রেল কেন উপেক্ষিত by হানিফ মাহমুদ
সামাজিক সেবা ও লাভজনক কোম্পানি হিসেবে টিকে থাকার মধ্যে এক সফল সমন্বয় করেছে ভারতীয় রেল। এই সাফল্য এসেছে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়িয়ে। যে যাত্রীবাহী ট্রেন আগে আটশ যাত্রী বহন করত, এখন তা দুই হাজার। আর এতেই খরচ কমে গেছে ৪৫ ভাগ। ফলে কোনো ভাড়া না বাড়িয়েই যাত্রীদের জন্য সেবা বেড়েছে।
যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ নিয়মিত ট্রেনে বিলাসবহুল কামরায় ভ্রমণ করতে পারে না, তাদের জন্য চালু হয়েছে ‘গরিব রথ’। এই ট্রেনে আছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে আরামদায়ক আসন। এভাবেই বিগত এক দশকে প্রতিবেশী ভারতে যোগাযোগব্যবস্থায় রেলের একটি বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটে গেছে। সরকারনিয়ন্ত্রিত একসময়ের লোকসানী রেল এখন বিপুল মুনাফার একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রায় ১৬ লাখ লোক কাজ করেন। উড়োজাহাজে চড়ার সুখ না পেলেও ভারতের দুই কোটি মানুষ প্রতিদিন চলছে ভারতের প্রায় ১১ হাজার ট্রেনে। এই রেলব্যবস্থায় প্রতিদিন ১৫ লাখ টন পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে, যা ভারতীয় রেলওয়ে উদ্যোক্তাদের অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় অনেকটা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দিয়েছে।
কিন্তু যেকোনো দেশের উন্নয়নে অত্যাবশ্যকীয় এই অবকাঠামোতে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যেসব পথ চালু ছিল নব্বইয়ের দশকে তার অনেকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন কোনো কোচ এবং যাত্রীসেবার মান উন্নত না হওয়ার কারণে ক্রমেই সাধারণ ভ্রমণকারীদের কাছে রেল অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
অতীতে বিরোধিতা করলেও নৌপথ ছোট হয়ে পড়া এবং সড়কপথের ওপর অতিরিক্ত চাপের কারণে ২০০৫ সালের দিকে উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে রেল উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। বিগত জোট সরকারের আমলে উন্নয়ন সহযোগীদের আগ্রহে বাংলাদেশ রেলওয়েকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা এবং বিভিন্ন স্থানে রেললাইন স্থাপন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ডবল ট্রাকে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১১ সালের মধ্যে মোট ৯২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ছয় হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি), বিশ্বব্যাংক এবং জাইকা অধিকাংশ অর্থ জোগান দিতে রাজি হয়। কিন্তু এসব অর্থ বিনিয়োগে উন্নয়নের সহযোগীরা শর্ত জুড়ে দেয়। সরকার তাদের সংস্কার প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়। রেলওয়ের এই সংস্কারপ্রক্রিয়া তদারকির জন্য যোগাযোগসচিবকে চেয়ারম্যান এবং অর্থসচিবকে কো-চেয়ারম্যান করে আন্তমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক ডজন বৈঠক করেছে কিন্তু সংস্কার পরিকল্পনা অনুমোদনের ব্যাপারে কিছুই হয়নি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলওয়ে থেকে সংস্কারের প্রস্তাবটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বর্তমান কাঠামো ভেঙে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানায় একটি বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়েকে কয়েকটি বিভাগ বা ‘লাইন অব বিজনেস’-এ (এলওবি) রূপান্তরের কথা আছে খসড়া সংস্কার প্রস্তাবে। খসড়া সংস্কার প্রস্তাবে পুরো রেলওয়েকে আটটি এলওবিতে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন এবং রেলওয়ের ভূমি ব্যবহার—এ তিনটিকে আয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর ব্যয় করা হবে পরিচালন, অবকাঠামো, রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ), করপোরেট সার্ভিস, অর্থ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে। প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করবে। সংস্কারপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যোগাযোগমন্ত্রীর অধীনে রেলওয়ের জন্য আট সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন বোর্ড গঠনেরও সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু সংস্কার হলে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা খর্ব হবে—এই আশঙ্কায় এই সংক্রান্ত ফাইলটি ঝুলে গেছে বলে একটি সুত্রে জানা গেছে।
শুধু ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার নয়, রেলওয়ের সেবা সম্প্রসারণ ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কাগজে-কলমে রেলওয়েতে বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। কিছু প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু অগ্রগতি শূন্য। বেশ কিছু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১১ সালে কিন্তু প্রকৃত বাস্তবায়ন ২-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রেলের সেবা উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি রেলের যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের জন্য ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ এবং ৬০টি ব্রডগেজ কোচ মেরামত/পুনর্বাসনে ১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এক বছর পাঁচ মাস পার হতে চলেছে, বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। বাকি ছয় মাসে ২৬০টি কোচের সংস্কারকাজ কীভাবে হবে, এর উত্তর কেউ জানে না।
আরো কয়েকটি উদাহরন দেওয়া যাক। রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে সীমান্ত এলাকার—এ ধরনের রেললাইনের মেরামতকাজ দুই বছর ধরে ঝুলে আছে। রাজশাহী-রোহানপুর সীমান্ত এবং আমনুরা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখায় ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইনের উন্নয়ন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় আড়াই বছর আগে। বাস্তবায়নের জন্য সময় আছে আর এক বছর তিন মাস। বাস্তব অগ্রগতি মাত্র এক শতাংশ। চারবার দরপত্র বাতিল হয়েছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলা শহর নারায়ণগঞ্জের মধ্যে রেলযোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয় তিন বছর আগে। ৪১ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্পটির ঠিকাদার ঠিক করতে রেলওয়ে সময় নিয়েছে দুই বছর। গত বছর অক্টোবরে ঠিকাদার নিয়োগ চূড়ান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি। টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত দুই লাইন করার উদ্যোগও একই ভাবে ঝুলে আছে। প্রায় ৭২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন হয় ২০০৬ সালের ১ জুলাই। এরপর প্রায় চার বছর সময় পার হতে চলেছে, কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের তেমন কোনো কাজ শুরু হয়নি।
অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০০২-০৩ থেকে ২০০৬-০৭ পর্যন্ত তাদের দশম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেল উন্নয়নে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) ব্যয় করেছে। আর ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তাদের ব্যয়ের পরিকল্পনা দুই লাখ ৫১ হাজার কোটি রুপি। নতুন রেলমন্ত্রী ভারতে ২০২০ সালের মধ্যে ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবেই ভারত ধাপে ধাপে রেলের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। অথচ অত্যাবশ্যকীয় এই অবকাঠামো উন্নয়নে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকার অবহেলা দেখিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশ যেখানে সমাজের একটি বড় অংশ মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, এদের অর্থনীতির মূল স্রোতের আওতায় নিয়ে আসতে রেল একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, রেলওয়ে অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা প্রণয়নে যত এগিয়ে, বাস্তবায়নে ততটা পিছিয়ে থাকে। এ জন্যই ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া রেলওয়ের বড় ধরনের উন্নতি হয়নি, বরং রেলপথ কমেছে। রেলওয়ের উন্নয়নে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, সেগুলোর উন্নয়ন একদিন পিছিয়ে যাওয়া দেশের উন্নয়নও কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার মতো।
কম খরচে, পরিবেশবান্ধব উপায়ে একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করতে পারে রেল। বাংলাদেশের মত জনবহুল ও প্রায় সমতল একটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবহন ব্যবস্থাটি কেন উপেক্ষিত তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। ভারতের অভিজ্ঞতা কী আমাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না?
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ নিয়মিত ট্রেনে বিলাসবহুল কামরায় ভ্রমণ করতে পারে না, তাদের জন্য চালু হয়েছে ‘গরিব রথ’। এই ট্রেনে আছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে আরামদায়ক আসন। এভাবেই বিগত এক দশকে প্রতিবেশী ভারতে যোগাযোগব্যবস্থায় রেলের একটি বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটে গেছে। সরকারনিয়ন্ত্রিত একসময়ের লোকসানী রেল এখন বিপুল মুনাফার একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রায় ১৬ লাখ লোক কাজ করেন। উড়োজাহাজে চড়ার সুখ না পেলেও ভারতের দুই কোটি মানুষ প্রতিদিন চলছে ভারতের প্রায় ১১ হাজার ট্রেনে। এই রেলব্যবস্থায় প্রতিদিন ১৫ লাখ টন পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে, যা ভারতীয় রেলওয়ে উদ্যোক্তাদের অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় অনেকটা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দিয়েছে।
কিন্তু যেকোনো দেশের উন্নয়নে অত্যাবশ্যকীয় এই অবকাঠামোতে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যেসব পথ চালু ছিল নব্বইয়ের দশকে তার অনেকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন কোনো কোচ এবং যাত্রীসেবার মান উন্নত না হওয়ার কারণে ক্রমেই সাধারণ ভ্রমণকারীদের কাছে রেল অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
অতীতে বিরোধিতা করলেও নৌপথ ছোট হয়ে পড়া এবং সড়কপথের ওপর অতিরিক্ত চাপের কারণে ২০০৫ সালের দিকে উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে রেল উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। বিগত জোট সরকারের আমলে উন্নয়ন সহযোগীদের আগ্রহে বাংলাদেশ রেলওয়েকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা এবং বিভিন্ন স্থানে রেললাইন স্থাপন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ডবল ট্রাকে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১১ সালের মধ্যে মোট ৯২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ছয় হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি), বিশ্বব্যাংক এবং জাইকা অধিকাংশ অর্থ জোগান দিতে রাজি হয়। কিন্তু এসব অর্থ বিনিয়োগে উন্নয়নের সহযোগীরা শর্ত জুড়ে দেয়। সরকার তাদের সংস্কার প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়। রেলওয়ের এই সংস্কারপ্রক্রিয়া তদারকির জন্য যোগাযোগসচিবকে চেয়ারম্যান এবং অর্থসচিবকে কো-চেয়ারম্যান করে আন্তমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক ডজন বৈঠক করেছে কিন্তু সংস্কার পরিকল্পনা অনুমোদনের ব্যাপারে কিছুই হয়নি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলওয়ে থেকে সংস্কারের প্রস্তাবটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বর্তমান কাঠামো ভেঙে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানায় একটি বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়েকে কয়েকটি বিভাগ বা ‘লাইন অব বিজনেস’-এ (এলওবি) রূপান্তরের কথা আছে খসড়া সংস্কার প্রস্তাবে। খসড়া সংস্কার প্রস্তাবে পুরো রেলওয়েকে আটটি এলওবিতে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন এবং রেলওয়ের ভূমি ব্যবহার—এ তিনটিকে আয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর ব্যয় করা হবে পরিচালন, অবকাঠামো, রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ), করপোরেট সার্ভিস, অর্থ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে। প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ কাজের জন্য জবাবদিহি করবে। সংস্কারপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যোগাযোগমন্ত্রীর অধীনে রেলওয়ের জন্য আট সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন বোর্ড গঠনেরও সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু সংস্কার হলে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা খর্ব হবে—এই আশঙ্কায় এই সংক্রান্ত ফাইলটি ঝুলে গেছে বলে একটি সুত্রে জানা গেছে।
শুধু ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার নয়, রেলওয়ের সেবা সম্প্রসারণ ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কাগজে-কলমে রেলওয়েতে বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। কিছু প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু অগ্রগতি শূন্য। বেশ কিছু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১১ সালে কিন্তু প্রকৃত বাস্তবায়ন ২-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রেলের সেবা উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি রেলের যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের জন্য ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ এবং ৬০টি ব্রডগেজ কোচ মেরামত/পুনর্বাসনে ১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এক বছর পাঁচ মাস পার হতে চলেছে, বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। বাকি ছয় মাসে ২৬০টি কোচের সংস্কারকাজ কীভাবে হবে, এর উত্তর কেউ জানে না।
আরো কয়েকটি উদাহরন দেওয়া যাক। রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে সীমান্ত এলাকার—এ ধরনের রেললাইনের মেরামতকাজ দুই বছর ধরে ঝুলে আছে। রাজশাহী-রোহানপুর সীমান্ত এবং আমনুরা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখায় ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইনের উন্নয়ন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় আড়াই বছর আগে। বাস্তবায়নের জন্য সময় আছে আর এক বছর তিন মাস। বাস্তব অগ্রগতি মাত্র এক শতাংশ। চারবার দরপত্র বাতিল হয়েছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলা শহর নারায়ণগঞ্জের মধ্যে রেলযোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয় তিন বছর আগে। ৪১ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্পটির ঠিকাদার ঠিক করতে রেলওয়ে সময় নিয়েছে দুই বছর। গত বছর অক্টোবরে ঠিকাদার নিয়োগ চূড়ান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি। টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত দুই লাইন করার উদ্যোগও একই ভাবে ঝুলে আছে। প্রায় ৭২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন হয় ২০০৬ সালের ১ জুলাই। এরপর প্রায় চার বছর সময় পার হতে চলেছে, কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের তেমন কোনো কাজ শুরু হয়নি।
অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০০২-০৩ থেকে ২০০৬-০৭ পর্যন্ত তাদের দশম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেল উন্নয়নে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) ব্যয় করেছে। আর ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তাদের ব্যয়ের পরিকল্পনা দুই লাখ ৫১ হাজার কোটি রুপি। নতুন রেলমন্ত্রী ভারতে ২০২০ সালের মধ্যে ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবেই ভারত ধাপে ধাপে রেলের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। অথচ অত্যাবশ্যকীয় এই অবকাঠামো উন্নয়নে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকার অবহেলা দেখিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশ যেখানে সমাজের একটি বড় অংশ মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, এদের অর্থনীতির মূল স্রোতের আওতায় নিয়ে আসতে রেল একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, রেলওয়ে অগ্রাধিকার বা পরিকল্পনা প্রণয়নে যত এগিয়ে, বাস্তবায়নে ততটা পিছিয়ে থাকে। এ জন্যই ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া রেলওয়ের বড় ধরনের উন্নতি হয়নি, বরং রেলপথ কমেছে। রেলওয়ের উন্নয়নে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, সেগুলোর উন্নয়ন একদিন পিছিয়ে যাওয়া দেশের উন্নয়নও কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার মতো।
কম খরচে, পরিবেশবান্ধব উপায়ে একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করতে পারে রেল। বাংলাদেশের মত জনবহুল ও প্রায় সমতল একটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবহন ব্যবস্থাটি কেন উপেক্ষিত তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। ভারতের অভিজ্ঞতা কী আমাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না?
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments