তিনটি বছর হোক গঠনমূলক কাজের by সৈয়দ আবুল মকসুদ
সাধারণ মানুষ কোনো সরকারের কাছেই অসম্ভব কিছু আশা করে না। তারা শুধু সেটুকুই চায়, যা সরকারের সম্পূর্ণ সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু সেটুকুও যখন পায় না, তখন তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়।
পাকিস্তানি আধা সামরিক শাসনের মধ্যেও ষাটের দশকটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য সম্ভাবনার দশক। আমরা কেউ স্বপ্ন দেখছিলাম সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার, কেউ স্বপ্ন দেখছিলাম পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের, যা প্রায় স্বাধীনতার মতোই। দুই রকমের প্রস্তুতিই চলছিল আমাদের মধ্যে: সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি ও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রস্তুতি। নিজস্ব এক সংস্কৃতি নির্মাণের প্রস্তুতিও ছিল। আমাদের একটি প্রবল ও দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ থাকায় বেশ শক্ত প্রস্তুতিই ছিল এবং তা ছিল বলেই যেদিন দুশমন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হিংস্র দাঁত-নখ নিয়ে, আমরা তা প্রতিহত করি এবং সফল হই। সেই সাফল্যের নাম মুক্তিযুদ্ধ।
সফলতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। সফল হওয়ার পর কেউ হয় সফলতর—নতুন সফলতার দিকে এগিয়ে যায়; কেউ ব্যর্থতার গ্লানিতে ডোবে। আমরা আমাদের একাত্তরের সফলতাকে সংহত করতে পারিনি। আমাদের সবকিছু কেমন গন্ডগোল হয়ে গেল—মানুষের যেমন হঠাৎ মাথা খারাপ হয়, সে রকম। নতুন জাতিরাষ্ট্র একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হলো। ফলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নতুন প্রাণ পেল না। একটি নতুন খাঁচায় পুরোনো সব জিনিসপত্র কোনো রকমে টিকে রইল। আমরা একটি প্রাণহীন বস্তুসর্বস্ব ভূখণ্ডের নাগরিক হয়ে রইলাম।
একাত্তরে সাধারণ মানুষ চেয়েছিল সুস্থ সংসদীয় রাজনীতি, মোটামুটি একটি কৃষিনির্ভর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কম বৈষম্য, জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভরতা এবং একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতীয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতি আমাদের সমৃদ্ধই ছিল, প্রয়োজন ছিল তাকে আরও সমৃদ্ধ, উজ্জ্বল ও পরিশীলিত করা। পুরোনো ভূখণ্ডে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা-ই করা হয়। যেমন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও স্বাধীনতার পর মাও ঝেদোঙ গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘নতুন চীন’ নির্মাণের ওপর। তিনি জোর দিয়েছিলেন পল্লি উন্নয়ন, সামাজিক সমতা, গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর। ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম শেষ হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর। তারাও চীনের পথই অনুসরণ করে। আমরা কোনো নতুন পথ তৈরি করতে পারিনি। একটি সংবিধান রচনা করেছিলাম। কিন্তু প্রস্তুতকারীদের কাছেই সেই সংবিধানের কোনো মূল্য ছিল না। সংবিধানে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র’—আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ছিলাম না। সংবিধানে খোদাই ছিল ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি—আমরা তার ধারেকাছে যাইনি। সংবিধানে অবলীলায় বসিয়ে দিয়েছিলাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে একটি কথা—আমরা তার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারিনি। নিষ্প্রয়োজনে সংবিধানে লিখেছিলাম ‘জাতীয়তাবাদ’—আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার লেশমাত্র ছিল না। আমরা সবকিছু বাদ দিয়ে মেঠো বক্তৃতায় বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করতে লাগলাম। মানুষের মুখের কথার যদি শিমুল তুলার সমানও ওজন থাকত, তাহলে গত ৩৯ বছরে নেতারা যত কথা বলেছেন, তার পরিমাণ হতো হাজার হাজার কোটি টন। মানুষের মুখনিঃসৃত বাণীতে যদি তৈরি হতো কোনো চিত্র, তাহলে বাংলাদেশের নেতাদের কথায় তৈরি চিত্রগুলো হতো সবচেয়ে কুৎসিত। ভয়ংকর, বীভৎস!
