‘অখন মরা ছাড়া কোনো বুদ্দি নাই’ by মোছাব্বের হোসেন
মেয়েটার নাম ঐশী। হয়েছে ফুটফুটে আর চঞ্চল। এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করছে আর দুষ্টুমিতে মেতে আছে সে। অথচ কী আশ্চর্য, সন্তানের এই দাপাদাপি, চঞ্চলতা কিংবা দুষ্টুমি কোনোটাই দেখতে পারছেন না তার বাবা-মা! কোনো দিনও দেখতে পাননি। এ জীবনে হয়তো দেখাও হবে না।
ঐশীর বাবা-মা দুজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ঐশীর মা রানু বেগমের যখন দুই বছর বয়স, তখন টাইফয়েডে উপযুক্ত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তিনি অন্ধ হয়ে যান। অল্প বয়সেই রানু বাবা হারান। এরপর বড় বোন রীতা বেগম বোনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। রীতা গার্মেন্টসে কাজ নেন। স্বামীও কাজ করেন। ভালোই চলছিল সংসার। ছোট বোন রীতা অন্ধ তো কী হয়েছে, তাকে লেখাপড়া করাতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো আপস করেননি তিনি। একে একে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়তে অনেক খরচ। তার পরও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে প্রতিবন্ধকতা। বছর দুই আগে ইডেন কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে পাস করে স্নাতক হয়েছেন রানু। নিজের প্রচণ্ড আগ্রহ আর বোনের সাহায্য রানুকে এনে দিয়েছে এই সাফল্য। কিন্তু সফল হওয়ার হাসিমাখা মুখ খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। রানু বেগমের বড় বোন রীতা বেগমের সংসারে নেমে এল অশান্তি। তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন। বাধ্য হয়ে বাইরের কাজ কমিয়ে দিতে হলো। অসুস্থ স্বামী, তিন সন্তান আর অন্ধ বোনকে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন রীতা বেগম। বোনটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক। এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে? বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলেন রীতা বেগম। এদিকে একটি প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের এক ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় রানু বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয় মনোয়ার হোসেনের। তিনিও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে বিএ পাস করেছেন। পরিচয় থেকে এ সম্পর্ক একসময় পরিণয়ে রূপ নেয়। রানু বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় মনোয়ার হোসেনের। বেকার মনোয়ার হোসেনও নিরুপায়। থাকতে শুরু করেন স্ত্রী রানু বেগমের বোনের বাসায়। এদিকে অসহায় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেন না রীতা বেগম। তাঁর একার আয়ে এত বড় সংসার চলে না। বড় ছেলেটা এখনো স্কুল ছাড়েনি। তার পরও বুকে পাথর বেঁধে তাকে কাজে পাঠান তিনি। আয় যা হয় তা খুবই কম।
এদিকে রানু বেগমের কোলজুড়ে আসে ঐশী। আরও একটি মুখ বাড়ে। একদিকে অসুস্থ স্বামী-সন্তান, অন্যদিকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বোন, তাঁর স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবেন রীতা বেগম? সাহায্য করার মতো কেউ নেই তাঁর। কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রীতা বেগম। বারবার মূর্ছা যান। আঁচল দিয়ে চোখ মোছার কথা ভুলেই যান। ওদিক থেকে কার যেন ডাক আসে, সেদিকে সাড়া দিতে রীতা বেগম চলে যান। এবার কথা বলি রানু বেগম ও তাঁর স্বামী মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
‘অল্প কয়েক মাস আগে একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরির ব্যবস্থা কইরে দেন এক আপা। সেই মগবাজারে। যাইতে-আসতে ডেইলি ৫০ টাকা খরচ হইয়া যায়। আর দুপুরে খাইতে পারি না। ব্যাগটা তো ছোট, খাবারও নিতে পারি না। জানটা বের হয়ে যায়।’ বলতে বলতে থামেন রানু বেগম। রানু বেগমের কথা শুনে বোঝা যায়, তাঁর কাজটা টেলিফোন অপারেটরের। এ থেকে তিনি যা বেতন পান, তার বেশির ভাগই যাওয়া-আসা করতে খরচ হয়ে যায়। আর অন্ধ মানুষ, এত দূরে যেতে-আসতে পথে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে মানুষ নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে স্ত্রী ও নিজের শিক্ষাজীবনের নানা পরীক্ষা পাসের সনদগুলো সামনে এগিয়ে দেন মনোয়ার হোসেন। ‘এত কষ্ট কইরা ল্যাখাপড়া করছি, মানুষের কতা শুনছি, তার পরও তো থামি নাই। কিন্তু অখন আমরা কী করতে পারি। কোন কাজ নাই। অর (রানুর) বইন তো আমাদের অনেক দিন থাকতে দিছে। হ্যায়ও আর পারতাছে না। অখন আমাদের মরা ছাড়া কোনো বুদ্দি নাই।’
কথাগুলো বলতে বলতে মনোয়ার হোসেন মাথা নিচু করে চোখ কচলাতে থাকেন আর তাঁদের সন্তান ঐশীকে ডাকতে থাকেন। মা-বাবার এমন কথা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি ঐশী, কিন্তু এটা যে কষ্টের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, এটি বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে এই অবুঝ শিশুটি। তাই তো তার হাসিমাখা মুখটিতে সহসাই রাজ্যের অন্ধকার এসে নেমেছে।
বাড়ি ভাড়াসহ অন্য সব খরচ বেড়েই চলছে। বোনও যেমন নিরুপায়, তেমনি নিরুপায় রানু ও তাঁর স্বামী মনোয়ার। বাড়ির পাশে ছোট একটি দোকান দিতে পারলে কোনোভাবে চলে যেত এই অভাবের সংসারটি। কিন্তু সে সামর্থ্য কি আর তাঁদের আছে?
ঐশীর বাবা-মা দুজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ঐশীর মা রানু বেগমের যখন দুই বছর বয়স, তখন টাইফয়েডে উপযুক্ত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তিনি অন্ধ হয়ে যান। অল্প বয়সেই রানু বাবা হারান। এরপর বড় বোন রীতা বেগম বোনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। রীতা গার্মেন্টসে কাজ নেন। স্বামীও কাজ করেন। ভালোই চলছিল সংসার। ছোট বোন রীতা অন্ধ তো কী হয়েছে, তাকে লেখাপড়া করাতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো আপস করেননি তিনি। একে একে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়তে অনেক খরচ। তার পরও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে প্রতিবন্ধকতা। বছর দুই আগে ইডেন কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে পাস করে স্নাতক হয়েছেন রানু। নিজের প্রচণ্ড আগ্রহ আর বোনের সাহায্য রানুকে এনে দিয়েছে এই সাফল্য। কিন্তু সফল হওয়ার হাসিমাখা মুখ খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। রানু বেগমের বড় বোন রীতা বেগমের সংসারে নেমে এল অশান্তি। তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন। বাধ্য হয়ে বাইরের কাজ কমিয়ে দিতে হলো। অসুস্থ স্বামী, তিন সন্তান আর অন্ধ বোনকে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলেন রীতা বেগম। বোনটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক। এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে? বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলেন রীতা বেগম। এদিকে একটি প্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের এক ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় রানু বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয় মনোয়ার হোসেনের। তিনিও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে বিএ পাস করেছেন। পরিচয় থেকে এ সম্পর্ক একসময় পরিণয়ে রূপ নেয়। রানু বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় মনোয়ার হোসেনের। বেকার মনোয়ার হোসেনও নিরুপায়। থাকতে শুরু করেন স্ত্রী রানু বেগমের বোনের বাসায়। এদিকে অসহায় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেন না রীতা বেগম। তাঁর একার আয়ে এত বড় সংসার চলে না। বড় ছেলেটা এখনো স্কুল ছাড়েনি। তার পরও বুকে পাথর বেঁধে তাকে কাজে পাঠান তিনি। আয় যা হয় তা খুবই কম।
এদিকে রানু বেগমের কোলজুড়ে আসে ঐশী। আরও একটি মুখ বাড়ে। একদিকে অসুস্থ স্বামী-সন্তান, অন্যদিকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বোন, তাঁর স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবেন রীতা বেগম? সাহায্য করার মতো কেউ নেই তাঁর। কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রীতা বেগম। বারবার মূর্ছা যান। আঁচল দিয়ে চোখ মোছার কথা ভুলেই যান। ওদিক থেকে কার যেন ডাক আসে, সেদিকে সাড়া দিতে রীতা বেগম চলে যান। এবার কথা বলি রানু বেগম ও তাঁর স্বামী মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
‘অল্প কয়েক মাস আগে একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরির ব্যবস্থা কইরে দেন এক আপা। সেই মগবাজারে। যাইতে-আসতে ডেইলি ৫০ টাকা খরচ হইয়া যায়। আর দুপুরে খাইতে পারি না। ব্যাগটা তো ছোট, খাবারও নিতে পারি না। জানটা বের হয়ে যায়।’ বলতে বলতে থামেন রানু বেগম। রানু বেগমের কথা শুনে বোঝা যায়, তাঁর কাজটা টেলিফোন অপারেটরের। এ থেকে তিনি যা বেতন পান, তার বেশির ভাগই যাওয়া-আসা করতে খরচ হয়ে যায়। আর অন্ধ মানুষ, এত দূরে যেতে-আসতে পথে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে মানুষ নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে স্ত্রী ও নিজের শিক্ষাজীবনের নানা পরীক্ষা পাসের সনদগুলো সামনে এগিয়ে দেন মনোয়ার হোসেন। ‘এত কষ্ট কইরা ল্যাখাপড়া করছি, মানুষের কতা শুনছি, তার পরও তো থামি নাই। কিন্তু অখন আমরা কী করতে পারি। কোন কাজ নাই। অর (রানুর) বইন তো আমাদের অনেক দিন থাকতে দিছে। হ্যায়ও আর পারতাছে না। অখন আমাদের মরা ছাড়া কোনো বুদ্দি নাই।’
কথাগুলো বলতে বলতে মনোয়ার হোসেন মাথা নিচু করে চোখ কচলাতে থাকেন আর তাঁদের সন্তান ঐশীকে ডাকতে থাকেন। মা-বাবার এমন কথা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি ঐশী, কিন্তু এটা যে কষ্টের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, এটি বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে এই অবুঝ শিশুটি। তাই তো তার হাসিমাখা মুখটিতে সহসাই রাজ্যের অন্ধকার এসে নেমেছে।
বাড়ি ভাড়াসহ অন্য সব খরচ বেড়েই চলছে। বোনও যেমন নিরুপায়, তেমনি নিরুপায় রানু ও তাঁর স্বামী মনোয়ার। বাড়ির পাশে ছোট একটি দোকান দিতে পারলে কোনোভাবে চলে যেত এই অভাবের সংসারটি। কিন্তু সে সামর্থ্য কি আর তাঁদের আছে?
No comments