কলমানি বাজারের প্রবণতা by ফারুক মঈনউদ্দীন

তারল্য নিয়ে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকলেও সম্প্রতি বহুল আলোচিত সেই তারল্য নিঃশেষ হয়ে ঠিক উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছিল আমাদের মুদ্রাবাজার। প্রয়োজনীয় তারল্য-সংকট ঘোচানোর জন্য দেশের প্রধান কয়েকটি ব্যাংককে অবিশ্বাস্য চড়া সুদে তহবিল ধার করতে হয়েছে অন্য ব্যাংক থেকে। সেই সুদের হার এমন এক উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ফলে মুদ্রাবাজারের পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এখানে সাধারণ পাঠকদের অবগতির জন্য জানানো প্রয়োজন যে কলমানি হচ্ছে স্বল্প মেয়াদের জন্য ব্যাংকগুলোর গৃহীত ঋণ। এই বাজার গঠিত হয় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে। তাৎক্ষণিক জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোনো ব্যাংকের প্রয়োজনীয় তহবিল তারল্য না থাকলে, সেই ব্যাংক অতিরিক্ত তারল্যসমৃদ্ধ কোনো ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারে। স্বল্পমেয়াদি এই ঋণের মেয়াদ হয় সাধারণত এক দিন থেকে এক সপ্তাহ। এই আন্তব্যাংক ঋণবাজারের সুদের হার নির্ধারিত হয় তহবিলের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। বাজারের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে বাজারে তারল্যসংকট থাকলে সুদের হার বেশি হয় এবং এর বিপরীত অবস্থায় সুদের হার থাকে খুবই নগণ্য। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্থ-বাণিজ্য কেন্দ্রে কলমানি বাজার একটা অপরিহার্য উপাদান। শুধু তরল উদ্বৃত্ত সাময়িকভাবে খাটানোর জন্য নয়, একটা সুস্থ বিনিয়োগ-পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্যও সচল কলমানি বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাজারে অর্থের সরবরাহ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা কৌতূহল থাকতে পারে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বাজারে মোট অর্থের পরিমাণকে অর্থের জোগান বলা যায় আর এই জোগানের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হচ্ছে ব্যাংক নোট। অর্থনীতির ভাষায়, কোনো পণ্যের জোগান বা সরবরাহ বলতে নির্দিষ্ট দামে সেই পণ্য যে পরিমাণ বিক্রয়ের জন্য বিক্রেতা ইচ্ছুক থাকে, তাকে বোঝায়। কিন্তু টাকা-পয়সা আর সব পণ্যের মতো ভোগ করে নিঃশেষ করা যায় না, বরং হাতবদল হয়ে মূল্য সমুন্নত রেখে ব্যবহূত হতে থাকে, তাই কোনো অর্থনীতিতে অর্থের সামগ্রিক পরিমাণকেই সরবরাহ বলে গণ্য করা হয়। আর এই সরবরাহ গড়ে ওঠে ধাতব মুদ্রা, ব্যাংক নোট এবং ব্যাংকের আমানতের সমন্বয়ে। এসব উপাদানের প্রাপ্তি বাড়লে বা কমলে অর্থের সরবরাহও বাড়ে বা কমে। প্রাচীনকালে কেবল ধাতব মুদ্রা এবং ব্যাংক নোটই ছিল অর্থের মূল সরবরাহ সূত্র। কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভব এবং উন্নয়নের সঙ্গে অর্থ সরবরাহের মূল উপাদান হয়ে পড়ে ব্যাংকের আমানত। কারণ, এই আমানত থেকে ঋণ সৃষ্টি করে বাজারে বিস্তৃত হয় অর্থের জোগান। ঋণ সৃষ্টির ফলে কীভাবে অর্থ সরবরাহ বাড়ে, সেটা সাধারণ পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য উদাহরণসহকারে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ধরা যাক, একটি দেশে কেবল দুটি ব্যাংক আছে, ‘ক’ ব্যাংক এবং ‘খ’ ব্যাংক। ‘ক’ ব্যাংকের আমানত আছে ১০০০ টাকা। এই আমানতের ২০ শতাংশ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জামানত হিসেবে গচ্ছিত রাখার পর ব্যাংকটি ৮০০ টাকা ঋণ বিতরণ করতে পারে। ব্যাংকটির ঋণগ্রহীতা(রা) ৮০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য বা সেবা কিনবে, সেই টাকা গিয়ে জমা হবে ‘খ’ ব্যাংকে। তাহলে ‘খ’ ব্যাংকের আমানত হয় ৮০০ টাকা; সে আমানত থেকে ২০ শতাংশ বিধিবদ্ধ জামানত রক্ষা করার পর ব্যাংকটি ঋণ দিতে পারে ৬৪০ টাকা। সেই টাকা যদি আবার অন্য কারও মাধ্যমে ‘ক’ ব্যাংকে বা ‘খ’ ব্যাংকে জমা হয়, সেই টাকা থেকে ঋণ বিতরণ করা যাবে ৫১২ টাকা। এই ঋণ থেকে সৃষ্ট আমানত থেকে আবার ঋণ বিতরণ করা যাবে ৪০৯ টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক আমানত ১০০০ টাকা থেকে চারবার হাত বদলানোর ভেতর দিয়ে মোট ঋণ সৃষ্টি হয়েছে ২৩৬২ টাকা, অর্থাৎ এভাবে সৃষ্ট ঋণের মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিধিবদ্ধ জামানত সংরক্ষণের হার যদি ২০ শতাংশ না হয়ে আরও কম হতো, তাহলে আরও বেশি ঋণ বিতরণ করা যেত এবং তাতে আমানত সৃষ্টি তথা অর্থের জোগান হতো অনেক বেশি।
অর্থনীতিতে এই ঋণ সৃষ্টির ফলে সাময়িক কিছু প্রভাব পড়ে। যেমন—উৎপাদনের মূল উপাদান তথা ভূমি, শ্রম ইত্যাদির মূল্য বেড়ে যায়। কারণ ব্যাংক-সৃষ্ট ঋণের ফলে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে উপকরণের বর্ধিত চাহিদা এসব উপাদানের মূল্যস্ফীতি ঘটায়। ঋণ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষের সঞ্চয় না বাড়ে, তাতে করে ভোগই শুধু বাড়ে। এ কারণে উৎপাদনের মূল উপাদানগুলো সহজে মানুষের ব্যবহারমুক্ত হয় না। পরবর্তী প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের মূল্যের ওপর। সম্প্রসারিত ঋণের কারণে অর্থ সরবরাহ বেড়ে গেলে মানুষের আয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা যেভাবে বাড়ে, সেভাবে বাড়ে না উৎপাদন; যেহেতু উৎপাদনের মূল উপাদানগুলো ভোগ্যপণ্যের মতো ততটা সহজপ্রাপ্য হয় না। উৎপাদনের মূল উপকরণগুলোর মূল্যবৃদ্ধির কারণে সহজ ঋণপ্রাপ্তি সত্ত্বেও উদ্যোক্তাদের অনুমিত আয় তথা মুনাফা হ্রাস পায়, কিংবা প্রত্যাশিত হারে বাড়ে না। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষ তথা ভোক্তাদের আয় বেড়ে গেলেও তাদের প্রকৃত আয় কমে যায়। কারণ, একই পরিমাণ অর্থের ক্রয়ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে যায়। উপরিউক্ত সব কটি প্রভাবের পর ব্যাংকিং খাতে ঋণ সম্প্রসারণের যে প্রভাব পড়ে, সেটা উল্লেখযোগ্য। ঋণবাজারে ক্রমেই বাড়তে থাকে সুদের হার। ঋণ সম্প্রসারণ যদি মানুষের সঞ্চয় বৃদ্ধির তুলনায় বেশি হারে বাড়ে, তাহলে ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যায়, কারণ ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকের আমানত যেহেতু আমানতকারীদের কাছে ব্যাংকের ঋণ, সেহেতু সেই ঋণ সংগ্রহের জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশি হারে সুদ গুনতে হয়।
আমরা জানি, ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মূলত নির্ভর করে মানুষের আমানতের ওপর। এই আমানত স্বাভাবিক পন্থায় বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কর্মসূচি নির্বিঘ্ন হয়। বাজারে আমানতের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের ঋণ বিতরণ অব্যাহত থাকলে তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বিকল্প পন্থা গ্রহণ করতে হয়। এর একটি হচ্ছে, ট্রেজারি বিল বা বন্ড ইত্যাদির বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এটা ‘রেপো’ (রিপারচেজ) নামে পরিচিত। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে ট্রেজারি বিল কেনে, সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃক্রয় করে ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট সুদে ঋণ দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ধরনের ঋণের সুযোগ পুরোপুরি ব্যবহূত হয়ে গেলে ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক বাজার থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ মেয়াদে গৃহীত ঋণের সুদের হার নির্দিষ্ট থাকে বিধায় গ্রহীতা ব্যাংক পূর্বানুমিত সুদের হিসাবে পরিকল্পনা মোতাবেক মেয়াদি ঋণ নিতে পারে আন্তব্যাংক বাজার থেকে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ঋণ অথবা কলমানি বলে পরিচিত ঋণের সুদের হার যথেষ্ট স্পর্শকাতর বলে এ ধরনের ঋণ গ্রহণ সাময়িক জরুরি প্রয়োজন মেটায় বটে, কিন্তু তারল্যের ঘাটতির বাজারে ব্যাংকগুলোকে মুখোমুখি করে চরম সংকটের। কারণ মেয়াদি ঋণের মতো সুদের হার নির্দিষ্ট থাকে না বলে কলমানি বাজারের সুদের হার দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। হঠাৎ করে এই বাজারের সুদের হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে ঋণ সম্প্রসারণমুখী ব্যাংকগুলোকে আচমকা বিপাকে পড়তে হয়। আর্থিক খাতে একাধিক ব্যাংক যদি কলমানি বাজার থেকে ঋণ গ্রহণ করতে উদ্যত হয়, তখন সুদের হার বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঠিক এমনই একটা সংকট দেখা দিয়েছিল।
