বিশ্বকাপ ও সোহরাব-রুস্তম প্রসঙ্গ
ম্যারাডোনা কি স্পেন-জার্মানির সেমিফাইনালটা দেখেছিলেন? দেখলে তাঁর নিশ্চয় খুব দুঃখ লাগছিল, কেন তিনি রিকেলমেকে ২৩ জনের দলে রাখেননি। রিকেলমে গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার ছিলেন। কিন্তু এবারের কোচ ম্যারাডোনার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে তিনি দলে থাকতে পারেননি। যদি রিকেলমে থাকতেন আর ভেরনকেও নামাতেন ম্যারাডোনা সেদিন, তাহলে জার্মানির হাতে আর্জেন্টিনার এই ভোগান্তিটা হতো না। অন্যদিকে স্পেনের কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক এমনি এমনি রিয়াল মাদ্রিদের কোচ ছিলেন না বোঝা গেল তাঁর মুনশিয়ানায়। দেল বস্ক জাভি আর ইনিয়েস্তাকে দিয়ে সারাক্ষণ মাঝমাঠ দখলে রাখলেন, ফলে জার্মানি নিচ থেকে মাঝমাঠ হয়ে সামনে আক্রমণে আসতেই পারল না, যে কৌশলটা আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ছিল তাদের প্রধান অস্ত্র। তার পরও দেল বস্ক কৌশলে জার্মানির কোমরটা ভেঙে রেখেছিলেন।
স্পেনের বিরামহীন পাসের সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং পিকাসো এসে বল দিয়ে মাটিতে আলপনা আঁকছেন। কম্পিউটার গ্রাফিক-শিল্পীরা স্পেনের পাসগুলোর ছক বের করলেই বোঝা যাবে, ফুটবল যতটা না পায়ের, তার চেয়ে বেশি মস্তিষ্কের। ভিসেন্তে দেল বস্ক বরাবরই ছিলেন ব্রাজিলের দুঙ্গার বিপরীত অবস্থানে। দুঙ্গা সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে জয়কে বড় করে দেখেছিলেন। এই চিন্তার ট্র্যাজিক পরিণতিও আমরা দেখেছি। আর দেল বস্ক ফাইনালে উঠেও বলছেন, হল্যান্ডের বিপক্ষে স্পেন বনিতো (সুন্দর) ফুটবল খেলবে। এই সৌন্দর্যের জন্যই জার্মানির সঙ্গে খেলায় স্পেন বল অধিকারের কেরামতিতে প্রতিপক্ষকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও একবারও মনে হয়নি যে তারা ভয়ংকর সরীসৃপ ‘কমোডো ড্রাগনের’ মরণকামড় দিয়ে জার্মানির টুঁটি চেপে ধরেছে। বরং মনে হয়েছে, কোনো সাপ যেন মাথার দোলানি দিয়ে শিকারকে সম্মোহিত করে রেখেছে।
তবে স্পেন ফাইনালে যাওয়ায় ম্যারাডোনার নিশ্চয় অত বড় দুঃখ হবে না, যদিও ঈর্ষা হতে পারে। আর্জেন্টিনা তো স্পেনেরই উপনিবেশ ছিল। আর্জেন্টিনার ভাষাও স্প্যানিশ। প্রতি বিশ্বকাপের অনুষ্ঠানে ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলোর সঙ্গে সাবেক উপনিবেশগুলোর মেলা বসে যেন। ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যান্ডের ১-০ গোলের হারের কথা বারবার কেন উঠে আসে? শুধু এ জন্য নয় যে, এটি একটি বিরাট অঘটন ছিল—ফুটবলে আনকোরা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পরাশক্তি ইংল্যান্ডের হার। আরও একটা মর্যাদার ব্যাপার ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র তো এককালে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল। তাদের ভাষাও এক—ইংরেজি। ঔপনিবেশিকতার তাত্ত্বিক আলোচনায় এই সম্পর্কটা হলো পিতা-পুত্রের। ভাষা এক সে কারণে। কিন্তু ভাষা ভিন্ন হলে সম্পর্কটা হয়ে যায় মাস্টার ও নেটিভ—যেটা ইংল্যান্ড-ভারতের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
খেলার মাঠ থেকে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কাগজে-কলমে দূরে থাকলেও ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশিত দেশগুলোর মধ্যে খেলা হলে সম্পর্কটা অনেক সময়ই প্রীতিপূর্ণ না হয়ে সোহরাব-রুস্তমের মতো যুধ্যমান হয়ে পড়ে।
পিতা-পুত্র সোহরাব আর রুস্তম অবশ্য পরস্পরকে না চিনেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছিলেন, কিন্তু ব্রাজিল আর পর্তুগাল যখন গ্রুপ পর্বে খেলতে নামল, দেখলাম যে প্রথম আধঘণ্টায় দুই পক্ষে হয় ১৭টা ফাউল।
দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ইগোর লড়াইটা এমনকি টিভির পর্দায়ও যেন স্পর্শ করা যাচ্ছিল।
পর্তুগালের রাগ, ব্রাজিল তার এককালীন উপনিবেশ হয়ে, তার ভাষায় কথা বলে কেন পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো। আর ব্রাজিলের রাগ, কী করে ইঁদুরের মতো পুঁচকে একটা দেশ হাতির মতো বিশাল ব্রাজিলকে পরাধীন করে রেখেছিল। খেলায় এসব বৈরিতা যে সচেতনভাবে কাজ করে তা নয়, তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা অনেক সময় ব্যাখ্যা করে—কোন দেশ কোন দেশের বিরুদ্ধে কেন আগুয়ান হয়ে খেলে। যেমন ক্রিকেটে অ্যাশেজ। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট লড়াইটা হচ্ছে মর্যাদার লড়াই। কিসের মর্যাদা? পিতার কাছে পুত্রের মর্যাদা, পুত্রের কাছে পিতার মর্যাদা।
এটাও উল্লেখ্য যে ফেরদৌসী রচিত পারস্য মহাকাব্য শাহনামা থেকে যে ইংরেজ কবি ‘সোহরাব ও রুস্তম’ আখ্যানটি অবলম্বন করে ইংরেজিতে চমৎকার একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন, সেই ম্যাথ্যু আর্নল্ড ছিলেন ভিক্টোরিয়া যুগ তথা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রধান কবি। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মধ্য গগনে, কাজেই আর্নল্ডের কাব্যিক মনে দূরপ্রাচ্যের এই ঘটনাটা আবেদন সৃষ্টি করেছিল। কেননা, ব্রিটেনের তরফ থেকে এই প্ররোচনার প্রয়োজন ছিল যে যদি পিতার দেশের প্রতি পুত্রের দেশের আনুগত্য না থাকে, তাহলে সোহরাব-রুস্তমের মতো ট্র্যাজেডি অনিবার্য। বলা বাহুল্য, ম্যাথ্যু আর্নল্ড এবং তাঁর সমকালীন শিক্ষিত ইংরেজরা সাম্র্যাজ্যবাদকে শুভ ও কল্যাণীয় মনে করতেন।
স্পেনের বিরামহীন পাসের সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং পিকাসো এসে বল দিয়ে মাটিতে আলপনা আঁকছেন। কম্পিউটার গ্রাফিক-শিল্পীরা স্পেনের পাসগুলোর ছক বের করলেই বোঝা যাবে, ফুটবল যতটা না পায়ের, তার চেয়ে বেশি মস্তিষ্কের। ভিসেন্তে দেল বস্ক বরাবরই ছিলেন ব্রাজিলের দুঙ্গার বিপরীত অবস্থানে। দুঙ্গা সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে জয়কে বড় করে দেখেছিলেন। এই চিন্তার ট্র্যাজিক পরিণতিও আমরা দেখেছি। আর দেল বস্ক ফাইনালে উঠেও বলছেন, হল্যান্ডের বিপক্ষে স্পেন বনিতো (সুন্দর) ফুটবল খেলবে। এই সৌন্দর্যের জন্যই জার্মানির সঙ্গে খেলায় স্পেন বল অধিকারের কেরামতিতে প্রতিপক্ষকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও একবারও মনে হয়নি যে তারা ভয়ংকর সরীসৃপ ‘কমোডো ড্রাগনের’ মরণকামড় দিয়ে জার্মানির টুঁটি চেপে ধরেছে। বরং মনে হয়েছে, কোনো সাপ যেন মাথার দোলানি দিয়ে শিকারকে সম্মোহিত করে রেখেছে।
