‘ডোন্ট ক্রাই ফর মি আর্জেন্টিনা’ by মোহীত উল আলম
ওপরের শিরোনামের বিখ্যাত গানটি প্রথমে গীত হয় ১৯৭৮ সালে এভিটা নামের একটি মিউজিক্যালে (সংগীতপ্রধান চলচ্চিত্র)। পরে ১৯৯৬ সালে সুবিখ্যাত পপগায়িকা ম্যাডোনা এভিটার আরেকটি সংস্করণে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে এবং গানটি গেয়ে তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলেন।
এভিটা চলচ্চিত্রটি ছিল আর্জেন্টিনার সাবেক ফার্স্ট লেডি প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের স্ত্রী ইভা পেরনের (১৯১৯-১৯৫২) ওপর। ক্ষণজন্মা এই মহিলা আর্জেন্টাইনদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু মাত্র ৩৩ বছরে তিনি ক্যানসারে মারা যান। যা হোক, নতুন সংস্করণে ম্যাডোনার গাওয়া গানটির কথা (টিম রাইস) ও সুর (অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার) খুবই মর্মস্পর্শী। গানটির মূল কথা হলো: আর্জেন্টিনার লোকেরা যেন তাঁর (ইভা) জন্য না কাঁদে। নিজের উৎক্ষিপ্ত জীবনযাপন সত্ত্বেও তিনি কখনো আর্জেন্টিনার প্রতি তাঁর দায়িত্ব ভোলেননি। আর্জেন্টিনা যেন তাঁকে দূরে সরিয়ে না রাখে।
ম্যারাডোনার জন্য এই গানই যেন গাওয়া যায়। হ্যাঁ, জার্মানি-আর্জেন্টিনা খেলার এই পরিণতি সবচেয়ে আশাবাদী জার্মান খেলোয়াড় বালাকের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, জার্মানি জিতবে ৩-১ গোলে। সেখানে হয়ে গেল ৪-০।
একটা প্রতিক্রিয়া হয় অতিশোকে পাথর হয়ে যাওয়া। আরেকটা প্রতিক্রিয়া হয় শোক ভুলে হাসার চেষ্টা করা। মনটা তো হালকা করতে হবে। যেমন জাপান করেছে। প্যারাগুয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে তাদের খেলোয়াড় কোমানো গোল মিস করেন। ওই কারণে জাপানও বেরিয়ে যায় বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু কোমানোর জেলা (প্রিফেকচার) কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছে, তারা একটি সম্মাননা মেডেল দেবে জাপানের ফুটবলে তাঁর অবদানের জন্য। এ ধরনের সিদ্ধান্তের অসুবিধা হলো যে, কোথায় যেন একটা মশকরা হচ্ছে—এই ভাবটা থেকেই যায়। অথচ এদিকে ব্রাজিলের সাবেক তারকা রোনালদো হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তাঁর দেশের খেলোয়াড় ফিলিপ ডি মেলোকে, তিনি যেন বাড়ি ফেরার চিন্তা না করেন। কারণ জার্মানির বিরুদ্ধে মেলো শুধু আত্মঘাতী প্রথম গোলটিই করেননি, লাল কার্ডও খেয়েছিলেন।
কোচ ম্যারাডোনার ব্যর্থতা সেই পুরোনো প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এল। ভালো খেলোয়াড়েরা কি ভালো কোচ হতে পারেন না? আমাদের শিক্ষকতার পেশায় দেখেছি প্রশ্নটি অমীমাংসিত। বহু ভালো ছাত্র যেমন ভালো শিক্ষক হতে পারেননি, তেমনি বহু ভালো ছাত্র ভালো শিক্ষক হতেও পেরেছেন। তবে খেলাধুলায় মনে হয় উত্তরটা মূলত ‘না’। ক্রিকেটে তো দেখিই না যে একজন ভালো ক্রিকেটার ভালো কোচ হয়েছেন, যদিও ফুটবলে কেউ কেউ ভালো কোচ হয়েছেন, যেমন—জার্মানির বেকেনবাওয়ার। জার্মানির বর্তমান কোচ জোয়াকিম লো ছিলেন নামকরা ফুটবলার-কাম-কোচ জুর্গেন ক্লিন্সম্যানের সহকারী গত বিশ্বকাপে। খেলোয়াড় হিসেবে লো-র কোনো নাম ছিল না। অথচ তিনি একদল তরুণকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার মতো দলের বিপক্ষে চার চারটি করে গোল আদায় করে নিয়েছেন। না, ক্লোসা, পোডোলস্কি, মুলারের জার্মানি মোটেও লোথার ম্যাথাউসের ‘জার্মান ট্যাংক’ কায়দায় খেলেনি; খেলেছে ইউরোপের গতিময় ফুটবলের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার ব্যক্তিগত নৈপুণ্য প্রদর্শনের ধারা মিশ্রিত করে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্লোসা-মুলার-পোডোলস্কি মিলে যে দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন, সেই শূন্য-সম্ভাবনা থেকে সৃষ্টি করা গোলটির দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসে। দক্ষতা ও সৃজনশীলতার এমন সম্মিলন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন জোয়াকিম লো! টিভি ভাষ্যকার একবার বলেছিলেন, জার্মানি নাকি ১৯৯০ সালের শুরুতে নতুন প্রজন্ম থেকে খেলোয়াড় তৈরি করার একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেটিই এখন ফল দিতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে মেসিদের বল ধরে রাখা এবং অগুনতি পাসের বাহুল্য দেখে যেমন এক যুগ আগের আর্জেন্টিনার ওর্তেগা-আইমারের নিষ্ফলা পাসের ধাঁধা সৃষ্টির কথা মনে হচ্ছিল, তেমনি মনে হচ্ছিল যেন মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা সে খেলাটাই খেলল, যখন গাছের জন্য বন দেখা যায় না। সাহিত্যতত্ত্বের ভাষায় বলতে হয়, আর্জেন্টিনার হিজিবিজি পাসের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও তাত্ত্বিক লুই আলথুসারের গদ্য পড়ছি—এমন কঠিন, এগোনো যাচ্ছে না। একবার মাঠের মাঝখানে মেসি, মারিয়া ও ওতামেন্দি মিলে ২০টি পাস খেললেন। খামাখা। বলা হয়ে থাকে, মোট চার পাস থেকে গোল হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। আর চার থেকে পাঁচ পাসে গেলে গোল হওয়ার সম্ভাবনা নেমে আসে ১৯ শতাংশে।
কী দেখলাম! ‘মেসিডোনা’ যৌগিক শব্দটা শেষ পর্যন্ত টিকল না। লিওনেল মেসি ওয়েন রুনির মতো একজন ব্যর্থ ফুটবলার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইলেন, আর ম্যারাডোনা রয়ে গেলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে। আবারও প্রমাণিত হলো, কেউ-ই আসলে ম্যারাডোনার মতো খেলতে পারেন না।
এভিটা চলচ্চিত্রটি ছিল আর্জেন্টিনার সাবেক ফার্স্ট লেডি প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের স্ত্রী ইভা পেরনের (১৯১৯-১৯৫২) ওপর। ক্ষণজন্মা এই মহিলা আর্জেন্টাইনদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু মাত্র ৩৩ বছরে তিনি ক্যানসারে মারা যান। যা হোক, নতুন সংস্করণে ম্যাডোনার গাওয়া গানটির কথা (টিম রাইস) ও সুর (অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার) খুবই মর্মস্পর্শী। গানটির মূল কথা হলো: আর্জেন্টিনার লোকেরা যেন তাঁর (ইভা) জন্য না কাঁদে। নিজের উৎক্ষিপ্ত জীবনযাপন সত্ত্বেও তিনি কখনো আর্জেন্টিনার প্রতি তাঁর দায়িত্ব ভোলেননি। আর্জেন্টিনা যেন তাঁকে দূরে সরিয়ে না রাখে।
ম্যারাডোনার জন্য এই গানই যেন গাওয়া যায়। হ্যাঁ, জার্মানি-আর্জেন্টিনা খেলার এই পরিণতি সবচেয়ে আশাবাদী জার্মান খেলোয়াড় বালাকের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, জার্মানি জিতবে ৩-১ গোলে। সেখানে হয়ে গেল ৪-০।
একটা প্রতিক্রিয়া হয় অতিশোকে পাথর হয়ে যাওয়া। আরেকটা প্রতিক্রিয়া হয় শোক ভুলে হাসার চেষ্টা করা। মনটা তো হালকা করতে হবে। যেমন জাপান করেছে। প্যারাগুয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে তাদের খেলোয়াড় কোমানো গোল মিস করেন। ওই কারণে জাপানও বেরিয়ে যায় বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু কোমানোর জেলা (প্রিফেকচার) কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছে, তারা একটি সম্মাননা মেডেল দেবে জাপানের ফুটবলে তাঁর অবদানের জন্য। এ ধরনের সিদ্ধান্তের অসুবিধা হলো যে, কোথায় যেন একটা মশকরা হচ্ছে—এই ভাবটা থেকেই যায়। অথচ এদিকে ব্রাজিলের সাবেক তারকা রোনালদো হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তাঁর দেশের খেলোয়াড় ফিলিপ ডি মেলোকে, তিনি যেন বাড়ি ফেরার চিন্তা না করেন। কারণ জার্মানির বিরুদ্ধে মেলো শুধু আত্মঘাতী প্রথম গোলটিই করেননি, লাল কার্ডও খেয়েছিলেন।
কোচ ম্যারাডোনার ব্যর্থতা সেই পুরোনো প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এল। ভালো খেলোয়াড়েরা কি ভালো কোচ হতে পারেন না? আমাদের শিক্ষকতার পেশায় দেখেছি প্রশ্নটি অমীমাংসিত। বহু ভালো ছাত্র যেমন ভালো শিক্ষক হতে পারেননি, তেমনি বহু ভালো ছাত্র ভালো শিক্ষক হতেও পেরেছেন। তবে খেলাধুলায় মনে হয় উত্তরটা মূলত ‘না’। ক্রিকেটে তো দেখিই না যে একজন ভালো ক্রিকেটার ভালো কোচ হয়েছেন, যদিও ফুটবলে কেউ কেউ ভালো কোচ হয়েছেন, যেমন—জার্মানির বেকেনবাওয়ার। জার্মানির বর্তমান কোচ জোয়াকিম লো ছিলেন নামকরা ফুটবলার-কাম-কোচ জুর্গেন ক্লিন্সম্যানের সহকারী গত বিশ্বকাপে। খেলোয়াড় হিসেবে লো-র কোনো নাম ছিল না। অথচ তিনি একদল তরুণকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার মতো দলের বিপক্ষে চার চারটি করে গোল আদায় করে নিয়েছেন। না, ক্লোসা, পোডোলস্কি, মুলারের জার্মানি মোটেও লোথার ম্যাথাউসের ‘জার্মান ট্যাংক’ কায়দায় খেলেনি; খেলেছে ইউরোপের গতিময় ফুটবলের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার ব্যক্তিগত নৈপুণ্য প্রদর্শনের ধারা মিশ্রিত করে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্লোসা-মুলার-পোডোলস্কি মিলে যে দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন, সেই শূন্য-সম্ভাবনা থেকে সৃষ্টি করা গোলটির দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসে। দক্ষতা ও সৃজনশীলতার এমন সম্মিলন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন জোয়াকিম লো! টিভি ভাষ্যকার একবার বলেছিলেন, জার্মানি নাকি ১৯৯০ সালের শুরুতে নতুন প্রজন্ম থেকে খেলোয়াড় তৈরি করার একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেটিই এখন ফল দিতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে মেসিদের বল ধরে রাখা এবং অগুনতি পাসের বাহুল্য দেখে যেমন এক যুগ আগের আর্জেন্টিনার ওর্তেগা-আইমারের নিষ্ফলা পাসের ধাঁধা সৃষ্টির কথা মনে হচ্ছিল, তেমনি মনে হচ্ছিল যেন মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা সে খেলাটাই খেলল, যখন গাছের জন্য বন দেখা যায় না। সাহিত্যতত্ত্বের ভাষায় বলতে হয়, আর্জেন্টিনার হিজিবিজি পাসের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও তাত্ত্বিক লুই আলথুসারের গদ্য পড়ছি—এমন কঠিন, এগোনো যাচ্ছে না। একবার মাঠের মাঝখানে মেসি, মারিয়া ও ওতামেন্দি মিলে ২০টি পাস খেললেন। খামাখা। বলা হয়ে থাকে, মোট চার পাস থেকে গোল হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। আর চার থেকে পাঁচ পাসে গেলে গোল হওয়ার সম্ভাবনা নেমে আসে ১৯ শতাংশে।
কী দেখলাম! ‘মেসিডোনা’ যৌগিক শব্দটা শেষ পর্যন্ত টিকল না। লিওনেল মেসি ওয়েন রুনির মতো একজন ব্যর্থ ফুটবলার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইলেন, আর ম্যারাডোনা রয়ে গেলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে। আবারও প্রমাণিত হলো, কেউ-ই আসলে ম্যারাডোনার মতো খেলতে পারেন না।
No comments