একাত্তরের স্বপ্নের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক। বাহাত্তরে সে স্বপ্ন ভেঙে কাচের পাত্রের মতো খান খান হয়ে গেল। জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পেল না, সে স্বাদ পেল একটি ভুঁইফোড় ক্ষুদ্র শ্রেণী। গণতন্ত্র কী জিনিস, তা বোঝা গেল না। কারণ, জনগণের মতামত ও বিরোধী দলের কথার কোনো দাম দেওয়া হলো না। কৃষক-শ্রমিকের কানের পাশ দিয়ে সমাজতন্ত্র শব্দটি শাঁ করে চলে গেল, তারা তা ধরতে পারল না। স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত ভারী মিল-কারখানায় চলতে থাকল ‘সমাজতান্ত্রিক’ লুণ্ঠন। ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু মুসলমানরাই উপভোগ করল, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসীরা বুঝতেই পারল না ধর্মনিরপেক্ষতা কাকে বলে। স্থানীয় নেতার জমির লাগোয়া হিন্দু কৈবর্তর একচিলতে জমিটি নেতার জমির সঙ্গে সেক্যুলার ভঙ্গিতে মিশে গেল। মানুষ ও সমাজ নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাদ পেল শুধু হিন্দুর সম্পত্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিজাতীয় বিশ্বজাতীয়তাবাদে বিলীন হয়ে গেল। মানুষ মনে করেছিল ৫০ পয়সা সের চাল কিনবে। কিন্তু দেখা গেল, ৫০ পয়সায় চাল পাওয়া যায় আড়াই ছটাক।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের স্বপ্নটি তেমন বড় ছিল না। ওই সময়টি জনগণ খুব সামান্যই চেয়েছিল। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল খুবই কম। এক কথায় বলতে গেলে তারা চেয়েছিল শতাব্দীর প্রথম আট বছরের অসুন্দর গণতন্ত্র ও অপশাসন থেকে মুক্তি। বড় দলের নেতাদের ট্যান্ডল ও মাস্তানদের চাহিদার তালিকা বিরাট। তা পরিপূর্ণভাবে বা সন্তোষজনকভাবে পূরণ করা যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই কঠিন। কিন্তু জনগণের চাহিদা পূরণ করা খুবই সহজ। জনগণ বাসমতি ও কালিজিরা চালের ভাত খেতে চায় না, তারা চায় মোটা ইরি চালের ভাত। যশোরের কই মাছের ভুনা বা দোপেয়াজা কিংবা গুঁজি আইড় মাখা মাখা করে রেঁধেও তারা খেতে চায় না। বিলুপ্তপ্রায় খইলসা বা পুঁটি মাছের চচ্চড়িই তাদের জন্য যথেষ্ট। লেহেঙ্গা তো নয়ই, কাতান-কাঞ্জিভরমও নয়, বাবুরহাটি মোটা কাপড় পেলেই কৃষক-শ্রমিকের বউ বেজায় খুশি। শহুরে নিম্ন ও মধ্যশ্রেণী মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিউতে চড়তে চায় না। তারা বিআরটিসির বাসে একটু ওঠার সুযোগ চায়। শার্ল দ্য গল বা হিথ্রোর মতো কোনো বিমানবন্দর তারা চায় না; তারা চায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে যানজট কম হোক। সাধারণ মানুষ চায় গ্রামীণ দারিদ্র্য ও শহরের দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন এবং বিদেশি প্রভুদের আশীর্বাদ নিয়ে ২০০৮ সালে যাঁরা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান, তাঁদের সামনে কোনো কঠিন চ্যালেঞ্জই ছিল না। জনগণের সহযোগিতা ও বিদেশি বন্ধুদের মদদ থাকায় তাঁদের খুব সহজেই জনগণের স্বার্থে কিছু ভালো কাজ করা সম্ভব ছিল। প্রতিবছর নির্বাচনী অঙ্গীকার ১৫ শতাংশ করে পূরণ করা হলে পাঁচ বছরে তিন-চতুর্থাংশ ওয়াদা পূরণ করা সম্ভব। সেটাই যথেষ্ট। তার বেশি আশা করা অনুচিত। ওই হিসাবে দুই বছরে ৩০ শতাংশ ওয়াদা পূরণ করা সম্ভব ছিল।
ভোটারদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চয়ই রয়েছে। কোনো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও চাল-ডালের দাম ঠিক রাখার ব্যাপার নয়। তার বাইরে শাসনব্যবস্থায় একটি গুণগত পরিবর্তনের ব্যাপার রয়েছে এবং বলতে গেলে সেটাই প্রধান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চেয়েছিল দেশের শাসনব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন। একটি অসুন্দর রাজনৈতিক অবস্থার বিপরীতে ও একটি শ্বাসরুদ্ধকর ধর্মান্ধ সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তে একটি মোটের ওপর ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিদেশি বন্ধুদের পাঁচ বছরে আমি যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় তাঁরাও প্রত্যাশা করেছিলেন তা-ই।
বর্তমান সরকারের দুই বছরে যে কাজটি আমার কাছে প্রশংসনীয় বলে মনে হয়েছে তা হলো, মুসলিম মৌলবাদীদের তারা দমন করতে পেরেছে। তবে মৌলবাদী রাজনীতি ও ধর্মান্ধতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে যে কায়দা বা নেগেটিভ পদ্ধতি তারা গ্রহণ করেছে, তা শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে কি না, বিবেচনা করা দরকার। যেহেতু বাংলাদেশ একটি ধর্মভীরু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ এবং সমাজের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাই ধর্মব্যবসা এখানে নানাভাবে থাকবে। সরকারের ভুল ও অপরিণামদর্শী নীতির কারণে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীরা এখানে ভিন্নভাবে মাথাচাড়া দিতে পারে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় আবেগ একটি পুঁজি। সেই পুঁজি যে গোত্রের সম্পদ, তারা তা খোয়াতে চাইবে না; বরং বাড়াতে চাইবে।
২০০৮ সালে বাংলার মানুষ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার দেখতে চেয়েছিল। আইন ও আদালতকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হোক, তা জনগণ চাইত না। সে জন্যই তারা পরিবর্তন চেয়েছিল। গত দুই বছরে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর যে কয়েকটি অনষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি দলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আইন একভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, বিরোধী দলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আইন বড়ই কঠোর ও নির্মম। এটা সভ্য জগতের নিয়ম নয়। কমনওয়েলথ দেশগুলোরও নিয়ম নয়। বিদেশিদের চোখে সেটা ধরা পড়েছে। সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার চেয়ে তাদের কানমলা দিয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছে। অপরাধী যত ঘৃণ্যই হোক, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণ হবে সভ্য ও সৌজন্যমূলক। আদালত তাকে কঠোরতম ও সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্র তার সঙ্গে অভদ্র ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারে না। তা করলে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে অপরাধীর কাঠগড়ায়। বিশেষ বিশেষ অপরাধীকে রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা আগেও ছিল। কিন্তু নেওয়া হতো না। মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ কারাভোগ করেছেন; কিন্তু কত দিন করে পাকিস্তানি পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। কোনো কোনো দলীয় মুখপাত্র ও মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কথাবার্তা এতটাই অসুন্দর যে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, সরকারি দলের অনেক ব্যক্তিই তাতে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ। অবস্থা দেখে মনে হয়, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বাস করে একজন দাস। দাস খোঁজে একজন প্রভু। প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য দাস পারে না হেন হাস্যকর কাজ নেই।
আজকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে জনমত জরিপ করছে। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েও পাঠকের মতামত জরিপ হচ্ছে। ওই সব জরিপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিখুঁত ও শক্ত নয়। ষোলো আনা সত্য বলেও ধরে নেওয়া যায় না। কিন্তু তাতে জনগণের বা পাঠকের হূৎস্পন্দন বা মনের ভাব বোঝা যায়। জনগণের প্রতিক্রিয়াটা পাওয়া যায়। গত দুই বছরে পত্রপত্রিকায় যত জনমত জরিপ হয়েছে, তাতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ সরকারের বিপক্ষে গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে কি ওই মতামতের কোনো মূল্যই নেই? তাঁরা কি জানেন না, ওই জরিপ কোনো বিএনপি-জামায়াতপন্থী কাগজ করেনি। সব কটিই মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার পক্ষের পত্রপত্রিকা। জনমত অগ্রাহ্য করার প্রবণতা সুখকর নয়—গণতন্ত্রসম্মত তো নয়ই।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও দলের লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো অন্যায় নয়। তবে তাঁদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকতে হবে। যদি অন্য দলের সমর্থক কেউ যোগ্যতর থাকেন, পদটি তাঁরই প্রাপ্য। কারণ, বেতন-ভাতা, বাড়ি-গাড়ি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র দেয়, দলীয় তহবিল থেকে দেওয়া হয় না। দুর্নীতি দমনের কথা কিছু বলতে চাই না। কারণ, ওটা দলীয় ব্যাপার নয়, সর্বদলীয় সমবায়ী ব্যবস্থা। একেবারে সেক্যুলার ব্যবস্থা। ধর্ম-বর্ণ-মতনির্বিশেষে সবাই ওই কাজে পারদর্শী। দুর্নীতি দূর করা কোনো এক সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। তবে যে সরকার দুর্নীতি কমাতে চেষ্টা করবে, সে সরকার প্রশংসা পাবে। বাংলাদেশের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবির সার্টিফিকেটেরও কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের দুর্নীতির অবস্থা শিশু ও উন্মাদ ছাড়া প্রত্যেকেই জানে।
কোনো প্রকাণ্ড রাজনৈতিক দলের গঠিত সরকারকে পরামর্শ বা বুদ্ধি দিই, তেমন বিদ্যা-বুদ্ধি আমার মতো নগণ্য মানুষের নেই। সে ধৃষ্টতাও নেই। আমাদের দেশে বহু লেখক, শিক্ষক ও কলাম লেখক আছেন তা করার জন্য। সরকার হলো তাঁদের পুত্রকন্যার মতো প্রিয়। আদর করে তাঁরা সরকারকে অনেক বুদ্ধি দেন, উপদেশ দেন। সরকারও কৃতার্থ হয়। তাঁরা হন পুরস্কৃত। কিন্তু দেশের মানুষের তাতে এক পয়সা লাভ হয় না। তারা হয় ক্ষতিগ্রস্ত।
পৃথিবীতে আজ যতগুলো এয়ারলাইনস আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় বিমানের অবস্থা যেমনটি ছিল, গত ১৫ বছরে তার চেয়ে ১৫ গুণ অধঃপতন ঘটেছে। ওই সংস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের, বিরোধী দলের নয়। তিন বছরের মধ্যে অনুমান করি এই সংস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার এ কথায় কেউ ‘সংক্ষুব্ধ’ হয়ে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার বা মানিকগঞ্জে মামলা ঠুকে দিতে পারেন। বিজ্ঞ বিচারক আমার বিরুদ্ধে ‘সমন’ জারি না করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। তবুও আমি বলব, দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিমান আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু সেই ধ্বংস রোধ করার কোনো আয়োজন নেই সরকারের পক্ষ থেকে। ঢাকা বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কাউকে বোঝানো যাবে না। ওটার নামকরণ যেহেতু কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নামে নয়, তাই তার অব্যবস্থা দূর করার কোনো চেষ্টাও নেই।
আমাদের বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও অন্য দেশের বিমান ওঠানামার জন্য আমাদের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে—একটি ঢাকায়, অন্যটি চট্টগ্রামে। কিন্তু মহাজোটের হাসিনা-এরশাদ-মেনন-ইনু-দিলীপ সরকার আর একটি প্রকাণ্ড বিমানবন্দর বানানোর জন্য বিস্ময়করভাবে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দর-বিষয়ক এই ব্যাকুলতার পরিণাম কী, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না।
যে দেশে মানুষ বেশি, সে দেশে এক ইঞ্চি জমির মূল্য সোনার চেয়ে দামি। আর সে জমি যদি হয় ফসলি জমি, তার মূল্য হীরা বা প্লাটিনামের চেয়ে বেশি। ত্রিশাল, ভাঙ্গা বেঁচে গেছে, সরকারের থাবা পড়েছে এখন বিক্রমপুরের মানুষের ওপর। যে বিক্রমপুর ছিল গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এলাকা, সেই বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর। যেখানে ৫০০-৬০০ যাত্রী নিয়ে ভারতীয়, আমেরিকান ও ইউরোপীয় জাম্বো জেট ও এয়ারবাস মিনিটে মিনিটে ওঠানামা করবে। যৎসামান্য কাপড় পরে ট্যুরিস্ট মেম সাহেবরা এসে নামবেন। কিন্তু তাঁরা কোনো দিনই জানবেন না ওই বিমানবন্দর বানাতে গিয়ে জাতির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ ধ্বংস করা হয়েছে। উর্বর ফসলের মাঠ ধ্বংস হয়েছে। বিমানে যাঁরা চড়বেন, তাঁরা জানবেন না ভিটায় ঘুঘু চড়েছে কত কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে ও অন্যান্য পেশার মানুষের। পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটা হারানোর হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে উঠবে জাম্বো জেটের ডানা। বাংলার আকাশের বাতাস হয়ে উঠবে ভারী।
অত্যন্ত কষ্ট থেকে একটি কথা বলতে চাই। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ভোটাররা সব দল নিষিদ্ধ করে একটি জাতীয় দল গঠনের ম্যান্ডেট দেয়নি। নির্বাচনী ম্যান্ডেটের বাইরে বাড়তি কাজ করতে গেলে দলের সাধারণ সমর্থকেরাও তা অনুমোদন করেন না। তারপর যেদিন বিপর্যয় ঘটে, সেদিন পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না। মানুষ মাত্রেই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সময় থাকতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন বিমানবন্দর বানানোর চেয়ে বাস টার্মিনালগুলো সংস্কার করলে দেশবাসী উপকৃত হবে। জমিজমা, মাঠঘাট ধ্বংস করে আত্মবিধ্বংসী কাজ করবেন না।