কয়েক বছর ধরে আমাদের ব্যাংকিং খাতে স্বাভাবিক কিংবা অতি তারল্য পরিস্থিতি বিরাজ করছিল বলে দেশের কলমানি বাজার ছিল স্থিতিশীল। আমাদের ব্যাংকিং খাতে কলমানির বাজার কিছুটা চাঙা হয় ঈদুল আজহার সময়। কারণ, তখন বহু ব্যাংক কোরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য চামড়ার ব্যবসায়ীদের নগদ ঋণ বিতরণ করে। সে সময় কলমানির সুদের হার কিছুটা বাড়লেও চলতি বছরের এই মৌসুমে সে হার ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে সীমিত ছিল। এমনকি চলতি (ডিসেম্বর) মাসের প্রথম দিকেও কলমানির সুদের হার ২০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের ভেতর সুদের হার ১৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে তো বটেই, সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। তবে স্বস্তির বিষয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সফলভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হওয়ায় সুদের হার দ্রুত নেমে আসে—যদিও বর্তমানে বিদ্যমান পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটাতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হয় তখনই, যখন ব্যাংকের ঋণদানযোগ্য আমানত বা তহবিলের অপ্রতুলতা দেখা দেয় এবং ব্যাংকিং খাতে এটা খুবই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু কলমানি বাজারে সুদের হার যখন অস্বাভাবিক হারে বেশি হয়ে যায়, অর্থাৎ কোনো ব্যাংককে যদি সেই পরিস্থিতিতে অবিশ্বাস্য চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়, তখন তাকে আর বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় না। যে ব্যাংক কলমানির জন্য অবিশ্বাস্য চড়া সুদ হাঁকে, তাদের স্মরণ রাখা উচিত, কোনো একদিন তাদেরও এ রকম চড়া সুদে ধার নেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। কলমানি বাজার ব্যাংকের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর প্রতিষ্ঠান, এটি কোনো ব্যাংকের মুনাফা অর্জনের বাজার নয়। কেবল নিউইয়র্ক ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো প্রধান কলমানি বাজার ফাটকাবাজারি মুনাফা এবং সিকিউরিটি মার্কেটের সঙ্গে এতটা সম্পৃক্ত নয়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে হঠাৎ তারল্যের ঘাটতির একটা প্রধান কারণ হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ এবং ক্ষমতাতিরিক্ত ঋণ সম্প্রসারণ। বেশির ভাগ গ্রহীতার স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদি ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করে সে অর্থ ভিন্ন খাতে (যেমন—জমি ক্রয়ের জন্য, এমনকি শেয়ারবাজারে) বিনিয়োগ করা। ফলে ব্যাংকগুলোর পূর্বাভাস বেশির ভাগ সময় সঠিক থাকে না। অথচ ঋণ সম্প্রসারণ না করলে অর্থনীতিতে দেখা দেয় স্থবিরতা, আবার উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিনিয়োগ না করলে দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি। কিন্তু ঋণ সম্প্রসারণ বা সংকোচনের মূল চাবিকাঠিটি থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। তাই দেশের আর্থিক বাজার চলমান ও সুস্থ রাখার জন্য এই উভয় সংকটের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেমন সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় ব্যাংকিং খাতের ওপর, তেমনই ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা, ঋণ বিতরণ ইত্যাদি কার্যক্রমেও থাকতে হয় পেশাদারি ও দক্ষতার ছাপ। এটুকু নিশ্চিত করা গেলে দেশের মুদ্রাবাজার সচল থাকবে স্বাভাবিক গতিতে।
>>>ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.