ওয়েলকম না সুইড আফ্রিকা
জোহানেসবার্গ ও আর টাম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢুকতেই বিশ্বকাপের গরম বাতাস গায়ে এসে লাগল। দেয়ালে দেয়ালে নেলসন ম্যান্ডেলার ছবি। দক্ষিণ আফ্রিকার মহান এই নেতা সোয়া ছয় কেজি ওজনের জগদ্বিখ্যাত সোনার ট্রফিটা আঁকড়ে ধরে আছেন এমন করেই, যেন ওটা আর ছাড়বেন না। পাশে বাফানা বাফানাদের বিশালাকৃতির সব কাটআউট। কোনোটায় মোকোয়েনা মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে ধরেছেন। কোনোটায় একই ভঙ্গিতে স্টিভ পিনার। আর পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলের মহাতারকারা তো আছেনই—আছেন মেসি, রোনালদো, কাকা, রুনিরা।
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ভদ্রমহিলার অফিশিয়াল ব্যাজে দেখা গেল অনেক বড় নাম। তবে মনে রাখার সুবিধার জন্য একটি নামই এঁকে নিলাম, হেনরিয়েটা। দেখতে রাশভারী, বিশালাকার—ভয় ভয় করছিল। ভিসা করে আসিনি। ফিফার সরকারিভাবে অনুমোদিত অ্যাক্রিডিটেশন-বিষয়ক চিঠিখানিই সম্বল। কিন্তু কাছে যেতেই ভদ্রমহিলা হাসলেন, একেবারে অন্তরঙ্গ হাসি। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এমনভাবে হাসতে পারেন, জানা ছিল না। হেসে হেসেই দুটো দুর্বোধ্য বাক্য উচ্চারণ করলেন। পর পর। ওয়েলকম না সুইড আফ্রিকা। ও অ্যামোকেলেকিলে মো আফ্রিকা বোরওয়া। পরে দুটোরই অর্থ বুঝিয়ে দিলেন—দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাগতম। প্রথমটি আফ্রিকানস ভাষায়, দ্বিতীয়টি চুয়ানায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় সরকারিভাবে ১১টি ভাষা প্রচলিত।
পরশু রাতে বিমানবন্দরে পৌঁছেই মনকে শক্ত করে নিলাম, এ রকম আরও অনেক দুর্বোধ্য ভাষাই শুনতে হবে। তবে একটা সুবিধাও আছে এই দেশটায়। ইংরেজি এদের সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা। সবাই কমবেশি ইংরেজি জানে। কোরিয়া-জাপানের মতো ‘মূকাভিনয়’ করার প্রয়োজন পড়বে না সামান্য ইংরেজি জানাশোনা লোকদের।
তো আবার ফিরে আসা যাক ইমিগ্রেশন প্রসঙ্গে। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেমন কড়াকড়ি, না, কড়াকড়ি না বলে অতিসতর্কতাই বলা উচিত। প্রথমে এমিরেটস এয়ারলাইনসের কর্মকর্তারা আমাকে ভিসা ছাড়া দেখে যেভাবে আঁতকে উঠলেন, সে আর কী বলব! আঁতিপাঁতি করে আমার সব কাগজ দেখে বোর্ডিং পাস দিলেন। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়েছি, সেখান থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন এমিরেটসের আরেক কর্তা। বললেন, দেখুন, আপনার পাসপোর্ট আর পত্রিকার ওজন দেখেই ছাড়ছি। না হলে শুধু একটা ফিফার চিঠির বলে ছাড়তাম না। ইমিগ্রেশনে গিয়েও বারদুয়েক খানাতল্লাশির কবলে পড়লাম। একসময় সব বাধা ডিঙিয়ে বিশাল বোয়িংটার পেটের মধ্যে ঢুকলাম। শেষ মুহূর্তে বিমানে উঠতে যাব, তখন আবারও সতর্ক করে দেওয়া হলো, দুবাইতে বিমানবন্দরে কিছু ঘটলে সেটা আমরা জানি না!
আদতে কিছুই ঘটল না। দুবাইয়ের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমার ফিফা অ্যাক্রিডিটেশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বরটা জেনে নিয়েই ছেড়ে দিলেন। এমনকি কাগজখানিও দেখতে চাইলেন না। তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? একটাই যুক্তি সাজিয়ে নেওয়া গেল নিজের মতো করে। বাংলাদেশের ফুটবলকে যেমন ফিফা মানচিত্রে দুরবিন দিয়ে দেখতে হয়, সে রকমই ফিফার একটি নির্দেশ আর একখানা কাগজের মূল্য কতটা, সেটি বুঝতে অক্ষম বাংলাদেশ বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা।
রাত নয়টায় জোহানেসবার্গ বিমানবন্দর থেকে ভিসা নিয়ে বেরোলাম। সঙ্গে অবশ্যই হেনরিয়েটার শুভকামনা, দক্ষিণ আফ্রিকায় যেন আমার দিনগুলো ভালো কাটে এবং আমি যেন বাফানা বাফানা মানে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নিয়ে বেশি বেশি ও ভালো ভালো লিখি।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নিয়ে কী লেখা যায়! বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো আয়োজক দেশ প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোবে না বলে ধরে নিয়েছে গোটা পৃথিবী। খবরদার, আফ্রিকানদের কাছে ও-কথা বলতে যাবেন না। তাদের গভীর বিশ্বাস, কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরা আর দুই খেলোয়াড় মোকোয়েনা ও স্টিভ পিনার দেশকে এমন লজ্জার মুখে পড়তে দেবেন না। হোটেলের কর্মচারী থেকে শুরু করে মিডিয়া সেন্টারের স্বেচ্ছাসেবক—সবাই একই বিশ্বাস নিয়ে সময় গুনছেন। যে গাড়িতে করে পরশু রাতে হোটেলে এলাম, সেটির ড্রাইভার নাকি ভীষণ উত্তেজিত। এই প্রথম কোনো সাংবাদিককে তিনি এবারের বিশ্বকাপে বহন করে নিয়ে এলেন বিমানবন্দর থেকে! তাঁর আরেকটা খুশির জায়গা, বাফানা বাফানাদের বেশি বেশি খবর আমার কাছ থেকে জানতে পারবে। মিডিয়া সেন্টার থেকে যখনই নতুন কার্ডটা গলায় ঝোলাতে পারলাম, দূর থেকে দৌড়ে এসে মাইকেল নামের এক স্বেচ্ছাসেবক, বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বললেন, গো সাউথ আফ্রিকা গো!
পরে নিজেই এসে বললেন, ‘আমরা জানি, সাউথ আফ্রিকা বেশি দূর যেতে পারবে না। তবে একটা বাজি ধরলাম, দ্বিতীয় রাউন্ডে আমরা যাবই।’
এটা আসলে স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে তো আর কর দেওয়া লাগে না। সাধারণ জনতার আর দোষ কী? যাঁকে কেন্দ্র করে এই স্বপ্ন দেখা, সেই বাফানা বাফানাদের সবচেয়ে বড় তারকা স্টিভ পিনার নিজেই তো বারবার বলছেন, তাঁদের ভালো সুযোগ আছে। সুযোগটা আগেভাগে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া, না ২০০২ দক্ষিণ কোরিয়ার মতো রূপকথা লেখা, সেটি অবশ্য ভেঙে বলছেন না তিনি। কাল বিশাল একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পিনার অ্যানিহোয়্যার অ্যানিটাইম ম্যাগাজিনে। তাতে ভীষণ একটা চমকজাগানো কথা বলেছেন এভারটনের মিডফিল্ডার। তিনি নাকি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখছেন, এবার ট্রফিটা নিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলেরও সুযোগ আছে, সে তো সব সময়ই থাকে। ইংল্যান্ডে খেলেন। ইংল্যান্ড দলটিকে নিয়ে ইংলিশ মিডিয়া যেভাবে ধেই ধেই করে নাচছে, তাতে ৪৪ বছর পর ইংল্যান্ড এবার চ্যাম্পিয়ন না হয়ে যায়ই না। ইংল্যান্ডকে দু-চারটে আশার কথা শোনাবেন তা না, পিনার শুনিয়েছেন চরম হতাশার কথা। ইংল্যান্ডের কোনো সুযোগই নেই!
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ভদ্রমহিলার অফিশিয়াল ব্যাজে দেখা গেল অনেক বড় নাম। তবে মনে রাখার সুবিধার জন্য একটি নামই এঁকে নিলাম, হেনরিয়েটা। দেখতে রাশভারী, বিশালাকার—ভয় ভয় করছিল। ভিসা করে আসিনি। ফিফার সরকারিভাবে অনুমোদিত অ্যাক্রিডিটেশন-বিষয়ক চিঠিখানিই সম্বল। কিন্তু কাছে যেতেই ভদ্রমহিলা হাসলেন, একেবারে অন্তরঙ্গ হাসি। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এমনভাবে হাসতে পারেন, জানা ছিল না। হেসে হেসেই দুটো দুর্বোধ্য বাক্য উচ্চারণ করলেন। পর পর। ওয়েলকম না সুইড আফ্রিকা। ও অ্যামোকেলেকিলে মো আফ্রিকা বোরওয়া। পরে দুটোরই অর্থ বুঝিয়ে দিলেন—দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাগতম। প্রথমটি আফ্রিকানস ভাষায়, দ্বিতীয়টি চুয়ানায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় সরকারিভাবে ১১টি ভাষা প্রচলিত।
পরশু রাতে বিমানবন্দরে পৌঁছেই মনকে শক্ত করে নিলাম, এ রকম আরও অনেক দুর্বোধ্য ভাষাই শুনতে হবে। তবে একটা সুবিধাও আছে এই দেশটায়। ইংরেজি এদের সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা। সবাই কমবেশি ইংরেজি জানে। কোরিয়া-জাপানের মতো ‘মূকাভিনয়’ করার প্রয়োজন পড়বে না সামান্য ইংরেজি জানাশোনা লোকদের।
তো আবার ফিরে আসা যাক ইমিগ্রেশন প্রসঙ্গে। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেমন কড়াকড়ি, না, কড়াকড়ি না বলে অতিসতর্কতাই বলা উচিত। প্রথমে এমিরেটস এয়ারলাইনসের কর্মকর্তারা আমাকে ভিসা ছাড়া দেখে যেভাবে আঁতকে উঠলেন, সে আর কী বলব! আঁতিপাঁতি করে আমার সব কাগজ দেখে বোর্ডিং পাস দিলেন। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়েছি, সেখান থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন এমিরেটসের আরেক কর্তা। বললেন, দেখুন, আপনার পাসপোর্ট আর পত্রিকার ওজন দেখেই ছাড়ছি। না হলে শুধু একটা ফিফার চিঠির বলে ছাড়তাম না। ইমিগ্রেশনে গিয়েও বারদুয়েক খানাতল্লাশির কবলে পড়লাম। একসময় সব বাধা ডিঙিয়ে বিশাল বোয়িংটার পেটের মধ্যে ঢুকলাম। শেষ মুহূর্তে বিমানে উঠতে যাব, তখন আবারও সতর্ক করে দেওয়া হলো, দুবাইতে বিমানবন্দরে কিছু ঘটলে সেটা আমরা জানি না!
আদতে কিছুই ঘটল না। দুবাইয়ের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমার ফিফা অ্যাক্রিডিটেশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বরটা জেনে নিয়েই ছেড়ে দিলেন। এমনকি কাগজখানিও দেখতে চাইলেন না। তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? একটাই যুক্তি সাজিয়ে নেওয়া গেল নিজের মতো করে। বাংলাদেশের ফুটবলকে যেমন ফিফা মানচিত্রে দুরবিন দিয়ে দেখতে হয়, সে রকমই ফিফার একটি নির্দেশ আর একখানা কাগজের মূল্য কতটা, সেটি বুঝতে অক্ষম বাংলাদেশ বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা।
রাত নয়টায় জোহানেসবার্গ বিমানবন্দর থেকে ভিসা নিয়ে বেরোলাম। সঙ্গে অবশ্যই হেনরিয়েটার শুভকামনা, দক্ষিণ আফ্রিকায় যেন আমার দিনগুলো ভালো কাটে এবং আমি যেন বাফানা বাফানা মানে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নিয়ে বেশি বেশি ও ভালো ভালো লিখি।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নিয়ে কী লেখা যায়! বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো আয়োজক দেশ প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোবে না বলে ধরে নিয়েছে গোটা পৃথিবী। খবরদার, আফ্রিকানদের কাছে ও-কথা বলতে যাবেন না। তাদের গভীর বিশ্বাস, কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরা আর দুই খেলোয়াড় মোকোয়েনা ও স্টিভ পিনার দেশকে এমন লজ্জার মুখে পড়তে দেবেন না। হোটেলের কর্মচারী থেকে শুরু করে মিডিয়া সেন্টারের স্বেচ্ছাসেবক—সবাই একই বিশ্বাস নিয়ে সময় গুনছেন। যে গাড়িতে করে পরশু রাতে হোটেলে এলাম, সেটির ড্রাইভার নাকি ভীষণ উত্তেজিত। এই প্রথম কোনো সাংবাদিককে তিনি এবারের বিশ্বকাপে বহন করে নিয়ে এলেন বিমানবন্দর থেকে! তাঁর আরেকটা খুশির জায়গা, বাফানা বাফানাদের বেশি বেশি খবর আমার কাছ থেকে জানতে পারবে। মিডিয়া সেন্টার থেকে যখনই নতুন কার্ডটা গলায় ঝোলাতে পারলাম, দূর থেকে দৌড়ে এসে মাইকেল নামের এক স্বেচ্ছাসেবক, বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বললেন, গো সাউথ আফ্রিকা গো!
পরে নিজেই এসে বললেন, ‘আমরা জানি, সাউথ আফ্রিকা বেশি দূর যেতে পারবে না। তবে একটা বাজি ধরলাম, দ্বিতীয় রাউন্ডে আমরা যাবই।’
এটা আসলে স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে তো আর কর দেওয়া লাগে না। সাধারণ জনতার আর দোষ কী? যাঁকে কেন্দ্র করে এই স্বপ্ন দেখা, সেই বাফানা বাফানাদের সবচেয়ে বড় তারকা স্টিভ পিনার নিজেই তো বারবার বলছেন, তাঁদের ভালো সুযোগ আছে। সুযোগটা আগেভাগে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া, না ২০০২ দক্ষিণ কোরিয়ার মতো রূপকথা লেখা, সেটি অবশ্য ভেঙে বলছেন না তিনি। কাল বিশাল একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পিনার অ্যানিহোয়্যার অ্যানিটাইম ম্যাগাজিনে। তাতে ভীষণ একটা চমকজাগানো কথা বলেছেন এভারটনের মিডফিল্ডার। তিনি নাকি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখছেন, এবার ট্রফিটা নিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলেরও সুযোগ আছে, সে তো সব সময়ই থাকে। ইংল্যান্ডে খেলেন। ইংল্যান্ড দলটিকে নিয়ে ইংলিশ মিডিয়া যেভাবে ধেই ধেই করে নাচছে, তাতে ৪৪ বছর পর ইংল্যান্ড এবার চ্যাম্পিয়ন না হয়ে যায়ই না। ইংল্যান্ডকে দু-চারটে আশার কথা শোনাবেন তা না, পিনার শুনিয়েছেন চরম হতাশার কথা। ইংল্যান্ডের কোনো সুযোগই নেই!
No comments