ডিসেম্বর ২০০৮-এর আগে ও পরে by সৈয়দ আবুল মকসুদ
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রচার বন্ধ হওয়ার আগের রাত পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহে আমি ৫০টির বেশি নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছি। কোনো বড় দলের নেতা হিসেবে নয়, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবেও নয়। ৮-১০টি নাগরিক সংগঠনের আমন্ত্রণে গিয়েছি তাদের আয়োজিত প্রজেকশন মিটিংয়ে। সেসব জনসভায় বড় বড় দলের প্রার্থীরা তাঁদের বক্তব্য দিতেন। প্রতিদ্বন্দ্বীর কোনো অভিযোগ বা প্রশ্নের উত্তর দিতেন, বিশেষ করে নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে গিয়ে জনগণের জন্য কী করবেন, তা ভোটারদের জানাতেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) থেকে তো আমরা শপথবাক্য পর্যন্ত পাঠ করিয়ে তাতে তাঁদের স্বাক্ষর নিয়েছি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাঁদের অনেকেই আজ সংসদ সদস্য।
আমাদের উপস্থিতিতে ওই সব জনসভায় প্রার্থীদের বক্তৃতা ছিল খুবই উপভোগ্য। ভাষা প্রাঞ্জল। মোহাম্মদ আলী ক্লের মতো মাংসপেশিওয়ালা প্রার্থীরও অতি নরম গলা। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, কারও কণ্ঠেই তখন কিছুমাত্র উগ্রতা দেখিনি।
দুই বছর আগে যাঁর সামনাসামনি হলে বহু মানুষ মূর্ছিত হতো, যাঁর গলার আওয়াজ শুনলে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত যেকোনো মানুষের, ২৯ ডিসেম্বরের আগের দিনগুলোয় দেখেছি, তাঁর গলায় কী মাধুর্য! যেমন-তেমন লোকের কথার যিনি জবাব দিতেন না, ঘনিষ্ঠ মানুষ দেখলেও পাজেরোর কাচ নামিয়ে সালামের উত্তর দিতেন না, তিনিও ওই সময়টুকুতে ছাবেদালি শেখ আর কেষ্ট কর্মকারকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। জড়িয়ে ধরার সময় অবশ্য মনে মনে বলতেন: স্লারা, ভালোয় ভালোয় ভোট দ্যাস তো দিলি, না দিলে অন্য ব্যবস্থা করা আছে।
সোয়া বছর আগের ঘটনা বলে তাঁদের বক্তৃতার বিষয়বস্তুও বেশ মনে আছে। মোটামুটি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন সিরিজের বক্তৃতার মতো। তবে তখন প্রার্থীরা কী বলেছেন, এর চেয়ে কী বলেননি, সেটাই এখন বেশি করে মনে হচ্ছে। তাঁরা কখনো বলেননি, নির্বাচিত হয়ে শেরেবাংলানগরের লাল দালানে গেলে অন্য দলের নেতার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করব যে তাঁর লাশ কবরে থাক বা না থাক, তাঁর অবিনাশী আত্মা ছটফট করতে থাকবে। যদি প্রয়াত নেতার আত্মার কান থাকে, তাহলে তিনি কানে আঙুল দেবেন। যদি প্রয়াত নেতার আত্মার চেতনা থাকে, তাহলে আমার বক্তৃতা শুনে অচেতন হয়ে যাবেন।
২৯ ডিসেম্বরপূর্ব কোনো সভায়ই কোনো প্রার্থী বলেননি যে আমাদের ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বছরখানেকের মধ্যেই বাড়িয়ে নেব। অবশ্য যে ভাতা এখন তাঁরা পান, তা কম। বাড়ানো দরকার। তবে অধিকাংশ সাংসদেরই মাসিক ভাতাটা এক দিনের পকেটখরচও নয়। আমি খুশি হতাম, যদি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বেতন পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। তাঁর মতো আরও কয়েকজন আছেন বর্তমান সংসদে। তাঁদের ভাতা বাড়ালে ভালো হয়।
একটি নির্বাচনী সভাতেও কোনো প্রার্থী বলেননি, প্রাণপ্রিয় ভাইয়েরা আমার, নির্বাচিত হলে শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যবস্থা কয়েক হপ্তার মধ্যেই করে ফেলব। গাড়ি দিলে আমাদের পূর্ববর্তীদের মতো দ্বিগুণ দামে বেচে দেব। সেদিন বরং বলতে চেয়েছেন, আপনারা ভোট দিন, সম্ভব হলে আপনাদের টয়োটা-বিএমডব্লিউ গাড়ি না হলেও মোটরসাইকেল কিনে দেব এবং সেটা চালানোর জন্য বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তা পাকা করে দেব।
সেদিন তারা ঘুণাক্ষরেও বলেননি, মন্ত্রী ইত্যাদি হয়ে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ পেলেও এমপির ফ্ল্যাটটি ছাড়ব না। দুটোই রাখব। ওতে আমাদের জন্মগত অধিকার। মোগল যুগের মৌরসি পাট্টা। তাঁরা বলেননি, আমি এবং বেগম সাহেবা ও তাঁর ভাইবোন (অথবা আমার কর্তা) সরকারি বাড়িতে উঠে গেলেও আমার এমপির ফ্ল্যাটে থাকবে আমার ড্রাইভার, কাজের বুয়া, অফিস সহকারী, দলীয় কর্মী ও আমার টেন্ডল। আমরা হাজি মুহসীন, ওরা গরিব মানুষ। আধুনিক ফ্ল্যাটে থাকেনি কোনো দিন, এখন একটু সুখ ভোগ করুক। এবং তাঁদের ‘দাপটে এমপি হোস্টেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম’ হয় তো হোক। তারপর যেদিন বোমা ফাটাবে, সেদিন বলব: জঙ্গিবাদ।
২০০৮-এর ডিসেম্বরে কোনো নির্বাচনী সভাতেই তাঁরা বলেননি, নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার স্কুল-কলেজগুলোর ভর্তি-বাণিজ্যে বেসাতি করব চুটিয়ে। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের প্রতিদিন সকালে-সন্ধ্যায় উপদেশ দেব। সেদিন কোনো প্রার্থীই বলেননি, নির্বাচিত হয়ে পয়লা মাসেই বিড়াল না মারলেও বিমানবন্দর ও ফেরিঘাটের লোকদের চড় মারব। বছরখানেক সংসদে না গেলেও লাল পাসপোর্ট নিয়ে সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণ করব, বিশেষ করে দ্বিতীয় স্বদেশ আমেরিকা।
খিস্তিখেউড় জীবনের অংশ। অশ্রাব্য গালিগালাজ বাক্স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। মৌলিক মানবাধিকার। এ ছাড়া শালা-টালা যদি ঘরের মধ্যে বা হাট-বাজারে বলা যায়, তাহলে লাল বাড়ির হলঘরে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না কেন? জীবনের যেকোনো অবস্থায় আস্তিন গোটানো দোষের নয়। লিঙ্গবৈষম্যহীনতার যুগে কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচানোও অস্বাভাবিক কিছু নয়। মাননীয় স্পিকার রসিক মানুষ। তাই তিনি শরীরে তেল মেখে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেসলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর ফাটা মাথা ও অকালমৃত্যুর কথাও তাঁর মনে পড়ে থাকবে।
উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য, কঠোর বাক্যবিনিময় বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশের সংসদেও হয়ে থাকে। হাতাহাতি ও জুতা-ছোড়াছুড়ি ভারতের সংসদেও হয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে বা নীতি-আদর্শগত কারণে। প্রয়াত নেতাদের প্রতি বিষোদ্গার থেকে নয়। বাংলাদেশি গণতন্ত্রের কপাল। জনপ্রতিনিধিদের কথা ও কাজ দেখে মনে হচ্ছে, ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে মার্চ ২০১০-এর দূরত্ব সোয়া এক বছর নয়, সোয়া এক শতাব্দীর!
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমাদের উপস্থিতিতে ওই সব জনসভায় প্রার্থীদের বক্তৃতা ছিল খুবই উপভোগ্য। ভাষা প্রাঞ্জল। মোহাম্মদ আলী ক্লের মতো মাংসপেশিওয়ালা প্রার্থীরও অতি নরম গলা। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, কারও কণ্ঠেই তখন কিছুমাত্র উগ্রতা দেখিনি।
দুই বছর আগে যাঁর সামনাসামনি হলে বহু মানুষ মূর্ছিত হতো, যাঁর গলার আওয়াজ শুনলে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত যেকোনো মানুষের, ২৯ ডিসেম্বরের আগের দিনগুলোয় দেখেছি, তাঁর গলায় কী মাধুর্য! যেমন-তেমন লোকের কথার যিনি জবাব দিতেন না, ঘনিষ্ঠ মানুষ দেখলেও পাজেরোর কাচ নামিয়ে সালামের উত্তর দিতেন না, তিনিও ওই সময়টুকুতে ছাবেদালি শেখ আর কেষ্ট কর্মকারকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। জড়িয়ে ধরার সময় অবশ্য মনে মনে বলতেন: স্লারা, ভালোয় ভালোয় ভোট দ্যাস তো দিলি, না দিলে অন্য ব্যবস্থা করা আছে।
সোয়া বছর আগের ঘটনা বলে তাঁদের বক্তৃতার বিষয়বস্তুও বেশ মনে আছে। মোটামুটি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন সিরিজের বক্তৃতার মতো। তবে তখন প্রার্থীরা কী বলেছেন, এর চেয়ে কী বলেননি, সেটাই এখন বেশি করে মনে হচ্ছে। তাঁরা কখনো বলেননি, নির্বাচিত হয়ে শেরেবাংলানগরের লাল দালানে গেলে অন্য দলের নেতার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করব যে তাঁর লাশ কবরে থাক বা না থাক, তাঁর অবিনাশী আত্মা ছটফট করতে থাকবে। যদি প্রয়াত নেতার আত্মার কান থাকে, তাহলে তিনি কানে আঙুল দেবেন। যদি প্রয়াত নেতার আত্মার চেতনা থাকে, তাহলে আমার বক্তৃতা শুনে অচেতন হয়ে যাবেন।
২৯ ডিসেম্বরপূর্ব কোনো সভায়ই কোনো প্রার্থী বলেননি যে আমাদের ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বছরখানেকের মধ্যেই বাড়িয়ে নেব। অবশ্য যে ভাতা এখন তাঁরা পান, তা কম। বাড়ানো দরকার। তবে অধিকাংশ সাংসদেরই মাসিক ভাতাটা এক দিনের পকেটখরচও নয়। আমি খুশি হতাম, যদি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বেতন পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। তাঁর মতো আরও কয়েকজন আছেন বর্তমান সংসদে। তাঁদের ভাতা বাড়ালে ভালো হয়।
একটি নির্বাচনী সভাতেও কোনো প্রার্থী বলেননি, প্রাণপ্রিয় ভাইয়েরা আমার, নির্বাচিত হলে শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যবস্থা কয়েক হপ্তার মধ্যেই করে ফেলব। গাড়ি দিলে আমাদের পূর্ববর্তীদের মতো দ্বিগুণ দামে বেচে দেব। সেদিন বরং বলতে চেয়েছেন, আপনারা ভোট দিন, সম্ভব হলে আপনাদের টয়োটা-বিএমডব্লিউ গাড়ি না হলেও মোটরসাইকেল কিনে দেব এবং সেটা চালানোর জন্য বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তা পাকা করে দেব।
সেদিন তারা ঘুণাক্ষরেও বলেননি, মন্ত্রী ইত্যাদি হয়ে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ পেলেও এমপির ফ্ল্যাটটি ছাড়ব না। দুটোই রাখব। ওতে আমাদের জন্মগত অধিকার। মোগল যুগের মৌরসি পাট্টা। তাঁরা বলেননি, আমি এবং বেগম সাহেবা ও তাঁর ভাইবোন (অথবা আমার কর্তা) সরকারি বাড়িতে উঠে গেলেও আমার এমপির ফ্ল্যাটে থাকবে আমার ড্রাইভার, কাজের বুয়া, অফিস সহকারী, দলীয় কর্মী ও আমার টেন্ডল। আমরা হাজি মুহসীন, ওরা গরিব মানুষ। আধুনিক ফ্ল্যাটে থাকেনি কোনো দিন, এখন একটু সুখ ভোগ করুক। এবং তাঁদের ‘দাপটে এমপি হোস্টেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম’ হয় তো হোক। তারপর যেদিন বোমা ফাটাবে, সেদিন বলব: জঙ্গিবাদ।
২০০৮-এর ডিসেম্বরে কোনো নির্বাচনী সভাতেই তাঁরা বলেননি, নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার স্কুল-কলেজগুলোর ভর্তি-বাণিজ্যে বেসাতি করব চুটিয়ে। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের প্রতিদিন সকালে-সন্ধ্যায় উপদেশ দেব। সেদিন কোনো প্রার্থীই বলেননি, নির্বাচিত হয়ে পয়লা মাসেই বিড়াল না মারলেও বিমানবন্দর ও ফেরিঘাটের লোকদের চড় মারব। বছরখানেক সংসদে না গেলেও লাল পাসপোর্ট নিয়ে সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণ করব, বিশেষ করে দ্বিতীয় স্বদেশ আমেরিকা।
খিস্তিখেউড় জীবনের অংশ। অশ্রাব্য গালিগালাজ বাক্স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। মৌলিক মানবাধিকার। এ ছাড়া শালা-টালা যদি ঘরের মধ্যে বা হাট-বাজারে বলা যায়, তাহলে লাল বাড়ির হলঘরে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না কেন? জীবনের যেকোনো অবস্থায় আস্তিন গোটানো দোষের নয়। লিঙ্গবৈষম্যহীনতার যুগে কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচানোও অস্বাভাবিক কিছু নয়। মাননীয় স্পিকার রসিক মানুষ। তাই তিনি শরীরে তেল মেখে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেসলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর ফাটা মাথা ও অকালমৃত্যুর কথাও তাঁর মনে পড়ে থাকবে।
উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য, কঠোর বাক্যবিনিময় বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশের সংসদেও হয়ে থাকে। হাতাহাতি ও জুতা-ছোড়াছুড়ি ভারতের সংসদেও হয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে বা নীতি-আদর্শগত কারণে। প্রয়াত নেতাদের প্রতি বিষোদ্গার থেকে নয়। বাংলাদেশি গণতন্ত্রের কপাল। জনপ্রতিনিধিদের কথা ও কাজ দেখে মনে হচ্ছে, ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে মার্চ ২০১০-এর দূরত্ব সোয়া এক বছর নয়, সোয়া এক শতাব্দীর!
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments