১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই by পাভেল পার্থ
বনবিভাগ, গণমাধ্যম ও পরিবেশকর্মীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই বৃক্ষ-প্রাণ হত্যা থামানোই যাচ্ছে না। সম্প্র্রতি আবারও ভোলার চর কুকরি-মুকরি নয়া ম্যানগ্রোভ বনকে খুন করে পাকা সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর।
৩ জুলাই প্রথম আলো জানিয়েছে, কুকরি-মুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রথমে বন কেটে সড়ক বানানো যাবে না বলে চিঠি দিলে পরবর্তী সময় গত ১৬ মে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন এই সমুদ্র উপকূলীয় দ্বীপ চরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রশ্নহীন প্রাণদণ্ডের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে ১৫ হাজার কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি। মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কীভাবে ১৫ হাজার নিরপরাধ জানের বুকে করাত চালাতে বলে? এসব সমুদ্র উপকূলীয় জোয়ারভাটার বৃক্ষপ্রজাতি ও বনভূমি বাঁচিয়ে রাখছে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। এমনকি সমকালের সিডর ও আইলার মতো আঘাত ও জখম সবচেয়ে প্রথম আগলে দাঁড়িয়েছে এই উপকূলীয় বনাঞ্চল। আর আজ মাত্র ১৫ মিনিট বাঁচাতে একটামাত্র পাকা সড়কের জন্য এই বীরবৃক্ষদের ওপর হামলে পড়ব?
এটি হচ্ছে আমাদের তথাকথিত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবেশীয় দর্শনের সমস্যা। যেখানে গাছকে কেবল ‘কাঠ’ হিসেবে এর ঘনফুট মাপা হয়। যেখানে একটি গাছ কেটে দুটি গাছ লাগানোর কথা বলে শিশু বয়সের প্রাকৃতিক বনভূমিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ আমরা জলবায়ু বিপর্যস্ত এ সময়ে দেশ-বিদেশে প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার মায়াকান্নায় কার্পেট ও গদি ভাসিয়ে দিই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উত্তরের ধনী দেশের সঙ্গে জলবায়ু-ফয়সালা করার আগে নিজের দেশটার কথাটি তো ভাবতে হবে। জলবায়ুবিপন্ন দক্ষিণের এক গরিব দেশ হিসেবে প্রাণপরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রতিবেশের প্রতি আমরা নিজেরা কতটা ন্যায়পরায়ণ তা যাচাই করেই না বুক ফুলিয়ে দায়ী ও অপরাধী ধনী দেশের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব।
কোনোভাবেই চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার কি ১৫টি গাছ কেটেও সড়ক নির্মাণ করা যাবে না। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন ও আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (সিবিডি ১৯৯২) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বন কেটে সড়ক নির্মাণ না করে বিকল্প পথগুলো যাচাই করে দেখতে হবে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, টাঙ্গাইলের মধুপুর জাতীয় উদ্যান ও গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের ফলে এসব বনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে গেছে। প্রাকৃতিক বনভূমির ভেতর দিয়ে কোনো রকম টানেলপথ না রেখে প্রচলিত পদ্ধতির পাকা সড়ক সরীসৃপ ও উভয়চর প্রাণীদের চলাচলে বিঘ্ন তৈরি করে। এতে একটি প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের খাদ্যশৃঙ্খল ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে থাকে, যা আর পরে বন হিসেবে বিকশিত হতে পারে না। পর্যায়ক্রমে তা বনভূমির কঙ্কাল ও পরিদর্শন বাগানে পরিণত হতে বাধ্য হয়।
আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশ ভূগোলে গর্ব করার মতো প্রাণের বৈচিত্র্য এখনো টিকে আছে। এখানে এখনো কাঁঠাল ও আখের মতো বড় ফলের পাশাপাশি মুড়মুড়ি ও করমচার মতো এই এত্তটুকুন খাওয়ার ফলও আছে। এখনো পৃথিবীর গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল। আমাদের দেশের মতো বাঁশ ও কচুর প্রজাতিবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে? তালিপাম আর বোস্তামি কাছিম দুনিয়ার আর কোথাও নেই। একক আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আমাদের সুন্দরবন। এসব প্রজাতির বৈচিত্র্য ও বিকাশের সঙ্গে দেশের ১৫ কোটি মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষসহ দেশের অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য মিলেই বাংলাদেশ ভূগোলের ঐতিহাসিক সংসার। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত বুঝে না বুঝে বা বুঝতে না চেয়ে এই সংসার ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছি।
ভাঙা সংসারের কী দুঃখ, যাতনা আর আহাজারি তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। চকরিয়ার ম্যানগ্রোভ প্যারাবন বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবন বাদে ভোলা, নোয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও বাগেরহাটের কিছু এলাকায় পর্যায়ক্রমিকভাবেও গড়ে উঠছে শিশু ম্যানগ্রোভ বনভূমি। উপকূলীয় বেষ্টনী ও বৃক্ষায়ন কিছু প্রকল্পও এখানে নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ রক্ষার জন্য দরকার শক্ত-সামর্থ্য জোয়ান ম্যানগ্রোভ উপকূলীয় বনাঞ্চল। ভোলার চর কুকরি-মুকরির শিশু ম্যানগ্রোভ বনসহ উপকূলের সকল শিশু বনভূমি রক্ষা ও এর নিজস্ব বিকাশ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কুকরি-মুকরি চরে এখন বনভূমির পরিমাণ আট হাজার ৫৬৫ হেক্টরের ভেতর ২১৭ হেক্টর বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। হরিণ, বানর, বনবিড়াল, নানা জাতের পাখি, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সাপ, শেয়াল, বনমোরগ, উদবিড়াল, মহিষ এরা টিকে আছে এই বনভূমির ওপর।
সরকারি হিসাবে ১৫ হাজার হলেও পাকা সড়ক নির্মাণে মারা পড়বে আরও শত-সহস্র শিশু চারা ও অঙ্কুরিত বৃক্ষপ্রাণ। সড়ক নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বনের নিজস্ব প্রতিবেশীয় ব্যবস্থায়। পাকা সড়ক নির্মাণ একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আমাদের বিশ্বাসের জন্য প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও সমীক্ষা করা হয়েছে নিরপেক্ষভাবেই। পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন কি ১৫ হাজার গাছ কেটে পাকা সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবনা রেখেছে? যদি না হয় তবে এই পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদনই ১৫ হাজার গাছকে আইনগতভাবে বাঁচাতে নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে আশা করি।
ভারতে গাছ বাঁচানোর জন্য রাজার তলোয়ারের তলে জান দিয়েছিল মানুষ। সেই থেকে গাছ ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন চিপকো আন্দোলন হিসেবে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যায়। নেত্রকোনার মেনকিফান্দা পাহাড়ের শাল বৃক্ষ বাঁচাতে অজিত রিছিল গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্বার আন্দোলন। বন বিভাগ শালগাছ কেটে সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া ও ম্যাঞ্জিয়াম গাছ লাগাতে চেয়েছিল। মধুপুর শালবনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান বিপন্ন করে ‘ইকোপার্ক’-এর নামে বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র গড়তে চেয়েছিল রাষ্ট্র। মধুপুর শালবন বাঁচাতে শহীদ হয়েছেন পীরেন স্নাল। ঢাকার নাগরিক সমাজ ওসমানী উদ্যানের ৩৩ হাজার গাছ কাটার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের নাহার চা-বাগানের চার হাজার গাছ হত্যার বিরুদ্ধে খাসিয়া আদিবাসীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। আমরা রাষ্ট্রের কাছে চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার বৃক্ষের প্রাণভিক্ষা চাইছি। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ বৃক্ষ ও বনের মৃত্যুদণ্ডের ঘোরবিরোধী। রাষ্ট্রকে জনগণের মন ও জনদর্শন বুঝতে হবে। চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের নির্দয় প্রাণদণ্ড আজকেই বাতিল করা হোক। আমরা রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবেশীয় ন্যায়পরায়ণতাই আশা করি বারবার।
পাভেল পার্থ: প্রাণ ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
৩ জুলাই প্রথম আলো জানিয়েছে, কুকরি-মুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রথমে বন কেটে সড়ক বানানো যাবে না বলে চিঠি দিলে পরবর্তী সময় গত ১৬ মে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন এই সমুদ্র উপকূলীয় দ্বীপ চরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রশ্নহীন প্রাণদণ্ডের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে ১৫ হাজার কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি। মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কীভাবে ১৫ হাজার নিরপরাধ জানের বুকে করাত চালাতে বলে? এসব সমুদ্র উপকূলীয় জোয়ারভাটার বৃক্ষপ্রজাতি ও বনভূমি বাঁচিয়ে রাখছে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। এমনকি সমকালের সিডর ও আইলার মতো আঘাত ও জখম সবচেয়ে প্রথম আগলে দাঁড়িয়েছে এই উপকূলীয় বনাঞ্চল। আর আজ মাত্র ১৫ মিনিট বাঁচাতে একটামাত্র পাকা সড়কের জন্য এই বীরবৃক্ষদের ওপর হামলে পড়ব?
এটি হচ্ছে আমাদের তথাকথিত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবেশীয় দর্শনের সমস্যা। যেখানে গাছকে কেবল ‘কাঠ’ হিসেবে এর ঘনফুট মাপা হয়। যেখানে একটি গাছ কেটে দুটি গাছ লাগানোর কথা বলে শিশু বয়সের প্রাকৃতিক বনভূমিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অথচ আমরা জলবায়ু বিপর্যস্ত এ সময়ে দেশ-বিদেশে প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার মায়াকান্নায় কার্পেট ও গদি ভাসিয়ে দিই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উত্তরের ধনী দেশের সঙ্গে জলবায়ু-ফয়সালা করার আগে নিজের দেশটার কথাটি তো ভাবতে হবে। জলবায়ুবিপন্ন দক্ষিণের এক গরিব দেশ হিসেবে প্রাণপরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রতিবেশের প্রতি আমরা নিজেরা কতটা ন্যায়পরায়ণ তা যাচাই করেই না বুক ফুলিয়ে দায়ী ও অপরাধী ধনী দেশের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব।
কোনোভাবেই চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার কি ১৫টি গাছ কেটেও সড়ক নির্মাণ করা যাবে না। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন ও আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (সিবিডি ১৯৯২) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বন কেটে সড়ক নির্মাণ না করে বিকল্প পথগুলো যাচাই করে দেখতে হবে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, টাঙ্গাইলের মধুপুর জাতীয় উদ্যান ও গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের ফলে এসব বনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে গেছে। প্রাকৃতিক বনভূমির ভেতর দিয়ে কোনো রকম টানেলপথ না রেখে প্রচলিত পদ্ধতির পাকা সড়ক সরীসৃপ ও উভয়চর প্রাণীদের চলাচলে বিঘ্ন তৈরি করে। এতে একটি প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের খাদ্যশৃঙ্খল ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে থাকে, যা আর পরে বন হিসেবে বিকশিত হতে পারে না। পর্যায়ক্রমে তা বনভূমির কঙ্কাল ও পরিদর্শন বাগানে পরিণত হতে বাধ্য হয়।
আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশ ভূগোলে গর্ব করার মতো প্রাণের বৈচিত্র্য এখনো টিকে আছে। এখানে এখনো কাঁঠাল ও আখের মতো বড় ফলের পাশাপাশি মুড়মুড়ি ও করমচার মতো এই এত্তটুকুন খাওয়ার ফলও আছে। এখনো পৃথিবীর গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল। আমাদের দেশের মতো বাঁশ ও কচুর প্রজাতিবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে? তালিপাম আর বোস্তামি কাছিম দুনিয়ার আর কোথাও নেই। একক আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আমাদের সুন্দরবন। এসব প্রজাতির বৈচিত্র্য ও বিকাশের সঙ্গে দেশের ১৫ কোটি মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষসহ দেশের অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য মিলেই বাংলাদেশ ভূগোলের ঐতিহাসিক সংসার। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত বুঝে না বুঝে বা বুঝতে না চেয়ে এই সংসার ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছি।
ভাঙা সংসারের কী দুঃখ, যাতনা আর আহাজারি তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। চকরিয়ার ম্যানগ্রোভ প্যারাবন বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবন বাদে ভোলা, নোয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও বাগেরহাটের কিছু এলাকায় পর্যায়ক্রমিকভাবেও গড়ে উঠছে শিশু ম্যানগ্রোভ বনভূমি। উপকূলীয় বেষ্টনী ও বৃক্ষায়ন কিছু প্রকল্পও এখানে নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ রক্ষার জন্য দরকার শক্ত-সামর্থ্য জোয়ান ম্যানগ্রোভ উপকূলীয় বনাঞ্চল। ভোলার চর কুকরি-মুকরির শিশু ম্যানগ্রোভ বনসহ উপকূলের সকল শিশু বনভূমি রক্ষা ও এর নিজস্ব বিকাশ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কুকরি-মুকরি চরে এখন বনভূমির পরিমাণ আট হাজার ৫৬৫ হেক্টরের ভেতর ২১৭ হেক্টর বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। হরিণ, বানর, বনবিড়াল, নানা জাতের পাখি, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সাপ, শেয়াল, বনমোরগ, উদবিড়াল, মহিষ এরা টিকে আছে এই বনভূমির ওপর।
সরকারি হিসাবে ১৫ হাজার হলেও পাকা সড়ক নির্মাণে মারা পড়বে আরও শত-সহস্র শিশু চারা ও অঙ্কুরিত বৃক্ষপ্রাণ। সড়ক নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বনের নিজস্ব প্রতিবেশীয় ব্যবস্থায়। পাকা সড়ক নির্মাণ একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আমাদের বিশ্বাসের জন্য প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও সমীক্ষা করা হয়েছে নিরপেক্ষভাবেই। পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন কি ১৫ হাজার গাছ কেটে পাকা সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবনা রেখেছে? যদি না হয় তবে এই পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদনই ১৫ হাজার গাছকে আইনগতভাবে বাঁচাতে নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে আশা করি।
ভারতে গাছ বাঁচানোর জন্য রাজার তলোয়ারের তলে জান দিয়েছিল মানুষ। সেই থেকে গাছ ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন চিপকো আন্দোলন হিসেবে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যায়। নেত্রকোনার মেনকিফান্দা পাহাড়ের শাল বৃক্ষ বাঁচাতে অজিত রিছিল গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্বার আন্দোলন। বন বিভাগ শালগাছ কেটে সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া ও ম্যাঞ্জিয়াম গাছ লাগাতে চেয়েছিল। মধুপুর শালবনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান বিপন্ন করে ‘ইকোপার্ক’-এর নামে বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র গড়তে চেয়েছিল রাষ্ট্র। মধুপুর শালবন বাঁচাতে শহীদ হয়েছেন পীরেন স্নাল। ঢাকার নাগরিক সমাজ ওসমানী উদ্যানের ৩৩ হাজার গাছ কাটার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের নাহার চা-বাগানের চার হাজার গাছ হত্যার বিরুদ্ধে খাসিয়া আদিবাসীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। আমরা রাষ্ট্রের কাছে চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার বৃক্ষের প্রাণভিক্ষা চাইছি। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ বৃক্ষ ও বনের মৃত্যুদণ্ডের ঘোরবিরোধী। রাষ্ট্রকে জনগণের মন ও জনদর্শন বুঝতে হবে। চর কুকরি-মুকরি বনের ১৫ হাজার ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের নির্দয় প্রাণদণ্ড আজকেই বাতিল করা হোক। আমরা রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবেশীয় ন্যায়পরায়ণতাই আশা করি বারবার।
পাভেল পার্থ: প্রাণ ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
No comments