তবে স্পেন ফাইনালে যাওয়ায় ম্যারাডোনার নিশ্চয় অত বড় দুঃখ হবে না, যদিও ঈর্ষা হতে পারে। আর্জেন্টিনা তো স্পেনেরই উপনিবেশ ছিল। আর্জেন্টিনার ভাষাও স্প্যানিশ। প্রতি বিশ্বকাপের অনুষ্ঠানে ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলোর সঙ্গে সাবেক উপনিবেশগুলোর মেলা বসে যেন। ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যান্ডের ১-০ গোলের হারের কথা বারবার কেন উঠে আসে? শুধু এ জন্য নয় যে, এটি একটি বিরাট অঘটন ছিল—ফুটবলে আনকোরা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পরাশক্তি ইংল্যান্ডের হার। আরও একটা মর্যাদার ব্যাপার ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র তো এককালে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল। তাদের ভাষাও এক—ইংরেজি। ঔপনিবেশিকতার তাত্ত্বিক আলোচনায় এই সম্পর্কটা হলো পিতা-পুত্রের। ভাষা এক সে কারণে। কিন্তু ভাষা ভিন্ন হলে সম্পর্কটা হয়ে যায় মাস্টার ও নেটিভ—যেটা ইংল্যান্ড-ভারতের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
খেলার মাঠ থেকে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কাগজে-কলমে দূরে থাকলেও ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশিত দেশগুলোর মধ্যে খেলা হলে সম্পর্কটা অনেক সময়ই প্রীতিপূর্ণ না হয়ে সোহরাব-রুস্তমের মতো যুধ্যমান হয়ে পড়ে।
পিতা-পুত্র সোহরাব আর রুস্তম অবশ্য পরস্পরকে না চিনেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছিলেন, কিন্তু ব্রাজিল আর পর্তুগাল যখন গ্রুপ পর্বে খেলতে নামল, দেখলাম যে প্রথম আধঘণ্টায় দুই পক্ষে হয় ১৭টা ফাউল।
দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ইগোর লড়াইটা এমনকি টিভির পর্দায়ও যেন স্পর্শ করা যাচ্ছিল।
পর্তুগালের রাগ, ব্রাজিল তার এককালীন উপনিবেশ হয়ে, তার ভাষায় কথা বলে কেন পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো। আর ব্রাজিলের রাগ, কী করে ইঁদুরের মতো পুঁচকে একটা দেশ হাতির মতো বিশাল ব্রাজিলকে পরাধীন করে রেখেছিল। খেলায় এসব বৈরিতা যে সচেতনভাবে কাজ করে তা নয়, তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা অনেক সময় ব্যাখ্যা করে—কোন দেশ কোন দেশের বিরুদ্ধে কেন আগুয়ান হয়ে খেলে। যেমন ক্রিকেটে অ্যাশেজ। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট লড়াইটা হচ্ছে মর্যাদার লড়াই। কিসের মর্যাদা? পিতার কাছে পুত্রের মর্যাদা, পুত্রের কাছে পিতার মর্যাদা।
এটাও উল্লেখ্য যে ফেরদৌসী রচিত পারস্য মহাকাব্য শাহনামা থেকে যে ইংরেজ কবি ‘সোহরাব ও রুস্তম’ আখ্যানটি অবলম্বন করে ইংরেজিতে চমৎকার একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন, সেই ম্যাথ্যু আর্নল্ড ছিলেন ভিক্টোরিয়া যুগ তথা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রধান কবি। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মধ্য গগনে, কাজেই আর্নল্ডের কাব্যিক মনে দূরপ্রাচ্যের এই ঘটনাটা আবেদন সৃষ্টি করেছিল। কেননা, ব্রিটেনের তরফ থেকে এই প্ররোচনার প্রয়োজন ছিল যে যদি পিতার দেশের প্রতি পুত্রের দেশের আনুগত্য না থাকে, তাহলে সোহরাব-রুস্তমের মতো ট্র্যাজেডি অনিবার্য। বলা বাহুল্য, ম্যাথ্যু আর্নল্ড এবং তাঁর সমকালীন শিক্ষিত ইংরেজরা সাম্র্যাজ্যবাদকে শুভ ও কল্যাণীয় মনে করতেন।
No comments