দুরবস্থার জন্য সামরিক শাসকেরাই দায়ী by আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? এ ব্যাপারে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই বা কী করণীয়? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক উপাচার্য।
ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি শক্তি। বারবারই তা প্রমাণিত হয়েছে। এই শক্তি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে অধিকার আদায়ে যেমন সরব ছিল, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও বারবার জেগে উঠেছে। সর্বশেষ এক-এগারোর সময়ে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারেও এই ছাত্রসমাজই নেতৃত্ব দিয়েছে। কাজেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে আমি। তবে এই কলুষিত ছাত্ররাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
অতীতে কখনো কখনো ছাত্ররা নিজেরাই আন্দোলন শুরু করেছে। আবার কখনো অন্যরা আন্দোলন শুরু করেছে, ছাত্ররা এতে যোগ দিয়েছে। শ্রমিকেরা একসময় আন্দোলনের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল। কিন্তু আদমজীসহ বিভিন্ন বড় বড় কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নয়। এখন একমাত্র শক্তি হিসেবে টিকে আছে এই ছাত্রসংগঠনগুলোই।
আজকের ছাত্ররাজনীতির যে কলুষতা, সেটি এক দিনে আসেনি। সামরিক ও স্বৈরশাসকেরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কারণ তারা আইয়ুব খানকে এই ছাত্রদের হাতেই পর্যদুস্ত হতে দেখেছিল। তখন নিজেদের কার্যসম্পাদন করতে অছাত্রদের নেতৃত্বে আনা শুরু করে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় আজ ছাত্রসংগঠনগুলোর এই অবস্থা।
আজকে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে অছাত্ররা। এরা কোনো কালে ছাত্র ছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অনেকে আবার বিবাহ করে সন্তানের জনক। এরা সংগঠনকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। ছাত্রসমাজ বা দেশের কল্যাণে তাদের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ছাত্রনেতা তারাই ছিল যারা ক্লাসে নিয়মিত যেত, পাঠাগারে তাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত, হলের ডাইনিংয়ে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তারা খাওয়াদাওয়া করত। এরই ফাঁকে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তারা আন্দোলন, মিছিল-মিটিং করত। তারা ছাত্ররাজনীতিকে ‘রাজনীতি’ হিসেবে দেখেনি। একে আত্মস্থ করেছিল ছাত্রদের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে।
স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর দেখা গেল, জাতীয় দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা শুরু করে। এটিও ছিল সামরিক শাসনের ফল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির মধ্য থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে। আর এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই হল সংসদ ও ছাত্র সংসদগুলোর মাধ্যমে নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু সামরিক শাসনামলে এই সংসদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেতৃত্বে এমন কিছু লোককে নিয়ে আসা হয়েছে, যারা ছাত্রদের কল্যাণের বদলে অকল্যাণই বেশি চায়।
ছাত্ররা চায়, সংগঠনগুলো ছাত্রদের দিয়েই চলুক। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে আবারও যোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে আসা গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এটি সম্ভব হচ্ছে না ছাত্রসংগঠনগুলোর কারণেই। এর নেতৃত্বে যারা আছে তারা সংগঠনগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে বলে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে চাচ্ছে না। এ সমস্য থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সরকার ও বিরোধী দলসহ সবাইকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।
এ ছাড়া বর্তমান সাংঘর্ষিক অবস্থার জন্য কিছু উপসর্গ রয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই ব্যর্থতার ফল। নানাবিধ সমস্যায় ছাত্ররা ক্ষিপ্ত থাকে। আর এ কারণে ছোটখাটো ঘটনাই বিস্ফোরণ আকারে দেখা দেয়। আবাসিক সমস্যা এর প্রধান কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখনো একই বিছানায় দুজন ছাত্রকে ঘুমাতে হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ছাত্রদের ন্যূনতম সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগের ক্ষমতাশীল ছাত্রসংগঠনকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেওয়া, হল প্রশাসনে রাতারাতি পরিবর্তন আনাও অন্যতম কারণ। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে রাতারাতি সব প্রভোস্টকে বদল করে দেওয়া হয়। সবাইকে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে এটি মুক্তবুদ্ধির জায়গা। এখানে চাপিয়ে দিয়ে কিছু করা যাবে না। এখানে সবাই থাকবে। কাউকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণে এবার ক্ষমতা বদল হলেও হলগুলোতে প্রশাসন বদল হয়নি। যারা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে ছিল, তারা এখন ক্যাম্পাসে এসে বিরোধী ছাত্রসংগঠনকে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু হওয়া উচিত, ক্যাম্পাসে সবাই থাকবে।
অনেকেই ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে বলেন। আমি সেই রকম মনে করি না। তবে অবশ্যই সেই রাজনীতি হতে হবে কলুষতামুক্ত। আদর্শগতভাবে মিল থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছাত্রসংগঠনগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া। ওপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। যারা ছাত্র তাদেরই কমিটিতে আসা উচিত। প্রতিবছর সংগঠনগুলোর সম্মেলন হতে হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি শক্তি। বারবারই তা প্রমাণিত হয়েছে। এই শক্তি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে অধিকার আদায়ে যেমন সরব ছিল, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও বারবার জেগে উঠেছে। সর্বশেষ এক-এগারোর সময়ে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারেও এই ছাত্রসমাজই নেতৃত্ব দিয়েছে। কাজেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে আমি। তবে এই কলুষিত ছাত্ররাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
অতীতে কখনো কখনো ছাত্ররা নিজেরাই আন্দোলন শুরু করেছে। আবার কখনো অন্যরা আন্দোলন শুরু করেছে, ছাত্ররা এতে যোগ দিয়েছে। শ্রমিকেরা একসময় আন্দোলনের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল। কিন্তু আদমজীসহ বিভিন্ন বড় বড় কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নয়। এখন একমাত্র শক্তি হিসেবে টিকে আছে এই ছাত্রসংগঠনগুলোই।
আজকের ছাত্ররাজনীতির যে কলুষতা, সেটি এক দিনে আসেনি। সামরিক ও স্বৈরশাসকেরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কারণ তারা আইয়ুব খানকে এই ছাত্রদের হাতেই পর্যদুস্ত হতে দেখেছিল। তখন নিজেদের কার্যসম্পাদন করতে অছাত্রদের নেতৃত্বে আনা শুরু করে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় আজ ছাত্রসংগঠনগুলোর এই অবস্থা।
আজকে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে অছাত্ররা। এরা কোনো কালে ছাত্র ছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অনেকে আবার বিবাহ করে সন্তানের জনক। এরা সংগঠনকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। ছাত্রসমাজ বা দেশের কল্যাণে তাদের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ছাত্রনেতা তারাই ছিল যারা ক্লাসে নিয়মিত যেত, পাঠাগারে তাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত, হলের ডাইনিংয়ে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তারা খাওয়াদাওয়া করত। এরই ফাঁকে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তারা আন্দোলন, মিছিল-মিটিং করত। তারা ছাত্ররাজনীতিকে ‘রাজনীতি’ হিসেবে দেখেনি। একে আত্মস্থ করেছিল ছাত্রদের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে।
স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর দেখা গেল, জাতীয় দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা শুরু করে। এটিও ছিল সামরিক শাসনের ফল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির মধ্য থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে। আর এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই হল সংসদ ও ছাত্র সংসদগুলোর মাধ্যমে নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু সামরিক শাসনামলে এই সংসদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেতৃত্বে এমন কিছু লোককে নিয়ে আসা হয়েছে, যারা ছাত্রদের কল্যাণের বদলে অকল্যাণই বেশি চায়।
ছাত্ররা চায়, সংগঠনগুলো ছাত্রদের দিয়েই চলুক। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে আবারও যোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে আসা গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এটি সম্ভব হচ্ছে না ছাত্রসংগঠনগুলোর কারণেই। এর নেতৃত্বে যারা আছে তারা সংগঠনগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে বলে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে চাচ্ছে না। এ সমস্য থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সরকার ও বিরোধী দলসহ সবাইকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।
এ ছাড়া বর্তমান সাংঘর্ষিক অবস্থার জন্য কিছু উপসর্গ রয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই ব্যর্থতার ফল। নানাবিধ সমস্যায় ছাত্ররা ক্ষিপ্ত থাকে। আর এ কারণে ছোটখাটো ঘটনাই বিস্ফোরণ আকারে দেখা দেয়। আবাসিক সমস্যা এর প্রধান কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখনো একই বিছানায় দুজন ছাত্রকে ঘুমাতে হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ছাত্রদের ন্যূনতম সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগের ক্ষমতাশীল ছাত্রসংগঠনকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেওয়া, হল প্রশাসনে রাতারাতি পরিবর্তন আনাও অন্যতম কারণ। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে রাতারাতি সব প্রভোস্টকে বদল করে দেওয়া হয়। সবাইকে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে এটি মুক্তবুদ্ধির জায়গা। এখানে চাপিয়ে দিয়ে কিছু করা যাবে না। এখানে সবাই থাকবে। কাউকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণে এবার ক্ষমতা বদল হলেও হলগুলোতে প্রশাসন বদল হয়নি। যারা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে ছিল, তারা এখন ক্যাম্পাসে এসে বিরোধী ছাত্রসংগঠনকে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু হওয়া উচিত, ক্যাম্পাসে সবাই থাকবে।
অনেকেই ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে বলেন। আমি সেই রকম মনে করি না। তবে অবশ্যই সেই রাজনীতি হতে হবে কলুষতামুক্ত। আদর্শগতভাবে মিল থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছাত্রসংগঠনগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া। ওপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। যারা ছাত্র তাদেরই কমিটিতে আসা উচিত। প্রতিবছর সংগঠনগুলোর সম্মেলন হতে হবে।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments