিধান পালনের আগ্রহ জোগাতে তাবলিগ জামাতের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ইজতেমার প্রবেশপথে অনেক মানুষ আসেন, অথচ কারও গায়ে একটু ধাক্কা পর্যন্ত লাগতে দেখা যায় না। কোনো শোরগোল ছাড়াই একে অন্যকে চলাচলের সুযোগ করে দেন। সবাই হাঁটেন জিকিরে ফিকিরে। ‘যার যার ডানে চলি ভাই’ বলেন। ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, সংঘাত-সহিংসতা তো দূরে থাক, কেউ একটু রেগে কথা বলেন—এমন দৃশ্যও কখনো চোখে পড়ে না।
তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে পথভোলা বহু মানুষ দ্বীনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা, ধৈর্য ও মতৈক্য দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। তাঁরা একে অন্যের কষ্টকে ভাগাভাগি করে নেন। কেউ তর্কবিতর্ক বা কটু কথা বলেন না বা গালাগালি করেন না। জামাতের ঘোষণা শুনেই সবাই নামাজের কাতার সোজা করে নেন। ধনী-দরিদ্রের কোনো ভেদাভেদ নেই। বিত্তশালী লোকেরা আরামের বিছানা ছেড়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চাটাইয়ের বিছানায় রাত যাপন করেন। সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে খাবার খান। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে সাম্য-মৈত্রীর অনুপম মহড়া ও দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। তাবলিগ জামাতের প্রচেষ্টায় দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে আলোকময় জীবনের অধিকারী হচ্ছেন। এভাবে শান্তি ও কল্যাণকামিতার ধর্ম ইসলামের মর্মবাণীর ব্যাপক বিস্তার লাভ হচ্ছে এবং দ্বীনের দাওয়াত সব দেশেই পৌঁছে যাচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
dr.munimkhan@yahoo.com
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments