ভীত ও রক্তাক্ত কায়রোর রাজপথ by রবার্ট ফিস্ক
যেন পাথর পড়ছে আকাশ থেকে। লড়াইটা এত ভয়াবহ, চারপাশে রক্তের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
‘প্রেসিডেন্ট’ মোবারকের প্রতিবিপ্লব এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের ওপর। ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই শহরের বুকের ঠিক মাঝখানে, তিনি নাকি যার শাসক। উভয় পক্ষেই হাজার হাজার তরুণ। উভয় পক্ষই ওড়াচ্ছে মিসরের পতাকা। এই সংঘর্ষ ছিল ভয়াবহ, নৃশংস ও সুপরিকল্পিত। মোবারককে ঘৃণা করার চূড়ান্ত ন্যায্যতা এই ঘটনা। এই ঘটনা ওবামা-ক্লিনটন গংদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক ভূমিকারও প্রমাণ, তাঁরা আমেরিকা ও ইসরায়েলের বশংবদ শাসককে অস্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তাহরির স্কয়ারে তখন রক্তের ঘ্রাণ। যে নারী ও পুরুষেরা মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরচারীর অবসান চাইছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তারাও। পাথর-বৃষ্টির মধ্যে অসীম সাহসে তারাও চালাচ্ছিল পাল্টা লড়াই। পরে এই সাহসই পরিণত হয় ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায়। কয়েকজন মোবারকের এক পুলিশকে টেনেহিঁচড়ে চত্বরের মাঝখানে এনে ফেলে পেটাতে থাকে, যতক্ষণ না পুলিশটির মাথা ফেটে রক্তে তাদের পোশাক ভিজে যায়। মিসরের থার্ড আর্মি ১৯৭৩ সালে সুয়েজ খাল পেরোনোর জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছে, তারাও পারেনি বা চায়নি আহত ব্যক্তিটিকে সাহায্য করতে।
হাজার মানুষের চিৎকার। রোমান সেনাদের মতো করে দুদল মিসরীয় পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন মিসর পা রাখল গৃহযুদ্ধের চৌকাঠে। আক্রমণের মুখে দেওয়া ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া জনতার ঢলে বিহ্বল হয়ে পড়ে চত্বর পাহারা দেওয়া প্রহরীরাও।
আমার থেকে ২০ ফুট দূরের একটি মার্কিন আব্রামস ট্যাংকের কমান্ডার ঝাঁপিয়ে লুকালেন ট্যাংকটির ভেতর। মোবারকপন্থীরা এবার ট্যাংকটির ওপর উঠে বিক্ষুব্ধ তরুণদের ওপর পাথর বর্ষণ করতে থাকল। হামলা শুরু করে তারাই এবং যুদ্ধে যা হয়, উভয় পক্ষের কিছু আচরণ লড়াইকে আরও তীব্র করে। দিনশেষে তিনজনের মৃত্যুর খবর আসে। খবর পাই মোবারকপন্থীরা এবার বিদেশি সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করতে শুরু করেছে।
এতক্ষণে আমি দুই দলের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছালাম। উভয় পক্ষ চিৎকার করছে, ঘৃণা মেশানো হাসিতে উপহাস করছে পরস্পরকে। তাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। একসময় জনতা মোবারকপন্থীদের হামলা সামলে ওঠে, তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
এই লড়াই মিসরীয়দের বিরুদ্ধে মিসরীয়দের। কিন্তু এই হামলাকারীদের আমরা কী নাম দেব? মোবারকপন্থী? ‘প্রতিবাদকারী’ অথবা ‘প্রতিরোধকারী’? মোবারককে যারা গদিছাড়া করতে চায়, তারাও তো নিজেদের বলছে প্রতিরোধকারী?
এ রকম এক প্রতিরোধকারী আমাকে বলল, ‘এটা মোবারকের কাজ, এরা মোবারকের ভাড়াটে লোক। মাত্র আরও নয় মাস ক্ষমতায় থাকার জন্য সে মিসরীয়দের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে মিসরীয়দের! সে পাগল হয়ে গেছে। আর তোমরা যারা পাশ্চাত্য থেকে এসেছ, তোমরাও কি পাগল?’ মনে নেই, কী উত্তর তাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু কীভাবে ভুলি, কিছুক্ষণ আগেই তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্য ‘বিশেষজ্ঞ’, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর মিট রমনে বলেছেন, ‘মোবারক স্বৈরশাসক নন, রাজকীয় ধরনের শাসক।’ মোবারক কেমন লোক, তার উত্তরে টেলিভিশনে তিনি এই কথা বলেন।
এই রাজার বিরাট বিরাট ছবি বিতরণ করছে মোবারকের দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মকর্তারা। ব্যারিকেডগুলোর জন্য এটা নিঃসন্দেহে উসকানি। অথচ গত শুক্রবারই জনতা এই দলের সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মাইকে তারা বাজাচ্ছে ‘অমর’ মোবারকের গান। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তো অমরই হতে চান। তাঁর ভাড়াটে গুন্ডারা টহল দিচ্ছে নতুন কেনা মোটরসাইকেলে।
বেতার ভবন পার হওয়ার সময় দেখলাম, শহরতলি থেকে কয়েক হাজার তরুণ আসছে। ছিল মেয়েরাও, বেশির ভাগই সনাতন কালো পোশাকের ওপর সাদা ওড়না পরা, তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু শিশুও। তারা বলছিল, তাদেরও অধিকার রয়েছে তাহরির স্কয়ারের ওপর। ঠিকই, প্রিয় প্রেসিডেন্ট যেখানে সবচেয়ে অপমানিত হয়েছেন, সেখানে গিয়েই তাঁকে ভালোবাসা জানানোর অধিকার তো তাদের রয়েছে।
এনডিপি বিভিন্ন জায়গায় তাদের দলের ক্যাডারদের জড়ো করেছে, যারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাজপথে যারা বিক্ষোভকারীদের হামলা করে। এমনকি উটের পিঠে চড়া তাদেরই একজন চিৎকার করে বলছে, ‘যে মোবারককে চেনে না, সে আল্লাহকেও চেনে না।’
এরাই গিয়ে আবার হামলা চালায় তাহরির স্কয়ারে। আবারও আকাশ ঢেকে যায় ছুড়ে দেওয়া পাথরে। ছয় ইঞ্চি ব্যাসের এক একটি পাথর যেন মর্টার শেলের মতো। মোবারকবিরোধীরাও সেটাই ছুড়ছে। জনতার ধাওয়া খেয়ে তারা আবারও পালাল। ঝাঁকে ঝাঁকে পাথর আসছে। একেকবারে শত শত। কিছু পরই আমার পাশে দেখলাম শত শত মোবারকবিরোধীকে। কিন্তু এখন তাদের স্লোগান বদলে গেছে। আর তারা ‘মোবারক নিপাত যাও’ বলছে না। বলছে, ‘আল্লাহ আকবর’। দিনমান বারবারই আমি এটা শুনলাম। একদলের ধ্বনি ‘মোবারক’, অন্য দলের ধ্বনি ‘আল্লাহ’। ২৪ ঘণ্টা আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না।
নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে গিয়ে একেবারে মোবারকপন্থীদের মাঝখানে পড়ে গেলাম। সত্য যে, আকাশ কালো করে পাথর পড়ছে বললে বেশি বলা হয়। কিন্তু একসঙ্গে শত শত পাথর এসে একটা ট্রাককে দুমড়ে দিল। মানুষগুলো ঘামছে, তাদের মাথায় লাল পট্টি, গলায় ঘৃণার গর্জন। অনেকেরই ক্ষতস্থানে সাদা কাপড় বাঁধা। অনেকেই রক্ত ঝরাতে ঝরাতে সরকারি দালালদের ধাওয়া করতে করতে আমাকে পেরিয়ে গেল।
ক্রমশই ইসলামপন্থীদের সংখ্যা বাড়তে দেখছি। তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচ্ছে আল্লাহর নাম। এ রকমটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মোবারকই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক শত্রুদের মাঠে নামানোর পাশাপাশি এদেরও টেনে এনেছেন তিনি। সুযোগ করে দিয়েছেন। বারবার এমন কিছু তরুণ জনতার হাতে ধরা পড়েছে, যাদের পোশাকের চিহ্ন থেকে বোঝা যায়, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোক। সেক্যুলার প্রতিরোধকর্মীরা এসব বন্দীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসলামপন্থীরা তাদের সব ক্রোধ ঢেলে দিচ্ছে দালালদের ওপর। এরই মধ্যে দুজন দশাসই মানুষ এসে এ রকম এক হতভাগাকে কাঁধে করে নিয়ে চলে গেল। এভাবেই বেঁচে গেছে মোহাম্মদ আবদুল আজিব মাবুরুক। পুলিশ সদস্য নম্বর-২১০২০৭৪।
এ সবকিছুর মধ্যে পরিহাসও ছিল। মধ্যদুপুরে মোবারকপন্থীরা তাহরির স্কয়ারের ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল চার অশ্বারোহীসহ এক উট-আরোহীকে। জনতা তাদের টেনেহিঁচড়ে নামায়। তিন ঘণ্টা পরে ঘোড়াগুলোকে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। অন্যদিকে দেখি দুটো বালক-বালিকা। তাদের দুজনের হাতে দুটি দস্তরখান। মেয়েটির দস্তরখানে সিগারেট আর ছেলেটির দস্তরখান পাথর।
এবং এই ঘৃণা আর রক্তপাতের নাটকে কি ছিল পাশ্চাত্যের ভূমিকা? প্রতিদিন এই লজ্জার বিবরণ পাঠাতে পাঠাতে আমার আর তা পড়তে পড়তে আপনাদের হয়তো অনিদ্রায় পেয়ে বসে। গত বুধবার বেলা তিনটার দিকে, দেখলাম ব্রিটেনের লর্ড ব্লেয়ার সাহেব সিএনএন টেলিভিশনে খুব পেরেশানি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ‘পরিবর্তন-প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের অংশীদারির’ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বলছেন, কেন আমাদের সবচেয়ে চরমপন্থীদের তৈরি ‘নৈরাজ্য’ পরিহার করা দরকার। এবং বললেন, ‘যে সরকার আমাদের সমর্থিত গণতান্ত্রিকব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত নয়’ তার কথা। এটাই তাঁর মুখ থেকে শোনা সেরা কথা। বেশ, আমরা জানি, কোন ধরনের ‘গণতন্ত্রের’ কথা তিনি বলছেন এবং সেই গণতন্ত্র কেমন শাসক উপহার দেয়। হোসনি মোবারক ৩০ বছর ধরে তেমন গণতন্ত্র চালাচ্ছেন মিসরে।
রাস্তায় গুজব রয়েছে যে মোবারক—মিট রমনের বলা ‘রাজা প্রকৃতির শাসক’—শুক্রবারে মিসর ছেড়ে পালাতে পারেন। আমি নিশ্চিত নই; যেমন নিশ্চিত নই আসলে বুধবারে তাহরির স্কয়ারে আসলে কে জিতেছে। তাহলেও বেশি দিন এ রকম অচলাবস্থা চলবে না, বিজয়ীর চেহারা ঠিকই দেখা যাবে শিগগিরই। সন্ধ্যাবেলায়ও রাস্তায় পাথর গড়াগড়ি করছিল, পড়ছিল মানুষের ওপর। কিছু পরই এক ঝাঁক পাখি উড়ে যেতে দেখে আমি ভয়ে মাথা লুকালাম।
আরও কিছু ঘটনা
বুধবারের সংঘর্ষে কায়রোতে তিনজন নিহত এবং আহত এক হাজার ৫০০ জন, বিদেশি সাংবাদিকেরাও আক্রমণের শিকার।
মোহাম্মদ এলবারাদি সংঘাতকে দোষারোপ করেছেন ‘অপরাধীদের শাসনের অপরাধমূলক কাজ’ বলে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, সরকারি তরফের সহিংসতা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
মুসলিম ব্রাদারহুড জনগণকে ‘পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে।
লন্ডনের দি ইনডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: দি ইনডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
‘প্রেসিডেন্ট’ মোবারকের প্রতিবিপ্লব এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের ওপর। ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই শহরের বুকের ঠিক মাঝখানে, তিনি নাকি যার শাসক। উভয় পক্ষেই হাজার হাজার তরুণ। উভয় পক্ষই ওড়াচ্ছে মিসরের পতাকা। এই সংঘর্ষ ছিল ভয়াবহ, নৃশংস ও সুপরিকল্পিত। মোবারককে ঘৃণা করার চূড়ান্ত ন্যায্যতা এই ঘটনা। এই ঘটনা ওবামা-ক্লিনটন গংদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক ভূমিকারও প্রমাণ, তাঁরা আমেরিকা ও ইসরায়েলের বশংবদ শাসককে অস্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তাহরির স্কয়ারে তখন রক্তের ঘ্রাণ। যে নারী ও পুরুষেরা মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরচারীর অবসান চাইছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তারাও। পাথর-বৃষ্টির মধ্যে অসীম সাহসে তারাও চালাচ্ছিল পাল্টা লড়াই। পরে এই সাহসই পরিণত হয় ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায়। কয়েকজন মোবারকের এক পুলিশকে টেনেহিঁচড়ে চত্বরের মাঝখানে এনে ফেলে পেটাতে থাকে, যতক্ষণ না পুলিশটির মাথা ফেটে রক্তে তাদের পোশাক ভিজে যায়। মিসরের থার্ড আর্মি ১৯৭৩ সালে সুয়েজ খাল পেরোনোর জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছে, তারাও পারেনি বা চায়নি আহত ব্যক্তিটিকে সাহায্য করতে।
হাজার মানুষের চিৎকার। রোমান সেনাদের মতো করে দুদল মিসরীয় পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন মিসর পা রাখল গৃহযুদ্ধের চৌকাঠে। আক্রমণের মুখে দেওয়া ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া জনতার ঢলে বিহ্বল হয়ে পড়ে চত্বর পাহারা দেওয়া প্রহরীরাও।
আমার থেকে ২০ ফুট দূরের একটি মার্কিন আব্রামস ট্যাংকের কমান্ডার ঝাঁপিয়ে লুকালেন ট্যাংকটির ভেতর। মোবারকপন্থীরা এবার ট্যাংকটির ওপর উঠে বিক্ষুব্ধ তরুণদের ওপর পাথর বর্ষণ করতে থাকল। হামলা শুরু করে তারাই এবং যুদ্ধে যা হয়, উভয় পক্ষের কিছু আচরণ লড়াইকে আরও তীব্র করে। দিনশেষে তিনজনের মৃত্যুর খবর আসে। খবর পাই মোবারকপন্থীরা এবার বিদেশি সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করতে শুরু করেছে।
এতক্ষণে আমি দুই দলের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছালাম। উভয় পক্ষ চিৎকার করছে, ঘৃণা মেশানো হাসিতে উপহাস করছে পরস্পরকে। তাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। একসময় জনতা মোবারকপন্থীদের হামলা সামলে ওঠে, তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
এই লড়াই মিসরীয়দের বিরুদ্ধে মিসরীয়দের। কিন্তু এই হামলাকারীদের আমরা কী নাম দেব? মোবারকপন্থী? ‘প্রতিবাদকারী’ অথবা ‘প্রতিরোধকারী’? মোবারককে যারা গদিছাড়া করতে চায়, তারাও তো নিজেদের বলছে প্রতিরোধকারী?
এ রকম এক প্রতিরোধকারী আমাকে বলল, ‘এটা মোবারকের কাজ, এরা মোবারকের ভাড়াটে লোক। মাত্র আরও নয় মাস ক্ষমতায় থাকার জন্য সে মিসরীয়দের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে মিসরীয়দের! সে পাগল হয়ে গেছে। আর তোমরা যারা পাশ্চাত্য থেকে এসেছ, তোমরাও কি পাগল?’ মনে নেই, কী উত্তর তাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু কীভাবে ভুলি, কিছুক্ষণ আগেই তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্য ‘বিশেষজ্ঞ’, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর মিট রমনে বলেছেন, ‘মোবারক স্বৈরশাসক নন, রাজকীয় ধরনের শাসক।’ মোবারক কেমন লোক, তার উত্তরে টেলিভিশনে তিনি এই কথা বলেন।
এই রাজার বিরাট বিরাট ছবি বিতরণ করছে মোবারকের দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মকর্তারা। ব্যারিকেডগুলোর জন্য এটা নিঃসন্দেহে উসকানি। অথচ গত শুক্রবারই জনতা এই দলের সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মাইকে তারা বাজাচ্ছে ‘অমর’ মোবারকের গান। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তো অমরই হতে চান। তাঁর ভাড়াটে গুন্ডারা টহল দিচ্ছে নতুন কেনা মোটরসাইকেলে।
বেতার ভবন পার হওয়ার সময় দেখলাম, শহরতলি থেকে কয়েক হাজার তরুণ আসছে। ছিল মেয়েরাও, বেশির ভাগই সনাতন কালো পোশাকের ওপর সাদা ওড়না পরা, তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু শিশুও। তারা বলছিল, তাদেরও অধিকার রয়েছে তাহরির স্কয়ারের ওপর। ঠিকই, প্রিয় প্রেসিডেন্ট যেখানে সবচেয়ে অপমানিত হয়েছেন, সেখানে গিয়েই তাঁকে ভালোবাসা জানানোর অধিকার তো তাদের রয়েছে।
এনডিপি বিভিন্ন জায়গায় তাদের দলের ক্যাডারদের জড়ো করেছে, যারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাজপথে যারা বিক্ষোভকারীদের হামলা করে। এমনকি উটের পিঠে চড়া তাদেরই একজন চিৎকার করে বলছে, ‘যে মোবারককে চেনে না, সে আল্লাহকেও চেনে না।’
এরাই গিয়ে আবার হামলা চালায় তাহরির স্কয়ারে। আবারও আকাশ ঢেকে যায় ছুড়ে দেওয়া পাথরে। ছয় ইঞ্চি ব্যাসের এক একটি পাথর যেন মর্টার শেলের মতো। মোবারকবিরোধীরাও সেটাই ছুড়ছে। জনতার ধাওয়া খেয়ে তারা আবারও পালাল। ঝাঁকে ঝাঁকে পাথর আসছে। একেকবারে শত শত। কিছু পরই আমার পাশে দেখলাম শত শত মোবারকবিরোধীকে। কিন্তু এখন তাদের স্লোগান বদলে গেছে। আর তারা ‘মোবারক নিপাত যাও’ বলছে না। বলছে, ‘আল্লাহ আকবর’। দিনমান বারবারই আমি এটা শুনলাম। একদলের ধ্বনি ‘মোবারক’, অন্য দলের ধ্বনি ‘আল্লাহ’। ২৪ ঘণ্টা আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না।
নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে গিয়ে একেবারে মোবারকপন্থীদের মাঝখানে পড়ে গেলাম। সত্য যে, আকাশ কালো করে পাথর পড়ছে বললে বেশি বলা হয়। কিন্তু একসঙ্গে শত শত পাথর এসে একটা ট্রাককে দুমড়ে দিল। মানুষগুলো ঘামছে, তাদের মাথায় লাল পট্টি, গলায় ঘৃণার গর্জন। অনেকেরই ক্ষতস্থানে সাদা কাপড় বাঁধা। অনেকেই রক্ত ঝরাতে ঝরাতে সরকারি দালালদের ধাওয়া করতে করতে আমাকে পেরিয়ে গেল।
ক্রমশই ইসলামপন্থীদের সংখ্যা বাড়তে দেখছি। তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচ্ছে আল্লাহর নাম। এ রকমটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মোবারকই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক শত্রুদের মাঠে নামানোর পাশাপাশি এদেরও টেনে এনেছেন তিনি। সুযোগ করে দিয়েছেন। বারবার এমন কিছু তরুণ জনতার হাতে ধরা পড়েছে, যাদের পোশাকের চিহ্ন থেকে বোঝা যায়, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোক। সেক্যুলার প্রতিরোধকর্মীরা এসব বন্দীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসলামপন্থীরা তাদের সব ক্রোধ ঢেলে দিচ্ছে দালালদের ওপর। এরই মধ্যে দুজন দশাসই মানুষ এসে এ রকম এক হতভাগাকে কাঁধে করে নিয়ে চলে গেল। এভাবেই বেঁচে গেছে মোহাম্মদ আবদুল আজিব মাবুরুক। পুলিশ সদস্য নম্বর-২১০২০৭৪।
এ সবকিছুর মধ্যে পরিহাসও ছিল। মধ্যদুপুরে মোবারকপন্থীরা তাহরির স্কয়ারের ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল চার অশ্বারোহীসহ এক উট-আরোহীকে। জনতা তাদের টেনেহিঁচড়ে নামায়। তিন ঘণ্টা পরে ঘোড়াগুলোকে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। অন্যদিকে দেখি দুটো বালক-বালিকা। তাদের দুজনের হাতে দুটি দস্তরখান। মেয়েটির দস্তরখানে সিগারেট আর ছেলেটির দস্তরখান পাথর।
এবং এই ঘৃণা আর রক্তপাতের নাটকে কি ছিল পাশ্চাত্যের ভূমিকা? প্রতিদিন এই লজ্জার বিবরণ পাঠাতে পাঠাতে আমার আর তা পড়তে পড়তে আপনাদের হয়তো অনিদ্রায় পেয়ে বসে। গত বুধবার বেলা তিনটার দিকে, দেখলাম ব্রিটেনের লর্ড ব্লেয়ার সাহেব সিএনএন টেলিভিশনে খুব পেরেশানি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ‘পরিবর্তন-প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের অংশীদারির’ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বলছেন, কেন আমাদের সবচেয়ে চরমপন্থীদের তৈরি ‘নৈরাজ্য’ পরিহার করা দরকার। এবং বললেন, ‘যে সরকার আমাদের সমর্থিত গণতান্ত্রিকব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত নয়’ তার কথা। এটাই তাঁর মুখ থেকে শোনা সেরা কথা। বেশ, আমরা জানি, কোন ধরনের ‘গণতন্ত্রের’ কথা তিনি বলছেন এবং সেই গণতন্ত্র কেমন শাসক উপহার দেয়। হোসনি মোবারক ৩০ বছর ধরে তেমন গণতন্ত্র চালাচ্ছেন মিসরে।
রাস্তায় গুজব রয়েছে যে মোবারক—মিট রমনের বলা ‘রাজা প্রকৃতির শাসক’—শুক্রবারে মিসর ছেড়ে পালাতে পারেন। আমি নিশ্চিত নই; যেমন নিশ্চিত নই আসলে বুধবারে তাহরির স্কয়ারে আসলে কে জিতেছে। তাহলেও বেশি দিন এ রকম অচলাবস্থা চলবে না, বিজয়ীর চেহারা ঠিকই দেখা যাবে শিগগিরই। সন্ধ্যাবেলায়ও রাস্তায় পাথর গড়াগড়ি করছিল, পড়ছিল মানুষের ওপর। কিছু পরই এক ঝাঁক পাখি উড়ে যেতে দেখে আমি ভয়ে মাথা লুকালাম।
আরও কিছু ঘটনা
বুধবারের সংঘর্ষে কায়রোতে তিনজন নিহত এবং আহত এক হাজার ৫০০ জন, বিদেশি সাংবাদিকেরাও আক্রমণের শিকার।
মোহাম্মদ এলবারাদি সংঘাতকে দোষারোপ করেছেন ‘অপরাধীদের শাসনের অপরাধমূলক কাজ’ বলে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, সরকারি তরফের সহিংসতা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
মুসলিম ব্রাদারহুড জনগণকে ‘পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে।
লন্ডনের দি ইনডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: দি ইনডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
No comments