২২০০ ক্যালরি ও বাঁচার মতো মজুরি by তানভীর মোকাম্মেল
সকালে কী খেয়ে এসেছ?—‘ভাত আর খেসারির ডাল।’ দুপুরে যেয়ে কী খাবে?—‘ভাত আর আলু-তরকারি।’ রাতেও কি ভাত খাবে?—‘না’। বলল খুরশীদা, ‘ফ্যাক্টরি থেকে এত রাতে বাসায় ফিরে আর রাঁধতে ইচ্ছে করে না। রাতে তাই পাউরুটি খাব।’ শুধু পাউরুটি? —‘না, চিনি দিয়ে।’ এ ছিল খুরশীদা নামের ঢাকার এক গার্মেন্টস কর্মীর সঙ্গে আমার কথোপকথন।
সবচেয়ে মোটা চাল এখন ২৮ টাকা, মসুরের ডাল কেজি ৯০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৪২ টাকা। আর চাষের পাঙাশ ছাড়া মাছ তো দশ-হাজারি মধ্যবিত্তরাও তেমন খেতে পারছে না। গার্মেন্টসের দুই-হাজারি মেয়েরা তা খাবে কেমন করে! ফলে শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন এসব মেয়ের কোথা থেকে আসবে, আমার জানা নেই। গার্মেন্টসের মেয়েদের নিয়ে বস্ত্রবালিকারা নামে একটা ছবি তৈরি করার সময় এসব নারীশ্রমিকের অনেকেরই দুঃসহ জীবন আমি কাছ থেকে দেখেছি।
২৮ জুলাইয়ের মধ্যে পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ বোর্ডের সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা। শ্রমিক প্রতিনিধিরা নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেছেন আর মালিকেরা দিতে চান এক হাজার ৯৮৯ টাকা। বর্তমান বাজারদরে এক হাজার ৯৮৯ টাকা, অর্থাৎ দিনে মাত্র ৬৬ টাকায় কোনো পরিবারকে জীবনযাপন করতে বলা এক নিষ্ঠুর কৌতুক মাত্র! আমি একটা সাদা কাগজ ও কলম নিয়ে যেকোনো কারখানা-মালিকের সঙ্গে বসতে রাজি। তিনি যদি আমাকে বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাতে পারেন যে মাসে এক হাজার ৯০০ টাকার নিম্নতম মজুরির যে অঙ্কটা তাঁরা বলছেন, তা দিয়ে বাসাভাড়া ও অন্যান্য খরচ না হয় বাদই দিলাম, কেবল বেঁচে থাকার জন্যই যে ২২০০ ক্যালরি একজন মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজন, চারজনের একটি শ্রমিক পরিবার তা কীভাবে পেতে সক্ষম? এটা আশ্চর্যজনক যে গার্মেন্টস শিল্প সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও বাংলাদেশে এই খাতেই নিম্নতম মজুরি সবচেয়ে কম, মায় দিনমজুরদের মজুরির থেকেও! কাটিং ও সেলাইয়ের কাজে কারখানাগুলো কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুনাফা করে। তা থেকে ২-৩ শতাংশ ছাড় দিয়ে মালিকেরা সহজেই শ্রমিকদের বাস্তবসম্মত একটা নিম্নতম মজুরি দিতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার।
অতিরিক্ত শ্রম আর পুষ্টিহীন যৎসামান্য খাদ্য গার্মেন্টসের মেয়েদের অল্পবয়সেই অসুস্থ করে তোলে। ১৬ বছরের ফুটফুটে মেয়ে নুরহাজানকে তিন বছর পরে দেখলে আজ আর চেনাই যায় না! স্রেফ অমানুষিক পরিশ্রম আর কম খেতে খেতে ওর শরীর আর চেহারা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। ৩০ বছরের বেশি বয়সের গার্মেন্টস নারীশ্রমিক খুব একটা চোখেই পড়বে না। ফ্যাক্টরিগুলো এসব মেয়ের যৌবনের শ্রমক্ষমতা, উৎসাহ ও উদ্যমকে নিংড়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টসের মালিকদের ভাগ্য ভালো যে বাঙালি মেয়েরা নীরব ও লক্ষ্মী। প্রতিবাদে সহসা সোচ্চার হয় না! তবে গার্মেন্টস শিল্পে অনেক পুরুষ ও যুবক শ্রমিকও রয়েছে। তারা এই বঞ্চনা মানবে কেন? ফলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ এই শিল্পের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে যন্ত্রপাতি ভাঙচুর, কারখানায় আগুন দেওয়ার মতো নানা উচ্ছৃঙ্খল প্রবণতাও, যা ২০০৬ সালে চরম আকার ধারণ করেছিল।
সাধারণভাবে এ দেশের গার্মেন্টস শিল্পের মালিকদের আমি প্রশংসা করি। কারণ সমস্যা-সংকুল এই বাংলাদেশে কোনো কিছুই সৃষ্টি করা সহজ নয়। বিদ্যুতের অভাব, অপদার্থ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতিবাজ কাস্টমস—এসব বাধা পেরিয়ে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা ও চালানোর ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা খুঁজে তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন এবং বহু মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তবে কেবল কর্মসংস্থান করাটাই কি যথেষ্ট? সেই কর্মে নিযুক্ত মানুষ যদি মানবিক একটা জীবন যাপন করতে না পারে, তবে সে কর্মসংস্থান তো বুমেরাং হয়ে পড়তে বাধ্য।
এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশেরই গার্মেন্টস শিল্পে মেয়েদের থাকার হোস্টেল আছে। ফ্যাক্টরিতে আনা-নেওয়ার জন্য কোম্পানির বাস আছে। নিয়মিত স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহের রেশনিং ব্যবস্থা আছে। এ দেশের ফ্যাক্টরি-মালিকেরা কবে তা শুরু করবেন? ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাস ব্যয়বহুল। গার্মেন্টসের অধিকাংশ মেয়ে তাই ৫-১০ কিলোমিটার হেঁটেও কারখানায় যাতায়াত করে। ভোরে ও রাতে। রোদে ও বৃষ্টিতে। অনেকেরই ছাতা কেনার সামর্থ্য নেই।
অন্যদিকে অনেক মালিক পরিবারের বিলাসী জীবনযাত্রা, যাঁদের পাঁচ-সাত বছর আগেও তেমন কিছু ছিল না, আজ সমাজে আলোচনার বিষয়। আমি একাধিক গার্মেন্টস কারখানার মালিক-পরিবারকে চিনি, যাঁরা প্রতিবছর সপরিবারে বিমানের প্রথম শ্রেণীতে বিশ্বভ্রমণে বের হন। অথচ কারখানার শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর প্রশ্নেই কেবল শোনা যায়, ব্যবসা খারাপ!
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুরবস্থার বিষয়টি বিদেশেও সমালোচিত। এতে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ছে না। বিদেশিদের কাছ থেকে চাপ আসছে কমপ্লায়েন্সের, অর্থাৎ শিল্প ও কারখানার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে কারখানাগুলো চালানোর চাপ। আমাদের দেশের শিল্প আইন ও কারখানা আইনেও শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কথা রয়েছে। আইনের সেসব ধারা কি মালিকেরা মানছেন? একটা সহজ উদাহরণ দিই। যেকোনো শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আমাদের সংবিধানেই স্বীকৃত। কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার সুযোগ মালিকেরা দিতেই চান না।
ট্রেড ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে সুযোগ থাকে মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের সরাসরি সংলাপের। সে সুযোগ না থাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভটা তাই প্রকাশ পাচ্ছে কেবল সংঘাতের মাধ্যমে। ঘটছে ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ ও সহিংসতার ঘটনা। পুরো শিল্পই ধাক্কা খাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যারে তুমি রেখেছ পিছে/ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে!’
আর এসব ক্ষেত্রে ‘বিদেশি শক্তি’, ‘তৃতীয় পক্ষ’ এসব বলে লাভ নেই। কারণ দ্বন্দ্বটা সহজ। মুনাফা আর শ্রমের দ্বন্দ্ব। সমাধানটাও সহজ। একজন মানুষকে খাটাতে হলে তাকে তার বেঁচে থাকার মতো মজুরি দিতেই হবে। পশ্চিমা দেশের কারখানা-মালিকেরা সেটা জানেন। বোঝা যাচ্ছে আমাদের দেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্প মালিকদের এখনো ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠটা নেওয়া হয়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারও তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। একদিকে মুনাফাআসক্ত মালিকপক্ষ, আরেক দিকে দিনরাত পরিশ্রম করা স্বল্প বেতনের শ্রমিকেরা। সরকারকে ঠিক করতে হবে সে কোন পক্ষে থাকবে।
তবে বিদেশি পক্ষ একটা আছে, তা হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলো—‘এইচ এম’ থেকে ‘ওয়ালমাট’ পোশাকশিল্পের সব বড় কোম্পানিই রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশে চটকদার সব বিজ্ঞাপন লাগিয়ে চলছে সুবিশাল এক ব্যবসা! এসব বহুজাতিক কোম্পানি যাতে এ দেশের ফ্যাক্টরি-মালিকদের হাত ধরে আমাদের সহজ-সরল শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েদের শ্রমকে অমানবিকভাবে শোষণ করতে না পারে, সেটা দেখাও সরকারের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, সস্তা কাপড় বলে কিছু নেই। কারও-না কারও শ্রমের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত করেই সেটা সস্তা হয়েছে।
তবে আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়ার দোষটা কেবল বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দিয়েও লাভ নেই। কারণ তারা জানে যে এ দেশের মালিকেরা শ্রমিকদের কত কম বেতন দেন। তাই এ দেশে তৈরি পোশাকের জন্য তাঁরা বেশি মূল্য দিতে চান না। শ্রমিকের বেতন বাড়লে পণ্যের মূল্য বাড়াতেও তাঁরা তখন বাধ্য হবেন। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে কমপ্লায়েন্সের নিয়ম-কানুন মেনে চললে আমাদের পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতার সংখ্যা কমবে না, বরং বাড়বে। আমাদের মালিকেরা যেমনটি মনে করেন যে, শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি দিয়ে পণ্যের দাম কম রাখলেই কেবল ব্যবসাটা বজায় রাখা যাবে, এই মফস্বলী ধারণাটা আজকের পৃথিবীতে একেবারেই সঠিক নয়।
এটা সবাই বোঝেন যে শ্রমিকদের মাত্র দুই-আড়াই হাজার টাকা বেতন দিয়ে, অভুক্ত-অর্ধভুক্ত রেখে, ভালো উৎপাদন সম্ভব নয়। বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে জীবন ধারণ-উপযোগী মজুরি তাদের দিতেই হবে। অন্যথায় শ্রম-অসন্তোষের কারণে এই শিল্পে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বয়স বর্তমানে প্রায় দুই যুগ পার হতে চলল। চরম বেকারত্বের এই দেশে এই শিল্প বহু মানুষের কর্মসংস্থান করেছে বলে গার্মেন্টস মালিকদের নানা নীতিবহির্ভূত কার্যকলাপ এ দেশের সরকারগুলো ও বিবেকমান মানুষ এত দিন সহ্য করে এসেছে। কিন্তু দুই যুগে হানিমুন-পিরিয়ডটা পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অনেক অশ্রু ও রক্ত ঝরেছে। এখন সময় এসেছে গার্মেন্টস মালিকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার, নিজেদের লাভ ও লোভের পরিমাণ কমিয়ে রাষ্ট্র ও ঈশ্বরের বিধানগুলো মেনে চলার। অন্যথায় ঘটে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই সামান্য ক্ষতি (!), যা পুষিয়ে নিতে ফ্যাক্টরি-মালিকদের হয়তো সারা জীবনও লেগে যেতে পারে। আরেকটি ২০০৬ সাল কারোরই কাম্য নয়!
এ দেশের নারীদের কর্মসংস্থানের সর্ববৃহৎ খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতটির রয়েছে একটি ব্যাপক আর্থসামাজিক তাৎপর্য এবং সম্ভাবনা। এই সোনার হাঁসটিকে রুগ্ণ করে ফেললে কেউ কি লাভবান হবেন?
তানভীর মোকাম্মেল: চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রাবন্ধিক।
সবচেয়ে মোটা চাল এখন ২৮ টাকা, মসুরের ডাল কেজি ৯০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৪২ টাকা। আর চাষের পাঙাশ ছাড়া মাছ তো দশ-হাজারি মধ্যবিত্তরাও তেমন খেতে পারছে না। গার্মেন্টসের দুই-হাজারি মেয়েরা তা খাবে কেমন করে! ফলে শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন এসব মেয়ের কোথা থেকে আসবে, আমার জানা নেই। গার্মেন্টসের মেয়েদের নিয়ে বস্ত্রবালিকারা নামে একটা ছবি তৈরি করার সময় এসব নারীশ্রমিকের অনেকেরই দুঃসহ জীবন আমি কাছ থেকে দেখেছি।
২৮ জুলাইয়ের মধ্যে পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ বোর্ডের সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা। শ্রমিক প্রতিনিধিরা নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেছেন আর মালিকেরা দিতে চান এক হাজার ৯৮৯ টাকা। বর্তমান বাজারদরে এক হাজার ৯৮৯ টাকা, অর্থাৎ দিনে মাত্র ৬৬ টাকায় কোনো পরিবারকে জীবনযাপন করতে বলা এক নিষ্ঠুর কৌতুক মাত্র! আমি একটা সাদা কাগজ ও কলম নিয়ে যেকোনো কারখানা-মালিকের সঙ্গে বসতে রাজি। তিনি যদি আমাকে বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাতে পারেন যে মাসে এক হাজার ৯০০ টাকার নিম্নতম মজুরির যে অঙ্কটা তাঁরা বলছেন, তা দিয়ে বাসাভাড়া ও অন্যান্য খরচ না হয় বাদই দিলাম, কেবল বেঁচে থাকার জন্যই যে ২২০০ ক্যালরি একজন মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজন, চারজনের একটি শ্রমিক পরিবার তা কীভাবে পেতে সক্ষম? এটা আশ্চর্যজনক যে গার্মেন্টস শিল্প সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও বাংলাদেশে এই খাতেই নিম্নতম মজুরি সবচেয়ে কম, মায় দিনমজুরদের মজুরির থেকেও! কাটিং ও সেলাইয়ের কাজে কারখানাগুলো কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুনাফা করে। তা থেকে ২-৩ শতাংশ ছাড় দিয়ে মালিকেরা সহজেই শ্রমিকদের বাস্তবসম্মত একটা নিম্নতম মজুরি দিতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার।
অতিরিক্ত শ্রম আর পুষ্টিহীন যৎসামান্য খাদ্য গার্মেন্টসের মেয়েদের অল্পবয়সেই অসুস্থ করে তোলে। ১৬ বছরের ফুটফুটে মেয়ে নুরহাজানকে তিন বছর পরে দেখলে আজ আর চেনাই যায় না! স্রেফ অমানুষিক পরিশ্রম আর কম খেতে খেতে ওর শরীর আর চেহারা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। ৩০ বছরের বেশি বয়সের গার্মেন্টস নারীশ্রমিক খুব একটা চোখেই পড়বে না। ফ্যাক্টরিগুলো এসব মেয়ের যৌবনের শ্রমক্ষমতা, উৎসাহ ও উদ্যমকে নিংড়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টসের মালিকদের ভাগ্য ভালো যে বাঙালি মেয়েরা নীরব ও লক্ষ্মী। প্রতিবাদে সহসা সোচ্চার হয় না! তবে গার্মেন্টস শিল্পে অনেক পুরুষ ও যুবক শ্রমিকও রয়েছে। তারা এই বঞ্চনা মানবে কেন? ফলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ এই শিল্পের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে যন্ত্রপাতি ভাঙচুর, কারখানায় আগুন দেওয়ার মতো নানা উচ্ছৃঙ্খল প্রবণতাও, যা ২০০৬ সালে চরম আকার ধারণ করেছিল।
সাধারণভাবে এ দেশের গার্মেন্টস শিল্পের মালিকদের আমি প্রশংসা করি। কারণ সমস্যা-সংকুল এই বাংলাদেশে কোনো কিছুই সৃষ্টি করা সহজ নয়। বিদ্যুতের অভাব, অপদার্থ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতিবাজ কাস্টমস—এসব বাধা পেরিয়ে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা ও চালানোর ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা খুঁজে তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন এবং বহু মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তবে কেবল কর্মসংস্থান করাটাই কি যথেষ্ট? সেই কর্মে নিযুক্ত মানুষ যদি মানবিক একটা জীবন যাপন করতে না পারে, তবে সে কর্মসংস্থান তো বুমেরাং হয়ে পড়তে বাধ্য।
এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশেরই গার্মেন্টস শিল্পে মেয়েদের থাকার হোস্টেল আছে। ফ্যাক্টরিতে আনা-নেওয়ার জন্য কোম্পানির বাস আছে। নিয়মিত স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহের রেশনিং ব্যবস্থা আছে। এ দেশের ফ্যাক্টরি-মালিকেরা কবে তা শুরু করবেন? ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাস ব্যয়বহুল। গার্মেন্টসের অধিকাংশ মেয়ে তাই ৫-১০ কিলোমিটার হেঁটেও কারখানায় যাতায়াত করে। ভোরে ও রাতে। রোদে ও বৃষ্টিতে। অনেকেরই ছাতা কেনার সামর্থ্য নেই।
অন্যদিকে অনেক মালিক পরিবারের বিলাসী জীবনযাত্রা, যাঁদের পাঁচ-সাত বছর আগেও তেমন কিছু ছিল না, আজ সমাজে আলোচনার বিষয়। আমি একাধিক গার্মেন্টস কারখানার মালিক-পরিবারকে চিনি, যাঁরা প্রতিবছর সপরিবারে বিমানের প্রথম শ্রেণীতে বিশ্বভ্রমণে বের হন। অথচ কারখানার শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর প্রশ্নেই কেবল শোনা যায়, ব্যবসা খারাপ!
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুরবস্থার বিষয়টি বিদেশেও সমালোচিত। এতে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ছে না। বিদেশিদের কাছ থেকে চাপ আসছে কমপ্লায়েন্সের, অর্থাৎ শিল্প ও কারখানার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে কারখানাগুলো চালানোর চাপ। আমাদের দেশের শিল্প আইন ও কারখানা আইনেও শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কথা রয়েছে। আইনের সেসব ধারা কি মালিকেরা মানছেন? একটা সহজ উদাহরণ দিই। যেকোনো শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আমাদের সংবিধানেই স্বীকৃত। কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার সুযোগ মালিকেরা দিতেই চান না।
ট্রেড ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে সুযোগ থাকে মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের সরাসরি সংলাপের। সে সুযোগ না থাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভটা তাই প্রকাশ পাচ্ছে কেবল সংঘাতের মাধ্যমে। ঘটছে ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ ও সহিংসতার ঘটনা। পুরো শিল্পই ধাক্কা খাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যারে তুমি রেখেছ পিছে/ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে!’
আর এসব ক্ষেত্রে ‘বিদেশি শক্তি’, ‘তৃতীয় পক্ষ’ এসব বলে লাভ নেই। কারণ দ্বন্দ্বটা সহজ। মুনাফা আর শ্রমের দ্বন্দ্ব। সমাধানটাও সহজ। একজন মানুষকে খাটাতে হলে তাকে তার বেঁচে থাকার মতো মজুরি দিতেই হবে। পশ্চিমা দেশের কারখানা-মালিকেরা সেটা জানেন। বোঝা যাচ্ছে আমাদের দেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্প মালিকদের এখনো ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠটা নেওয়া হয়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারও তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। একদিকে মুনাফাআসক্ত মালিকপক্ষ, আরেক দিকে দিনরাত পরিশ্রম করা স্বল্প বেতনের শ্রমিকেরা। সরকারকে ঠিক করতে হবে সে কোন পক্ষে থাকবে।
তবে বিদেশি পক্ষ একটা আছে, তা হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলো—‘এইচ এম’ থেকে ‘ওয়ালমাট’ পোশাকশিল্পের সব বড় কোম্পানিই রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশে চটকদার সব বিজ্ঞাপন লাগিয়ে চলছে সুবিশাল এক ব্যবসা! এসব বহুজাতিক কোম্পানি যাতে এ দেশের ফ্যাক্টরি-মালিকদের হাত ধরে আমাদের সহজ-সরল শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েদের শ্রমকে অমানবিকভাবে শোষণ করতে না পারে, সেটা দেখাও সরকারের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, সস্তা কাপড় বলে কিছু নেই। কারও-না কারও শ্রমের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত করেই সেটা সস্তা হয়েছে।
তবে আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়ার দোষটা কেবল বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দিয়েও লাভ নেই। কারণ তারা জানে যে এ দেশের মালিকেরা শ্রমিকদের কত কম বেতন দেন। তাই এ দেশে তৈরি পোশাকের জন্য তাঁরা বেশি মূল্য দিতে চান না। শ্রমিকের বেতন বাড়লে পণ্যের মূল্য বাড়াতেও তাঁরা তখন বাধ্য হবেন। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে কমপ্লায়েন্সের নিয়ম-কানুন মেনে চললে আমাদের পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতার সংখ্যা কমবে না, বরং বাড়বে। আমাদের মালিকেরা যেমনটি মনে করেন যে, শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি দিয়ে পণ্যের দাম কম রাখলেই কেবল ব্যবসাটা বজায় রাখা যাবে, এই মফস্বলী ধারণাটা আজকের পৃথিবীতে একেবারেই সঠিক নয়।
এটা সবাই বোঝেন যে শ্রমিকদের মাত্র দুই-আড়াই হাজার টাকা বেতন দিয়ে, অভুক্ত-অর্ধভুক্ত রেখে, ভালো উৎপাদন সম্ভব নয়। বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে জীবন ধারণ-উপযোগী মজুরি তাদের দিতেই হবে। অন্যথায় শ্রম-অসন্তোষের কারণে এই শিল্পে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বয়স বর্তমানে প্রায় দুই যুগ পার হতে চলল। চরম বেকারত্বের এই দেশে এই শিল্প বহু মানুষের কর্মসংস্থান করেছে বলে গার্মেন্টস মালিকদের নানা নীতিবহির্ভূত কার্যকলাপ এ দেশের সরকারগুলো ও বিবেকমান মানুষ এত দিন সহ্য করে এসেছে। কিন্তু দুই যুগে হানিমুন-পিরিয়ডটা পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অনেক অশ্রু ও রক্ত ঝরেছে। এখন সময় এসেছে গার্মেন্টস মালিকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার, নিজেদের লাভ ও লোভের পরিমাণ কমিয়ে রাষ্ট্র ও ঈশ্বরের বিধানগুলো মেনে চলার। অন্যথায় ঘটে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই সামান্য ক্ষতি (!), যা পুষিয়ে নিতে ফ্যাক্টরি-মালিকদের হয়তো সারা জীবনও লেগে যেতে পারে। আরেকটি ২০০৬ সাল কারোরই কাম্য নয়!
এ দেশের নারীদের কর্মসংস্থানের সর্ববৃহৎ খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতটির রয়েছে একটি ব্যাপক আর্থসামাজিক তাৎপর্য এবং সম্ভাবনা। এই সোনার হাঁসটিকে রুগ্ণ করে ফেললে কেউ কি লাভবান হবেন?
তানভীর মোকাম্মেল: চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রাবন্ধিক।
No comments