আমার দেশ: সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা by আসিফ নজরুল
৩০ মে একটি আলোচনা সভা ছিল টিভি চ্যানেলগুলো নিয়ে। চ্যানেল ওয়ান সরকার বন্ধ করেছে, যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। সবারই অভিমত, এগুলো কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিচায়ক নয়। তবে আলোচনাকালে আমরা একমত হলাম যে প্রিন্ট মিডিয়ার অন্তত সে দুরবস্থা নেই, সরকার চাইলেই কোনো পত্রিকা এখন আর বন্ধ করে দিতে পারবে না। আমরা তখন ভাবতে পারিনি, সরকার চাইলে আসলে সব পারে। সরকারের হাতে আইন, ক্ষমতা, পুলিশ। এসবের অপব্যবহার করে কীভাবে সরকার রাতারাতি একটি দৈনিকের কণ্ঠরোধ করতে পারে তার খুবই খারাপ একটি নজির স্থাপিত হলো ১ জুন। যে প্রক্রিয়ায় এদিন আমার দেশ বন্ধ করে দেওয়া হলো, যে অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলো, যেভাবে পরে পত্রিকাটির সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি গ্রেপ্তারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে মামলা হলো তা অচিন্তনীয়, অগ্রহণযোগ্য এবং সকল অর্থে নিন্দনীয়।
আমার দেশ পত্রিকায় সরকারের মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এই পত্রিকাটি সরকারের বিদেশনীতি বিশেষ করে ভারতের প্রতি ‘নতজানু’নীতির তীব্র সমালোচক। এসব প্রতিবেদন ও সমালোচনা সবই ন্যায়সংগত বা বস্তুনিষ্ঠ তা হয়তো বলা যাবে না (আরও বহু পত্রিকার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য)। এর ফলে দেশের কোনো আইনেরও (যেমন মানহানিসংক্রান্ত দণ্ডবিধির বিধান) লঙ্ঘন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তার বিচার করার জন্য আদালত রয়েছেন। বিভিন্ন আদালতে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলাও করা হয়েছে সে কারণে। অতীতেও বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু পত্রিকার অব্যাহত সমালোচনার মুখে এ রকম মামলা হয়েছে। কিন্তু সে জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা নব্বই-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম।
অতীতে চার দলীয় জোট সরকার কিছু সাংবাদিক ও লেখকের প্রতি নানাভাবে তার অসহিষ্ণুতা ও কখনো কখনো নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে। তখন আওয়ামী লীগ তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করেছে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু একের পর এক গণমাধ্যম দমনের পদক্ষেপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এই অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ইতিমধ্যেই ধূলিসাৎ করেছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে সংবাদপত্র দমনে আইনের অপব্যবহারের এক আতঙ্কজনক নজির স্থাপন করেছে।
২.
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের ইতিমধ্যে বলেছেন, আমার দেশ সরকার বন্ধ করেনি, বন্ধ করেছেন প্রকাশক! ২ জুন টিভিতে দেখলাম, এই কথা বলে তিনি তড়িঘড়ি সচিবালয়ের লিফটে ঢুকে গেছেন। তাঁর এই বক্তব্য এতই অসার এবং ঠুনকো যে এটি যেকোনো বিবেকবান মানুষকে আরও হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করবে।
আমার দেশ প্রকাশক বন্ধ করেননি, এটি সরকারই পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করেছে, এটি সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রেপ্তারের আগে বিভিন্ন প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমানের দেওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, হাসমত আলীর সম্মতিক্রমে তাঁর বদলে মাহমুদুর রহমানকে আমার দেশ-এর প্রকাশক হিসেবে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। সে মোতাবেক জেলা প্রশাসক অফিসে চিঠি লিখে হাসমত আলীর পদত্যাগ ও প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। ৫ নভেম্বর ২০০৯ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তরের উপপরিচালক (নিবন্ধন) স্বাক্ষরিত একটি পত্রে জেলা প্রশাসক অফিসকে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করায় হাসমত আলীর পরিবর্তে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এরপর দীর্ঘদিন জেলা প্রশাসক অফিস এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
জেলা প্রশাসক এই চিঠি লিখে অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত প্রকাশক হিসেবে হাসমত আলীর নাম ব্যবহার করেছে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালের দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট অনুসারে প্রকাশক হিসেবে কারও নাম না ছাপিয়ে পত্রিকা বের করা সম্পূর্ণ অবৈধ। আমার দেশ কর্তৃপক্ষের তাই মাত্র দুটো বিকল্প খোলা ছিল: ক. হাসমত আলীর বদলে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রকাশক হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত হাসমত আলীর নামই প্রকাশক হিসেবে ছাপানো; খ. অথবা আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা তত দিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা। আমার দেশ কর্তৃপক্ষ প্রথম কাজটি করেছে। এটি যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব জেলা প্রশাসক অফিস তথা সরকারের। ডিএফপি এবং এসবির অনাপত্তি থাকা সত্ত্বেও এত দিন ধরে তার আবেদনটি ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? কেনই বা পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পরে জানানো হলো যে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না?
আগের প্রকাশকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও প্রস্তাবিত নতুন প্রকাশকের নাম অনুমোদন না করার মানে হলো, একটি পত্রিকাকে প্রকাশকহীন করে ফেলা। প্রকাশকহীন করা মানে হলো পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়াকে আইনসিদ্ধ করা। ‘দিনবদলের’ সরকারের এই অভিনব আবিষ্কার ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার আরও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করবে না এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কুবুদ্ধির প্রতিযোগিতায় কেউ কারও চেয়ে কম যায় না, আমাদের সরকারগুলোর ইতিহাস তো এটিই!
মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াও অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে এ দেশে। হাসমত আলীকে সরকারের একটি বিশেষ এজেন্সি ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করিয়েছে, পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার ছাপাখানা সিলগালা করেছে, পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তারের জন্য সদলবলে পত্রিকা অফিস ঘিরে ফেলেছে। এসব যদি আমরা সমর্থনীয় ধরে নিই, তাহলে ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে মামলা করিয়েই বিরুদ্ধ মতের যে কাউকে গ্রেপ্তার এবং পত্রিকা বন্ধের ঘটনা আমাদের মেনে নিতে হবে। তাই যদি হয়, দেশে আর যা-ই থাকুক, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার আর আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না।
৩.
মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে অর্থাৎ গ্রেপ্তারে বাধাদানের অভিযোগও আনা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পত্রিকাটির সাংবাদিকেরা অফিসের প্রবেশপথ আগলে রেখেছিলেন। চাইলে এটিকে সরকারি কাজে বাধাদান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়তো সম্ভব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দেশের আইন প্রয়োগ করা হয় সে দেশের সমাজ-সংস্কৃতি অনুসারে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষকে কোনো একটি মামলায় মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের জন্য শাহবাগ থানার ওসিসহ অসংখ্য পুলিশ তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষসহ অনেক শিক্ষক সেখানে ছুটে যান। পুলিশ একপর্যায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার না করে চলে যায়। ওই ঘটনাকেও এক অর্থে সরকারি কাজে বাধাদান বলে আখ্যায়িত করা যায়। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করতে গেলে সমর্থকদের দ্বারা বিক্ষোভ বা তা কিছুটা বিলম্বিত করার ঘটনা ঘটেছে। তাই বলে এসব ঘটনায় সরকারি কাজে বাধাদানের কারণে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়নি।
সরকার তাহলে এবার এমন খড়্গহস্ত হলো কেন আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে? পত্রিকাটির কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিকসহ অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার মানে হলো, পত্রিকাটির যেকোনো সাংবাদিককে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করার লাইসেন্স নিয়ে রাখা। শুধু চাকরিচ্যুতি নয়, আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের তাই এখন পালিয়ে থাকতে হবে গ্রেপ্তার এড়াতে চাইলে।
এই পরিস্থিতি সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রশিল্পের জন্য এক ঘোর অমানিশার ইঙ্গিতবাহী।
৪.
এসব ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি চিন্তা করে আমরা উদ্বিগ্ন। এতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শুধু তা নয়, এটি অন্য সব সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে সরকারগুলো ঐতিহাসিকভাবে অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং চিন্তাচেতনায় সামন্তবাদী। এর বিরুদ্ধে নাগরিক স্বার্থের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হচ্ছে সংবাদপত্র। পত্রিকা যে চাইলেই আসলে বন্ধ করে দেওয়া যায়, এই আশঙ্কা গেড়ে বসলে সাংবাদিকতা নানাভাবে শৃঙ্খলিত হবে। সরকারগুলো আরও স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পাবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সাংবাদিকদের সুস্পষ্ট অনৈক্যই বাংলাদেশের সরকারগুলোকে ক্রমাগত গণমাধ্যমবিরোধী ভূমিকা গ্রহণে বাড়তি সাহস জুগিয়েছে। মাহমুদুর রহমান যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলা করেছেন এবং তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন, সেই পত্রিকাগুলোতেও আমার দেশ বন্ধের ও তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ার নিন্দা করে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক সমিতিগুলো এখনো ঐক্যবদ্ধভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারেনি।
দলমতনির্বিশেষে সাংবাদিকনেতারা সবাই মিলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার পদক্ষেপ নিলে আমার দেশ (এবং চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি) বন্ধের আদেশ এবং প্রশ্নবিদ্ধ মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়তো সম্ভব। এটুকু দায়িত্ব পালনে তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ হবে। আরও সাংবাদিক কোনো না কোনো সময় অন্যায় গ্রেপ্তারের শিকার হবেন।
কোনো মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে এই পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার দেশ পত্রিকায় সরকারের মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এই পত্রিকাটি সরকারের বিদেশনীতি বিশেষ করে ভারতের প্রতি ‘নতজানু’নীতির তীব্র সমালোচক। এসব প্রতিবেদন ও সমালোচনা সবই ন্যায়সংগত বা বস্তুনিষ্ঠ তা হয়তো বলা যাবে না (আরও বহু পত্রিকার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য)। এর ফলে দেশের কোনো আইনেরও (যেমন মানহানিসংক্রান্ত দণ্ডবিধির বিধান) লঙ্ঘন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তার বিচার করার জন্য আদালত রয়েছেন। বিভিন্ন আদালতে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলাও করা হয়েছে সে কারণে। অতীতেও বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু পত্রিকার অব্যাহত সমালোচনার মুখে এ রকম মামলা হয়েছে। কিন্তু সে জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা নব্বই-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম।
অতীতে চার দলীয় জোট সরকার কিছু সাংবাদিক ও লেখকের প্রতি নানাভাবে তার অসহিষ্ণুতা ও কখনো কখনো নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে। তখন আওয়ামী লীগ তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করেছে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু একের পর এক গণমাধ্যম দমনের পদক্ষেপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এই অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ইতিমধ্যেই ধূলিসাৎ করেছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে সংবাদপত্র দমনে আইনের অপব্যবহারের এক আতঙ্কজনক নজির স্থাপন করেছে।
২.
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের ইতিমধ্যে বলেছেন, আমার দেশ সরকার বন্ধ করেনি, বন্ধ করেছেন প্রকাশক! ২ জুন টিভিতে দেখলাম, এই কথা বলে তিনি তড়িঘড়ি সচিবালয়ের লিফটে ঢুকে গেছেন। তাঁর এই বক্তব্য এতই অসার এবং ঠুনকো যে এটি যেকোনো বিবেকবান মানুষকে আরও হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করবে।
আমার দেশ প্রকাশক বন্ধ করেননি, এটি সরকারই পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করেছে, এটি সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রেপ্তারের আগে বিভিন্ন প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমানের দেওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, হাসমত আলীর সম্মতিক্রমে তাঁর বদলে মাহমুদুর রহমানকে আমার দেশ-এর প্রকাশক হিসেবে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। সে মোতাবেক জেলা প্রশাসক অফিসে চিঠি লিখে হাসমত আলীর পদত্যাগ ও প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। ৫ নভেম্বর ২০০৯ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তরের উপপরিচালক (নিবন্ধন) স্বাক্ষরিত একটি পত্রে জেলা প্রশাসক অফিসকে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করায় হাসমত আলীর পরিবর্তে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এরপর দীর্ঘদিন জেলা প্রশাসক অফিস এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
জেলা প্রশাসক এই চিঠি লিখে অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত প্রকাশক হিসেবে হাসমত আলীর নাম ব্যবহার করেছে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালের দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট অনুসারে প্রকাশক হিসেবে কারও নাম না ছাপিয়ে পত্রিকা বের করা সম্পূর্ণ অবৈধ। আমার দেশ কর্তৃপক্ষের তাই মাত্র দুটো বিকল্প খোলা ছিল: ক. হাসমত আলীর বদলে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রকাশক হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত হাসমত আলীর নামই প্রকাশক হিসেবে ছাপানো; খ. অথবা আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা তত দিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা। আমার দেশ কর্তৃপক্ষ প্রথম কাজটি করেছে। এটি যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব জেলা প্রশাসক অফিস তথা সরকারের। ডিএফপি এবং এসবির অনাপত্তি থাকা সত্ত্বেও এত দিন ধরে তার আবেদনটি ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? কেনই বা পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পরে জানানো হলো যে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না?
আগের প্রকাশকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও প্রস্তাবিত নতুন প্রকাশকের নাম অনুমোদন না করার মানে হলো, একটি পত্রিকাকে প্রকাশকহীন করে ফেলা। প্রকাশকহীন করা মানে হলো পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়াকে আইনসিদ্ধ করা। ‘দিনবদলের’ সরকারের এই অভিনব আবিষ্কার ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার আরও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করবে না এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কুবুদ্ধির প্রতিযোগিতায় কেউ কারও চেয়ে কম যায় না, আমাদের সরকারগুলোর ইতিহাস তো এটিই!
মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াও অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে এ দেশে। হাসমত আলীকে সরকারের একটি বিশেষ এজেন্সি ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করিয়েছে, পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার ছাপাখানা সিলগালা করেছে, পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তারের জন্য সদলবলে পত্রিকা অফিস ঘিরে ফেলেছে। এসব যদি আমরা সমর্থনীয় ধরে নিই, তাহলে ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে মামলা করিয়েই বিরুদ্ধ মতের যে কাউকে গ্রেপ্তার এবং পত্রিকা বন্ধের ঘটনা আমাদের মেনে নিতে হবে। তাই যদি হয়, দেশে আর যা-ই থাকুক, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার আর আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না।
৩.
মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে অর্থাৎ গ্রেপ্তারে বাধাদানের অভিযোগও আনা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পত্রিকাটির সাংবাদিকেরা অফিসের প্রবেশপথ আগলে রেখেছিলেন। চাইলে এটিকে সরকারি কাজে বাধাদান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়তো সম্ভব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দেশের আইন প্রয়োগ করা হয় সে দেশের সমাজ-সংস্কৃতি অনুসারে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষকে কোনো একটি মামলায় মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের জন্য শাহবাগ থানার ওসিসহ অসংখ্য পুলিশ তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষসহ অনেক শিক্ষক সেখানে ছুটে যান। পুলিশ একপর্যায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার না করে চলে যায়। ওই ঘটনাকেও এক অর্থে সরকারি কাজে বাধাদান বলে আখ্যায়িত করা যায়। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করতে গেলে সমর্থকদের দ্বারা বিক্ষোভ বা তা কিছুটা বিলম্বিত করার ঘটনা ঘটেছে। তাই বলে এসব ঘটনায় সরকারি কাজে বাধাদানের কারণে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়নি।
সরকার তাহলে এবার এমন খড়্গহস্ত হলো কেন আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে? পত্রিকাটির কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিকসহ অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার মানে হলো, পত্রিকাটির যেকোনো সাংবাদিককে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করার লাইসেন্স নিয়ে রাখা। শুধু চাকরিচ্যুতি নয়, আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের তাই এখন পালিয়ে থাকতে হবে গ্রেপ্তার এড়াতে চাইলে।
এই পরিস্থিতি সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রশিল্পের জন্য এক ঘোর অমানিশার ইঙ্গিতবাহী।
৪.
এসব ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি চিন্তা করে আমরা উদ্বিগ্ন। এতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শুধু তা নয়, এটি অন্য সব সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে সরকারগুলো ঐতিহাসিকভাবে অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং চিন্তাচেতনায় সামন্তবাদী। এর বিরুদ্ধে নাগরিক স্বার্থের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হচ্ছে সংবাদপত্র। পত্রিকা যে চাইলেই আসলে বন্ধ করে দেওয়া যায়, এই আশঙ্কা গেড়ে বসলে সাংবাদিকতা নানাভাবে শৃঙ্খলিত হবে। সরকারগুলো আরও স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পাবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সাংবাদিকদের সুস্পষ্ট অনৈক্যই বাংলাদেশের সরকারগুলোকে ক্রমাগত গণমাধ্যমবিরোধী ভূমিকা গ্রহণে বাড়তি সাহস জুগিয়েছে। মাহমুদুর রহমান যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলা করেছেন এবং তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন, সেই পত্রিকাগুলোতেও আমার দেশ বন্ধের ও তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ার নিন্দা করে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক সমিতিগুলো এখনো ঐক্যবদ্ধভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারেনি।
দলমতনির্বিশেষে সাংবাদিকনেতারা সবাই মিলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার পদক্ষেপ নিলে আমার দেশ (এবং চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি) বন্ধের আদেশ এবং প্রশ্নবিদ্ধ মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়তো সম্ভব। এটুকু দায়িত্ব পালনে তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ হবে। আরও সাংবাদিক কোনো না কোনো সময় অন্যায় গ্রেপ্তারের শিকার হবেন।
কোনো মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে এই পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments