আমি বরং জেলে যাব, নির্বাসনে নয় -অপারেশন গ্রিন হান্ট by অরুন্ধতী রায়
দান্তেওয়াদার ঘটনার আগে ও পরে বলে কিছু নেই। (ভারতের মাওবাদী প্রভাবিত দান্তেওয়াদা এলাকায় আধাসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালাতে গেলে মাওবাদী গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে তাদের ৭৬ জন নিহত হন—অনুবাদক) আসলে সহিংসতার চক্রটি বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। মাওবাদীদের হাতে এত বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০০৫-০৭ সালে ঘটা এ রকম বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে আমি লিখেছি। আমি তাদের মধ্যে পড়ি না, যারা সিআরএফ জওয়ানেরা মারা যাওয়ায় উল্লসিত; আমি তাদেরও কেউ নই, যারা মাওবাদীদের নির্মূল করা দেখতে অধীর। আমাদের বুঝতে হবে, প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। একটি ব্যবস্থা, একটি যুদ্ধ যখন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা হয়ে দাঁড়ায় গরিবের বিরুদ্ধে বড়লোকের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে বড়লোকেরা গরিবস্য গরিবদের লেলিয়ে দেয় গরিবদেরই বিরুদ্ধে। সিআরএফ জওয়ানেরা এ রকমই এক যুদ্ধের ভয়াবহ শিকার। কিন্তু তারা কেবল মাওবাদীদেরই শিকার নয়, তারা শিকার হয়েছে এমন এক ব্যবস্থার হাতে, যা চরিত্রগতভাবেই সহিংস। যাঁরা এর বিরুদ্ধে নিন্দার কারখানা খুলে বসেছেন, তাঁদের ওই সব নিন্দা অনেকটাই অর্থহীন। কারণ, যাঁদের মৃত্যুর নিন্দা তাঁরা করছেন, সেই নিহত ব্যক্তিদের প্রতি তাঁদের আসলেই সহানুভূতি নেই। তাঁরাই তো এই জওয়ানদের দাবার বোড়ের মতো ব্যবহার করেছেন।
সরকারের যুক্তি হলো, মাওবাদীদের ভাইরাসের মতো ঝাড়বংশে বিনাশ করে দরিদ্র এলাকায় হাসপাতাল, বিদ্যালয় ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। ভারতের অনেক গরিব এলাকায়ই তো হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পুষ্টিবটিকা কর্মসূচিসহ অঢেল উন্নয়ন কার্যক্রম রয়েছে। তার পরও কি সেসব জায়গায় মাওবাদীরা নেই? আসলে সরকার স্কুলগুলোকে সেনাসদস্যদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করছে, যাতে বলতে পারে দেখো, মাওবাদীরা স্কুল ধ্বংস করে এবং তারা উন্নয়নের বিরুদ্ধে।
যে আমি ১০ বছর ধরে অহিংসা ও অহিংস আন্দোলন নিয়ে লিখে আসছি, সেই আমাকে সহিংসতার পক্ষে ভাবা অদ্ভুত। তবে অরণ্যে কিংবা ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’সহ এ রকম অজস্র অহিংস আন্দোলন কোনো একপর্যায়ে সফল হলেও সার্বিকভাবে ফল দিচ্ছে না। অহিংসা, বিশেষত, গান্ধীবাদী অহিংসা হলো এমন এক থিয়েটার, যেখানে দর্শক প্রয়োজন। কিন্তু অরণ্যের ভেতরে, যেখানে আপনার অহিংস মার খাওয়া দেখার কেউ নেই, সেখানে মধ্যরাতে হাজার হাজার পুলিশ আদিবাসীদের গ্রাম ঘিরে ফেললে কী করতে পারে তারা? যার পেটে খাবারই নেই, সে কীভাবে অনশন ধর্মঘট করবে? যাদের কোনো টাকা নেই, তাদের কর দেওয়া বন্ধ বা বিদেশি বা দেশি পণ্য বর্জন করতে বলার কী অর্থ? তারা আক্ষরিকভাবেই সর্বহারা। অরণ্যের আদিবাসীদের সহিংসতাকে আমি পাল্টা-সহিংসতা হিসেবে দেখি। তারা চালাচ্ছে প্রতিরোধের সহিংসতা, আগ্রাসী সহিংসতা নয়। সরকার সেই সহিংসতা দমনে যতই অস্ত্র নামায়, ততই সেসব অস্ত্র চলে যায় মাওবাদী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর কাছে। যেকোনো সমাজের জন্যই এ পরিস্থিতি ভয়ংকর। এই গরিবদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র হাজার হাজার প্যারা-মিলিটারি বাহিনী পাঠাচ্ছে। ওই জঙ্গলে একে-৪৭ ও গ্রেনেড হাতে তারা কী করছে আসলে?
আসলে আদিবাসী এলাকায় রাষ্ট্রের কাঠামোগত সন্ত্রাস ‘গণহত্যার মতো’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। আদিবাসীদের পুষ্টিহীনতা, তাদের দুর্দশা দেখে যেকোনো দায়িত্বশীল মানুষ বলবে, এদের ওপর থেকে এমন চাপ বন্ধ করুন, সহিংসতাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই আদিবাসীরা সংখ্যায় অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এত বিপুল মানুষের অস্তিত্বকে খনি করার জন্য মুনাফার নামে, উন্নয়নের নামে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দেওয়ার যুদ্ধ তো আসলে দেশবাসীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ। রাষ্ট্রের এই আগ্রাসী যুদ্ধের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধযুদ্ধের তুলনা অনৈতিক।
১৬ বছরের এক কিশোরী যদি দেখে যে সিপিআরএফের জওয়ানেরা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তার মা-বাবাকে মেরে ফেলছে; সেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে গেলে সে যদি বলে, আমি ওদের বিরুদ্ধে লড়ব, তাহলে তাকে কী বলার রয়েছে? বন্দুক হাতে তাকে দেখে আমার মধ্যে ভয়ংকর অনুভূতি হবে। তার পরও নিজের ধ্বংস মেনে নেওয়ার চেয়ে এই রুখে দাঁড়ানো ভালো।
ভারত হলো এমন এক মুষ্টিমেয়তন্ত্র, যেখানে গণতন্ত্র মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের স্বার্থ দেখছে। যে গণতন্ত্র গণমানুষের জন্য কাজ করে না, তা ভুয়া গণতন্ত্র। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শূন্যগর্ভ, এগুলো থেকে গরিবদের কিছু পাওয়ার নেই। নির্বাচন দেখুন, আদালত দেখুন, বিচারকদের দেখুন, দেখুন মিডিয়াকে। এর সবকিছুই বিরাট অংশের মানুষকে বাদ দিয়েই যা করার করে যাচ্ছে। কথা হলো, আপনি কোন প্রান্ত থেকে দেখছেন? আপনি যদি উঁচু থেকে দেখেন তো দেখবেন, কী মহান গণতন্ত্র আমাদের! কিন্তু দান্তেওয়াদা থেকে দেখলে এটা কোনো গণতন্ত্রই নয়। আমাদের এমন এক মুখ্যমন্ত্রী আছেন, যিনি বলেন যারা সালভা জুদামের বন্দিশিবিরে থাকতে রাজি হবে না, তারা সন্ত্রাসী। তার মানে, নিজের বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করা বা খেতখামারি করাও সন্ত্রাসী কাজ?
অপারেশন গ্রিন হান্ট নিয়ে আমার বক্তব্য হলো: এক. সরকারকে বহুজাতিক খনি কোম্পানির সঙ্গে করা সব চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, সব প্রকল্প স্থগিত ঘোষণা করতে হবে। দুই. উচ্ছেদ করা লাখ লাখ গ্রামবাসীকে পুনর্বাসিত করতে হবে। এবং তিন. অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
কারা এই মাওবাদী? তাদের আদর্শিক নেতারা ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে চায়। কিন্তু তাদের পথে যারা লড়ছে, তারা জানেই না রাষ্ট্র কী জিনিস? তার পরও এ মুহূর্তে উভয়ের লক্ষ্য একটি জায়গায় মিলে গেছে। আমি বলতে চাইছি, মাওবাদীরাই একমাত্র নয়, যারা ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে চায়। ‘হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প’ আর করপোরেট প্রকল্পগুলো এরই মধ্যে ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে এর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তাদের হাতে ভারতের সংবিধান গভীরভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
অনেকের মধ্যে একটা মিথ্যা ধারণা রয়েছে যে খনি প্রকল্প হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্বার্থে। এভাবে অদ্ভুত পন্থায় প্রবৃদ্ধি বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু এর সঙ্গে জনগণের সত্যিকার উন্নতির সম্পর্ক নেই। যেখানে একটি লোহার খনিতে প্রাইভেট কোম্পানির প্রতি পাঁচ হাজার টনের মুনাফা থেকে সরকার পায় মাত্র ২৭ রুপি, সেখানে একে প্রবৃদ্ধি বলা কঠিন। অথচ এর সবই করা হচ্ছে আদিবাসী ও কৃষকদের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লড়াই করছেন এসব কোম্পানির স্বার্থরক্ষার জন্য। দুর্নীতি করুন কি না করুন, তিনি তাদেরই প্রতিনিধি।
আমার বিরুদ্ধে ছত্তিশগড়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। ভীত না হওয়ার মতো হোমরাচোমরা কেউ নই আমি। আমাকে নিশানা করে আসলে তারা সবাইকে হুঁশিয়ার করতে চাইছে। তারা এখন যুদ্ধটাকে আরও তীব্র করবে। তারা এ দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় বিমানের হামলা চালাতে যাচ্ছে।
তার আগে তারা শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে নিশানা করেছে। এখন কেউ সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করলেই তাকে বলা হচ্ছে মাওবাদী। তারা পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস সংস্থার কোবাদ গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খাড়া করেছে। জেলে পোরা হয়েছে শত শত নাম না জানা মানুষকে। অরণ্যের ভেতরের সশস্ত্র সংগ্রামী থেকে শুরু করে অরণ্যের বাইরের অহিংস কর্মীদের ওপর করপোরেটদের হিংসা ছড়ানো শুরু হয়েছে। পৃথিবীর আর কোথাও এত বড় আকারে এমনটি ঘটছে না।
যা-ই হোক, আমি এখানেই থাকব। কেননা, এ দেশের জনগণই এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমি এর জন্য গর্বিত। এই প্রতিরোধের জন্য আমি তাদের স্যালুট জানাই। তাদের সমর্থনের জন্য আমি বরং জেলে যাব, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে সুন্দর নির্বাসনে যাব না।
ভারতের সিএনএন-আইবিএন টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে রূপান্তরিত।
কাউন্টারকারেন্টস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: ভারতের প্রতিবাদী লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
সরকারের যুক্তি হলো, মাওবাদীদের ভাইরাসের মতো ঝাড়বংশে বিনাশ করে দরিদ্র এলাকায় হাসপাতাল, বিদ্যালয় ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। ভারতের অনেক গরিব এলাকায়ই তো হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পুষ্টিবটিকা কর্মসূচিসহ অঢেল উন্নয়ন কার্যক্রম রয়েছে। তার পরও কি সেসব জায়গায় মাওবাদীরা নেই? আসলে সরকার স্কুলগুলোকে সেনাসদস্যদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করছে, যাতে বলতে পারে দেখো, মাওবাদীরা স্কুল ধ্বংস করে এবং তারা উন্নয়নের বিরুদ্ধে।
যে আমি ১০ বছর ধরে অহিংসা ও অহিংস আন্দোলন নিয়ে লিখে আসছি, সেই আমাকে সহিংসতার পক্ষে ভাবা অদ্ভুত। তবে অরণ্যে কিংবা ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’সহ এ রকম অজস্র অহিংস আন্দোলন কোনো একপর্যায়ে সফল হলেও সার্বিকভাবে ফল দিচ্ছে না। অহিংসা, বিশেষত, গান্ধীবাদী অহিংসা হলো এমন এক থিয়েটার, যেখানে দর্শক প্রয়োজন। কিন্তু অরণ্যের ভেতরে, যেখানে আপনার অহিংস মার খাওয়া দেখার কেউ নেই, সেখানে মধ্যরাতে হাজার হাজার পুলিশ আদিবাসীদের গ্রাম ঘিরে ফেললে কী করতে পারে তারা? যার পেটে খাবারই নেই, সে কীভাবে অনশন ধর্মঘট করবে? যাদের কোনো টাকা নেই, তাদের কর দেওয়া বন্ধ বা বিদেশি বা দেশি পণ্য বর্জন করতে বলার কী অর্থ? তারা আক্ষরিকভাবেই সর্বহারা। অরণ্যের আদিবাসীদের সহিংসতাকে আমি পাল্টা-সহিংসতা হিসেবে দেখি। তারা চালাচ্ছে প্রতিরোধের সহিংসতা, আগ্রাসী সহিংসতা নয়। সরকার সেই সহিংসতা দমনে যতই অস্ত্র নামায়, ততই সেসব অস্ত্র চলে যায় মাওবাদী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর কাছে। যেকোনো সমাজের জন্যই এ পরিস্থিতি ভয়ংকর। এই গরিবদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র হাজার হাজার প্যারা-মিলিটারি বাহিনী পাঠাচ্ছে। ওই জঙ্গলে একে-৪৭ ও গ্রেনেড হাতে তারা কী করছে আসলে?
আসলে আদিবাসী এলাকায় রাষ্ট্রের কাঠামোগত সন্ত্রাস ‘গণহত্যার মতো’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। আদিবাসীদের পুষ্টিহীনতা, তাদের দুর্দশা দেখে যেকোনো দায়িত্বশীল মানুষ বলবে, এদের ওপর থেকে এমন চাপ বন্ধ করুন, সহিংসতাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই আদিবাসীরা সংখ্যায় অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এত বিপুল মানুষের অস্তিত্বকে খনি করার জন্য মুনাফার নামে, উন্নয়নের নামে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দেওয়ার যুদ্ধ তো আসলে দেশবাসীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ। রাষ্ট্রের এই আগ্রাসী যুদ্ধের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধযুদ্ধের তুলনা অনৈতিক।
১৬ বছরের এক কিশোরী যদি দেখে যে সিপিআরএফের জওয়ানেরা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তার মা-বাবাকে মেরে ফেলছে; সেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে গেলে সে যদি বলে, আমি ওদের বিরুদ্ধে লড়ব, তাহলে তাকে কী বলার রয়েছে? বন্দুক হাতে তাকে দেখে আমার মধ্যে ভয়ংকর অনুভূতি হবে। তার পরও নিজের ধ্বংস মেনে নেওয়ার চেয়ে এই রুখে দাঁড়ানো ভালো।
ভারত হলো এমন এক মুষ্টিমেয়তন্ত্র, যেখানে গণতন্ত্র মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের স্বার্থ দেখছে। যে গণতন্ত্র গণমানুষের জন্য কাজ করে না, তা ভুয়া গণতন্ত্র। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শূন্যগর্ভ, এগুলো থেকে গরিবদের কিছু পাওয়ার নেই। নির্বাচন দেখুন, আদালত দেখুন, বিচারকদের দেখুন, দেখুন মিডিয়াকে। এর সবকিছুই বিরাট অংশের মানুষকে বাদ দিয়েই যা করার করে যাচ্ছে। কথা হলো, আপনি কোন প্রান্ত থেকে দেখছেন? আপনি যদি উঁচু থেকে দেখেন তো দেখবেন, কী মহান গণতন্ত্র আমাদের! কিন্তু দান্তেওয়াদা থেকে দেখলে এটা কোনো গণতন্ত্রই নয়। আমাদের এমন এক মুখ্যমন্ত্রী আছেন, যিনি বলেন যারা সালভা জুদামের বন্দিশিবিরে থাকতে রাজি হবে না, তারা সন্ত্রাসী। তার মানে, নিজের বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করা বা খেতখামারি করাও সন্ত্রাসী কাজ?
অপারেশন গ্রিন হান্ট নিয়ে আমার বক্তব্য হলো: এক. সরকারকে বহুজাতিক খনি কোম্পানির সঙ্গে করা সব চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, সব প্রকল্প স্থগিত ঘোষণা করতে হবে। দুই. উচ্ছেদ করা লাখ লাখ গ্রামবাসীকে পুনর্বাসিত করতে হবে। এবং তিন. অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
কারা এই মাওবাদী? তাদের আদর্শিক নেতারা ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে চায়। কিন্তু তাদের পথে যারা লড়ছে, তারা জানেই না রাষ্ট্র কী জিনিস? তার পরও এ মুহূর্তে উভয়ের লক্ষ্য একটি জায়গায় মিলে গেছে। আমি বলতে চাইছি, মাওবাদীরাই একমাত্র নয়, যারা ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে চায়। ‘হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প’ আর করপোরেট প্রকল্পগুলো এরই মধ্যে ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে এর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তাদের হাতে ভারতের সংবিধান গভীরভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
অনেকের মধ্যে একটা মিথ্যা ধারণা রয়েছে যে খনি প্রকল্প হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্বার্থে। এভাবে অদ্ভুত পন্থায় প্রবৃদ্ধি বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু এর সঙ্গে জনগণের সত্যিকার উন্নতির সম্পর্ক নেই। যেখানে একটি লোহার খনিতে প্রাইভেট কোম্পানির প্রতি পাঁচ হাজার টনের মুনাফা থেকে সরকার পায় মাত্র ২৭ রুপি, সেখানে একে প্রবৃদ্ধি বলা কঠিন। অথচ এর সবই করা হচ্ছে আদিবাসী ও কৃষকদের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লড়াই করছেন এসব কোম্পানির স্বার্থরক্ষার জন্য। দুর্নীতি করুন কি না করুন, তিনি তাদেরই প্রতিনিধি।
আমার বিরুদ্ধে ছত্তিশগড়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। ভীত না হওয়ার মতো হোমরাচোমরা কেউ নই আমি। আমাকে নিশানা করে আসলে তারা সবাইকে হুঁশিয়ার করতে চাইছে। তারা এখন যুদ্ধটাকে আরও তীব্র করবে। তারা এ দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় বিমানের হামলা চালাতে যাচ্ছে।
তার আগে তারা শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে নিশানা করেছে। এখন কেউ সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করলেই তাকে বলা হচ্ছে মাওবাদী। তারা পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস সংস্থার কোবাদ গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খাড়া করেছে। জেলে পোরা হয়েছে শত শত নাম না জানা মানুষকে। অরণ্যের ভেতরের সশস্ত্র সংগ্রামী থেকে শুরু করে অরণ্যের বাইরের অহিংস কর্মীদের ওপর করপোরেটদের হিংসা ছড়ানো শুরু হয়েছে। পৃথিবীর আর কোথাও এত বড় আকারে এমনটি ঘটছে না।
যা-ই হোক, আমি এখানেই থাকব। কেননা, এ দেশের জনগণই এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমি এর জন্য গর্বিত। এই প্রতিরোধের জন্য আমি তাদের স্যালুট জানাই। তাদের সমর্থনের জন্য আমি বরং জেলে যাব, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে সুন্দর নির্বাসনে যাব না।
ভারতের সিএনএন-আইবিএন টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে রূপান্তরিত।
কাউন্টারকারেন্টস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: ভারতের প্রতিবাদী লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
No comments