সাগরপাড়ের খুদে গানওয়ালা by বিপাশা চক্রবর্তী
কক্সবাজারে পা দিতেই উত্তাপ কামড় বসাল গায়ে। তখন মধ্যদুপুর। ঘোরাঘুরির জন্য বিকেল তো আছেই। সুদূর ঢাকা থেকে সমুদ্র টেনে এনেছে এত দূর। এখন হাতের কাছেই সাগর, নিরন্তর ঢেউয়ের গর্জন, সৈকতের পবন (বিলাতি ঝাউ) ঝাউয়ের বাগান আর ধু ধু বালিয়াড়ি। দেখতে দেখতে বিকেল নেমে এল। কিন্তু রোদের তেজ কমল না। আমরা, মানে আমি আর আমার সহকর্মী সৈকতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। বিচে যাওয়ার জন্য কাঠের পাটাতন বিছানো রাস্তাটার মুখে আসতেই দেখি, ১০-১২ বছরের দুটো ছেলে কেমন অস্থির মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখতে পাইনি, এমন ভান করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। ওরাও আমাদের পিছু নিল। কিন্তু কেন?
ওদের হাতে ক্যামেরা নেই যে ছবি তুলবে বা বিক্রি করার মতো কোনো জিনিসপত্রও দেখছি না। তাহলে কি সাহায্য চাইবে? ভাব দেখে তো সে রকমও মনে হচ্ছে না। তাহলে? হঠাৎ একজন বলে উঠল, ‘গান শুনবেন আপা?’
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গান? কী গান? এখানে কোথায় গান?’
একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করে ফেললাম, দুজনের একজন বলল, ‘আপা, আমরা গান শুনাব, আমরা গান গাইতে পারি তো!’
ওদের ভাবটা এমনই যে আমাদের গান শুনিয়েই ছাড়বে। আমার সহকর্মী খানিকটা নিরস্ত করার জন্য বলল, ‘দেখ, আমরা কিন্তু সঙ্গে টাকাপয়সা আনিনি, হোটেলে রেখে এসেছি।’ কিন্তু ওরা দমার পাত্র নয়।
বলল, ‘স্যার, টাকা লাগব না। আপা আমগো বইনের মতো। আপার জন্য একটা গান ফ্রি—এই বলে ওরা দুজন একসঙ্গে গান শুরু করে দিল, ‘কতো রঙ্গ জানো রে মানুষ...’।
গানটা কি দ্বৈত সংগীত, কোরাস, না রিমিক্স? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি আর আমাদের পিছু পিছু খুদে দুই শিল্পী গান গাইতে গাইতে আসছে। একজন গাইছে আর একজন একই কলি একটু পরে ধরছে, তাও আবার চিকন মিনমিনে গলায়। অদ্ভুত কম্বিনেশন। সেদিন সৈকতে আমরা খুব ঘুরলাম, ছবি তুলাম, বিচ-বাইক চালালাম। আশ্চর্যের বিষয়, এদের একজন এসএলআর ক্যামেরাও চালাতে জানে। নাম কাইয়ুম। আমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দিল। এই সুযোগে আমিও কাইয়ুমের সঙ্গে একটি ছবি তুললাম। ওরা টাকার বদলে আমাদের সঙ্গে বিচ-বাইকে চড়ে ঘুরল। আমরা হোটেলের সামনের বিচ থেকে একেবারে কলাতলি বিচের শেষ মাথা পর্যন্ত বাইক চালিয়ে গেলাম। এ সময়টা সৈকতে পর্যটকদের চাপ কম থাকে। বাতাস আর ঢেউয়ের গর্জনটা একটু বেশিই।
দেখতে দেখতে কাইয়ুমদের সঙ্গে আরও কয়েকজন গানওয়ালা এসে জুটল। ওরা ওদের কাজ ফেলে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটাকেই বেশি পছন্দ করল। কাইয়ুম, রফিক, শহীদ হোসেন—ওরা সৈকতে বেড়াতে আসা লোকজনকে গান শোনায়। এ থেকে ওদের ভালোই আয় হয়। কথা বলে জানলাম, প্রথম শুরুটা করেছিল জসীম নামের এক গানওয়ালা। তারও বয়স বেশি নয়। সে-ই এখন কাইয়ুমদের ট্রেনিং দিচ্ছে। তার দেওয়া ট্রেনিং যে বৃথা যায়নি, তা ওদের গান শুনলেই বোঝা যায়। কাইয়ুম জানাল, এমনও হয়েছে, মাত্র তিন-চার দিন গান গেয়ে তেরো-চৌদ্দ শ টাকা আয় করেছে। আবার এমনও হয়েছে, দিনে ৫০ টাকাও পায়নি। এখন সে রকমই অবস্থা। কারণ গরমে সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটক খুব বেশি আসে না। বেশি আয় হয় বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিদেশিদের কী বলে গান শোনাও।’
গানওয়ালা শহীদ হোসেন বলল, ‘বিদেশিদের কাছে গিয়ে বলি, হ্যালো স্যার, সিং এ সং!’
আমি তো হেসেই খুন! মনে মনে ভাবলাম, তবুও তো ইংরেজি বলার চেষ্টা করছে। আমার সহকর্মী তখন বেশ সময় নিয়ে খুব ধৈর্য ধরে শেখালেন, বিদেশি পর্যটক এলে কী বলে গান শোনার জন্য অনুরোধ জানাতে হবে। জীবিকার প্রয়োজনেই কিনা জানি না, ওরাও বেশ আগ্রহের সঙ্গে শিখল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে রপ্ত করার চেষ্টা করল, ‘হ্যালো স্যার, ডু ইউ ওয়ান্ট টু লিসেন আ সং? আই ক্যান সিং আ সং ফর ইউ!’
জিজ্ঞেস করলাম ‘স্কুলে যাও?’
কাইয়ুম জানাল, সে নিয়মিত স্কুলে যায়, কক্সবাজারের মধ্যপাড়ায় তার বাসা। স্থানীয় একটি এনজিও পরিচালিত ‘লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন’ স্কুলে সে ক্লাস টুতে পড়ে। বাকিরা তেমন কেউ স্কুলে যায় না। গান গেয়ে যে টাকা পাও, সে টাকা কী করো? ওরা বলল, ‘মার কাছে নিয়া দিই।’ আমাদের জটলা দেখে একফাঁকে বেশ কয়েকজন ফেরিওয়ালা ঢুঁ মেরে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি ঝিনুকের মালা পছন্দ হলো, কিন্তু ফেরিওয়ালা দাম হাঁকল ৪০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম সাহায্য করল, সে আমাদের কানে কানে বলে দিল, কিছুতেই ৮০ টাকার বেশি হবে না। শেষ পর্যন্ত ১২০ টাকায় রফা হলো। এবার ফেরার পালা। যাওয়ার আগে খুদে গানওয়ালাদের বললাম, কাল ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় একই স্থানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে। আমার সহকর্মী ওদের কথা দিলেন, কাল একটা দুর্দান্ত গান শিখিয়ে দেবেন। পরের দিন আমরা কাজ করলাম উখিয়ায়। সারা দিন কাজে এতই মগ্ন ছিলাম যে গানওয়ালাদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হোটেলে ফিরে আবার যখন বিচে নামলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় সাতটা। অন্ধকারে সাগরের সৌন্দর্য আরেক রকম। ভাবলাম, এত দেরিতে মনে হয় ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করি, খুদে গানওয়ালা কাইয়ুম তার দলবল নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে বলল, ‘স্যার, আমরা সাড়ে পাঁচটা থেকে দাঁড়ায়া আছি।’ তারপর যথারীতি গান শুরু হলো। সেদিন ওরা আমাদের অনেক গান শোনাল। আমার সহকর্মী ওদের বেশ কয়েকটা গান শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা নিলেন। তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ওরা কিন্তু ঠিকই আমাদের কক্সবাজারের একটি আঞ্চলিক গান শিখিয়ে ছাড়ল। ‘ককস্বাজার দইজ্জার চর, দারুণ নদীর পাড়’—গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আমরা ফিরে চললাম হোটেলে। কিন্তু এ কথাটি বলা হলো না, কাল আর ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।
ওদের হাতে ক্যামেরা নেই যে ছবি তুলবে বা বিক্রি করার মতো কোনো জিনিসপত্রও দেখছি না। তাহলে কি সাহায্য চাইবে? ভাব দেখে তো সে রকমও মনে হচ্ছে না। তাহলে? হঠাৎ একজন বলে উঠল, ‘গান শুনবেন আপা?’
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গান? কী গান? এখানে কোথায় গান?’
একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করে ফেললাম, দুজনের একজন বলল, ‘আপা, আমরা গান শুনাব, আমরা গান গাইতে পারি তো!’
ওদের ভাবটা এমনই যে আমাদের গান শুনিয়েই ছাড়বে। আমার সহকর্মী খানিকটা নিরস্ত করার জন্য বলল, ‘দেখ, আমরা কিন্তু সঙ্গে টাকাপয়সা আনিনি, হোটেলে রেখে এসেছি।’ কিন্তু ওরা দমার পাত্র নয়।
বলল, ‘স্যার, টাকা লাগব না। আপা আমগো বইনের মতো। আপার জন্য একটা গান ফ্রি—এই বলে ওরা দুজন একসঙ্গে গান শুরু করে দিল, ‘কতো রঙ্গ জানো রে মানুষ...’।
গানটা কি দ্বৈত সংগীত, কোরাস, না রিমিক্স? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি আর আমাদের পিছু পিছু খুদে দুই শিল্পী গান গাইতে গাইতে আসছে। একজন গাইছে আর একজন একই কলি একটু পরে ধরছে, তাও আবার চিকন মিনমিনে গলায়। অদ্ভুত কম্বিনেশন। সেদিন সৈকতে আমরা খুব ঘুরলাম, ছবি তুলাম, বিচ-বাইক চালালাম। আশ্চর্যের বিষয়, এদের একজন এসএলআর ক্যামেরাও চালাতে জানে। নাম কাইয়ুম। আমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দিল। এই সুযোগে আমিও কাইয়ুমের সঙ্গে একটি ছবি তুললাম। ওরা টাকার বদলে আমাদের সঙ্গে বিচ-বাইকে চড়ে ঘুরল। আমরা হোটেলের সামনের বিচ থেকে একেবারে কলাতলি বিচের শেষ মাথা পর্যন্ত বাইক চালিয়ে গেলাম। এ সময়টা সৈকতে পর্যটকদের চাপ কম থাকে। বাতাস আর ঢেউয়ের গর্জনটা একটু বেশিই।
দেখতে দেখতে কাইয়ুমদের সঙ্গে আরও কয়েকজন গানওয়ালা এসে জুটল। ওরা ওদের কাজ ফেলে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটাকেই বেশি পছন্দ করল। কাইয়ুম, রফিক, শহীদ হোসেন—ওরা সৈকতে বেড়াতে আসা লোকজনকে গান শোনায়। এ থেকে ওদের ভালোই আয় হয়। কথা বলে জানলাম, প্রথম শুরুটা করেছিল জসীম নামের এক গানওয়ালা। তারও বয়স বেশি নয়। সে-ই এখন কাইয়ুমদের ট্রেনিং দিচ্ছে। তার দেওয়া ট্রেনিং যে বৃথা যায়নি, তা ওদের গান শুনলেই বোঝা যায়। কাইয়ুম জানাল, এমনও হয়েছে, মাত্র তিন-চার দিন গান গেয়ে তেরো-চৌদ্দ শ টাকা আয় করেছে। আবার এমনও হয়েছে, দিনে ৫০ টাকাও পায়নি। এখন সে রকমই অবস্থা। কারণ গরমে সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটক খুব বেশি আসে না। বেশি আয় হয় বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিদেশিদের কী বলে গান শোনাও।’
গানওয়ালা শহীদ হোসেন বলল, ‘বিদেশিদের কাছে গিয়ে বলি, হ্যালো স্যার, সিং এ সং!’
আমি তো হেসেই খুন! মনে মনে ভাবলাম, তবুও তো ইংরেজি বলার চেষ্টা করছে। আমার সহকর্মী তখন বেশ সময় নিয়ে খুব ধৈর্য ধরে শেখালেন, বিদেশি পর্যটক এলে কী বলে গান শোনার জন্য অনুরোধ জানাতে হবে। জীবিকার প্রয়োজনেই কিনা জানি না, ওরাও বেশ আগ্রহের সঙ্গে শিখল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে রপ্ত করার চেষ্টা করল, ‘হ্যালো স্যার, ডু ইউ ওয়ান্ট টু লিসেন আ সং? আই ক্যান সিং আ সং ফর ইউ!’
জিজ্ঞেস করলাম ‘স্কুলে যাও?’
কাইয়ুম জানাল, সে নিয়মিত স্কুলে যায়, কক্সবাজারের মধ্যপাড়ায় তার বাসা। স্থানীয় একটি এনজিও পরিচালিত ‘লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন’ স্কুলে সে ক্লাস টুতে পড়ে। বাকিরা তেমন কেউ স্কুলে যায় না। গান গেয়ে যে টাকা পাও, সে টাকা কী করো? ওরা বলল, ‘মার কাছে নিয়া দিই।’ আমাদের জটলা দেখে একফাঁকে বেশ কয়েকজন ফেরিওয়ালা ঢুঁ মেরে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি ঝিনুকের মালা পছন্দ হলো, কিন্তু ফেরিওয়ালা দাম হাঁকল ৪০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম সাহায্য করল, সে আমাদের কানে কানে বলে দিল, কিছুতেই ৮০ টাকার বেশি হবে না। শেষ পর্যন্ত ১২০ টাকায় রফা হলো। এবার ফেরার পালা। যাওয়ার আগে খুদে গানওয়ালাদের বললাম, কাল ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় একই স্থানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে। আমার সহকর্মী ওদের কথা দিলেন, কাল একটা দুর্দান্ত গান শিখিয়ে দেবেন। পরের দিন আমরা কাজ করলাম উখিয়ায়। সারা দিন কাজে এতই মগ্ন ছিলাম যে গানওয়ালাদের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হোটেলে ফিরে আবার যখন বিচে নামলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় সাতটা। অন্ধকারে সাগরের সৌন্দর্য আরেক রকম। ভাবলাম, এত দেরিতে মনে হয় ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করি, খুদে গানওয়ালা কাইয়ুম তার দলবল নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে বলল, ‘স্যার, আমরা সাড়ে পাঁচটা থেকে দাঁড়ায়া আছি।’ তারপর যথারীতি গান শুরু হলো। সেদিন ওরা আমাদের অনেক গান শোনাল। আমার সহকর্মী ওদের বেশ কয়েকটা গান শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা নিলেন। তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ওরা কিন্তু ঠিকই আমাদের কক্সবাজারের একটি আঞ্চলিক গান শিখিয়ে ছাড়ল। ‘ককস্বাজার দইজ্জার চর, দারুণ নদীর পাড়’—গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আমরা ফিরে চললাম হোটেলে। কিন্তু এ কথাটি বলা হলো না, কাল আর ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।
No comments