নেপথ্যের বিষয় কিন্তু উপেক্ষার নয় by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
আমার এক অধ্যাপক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার পর আক্ষেপ করে আমাকে বলেছিলেন, আমাদের লেখাপড়া হালে যে কী পর্যায়ে চলে গেছে, বলতেই কষ্ট হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলে-মেয়েদের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থী বলে বোর্ড সনদ দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কষ্টের কারণ হলো, এরা দু-একজন বাদে সবাই হতাশ করেছে।’ অধ্যাপক বন্ধু লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে ইংরেজি ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে জানতে শিক্ষার্থীদের অতি সাধারণ একটি বাংলা বাক্য ইংরেজি করতে বলেছিলেন। এ অভিজ্ঞতা কেবল ওই অধ্যাপকের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরই আছে। এই অবস্থার জন্য আমরা দুষব কাকে? আদতে যেটা ঘটছে তা হলো, শিক্ষার্থীরা গোড়া থেকেই দুর্বল হয়ে গড়ে উঠেছে। দুর্বল, দক্ষতাবিহীন বুনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাদের।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে অনেকেই দায়ী করেন বুনিয়াদি শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষাকে। যদিও প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে এন্তার লেখালেখি হয়েছে দেশে, কিন্তু ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। গলদটা রয়েছে এই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নিয়োজিত শিক্ষাদাতাদের মধ্যে। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী শিক্ষকেরা শিক্ষার এই স্তরের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২.০০ সিজিপিএ পাওয়া নারী-প্রার্থী এবং উচ্চমাধ্যমিকে ২.০০ সিজিপিএ পাওয়া পুরুষ-প্রার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করতে পারবেন। বর্তমান সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষানীতির বাস্তবায়নও শুরু হচ্ছে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি করে পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও এই সুপারিশ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বুনিয়াদি শিক্ষার এই স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। কিন্তু সমস্যা তো অন্যত্র। এবং সে সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। সমস্যা থাকছে শিক্ষকদের যোগ্যতার বিষয় নিয়েও।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো একেবারে ভিত গড়ে ওঠা পর্যায়ের শিক্ষা। বলা হয়ে থাকে, এই শিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থী রিডিং, রাইটিং ও কাউন্টিং শিখবে। শিক্ষার মজবুত প্লাটফরম এভাবেই গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। একজন পাশ্চাত্য পণ্ডিত শিশুর শিক্ষার এই পর্যায়কে তুলনা করেছেন একদলা নরম-কর্দমাক্ত মাটির সঙ্গে। শিশু ওই কাদার মতোই, এই কর্দম অবস্থায় যে রূপ দেওয়া হবে, পরবর্তীকালে শুকনো অবস্থায় সে রূপই লাভ করবে। মাটিকে কর্দম অবস্থায় নানা উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি করে নিতে হয়। কোনো উপাদান মেশাতে ভুলে গেলে শুকনো মাটিতে সেটি মেশানো আর সম্ভব হবে না। চমৎকার এই কথাটি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য।
আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অযত্ন ও অবহেলার শুরু হয়েছে ১৯ শতকের শেষ দশক থেকে। এ সময় থেকে প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধানের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এই শিক্ষাব্যবস্থা। তবে ২০ শতকের শুরু থেকে এর খানিকটা উন্নতি হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৫ ও ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে এবং ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বেশ খানিকটা নজর দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে সংবিধানে ব্যবস্থামতে সরকার কর্তৃক জারি করা জাতীয়করণ ডিক্রির অন্তর্ভুক্ত করা হয় দেশের ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। কিন্তু এখানে অন্য সমস্যা রয়েই গেল। দেশের প্রায় সমানসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় এ সময়ও বেসরকারি থেকে যায়। এই বেসরকারি স্কুলগুলোর অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। যদিও এর কিছু কিছু স্কুল সরকারি অনুদান পেতে থাকে, বাকিরা থেকে যায় বাইরে।
এসব কারণে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পরিমণ্ডলে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত আসেনি। ’৭৪-এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে যে নতুন কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতি হয়েছে ১৯৮১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা আইনে। এ সময়ের সরকার স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করলে সব ভেস্তে যায়।
আগেই উল্লেখ করেছি, সরকার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বৃদ্ধি করে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে এই শিক্ষাকর্মে নিয়োজিত শিক্ষকদের শিক্ষার মান নিয়ে। এযাবৎ যাঁরা প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান করে আসছেন, শিক্ষক হিসেবে তাঁদের যোগ্যতা কতটুকু? এ প্রসঙ্গে আমার শোনা একটি গল্প বলছি:
এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন পাশের গ্রামের হাইস্কুলে যান। এ স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর খানিকটা ভূমিকাও ছিল। তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে কিছু কথা বলবেন। স্কুলের বড় একটি শ্রেণীকক্ষে সে ব্যবস্থা হলো। ভদ্রলোক ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন—এশিয়ার কোন প্রান্তে বাংলাদেশ, গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে কখন থেকে মানববসতির শুরু, কোন কোন রাজবংশ এখানে শাসন করেছে ইত্যাদি। ভদ্রলোক একপর্যায়ে তাঁর কথা বলা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাজার বছর আগে তো এ দেশে বৌদ্ধ পাল রাজারা শাসন করেছেন; তার আগে কারা এ দেশে রাজত্ব করেছেন? ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তর দিতে না পারায় ইতিহাসেরই শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকের কাছে ভদ্রলোক উত্তরটি জানতে চান। প্রধান শিক্ষক সঠিক জবাব তো দিতেই পারেননি, অধিকন্তু এমন একটি উদ্ভট উত্তর দিলেন, যাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের কালানুক্রমটাই সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলতে হয়। এটাই আমাদের বুনিয়াদি পর্যায়ের শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের যোগ্যতার উদাহরণ।
শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন। তবে কাজটি অত্যন্ত দুরূহ, সন্দেহ নেই। দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজ করতে হবে। বুনিয়াদি পর্যায় থেকেই ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। এরাই তো হবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির ফিডার। দেশ পরিচালনার ভবিষ্যৎ কর্মী তো এদের মধ্য থেকেই আসবে। এ সমস্যার সমাধানে পথ একটাই। তা হলো, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সেরা শিক্ষার্থীদের এই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাদান কাজে নিয়োগ করা। উচ্চতর প্রারম্ভিক বেতন স্কেল দিতে হবে তাঁদের। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলে তাঁরা যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেতেন, খানিকটা হলেও তার কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা থাকলে আমার বিশ্বাস, এই পর্যায়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ উদ্যমী যুবক এই মহৎ কাজে নিজেদের জড়াতে চাইবেন। তবে, এসব ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই বড় কথা।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে অনেকেই দায়ী করেন বুনিয়াদি শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষাকে। যদিও প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে এন্তার লেখালেখি হয়েছে দেশে, কিন্তু ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। গলদটা রয়েছে এই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নিয়োজিত শিক্ষাদাতাদের মধ্যে। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী শিক্ষকেরা শিক্ষার এই স্তরের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২.০০ সিজিপিএ পাওয়া নারী-প্রার্থী এবং উচ্চমাধ্যমিকে ২.০০ সিজিপিএ পাওয়া পুরুষ-প্রার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করতে পারবেন। বর্তমান সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষানীতির বাস্তবায়নও শুরু হচ্ছে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি করে পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও এই সুপারিশ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বুনিয়াদি শিক্ষার এই স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। কিন্তু সমস্যা তো অন্যত্র। এবং সে সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। সমস্যা থাকছে শিক্ষকদের যোগ্যতার বিষয় নিয়েও।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো একেবারে ভিত গড়ে ওঠা পর্যায়ের শিক্ষা। বলা হয়ে থাকে, এই শিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থী রিডিং, রাইটিং ও কাউন্টিং শিখবে। শিক্ষার মজবুত প্লাটফরম এভাবেই গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। একজন পাশ্চাত্য পণ্ডিত শিশুর শিক্ষার এই পর্যায়কে তুলনা করেছেন একদলা নরম-কর্দমাক্ত মাটির সঙ্গে। শিশু ওই কাদার মতোই, এই কর্দম অবস্থায় যে রূপ দেওয়া হবে, পরবর্তীকালে শুকনো অবস্থায় সে রূপই লাভ করবে। মাটিকে কর্দম অবস্থায় নানা উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি করে নিতে হয়। কোনো উপাদান মেশাতে ভুলে গেলে শুকনো মাটিতে সেটি মেশানো আর সম্ভব হবে না। চমৎকার এই কথাটি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য।
আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অযত্ন ও অবহেলার শুরু হয়েছে ১৯ শতকের শেষ দশক থেকে। এ সময় থেকে প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধানের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এই শিক্ষাব্যবস্থা। তবে ২০ শতকের শুরু থেকে এর খানিকটা উন্নতি হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৫ ও ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে এবং ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বেশ খানিকটা নজর দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে সংবিধানে ব্যবস্থামতে সরকার কর্তৃক জারি করা জাতীয়করণ ডিক্রির অন্তর্ভুক্ত করা হয় দেশের ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। কিন্তু এখানে অন্য সমস্যা রয়েই গেল। দেশের প্রায় সমানসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় এ সময়ও বেসরকারি থেকে যায়। এই বেসরকারি স্কুলগুলোর অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। যদিও এর কিছু কিছু স্কুল সরকারি অনুদান পেতে থাকে, বাকিরা থেকে যায় বাইরে।
এসব কারণে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পরিমণ্ডলে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত আসেনি। ’৭৪-এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে যে নতুন কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতি হয়েছে ১৯৮১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা আইনে। এ সময়ের সরকার স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করলে সব ভেস্তে যায়।
আগেই উল্লেখ করেছি, সরকার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বৃদ্ধি করে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে এই শিক্ষাকর্মে নিয়োজিত শিক্ষকদের শিক্ষার মান নিয়ে। এযাবৎ যাঁরা প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান করে আসছেন, শিক্ষক হিসেবে তাঁদের যোগ্যতা কতটুকু? এ প্রসঙ্গে আমার শোনা একটি গল্প বলছি:
এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন পাশের গ্রামের হাইস্কুলে যান। এ স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর খানিকটা ভূমিকাও ছিল। তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে কিছু কথা বলবেন। স্কুলের বড় একটি শ্রেণীকক্ষে সে ব্যবস্থা হলো। ভদ্রলোক ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন—এশিয়ার কোন প্রান্তে বাংলাদেশ, গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে কখন থেকে মানববসতির শুরু, কোন কোন রাজবংশ এখানে শাসন করেছে ইত্যাদি। ভদ্রলোক একপর্যায়ে তাঁর কথা বলা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাজার বছর আগে তো এ দেশে বৌদ্ধ পাল রাজারা শাসন করেছেন; তার আগে কারা এ দেশে রাজত্ব করেছেন? ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তর দিতে না পারায় ইতিহাসেরই শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকের কাছে ভদ্রলোক উত্তরটি জানতে চান। প্রধান শিক্ষক সঠিক জবাব তো দিতেই পারেননি, অধিকন্তু এমন একটি উদ্ভট উত্তর দিলেন, যাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের কালানুক্রমটাই সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলতে হয়। এটাই আমাদের বুনিয়াদি পর্যায়ের শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের যোগ্যতার উদাহরণ।
শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন। তবে কাজটি অত্যন্ত দুরূহ, সন্দেহ নেই। দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজ করতে হবে। বুনিয়াদি পর্যায় থেকেই ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। এরাই তো হবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির ফিডার। দেশ পরিচালনার ভবিষ্যৎ কর্মী তো এদের মধ্য থেকেই আসবে। এ সমস্যার সমাধানে পথ একটাই। তা হলো, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সেরা শিক্ষার্থীদের এই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাদান কাজে নিয়োগ করা। উচ্চতর প্রারম্ভিক বেতন স্কেল দিতে হবে তাঁদের। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলে তাঁরা যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেতেন, খানিকটা হলেও তার কাছাকাছি একটা ব্যবস্থা থাকলে আমার বিশ্বাস, এই পর্যায়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ উদ্যমী যুবক এই মহৎ কাজে নিজেদের জড়াতে চাইবেন। তবে, এসব ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই বড় কথা।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
No comments