শুরুতে যা বলেছি। বাংলার মানুষের চাহিদা খুব সামান্য। তা পূরণ করা কঠিন কিছু নয়। দুটি বছর মামলা-মোকদ্দমা এবং অসুন্দর ও অর্থহীন কাজে অপচয় হয়েছে। আগামী তিনটি বছর গঠনমূলক ও গণমুখী কাজে ব্যয় হলে সাধারণ মানুষ শুধু উপকৃত হবে তা-ই নয়, পরবর্তী নির্বাচনে কোনো কৌশল ছাড়াই বিজয়ী হওয়া যাবে। এমনকি তার পরের নির্বাচনেও বিজয়ী হওয়া সম্ভব। তা না হলে ২০২১ সালের পরিকল্পনা শুধু স্বপ্ন হয়েই থাকবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পাকিস্তানি আধা সামরিক শাসনের মধ্যেও ষাটের দশকটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য সম্ভাবনার দশক। আমরা কেউ স্বপ্ন দেখছিলাম সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার, কেউ স্বপ্ন দেখছিলাম পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের, যা প্রায় স্বাধীনতার মতোই। দুই রকমের প্রস্তুতিই চলছিল আমাদের মধ্যে: সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি ও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রস্তুতি। নিজস্ব এক সংস্কৃতি নির্মাণের প্রস্তুতিও ছিল। আমাদের একটি প্রবল ও দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ থাকায় বেশ শক্ত প্রস্তুতিই ছিল এবং তা ছিল বলেই যেদিন দুশমন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হিংস্র দাঁত-নখ নিয়ে, আমরা তা প্রতিহত করি এবং সফল হই। সেই সাফল্যের নাম মুক্তিযুদ্ধ।
সফলতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। সফল হওয়ার পর কেউ হয় সফলতর—নতুন সফলতার দিকে এগিয়ে যায়; কেউ ব্যর্থতার গ্লানিতে ডোবে। আমরা আমাদের একাত্তরের সফলতাকে সংহত করতে পারিনি। আমাদের সবকিছু কেমন গন্ডগোল হয়ে গেল—মানুষের যেমন হঠাৎ মাথা খারাপ হয়, সে রকম। নতুন জাতিরাষ্ট্র একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হলো। ফলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নতুন প্রাণ পেল না। একটি নতুন খাঁচায় পুরোনো সব জিনিসপত্র কোনো রকমে টিকে রইল। আমরা একটি প্রাণহীন বস্তুসর্বস্ব ভূখণ্ডের নাগরিক হয়ে রইলাম।
একাত্তরে সাধারণ মানুষ চেয়েছিল সুস্থ সংসদীয় রাজনীতি, মোটামুটি একটি কৃষিনির্ভর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কম বৈষম্য, জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভরতা এবং একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতীয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতি আমাদের সমৃদ্ধই ছিল, প্রয়োজন ছিল তাকে আরও সমৃদ্ধ, উজ্জ্বল ও পরিশীলিত করা। পুরোনো ভূখণ্ডে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা-ই করা হয়। যেমন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও স্বাধীনতার পর মাও ঝেদোঙ গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘নতুন চীন’ নির্মাণের ওপর। তিনি জোর দিয়েছিলেন পল্লি উন্নয়ন, সামাজিক সমতা, গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর। ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম শেষ হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর। তারাও চীনের পথই অনুসরণ করে। আমরা কোনো নতুন পথ তৈরি করতে পারিনি। একটি সংবিধান রচনা করেছিলাম। কিন্তু প্রস্তুতকারীদের কাছেই সেই সংবিধানের কোনো মূল্য ছিল না। সংবিধানে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র’—আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ছিলাম না। সংবিধানে খোদাই ছিল ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি—আমরা তার ধারেকাছে যাইনি। সংবিধানে অবলীলায় বসিয়ে দিয়েছিলাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে একটি কথা—আমরা তার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারিনি। নিষ্প্রয়োজনে সংবিধানে লিখেছিলাম ‘জাতীয়তাবাদ’—আমাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার লেশমাত্র ছিল না। আমরা সবকিছু বাদ দিয়ে মেঠো বক্তৃতায় বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করতে লাগলাম। মানুষের মুখের কথার যদি শিমুল তুলার সমানও ওজন থাকত, তাহলে গত ৩৯ বছরে নেতারা যত কথা বলেছেন, তার পরিমাণ হতো হাজার হাজার কোটি টন। মানুষের মুখনিঃসৃত বাণীতে যদি তৈরি হতো কোনো চিত্র, তাহলে বাংলাদেশের নেতাদের কথায় তৈরি চিত্রগুলো হতো সবচেয়ে কুৎসিত। ভয়ংকর, বীভৎস!
একাত্তরের স্বপ্নের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক। বাহাত্তরে সে স্বপ্ন ভেঙে কাচের পাত্রের মতো খান খান হয়ে গেল। জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পেল না, সে স্বাদ পেল একটি ভুঁইফোড় ক্ষুদ্র শ্রেণী। গণতন্ত্র কী জিনিস, তা বোঝা গেল না। কারণ, জনগণের মতামত ও বিরোধী দলের কথার কোনো দাম দেওয়া হলো না। কৃষক-শ্রমিকের কানের পাশ দিয়ে সমাজতন্ত্র শব্দটি শাঁ করে চলে গেল, তারা তা ধরতে পারল না। স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত ভারী মিল-কারখানায় চলতে থাকল ‘সমাজতান্ত্রিক’ লুণ্ঠন। ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু মুসলমানরাই উপভোগ করল, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসীরা বুঝতেই পারল না ধর্মনিরপেক্ষতা কাকে বলে। স্থানীয় নেতার জমির লাগোয়া হিন্দু কৈবর্তর একচিলতে জমিটি নেতার জমির সঙ্গে সেক্যুলার ভঙ্গিতে মিশে গেল। মানুষ ও সমাজ নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাদ পেল শুধু হিন্দুর সম্পত্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিজাতীয় বিশ্বজাতীয়তাবাদে বিলীন হয়ে গেল। মানুষ মনে করেছিল ৫০ পয়সা সের চাল কিনবে। কিন্তু দেখা গেল, ৫০ পয়সায় চাল পাওয়া যায় আড়াই ছটাক।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের স্বপ্নটি তেমন বড় ছিল না। ওই সময়টি জনগণ খুব সামান্যই চেয়েছিল। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল খুবই কম। এক কথায় বলতে গেলে তারা চেয়েছিল শতাব্দীর প্রথম আট বছরের অসুন্দর গণতন্ত্র ও অপশাসন থেকে মুক্তি। বড় দলের নেতাদের ট্যান্ডল ও মাস্তানদের চাহিদার তালিকা বিরাট। তা পরিপূর্ণভাবে বা সন্তোষজনকভাবে পূরণ করা যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই কঠিন। কিন্তু জনগণের চাহিদা পূরণ করা খুবই সহজ। জনগণ বাসমতি ও কালিজিরা চালের ভাত খেতে চায় না, তারা চায় মোটা ইরি চালের ভাত। যশোরের কই মাছের ভুনা বা দোপেয়াজা কিংবা গুঁজি আইড় মাখা মাখা করে রেঁধেও তারা খেতে চায় না। বিলুপ্তপ্রায় খইলসা বা পুঁটি মাছের চচ্চড়িই তাদের জন্য যথেষ্ট। লেহেঙ্গা তো নয়ই, কাতান-কাঞ্জিভরমও নয়, বাবুরহাটি মোটা কাপড় পেলেই কৃষক-শ্রমিকের বউ বেজায় খুশি। শহুরে নিম্ন ও মধ্যশ্রেণী মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিউতে চড়তে চায় না। তারা বিআরটিসির বাসে একটু ওঠার সুযোগ চায়। শার্ল দ্য গল বা হিথ্রোর মতো কোনো বিমানবন্দর তারা চায় না; তারা চায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে যানজট কম হোক। সাধারণ মানুষ চায় গ্রামীণ দারিদ্র্য ও শহরের দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন এবং বিদেশি প্রভুদের আশীর্বাদ নিয়ে ২০০৮ সালে যাঁরা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান, তাঁদের সামনে কোনো কঠিন চ্যালেঞ্জই ছিল না। জনগণের সহযোগিতা ও বিদেশি বন্ধুদের মদদ থাকায় তাঁদের খুব সহজেই জনগণের স্বার্থে কিছু ভালো কাজ করা সম্ভব ছিল। প্রতিবছর নির্বাচনী অঙ্গীকার ১৫ শতাংশ করে পূরণ করা হলে পাঁচ বছরে তিন-চতুর্থাংশ ওয়াদা পূরণ করা সম্ভব। সেটাই যথেষ্ট। তার বেশি আশা করা অনুচিত। ওই হিসাবে দুই বছরে ৩০ শতাংশ ওয়াদা পূরণ করা সম্ভব ছিল।
ভোটারদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চয়ই রয়েছে। কোনো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও চাল-ডালের দাম ঠিক রাখার ব্যাপার নয়। তার বাইরে শাসনব্যবস্থায় একটি গুণগত পরিবর্তনের ব্যাপার রয়েছে এবং বলতে গেলে সেটাই প্রধান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চেয়েছিল দেশের শাসনব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন। একটি অসুন্দর রাজনৈতিক অবস্থার বিপরীতে ও একটি শ্বাসরুদ্ধকর ধর্মান্ধ সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তে একটি মোটের ওপর ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিদেশি বন্ধুদের পাঁচ বছরে আমি যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় তাঁরাও প্রত্যাশা করেছিলেন তা-ই।
বর্তমান সরকারের দুই বছরে যে কাজটি আমার কাছে প্রশংসনীয় বলে মনে হয়েছে তা হলো, মুসলিম মৌলবাদীদের তারা দমন করতে পেরেছে। তবে মৌলবাদী রাজনীতি ও ধর্মান্ধতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে যে কায়দা বা নেগেটিভ পদ্ধতি তারা গ্রহণ করেছে, তা শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে কি না, বিবেচনা করা দরকার। যেহেতু বাংলাদেশ একটি ধর্মভীরু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ এবং সমাজের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাই ধর্মব্যবসা এখানে নানাভাবে থাকবে। সরকারের ভুল ও অপরিণামদর্শী নীতির কারণে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীরা এখানে ভিন্নভাবে মাথাচাড়া দিতে পারে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় আবেগ একটি পুঁজি। সেই পুঁজি যে গোত্রের সম্পদ, তারা তা খোয়াতে চাইবে না; বরং বাড়াতে চাইবে।
২০০৮ সালে বাংলার মানুষ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার দেখতে চেয়েছিল। আইন ও আদালতকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হোক, তা জনগণ চাইত না। সে জন্যই তারা পরিবর্তন চেয়েছিল। গত দুই বছরে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর যে কয়েকটি অনষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি দলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আইন একভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, বিরোধী দলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আইন বড়ই কঠোর ও নির্মম। এটা সভ্য জগতের নিয়ম নয়। কমনওয়েলথ দেশগুলোরও নিয়ম নয়। বিদেশিদের চোখে সেটা ধরা পড়েছে। সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার চেয়ে তাদের কানমলা দিয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছে। অপরাধী যত ঘৃণ্যই হোক, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণ হবে সভ্য ও সৌজন্যমূলক। আদালত তাকে কঠোরতম ও সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্র তার সঙ্গে অভদ্র ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারে না। তা করলে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে অপরাধীর কাঠগড়ায়। বিশেষ বিশেষ অপরাধীকে রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা আগেও ছিল। কিন্তু নেওয়া হতো না। মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ কারাভোগ করেছেন; কিন্তু কত দিন করে পাকিস্তানি পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। কোনো কোনো দলীয় মুখপাত্র ও মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কথাবার্তা এতটাই অসুন্দর যে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, সরকারি দলের অনেক ব্যক্তিই তাতে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ। অবস্থা দেখে মনে হয়, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বাস করে একজন দাস। দাস খোঁজে একজন প্রভু। প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য দাস পারে না হেন হাস্যকর কাজ নেই।
আজকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে জনমত জরিপ করছে। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েও পাঠকের মতামত জরিপ হচ্ছে। ওই সব জরিপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিখুঁত ও শক্ত নয়। ষোলো আনা সত্য বলেও ধরে নেওয়া যায় না। কিন্তু তাতে জনগণের বা পাঠকের হূৎস্পন্দন বা মনের ভাব বোঝা যায়। জনগণের প্রতিক্রিয়াটা পাওয়া যায়। গত দুই বছরে পত্রপত্রিকায় যত জনমত জরিপ হয়েছে, তাতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ সরকারের বিপক্ষে গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে কি ওই মতামতের কোনো মূল্যই নেই? তাঁরা কি জানেন না, ওই জরিপ কোনো বিএনপি-জামায়াতপন্থী কাগজ করেনি। সব কটিই মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার পক্ষের পত্রপত্রিকা। জনমত অগ্রাহ্য করার প্রবণতা সুখকর নয়—গণতন্ত্রসম্মত তো নয়ই।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও দলের লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো অন্যায় নয়। তবে তাঁদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকতে হবে। যদি অন্য দলের সমর্থক কেউ যোগ্যতর থাকেন, পদটি তাঁরই প্রাপ্য। কারণ, বেতন-ভাতা, বাড়ি-গাড়ি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র দেয়, দলীয় তহবিল থেকে দেওয়া হয় না। দুর্নীতি দমনের কথা কিছু বলতে চাই না। কারণ, ওটা দলীয় ব্যাপার নয়, সর্বদলীয় সমবায়ী ব্যবস্থা। একেবারে সেক্যুলার ব্যবস্থা। ধর্ম-বর্ণ-মতনির্বিশেষে সবাই ওই কাজে পারদর্শী। দুর্নীতি দূর করা কোনো এক সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। তবে যে সরকার দুর্নীতি কমাতে চেষ্টা করবে, সে সরকার প্রশংসা পাবে। বাংলাদেশের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবির সার্টিফিকেটেরও কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের দুর্নীতির অবস্থা শিশু ও উন্মাদ ছাড়া প্রত্যেকেই জানে।
কোনো প্রকাণ্ড রাজনৈতিক দলের গঠিত সরকারকে পরামর্শ বা বুদ্ধি দিই, তেমন বিদ্যা-বুদ্ধি আমার মতো নগণ্য মানুষের নেই। সে ধৃষ্টতাও নেই। আমাদের দেশে বহু লেখক, শিক্ষক ও কলাম লেখক আছেন তা করার জন্য। সরকার হলো তাঁদের পুত্রকন্যার মতো প্রিয়। আদর করে তাঁরা সরকারকে অনেক বুদ্ধি দেন, উপদেশ দেন। সরকারও কৃতার্থ হয়। তাঁরা হন পুরস্কৃত। কিন্তু দেশের মানুষের তাতে এক পয়সা লাভ হয় না। তারা হয় ক্ষতিগ্রস্ত।
পৃথিবীতে আজ যতগুলো এয়ারলাইনস আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় বিমানের অবস্থা যেমনটি ছিল, গত ১৫ বছরে তার চেয়ে ১৫ গুণ অধঃপতন ঘটেছে। ওই সংস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের, বিরোধী দলের নয়। তিন বছরের মধ্যে অনুমান করি এই সংস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার এ কথায় কেউ ‘সংক্ষুব্ধ’ হয়ে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার বা মানিকগঞ্জে মামলা ঠুকে দিতে পারেন। বিজ্ঞ বিচারক আমার বিরুদ্ধে ‘সমন’ জারি না করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। তবুও আমি বলব, দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিমান আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু সেই ধ্বংস রোধ করার কোনো আয়োজন নেই সরকারের পক্ষ থেকে। ঢাকা বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কাউকে বোঝানো যাবে না। ওটার নামকরণ যেহেতু কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নামে নয়, তাই তার অব্যবস্থা দূর করার কোনো চেষ্টাও নেই।
আমাদের বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও অন্য দেশের বিমান ওঠানামার জন্য আমাদের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে—একটি ঢাকায়, অন্যটি চট্টগ্রামে। কিন্তু মহাজোটের হাসিনা-এরশাদ-মেনন-ইনু-দিলীপ সরকার আর একটি প্রকাণ্ড বিমানবন্দর বানানোর জন্য বিস্ময়করভাবে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দর-বিষয়ক এই ব্যাকুলতার পরিণাম কী, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না।
যে দেশে মানুষ বেশি, সে দেশে এক ইঞ্চি জমির মূল্য সোনার চেয়ে দামি। আর সে জমি যদি হয় ফসলি জমি, তার মূল্য হীরা বা প্লাটিনামের চেয়ে বেশি। ত্রিশাল, ভাঙ্গা বেঁচে গেছে, সরকারের থাবা পড়েছে এখন বিক্রমপুরের মানুষের ওপর। যে বিক্রমপুর ছিল গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এলাকা, সেই বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর। যেখানে ৫০০-৬০০ যাত্রী নিয়ে ভারতীয়, আমেরিকান ও ইউরোপীয় জাম্বো জেট ও এয়ারবাস মিনিটে মিনিটে ওঠানামা করবে। যৎসামান্য কাপড় পরে ট্যুরিস্ট মেম সাহেবরা এসে নামবেন। কিন্তু তাঁরা কোনো দিনই জানবেন না ওই বিমানবন্দর বানাতে গিয়ে জাতির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ ধ্বংস করা হয়েছে। উর্বর ফসলের মাঠ ধ্বংস হয়েছে। বিমানে যাঁরা চড়বেন, তাঁরা জানবেন না ভিটায় ঘুঘু চড়েছে কত কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে ও অন্যান্য পেশার মানুষের। পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটা হারানোর হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে উঠবে জাম্বো জেটের ডানা। বাংলার আকাশের বাতাস হয়ে উঠবে ভারী।
অত্যন্ত কষ্ট থেকে একটি কথা বলতে চাই। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ভোটাররা সব দল নিষিদ্ধ করে একটি জাতীয় দল গঠনের ম্যান্ডেট দেয়নি। নির্বাচনী ম্যান্ডেটের বাইরে বাড়তি কাজ করতে গেলে দলের সাধারণ সমর্থকেরাও তা অনুমোদন করেন না। তারপর যেদিন বিপর্যয় ঘটে, সেদিন পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না। মানুষ মাত্রেই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সময় থাকতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন বিমানবন্দর বানানোর চেয়ে বাস টার্মিনালগুলো সংস্কার করলে দেশবাসী উপকৃত হবে। জমিজমা, মাঠঘাট ধ্বংস করে আত্মবিধ্বংসী কাজ করবেন না।
শুরুতে যা বলেছি। বাংলার মানুষের চাহিদা খুব সামান্য। তা পূরণ করা কঠিন কিছু নয়। দুটি বছর মামলা-মোকদ্দমা এবং অসুন্দর ও অর্থহীন কাজে অপচয় হয়েছে। আগামী তিনটি বছর গঠনমূলক ও গণমুখী কাজে ব্যয় হলে সাধারণ মানুষ শুধু উপকৃত হবে তা-ই নয়, পরবর্তী নির্বাচনে কোনো কৌশল ছাড়াই বিজয়ী হওয়া যাবে। এমনকি তার পরের নির্বাচনেও বিজয়ী হওয়া সম্ভব। তা না হলে ২০২১ সালের পরিকল্পনা শুধু স্বপ্ন হয়েই থাকবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments