বিস্কুট-দৌড় এবং উপেক্ষিত জনসংখ্যা ইস্যু by আনিসুল হক
বিস্কুট-দৌড়ের সঙ্গে আমাদের সবারই কমবেশি পরিচয় আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাধারণত এই খেলাটা হয়ে থাকে। একটা দড়ির সঙ্গে সুতোর সাহায্যে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেকগুলো বিস্কুট। দুজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা দড়িটার দুই মাথা ধরে মাঠের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক প্রান্তে বাচ্চারা লাইন ধরে দাঁড়ায়। তারপর যে-ই না বাঁশি বেজে উঠল, বাচ্চারা সবাই দৌড় ধরল বিস্কুটের দিকে। তাদের সবারই আবার হাত পেছন দিকে বাঁধা। তারা এবার আঙুরের মতো ঝুলতে থাকা বিস্কুট মুখে পোরার জন্য লাফাতে শুরু করল। শিক্ষক দুজনও দড়ি ধরে নাড়তে লাগলেন। বিস্কুটও নড়ছে। সেই বিস্কুট মুখে পোরা কি যা-তা কথা। তবুও কেউ না কেউ মুখে পুরে ফেলে। তারপর এক ঝটকায় সুতো ছিঁড়ে সে দৌড় ধরল শেষ গন্তব্য লাইনের দিকে।
পেছনে হাতবাঁধা বাচ্চারা যখন বিস্কুট মুখে পোরার জন্য লাফায়, তখন দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। কেউ বা হেসে গড়িয়ে পড়ে। অবশ্য যাদের ছেলেমেয়েরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, তাদের পক্ষে হাসা কঠিন, প্রতিযোগিতার উত্তেজনায় তাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিস্কুট-দৌড়ের মতো। আমাদের কিছু উন্নয়ন-সহযোগী আছে। তাদের হাতে থাকে দড়ি। সেই দড়িতে তারা সুতো দিয়ে তহবিল বেঁধে রাখে। আর আমাদের উন্নয়ন সংস্থাগুলো দৌড় ধরে সেই তহবিল বা ফান্ড মুখে পোরার জন্য। তারা যে খুব সহজে বিস্কুটোপম তহবিলটা গলাধঃকরণ করতে পারে, তা নয়। খুব সহজে লক্ষ্যেও পৌঁছাতে তারা পারে না। কী করব বলুন, আমাদের হাত-পা যে দাতাদের কাছে বাঁধা! তাদের এই যুক্তি তো আমাদের মানতেই হবে।
একেকবার একেকটা বিষয় নিয়ে খুব একটা হইচই শুরু হয়। কারণ কী? কারণ ওই বিষয়ে ব্যাপক তহবিল এসেছে। তো সবারই ওই বিষয়ে এক বা একাধিক প্রকল্প তৈরি হয়ে যায়! যখন যে বিষয়ে ফান্ড আসে, আর সেই তহবিলের অর্থপ্রবাহ যত দিন থাকে, তত দিনই ব্যাপক তৎপরতা। প্রকল্প শেষ তো ওই বিষয়ে আমাদের সব আগ্রহ, উদ্বেগ, ভালোবাসাও শেষ। এর আরেক নাম হয়তো মুরগি পোষা ভালোবাসা। যত দিন মুরগি ডিম দেয়, তত দিনই সে গৃহস্থের ভালোবাসা পায়; যেই ডিম দেওয়া বন্ধ, অমনি তাকে ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলা শেষ।
কিছুদিন এই দেশে খুব হইচই হলো এইডস নিয়ে। এইডস নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। সেই সচেতনতাটা হতে হবে স্থায়ী, কেবল যে কদিন তহবিল আসছে, সেই কদিনের জন্য তো নয়। তো যাদের কাছে অর্থ আসছে, তাঁরা এইডস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, যাঁদের কাছে আসছে না, তাঁদের মাথাব্যথা সেরে গেছে। আর্সেনিকের চিন্তায় অনেকেরই ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, কারণ তহবিল এসেছিল এই খাতে। এখনো আর্সেনিক আছে, সেই সমস্যা আছে, কেবল অনিদ্রা কেটে গেছে, কারণ হয়তো এ বিষয়ে আর তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। একেকবার একেক জিনিস নিয়ে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কদিন গেল সবুজ ছাতা, তারপর এল সূর্যের হাসি। এখন কোথায় সবুজ ছাতা আর কোথায় সূর্যের হাসি, কে জানে। এখন ব্যাপক টাকার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে। সরকারের বরাদ্দ করা ৭০০ কোটি টাকার জন্য হাজারো প্রকল্প প্রস্তাব জমা পড়েছে, শত শত তদবির আসতে শুরু করেছে—কাগজে পড়েছেন নিশ্চয়ই। এই প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছে।
তো বাংলাদেশে খুব জোরেশোরে শুরু হয়েছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম। বেতারে-টেলিভিশনে রাস্তাঘাটে চলেছিল ব্যাপক প্রচারণা। পরিবার পরিকল্পনা সুবিধাও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়েছিল। তার সুফল দেখা দিয়েছিল। এই দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছিল। এখন আর বেতারে-টিভিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার কথা শুনিই না বললে চলে। আমাদের ছাত্রজীবনে তো স্কুলপাঠ্য গল্প ছিল, মোমেনরা সাত ভাই। এখন এই রকম কোনো গল্প আছে বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, ২০১৫ সালে হবে ১৮ কোটি। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটা। অস্ট্রেলিয়া আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৬৫ গুণ বড়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বে যদি অস্ট্রেলিয়াতে লোক বসানো যায়, তাহলে পৃথিবীর সব লোক অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেকটাতেই এঁটে যাবে, বাকি অর্ধেক অস্ট্রেলিয়া খালি পড়ে থাকবে। অথচ অস্ট্রেলিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটির মতো। পৃথিবীর সব লোককে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের হারে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বসানো হয়, তাহলে আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশেই সবার জায়গা হয়ে যাবে, বাকি এক ভাগ খালি পড়ে থাকবে।
আর ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কোনো গণিতের সূত্র মানে না। উপকূলে আইলা-সিডরের পানি নামছে না, মানুষ চলে আসে ঢাকায়; নদীতে ভেঙে যাচ্ছে জনপদ, মানুষ চলে আসছে ঢাকায়; চরাঞ্চলে মঙ্গা, মানুষ চলে আসছে ঢাকায়। আবার সবার ছেলেমেয়েকে ঢাকায় পড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গার্মেন্টস কলকারখানা, সেনানিবাস—সব এই ঢাকাতেই হতে হবে।
ঢাকার যানজট নিয়ে আমরা চিন্তিত। একদিন নিয়ম করে দিন, বলুন, আজ সবাইকে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-কারখানায় যেতে হবে, কিন্তু কোনো যান চলবে না, দেখুন রাস্তায় মানবজট লাগে কি না! ফুটপাতে মানুষের জায়গা হয় না, যদি ফুটপাতে কোনো ফেরিওয়ালা না বসে, তবুও। লাখ লাখ লোক প্রতিটা মোড়ে রাস্তা পার হচ্ছে, ওই সব মোড়ে যানজট লাগবেই। এত মানুষকে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস দেবেন, যানসুবিধা দেবেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান দেবেন, কীভাবে দেবেন, আল্লাহ জানেন।
আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর কথা বলি না, কারণ এই বিষয়ে এখন আর দাতাদের তহবিল আসছে না। আর আমরা বিকেন্দ্রীকরণের নাম কেউ মুখেও আনছি না। আমাদের সবকিছু ঢাকামুখী! বন্দরনগর চট্টগ্রামকে খুব বাহারি একটা নাম দেওয়া হয়েছে, বাণিজ্যিক রাজধানী। কিন্তু আমাদের বণিকেরাও সব বাস করেন ঢাকায়, আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রও ঢাকায়, এমনকি আমাদের পোশাক কারখানাগুলোও ঢাকায়। অথচ চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী করে গড়ে তুলে সেটাকেই বাণিজ্যের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা উচিত। আমাদের একটা শিক্ষা শহর গড়ে উঠতে পারে। রাজশাহীর কথা একবার শুনেছিলাম এই বিষয়ে। হোক না রাজশাহী এবং আরও কোনো কোনো শহর শিক্ষার জন্য বিখ্যাত, যাকে আমরা ডাকব বাংলার ক্যামব্রিজ বা বোস্টন বলে। সেখানে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, কলেজ থাকবে, প্রকৌশল বা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থাকবে অনেকগুলো। আমাদের একটা চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত শহর থাকতে পারে ঢাকার বাইরে। কিন্তু এখন কান ফুটো করতেও মানুষকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। আমাদের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর—সবকিছুর কেন্দ্র ঢাকায়। বিকেন্দ্রীকরণের কথা আমরা বেমালুম চেপে গেছি। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর বরিশালে করা হয়েছিল, ওখানে কেউ যেতে চায় না, অগত্যা ওটা ফের ফিরিয়ে আনা হয়েছে ঢাকায়।
সত্য বটে, আমাদের জনসংখ্যাই আমাদের শক্তি। কিন্তু সংখ্যাকে শক্তি হিসেবে তৈরি করতে হলে তো তাকে শিক্ষা দিতে হবে, স্বাস্থ্য দিতে হবে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের জন্য সত্যি বিশাল সম্পদ, কিন্তু অদক্ষ জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যা আমাদের জন্য সম্পদ নয়, বোঝা।
সরকারের উচিত আবার একটা আন্দোলন গড়ে তোলা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের আন্দোলন। একটা বৈপ্লবিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া—বিকেন্দ্রীকরণের বিপ্লব। আমাদের অবশ্যই স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের অবশ্যই উপজেলা পর্যায়ে মানসম্মত বিশেষজ্ঞ শিক্ষা-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আর সাধারণ শিক্ষা ও চিকিৎসা সুপ্রতুল করতে হবে গ্রামগঞ্জ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত।
এই সরকার অবশ্য দুটো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, এক বাড়ি এক খামার আর মঙ্গা এলাকায় প্রতিটি পরিবারের একজনকে কাজ দেওয়ার কর্মসূচি। এই সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় গ্রামের কথা, গরিব মানুষের কথা, গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা শুনতে পাই। এটা ভালো। শহরমুখী জনস্রোত অবশ্যই রোধ করতে হবে, আর অবশ্যই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিষয়টাকে সরকারের, কিংবা নীতিনির্ধারকদের বা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অগ্রাধিকার তালিকায় আর দেখতে পাই না। আগে রেডিও খুললেই সুখী পরিবার ধরনের অনুষ্ঠান শুনতে পেতাম, এখন কোনো বেসরকারি চ্যানেলে কোনো দিন কাউকে পরিবার পরিকল্পনার কথা মুখে আনতে শুনি না, সরকারি টেলিভিশনেও আদৌ এই জাতীয় অনুষ্ঠান হয় কি না, আমাদের চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশের উন্নয়নকে যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক একটা পরিকল্পনা, একটা লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হবে। আর ঢাকাকে যদি দু-চার বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত নগর হিসেবে ঘোষণা না দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
আমাদের উন্নয়ন নীতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেন বিস্কুট-দৌড়ের নিয়ম দিয়ে পরিচালিত না হয়। খালি বিস্কুটের লোভে আমরা যেন লাফালাফি না করি।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা বুঝে নিয়েছেন, এ দেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাঁদের অনেকেই বিদেশে টাকাকড়ি জমাচ্ছেন, কেউ কেউ নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন, ছেলেপুলেদের তো অবশ্যই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। লুটে শুষে দেশটাকে ছোবড়া বানানো হয়ে গেলে তাঁরা বিমানের সিটে বসে পড়বেন। কিন্তু আমাদের তো আরেকটা পাসপোর্ট নেই। দেশের নব্বই ভাগ লোকের এই দেশটাই শেষ ঠিকানা। কাজেই দেশটাকে বাঁচাতে হবে, মনুষ্য বসবাসের উপযোগী রাখতে হবে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে জনসংখ্যাটাকে আমাদের এক নম্বর ইস্যু হিসেবে সামনে আনতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নদনদী পাহাড় সমুদ্র কৃষিজমি বন পরিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে হবে। আবার প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিতে হবে। দাতারা যদি আমাদের বিস্কুট নাও দেয়, তবুও নিজের ভালো নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। আমরা এখনো নিশ্চয়ই অতটা পাগল হইনি যে নিজের ভালোটাও বুঝব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
পেছনে হাতবাঁধা বাচ্চারা যখন বিস্কুট মুখে পোরার জন্য লাফায়, তখন দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। কেউ বা হেসে গড়িয়ে পড়ে। অবশ্য যাদের ছেলেমেয়েরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, তাদের পক্ষে হাসা কঠিন, প্রতিযোগিতার উত্তেজনায় তাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিস্কুট-দৌড়ের মতো। আমাদের কিছু উন্নয়ন-সহযোগী আছে। তাদের হাতে থাকে দড়ি। সেই দড়িতে তারা সুতো দিয়ে তহবিল বেঁধে রাখে। আর আমাদের উন্নয়ন সংস্থাগুলো দৌড় ধরে সেই তহবিল বা ফান্ড মুখে পোরার জন্য। তারা যে খুব সহজে বিস্কুটোপম তহবিলটা গলাধঃকরণ করতে পারে, তা নয়। খুব সহজে লক্ষ্যেও পৌঁছাতে তারা পারে না। কী করব বলুন, আমাদের হাত-পা যে দাতাদের কাছে বাঁধা! তাদের এই যুক্তি তো আমাদের মানতেই হবে।
একেকবার একেকটা বিষয় নিয়ে খুব একটা হইচই শুরু হয়। কারণ কী? কারণ ওই বিষয়ে ব্যাপক তহবিল এসেছে। তো সবারই ওই বিষয়ে এক বা একাধিক প্রকল্প তৈরি হয়ে যায়! যখন যে বিষয়ে ফান্ড আসে, আর সেই তহবিলের অর্থপ্রবাহ যত দিন থাকে, তত দিনই ব্যাপক তৎপরতা। প্রকল্প শেষ তো ওই বিষয়ে আমাদের সব আগ্রহ, উদ্বেগ, ভালোবাসাও শেষ। এর আরেক নাম হয়তো মুরগি পোষা ভালোবাসা। যত দিন মুরগি ডিম দেয়, তত দিনই সে গৃহস্থের ভালোবাসা পায়; যেই ডিম দেওয়া বন্ধ, অমনি তাকে ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলা শেষ।
কিছুদিন এই দেশে খুব হইচই হলো এইডস নিয়ে। এইডস নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। সেই সচেতনতাটা হতে হবে স্থায়ী, কেবল যে কদিন তহবিল আসছে, সেই কদিনের জন্য তো নয়। তো যাদের কাছে অর্থ আসছে, তাঁরা এইডস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, যাঁদের কাছে আসছে না, তাঁদের মাথাব্যথা সেরে গেছে। আর্সেনিকের চিন্তায় অনেকেরই ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, কারণ তহবিল এসেছিল এই খাতে। এখনো আর্সেনিক আছে, সেই সমস্যা আছে, কেবল অনিদ্রা কেটে গেছে, কারণ হয়তো এ বিষয়ে আর তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। একেকবার একেক জিনিস নিয়ে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কদিন গেল সবুজ ছাতা, তারপর এল সূর্যের হাসি। এখন কোথায় সবুজ ছাতা আর কোথায় সূর্যের হাসি, কে জানে। এখন ব্যাপক টাকার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে। সরকারের বরাদ্দ করা ৭০০ কোটি টাকার জন্য হাজারো প্রকল্প প্রস্তাব জমা পড়েছে, শত শত তদবির আসতে শুরু করেছে—কাগজে পড়েছেন নিশ্চয়ই। এই প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছে।
তো বাংলাদেশে খুব জোরেশোরে শুরু হয়েছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম। বেতারে-টেলিভিশনে রাস্তাঘাটে চলেছিল ব্যাপক প্রচারণা। পরিবার পরিকল্পনা সুবিধাও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়েছিল। তার সুফল দেখা দিয়েছিল। এই দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছিল। এখন আর বেতারে-টিভিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার কথা শুনিই না বললে চলে। আমাদের ছাত্রজীবনে তো স্কুলপাঠ্য গল্প ছিল, মোমেনরা সাত ভাই। এখন এই রকম কোনো গল্প আছে বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, ২০১৫ সালে হবে ১৮ কোটি। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটা। অস্ট্রেলিয়া আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৬৫ গুণ বড়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বে যদি অস্ট্রেলিয়াতে লোক বসানো যায়, তাহলে পৃথিবীর সব লোক অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেকটাতেই এঁটে যাবে, বাকি অর্ধেক অস্ট্রেলিয়া খালি পড়ে থাকবে। অথচ অস্ট্রেলিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটির মতো। পৃথিবীর সব লোককে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের হারে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বসানো হয়, তাহলে আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশেই সবার জায়গা হয়ে যাবে, বাকি এক ভাগ খালি পড়ে থাকবে।
আর ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কোনো গণিতের সূত্র মানে না। উপকূলে আইলা-সিডরের পানি নামছে না, মানুষ চলে আসে ঢাকায়; নদীতে ভেঙে যাচ্ছে জনপদ, মানুষ চলে আসছে ঢাকায়; চরাঞ্চলে মঙ্গা, মানুষ চলে আসছে ঢাকায়। আবার সবার ছেলেমেয়েকে ঢাকায় পড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গার্মেন্টস কলকারখানা, সেনানিবাস—সব এই ঢাকাতেই হতে হবে।
ঢাকার যানজট নিয়ে আমরা চিন্তিত। একদিন নিয়ম করে দিন, বলুন, আজ সবাইকে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-কারখানায় যেতে হবে, কিন্তু কোনো যান চলবে না, দেখুন রাস্তায় মানবজট লাগে কি না! ফুটপাতে মানুষের জায়গা হয় না, যদি ফুটপাতে কোনো ফেরিওয়ালা না বসে, তবুও। লাখ লাখ লোক প্রতিটা মোড়ে রাস্তা পার হচ্ছে, ওই সব মোড়ে যানজট লাগবেই। এত মানুষকে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস দেবেন, যানসুবিধা দেবেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান দেবেন, কীভাবে দেবেন, আল্লাহ জানেন।
আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর কথা বলি না, কারণ এই বিষয়ে এখন আর দাতাদের তহবিল আসছে না। আর আমরা বিকেন্দ্রীকরণের নাম কেউ মুখেও আনছি না। আমাদের সবকিছু ঢাকামুখী! বন্দরনগর চট্টগ্রামকে খুব বাহারি একটা নাম দেওয়া হয়েছে, বাণিজ্যিক রাজধানী। কিন্তু আমাদের বণিকেরাও সব বাস করেন ঢাকায়, আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রও ঢাকায়, এমনকি আমাদের পোশাক কারখানাগুলোও ঢাকায়। অথচ চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী করে গড়ে তুলে সেটাকেই বাণিজ্যের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা উচিত। আমাদের একটা শিক্ষা শহর গড়ে উঠতে পারে। রাজশাহীর কথা একবার শুনেছিলাম এই বিষয়ে। হোক না রাজশাহী এবং আরও কোনো কোনো শহর শিক্ষার জন্য বিখ্যাত, যাকে আমরা ডাকব বাংলার ক্যামব্রিজ বা বোস্টন বলে। সেখানে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, কলেজ থাকবে, প্রকৌশল বা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থাকবে অনেকগুলো। আমাদের একটা চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত শহর থাকতে পারে ঢাকার বাইরে। কিন্তু এখন কান ফুটো করতেও মানুষকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। আমাদের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর—সবকিছুর কেন্দ্র ঢাকায়। বিকেন্দ্রীকরণের কথা আমরা বেমালুম চেপে গেছি। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর বরিশালে করা হয়েছিল, ওখানে কেউ যেতে চায় না, অগত্যা ওটা ফের ফিরিয়ে আনা হয়েছে ঢাকায়।
সত্য বটে, আমাদের জনসংখ্যাই আমাদের শক্তি। কিন্তু সংখ্যাকে শক্তি হিসেবে তৈরি করতে হলে তো তাকে শিক্ষা দিতে হবে, স্বাস্থ্য দিতে হবে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের জন্য সত্যি বিশাল সম্পদ, কিন্তু অদক্ষ জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যা আমাদের জন্য সম্পদ নয়, বোঝা।
সরকারের উচিত আবার একটা আন্দোলন গড়ে তোলা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের আন্দোলন। একটা বৈপ্লবিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া—বিকেন্দ্রীকরণের বিপ্লব। আমাদের অবশ্যই স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের অবশ্যই উপজেলা পর্যায়ে মানসম্মত বিশেষজ্ঞ শিক্ষা-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আর সাধারণ শিক্ষা ও চিকিৎসা সুপ্রতুল করতে হবে গ্রামগঞ্জ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত।
এই সরকার অবশ্য দুটো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, এক বাড়ি এক খামার আর মঙ্গা এলাকায় প্রতিটি পরিবারের একজনকে কাজ দেওয়ার কর্মসূচি। এই সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় গ্রামের কথা, গরিব মানুষের কথা, গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা শুনতে পাই। এটা ভালো। শহরমুখী জনস্রোত অবশ্যই রোধ করতে হবে, আর অবশ্যই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিষয়টাকে সরকারের, কিংবা নীতিনির্ধারকদের বা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অগ্রাধিকার তালিকায় আর দেখতে পাই না। আগে রেডিও খুললেই সুখী পরিবার ধরনের অনুষ্ঠান শুনতে পেতাম, এখন কোনো বেসরকারি চ্যানেলে কোনো দিন কাউকে পরিবার পরিকল্পনার কথা মুখে আনতে শুনি না, সরকারি টেলিভিশনেও আদৌ এই জাতীয় অনুষ্ঠান হয় কি না, আমাদের চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশের উন্নয়নকে যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক একটা পরিকল্পনা, একটা লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হবে। আর ঢাকাকে যদি দু-চার বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত নগর হিসেবে ঘোষণা না দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
আমাদের উন্নয়ন নীতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেন বিস্কুট-দৌড়ের নিয়ম দিয়ে পরিচালিত না হয়। খালি বিস্কুটের লোভে আমরা যেন লাফালাফি না করি।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা বুঝে নিয়েছেন, এ দেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাঁদের অনেকেই বিদেশে টাকাকড়ি জমাচ্ছেন, কেউ কেউ নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন, ছেলেপুলেদের তো অবশ্যই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। লুটে শুষে দেশটাকে ছোবড়া বানানো হয়ে গেলে তাঁরা বিমানের সিটে বসে পড়বেন। কিন্তু আমাদের তো আরেকটা পাসপোর্ট নেই। দেশের নব্বই ভাগ লোকের এই দেশটাই শেষ ঠিকানা। কাজেই দেশটাকে বাঁচাতে হবে, মনুষ্য বসবাসের উপযোগী রাখতে হবে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে জনসংখ্যাটাকে আমাদের এক নম্বর ইস্যু হিসেবে সামনে আনতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নদনদী পাহাড় সমুদ্র কৃষিজমি বন পরিবেশ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে হবে। আবার প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিতে হবে। দাতারা যদি আমাদের বিস্কুট নাও দেয়, তবুও নিজের ভালো নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। আমরা এখনো নিশ্চয়ই অতটা পাগল হইনি যে নিজের ভালোটাও বুঝব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments