বাজার সিন্ডিকেট অথবা হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ by সোহরাব হাসান

গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ১৩ মাস বয়সী সরকারের সাফল্য ও কৃতিত্ব বর্ণনা করেছেন—এটা স্বাভাবিক। একই সঙ্গে তিনি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির খতিয়ান দিয়েছেন, তাতেও আপত্তির কিছু নেই। বাংলাদেশে যেকোনো সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ পার করার পর তারা এমন সব ‘কীর্তি’ রেখে যায়, পরবর্তী পাঁচ-দশ বছর যার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যায় না। সেদিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী অন্যায় কিছু করেননি।
কিন্তু সেদিনের ভাষণে তিনি অন্তত একটি ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ব্যর্থতার কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেই লুটের টাকা ছড়িয়ে কৃত্রিমভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। তারা সিন্ডিকেট করেই জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে।... আসলে মানুষ যে কষ্ট পাবে সে চিন্তা বিএনপির মাথায় নেই। তারা শুধু আওয়ামী লীগকে খাটো করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।’ (যুগান্তর, ১২ মার্চ ২০১০)। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো সরকার শেখ হাসিনা চালালেও বাজার চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট। অর্থাত্ বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে কত টাকায় চাল খাওয়াত তা নিয়ে মানুষ মাথা ঘামাচ্ছে না। কেননা তারা ক্ষমতায় আসেনি। আওয়ামী লীগের ভাষায়, ‘জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।’
অতএব বাজারে যদি কোনো সিন্ডিকেট থেকে থাকে (মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করেছেন) তাহলে সরকারের দায়িত্ব সেই সিন্ডিকেটে কারা আছেন, তাঁরা কীভাবে বাজারে কারসাজি করছেন, কারা তাঁদের মদদ দিচ্ছেন, তা সবিস্তারে প্রকাশ করা। যাতে জনগণ গণশত্রুদের চিহ্নিত করতে পারে। গয়রহ অভিযোগ করে লাভ নেই।
বিএনপির আমলে যখন দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল, তখনো তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বাজার সিন্ডিকেট, বিরোধী দল ও সংবাদপত্রের ওপর দায় চাপাচ্ছিলেন। শেখ হাসিনা এখনো সংবাদপত্রকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। বাজার অস্থিতিশীল করতে নেপথ্যে যাঁরাই কলকাঠি নাড়াক না কেন, প্রকাশ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরাই। আমরা যত দূর জানি, তাঁরা বরাবর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন, নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য মন্ত্রী-সাংসদদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন। আবার কারসাজি করে তার চেয়েও বেশি মুনাফা হাতিয়ে নেন। ব্যবসায়ী শ্রেণীর একটাই আদর্শ তা হলো মুনাফা। মুনাফা ছাড়া তাঁরা কিছুই বোঝেন না। কয়েক বছর আগে টিআইবির এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অষ্টম জাতীয় সংসদে নির্বাচিতদের ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী। বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা আরও বেশি এবং তাঁদের সিংহভাগই যে সরকারি দলের তাতে সন্দেহ নেই। অতএব, বিরোধী দল ব্যবসায়ীদের হাত করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে এই যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপদ হলো, এতে প্রকৃতই যাঁরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা ভাবতে পারেন কারসাজিটা যখন সরকার ধরতে পারছে না তখন ভোক্তাদের গলা কাটতে কোনো অসুবিধা নেই।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি, বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতারা ক্ষমতায় থাকতে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এ পর্যন্ত না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু সেই পাচার করা অর্থ কীভাবে তাঁরা বাজার সিন্ডিকেটে ব্যবহার করছেন? সরকার কেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না? প্রধানমন্ত্রী বা বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে এসব বিষয়ে কি সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে? থাকলে তাঁরা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না কেন? বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কী পরিমাণ দুর্নীতি-অপচয় হয়েছে, তা দেশের মানুষ জানে। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে জনগণ তাঁকে স্বাগতই জানাবে। কিন্তু তাঁরা এখনো দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন, ব্যবসায়ীরা তাঁদের কথায় উঠবস করছেন সেটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
পূর্বসূরিদের সঙ্গে তুলনা করলে মহাজোট সরকার গত ১৩ মাসে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তারা মন্দা অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে, কৃষি উত্পাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎউত্পাদন বাড়াতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে বাস্তবায়ন শুরুর ক্ষেত্রে কার্যকর কিছুই লক্ষণীয় নয়। অন্যদিকে এই খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যে রোড শো করেছে তা কার্যত অর্থহীন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। সরকার গরিব মানুষের কল্যাণে কিছু কর্মসূচি নিয়েছে, যা প্রশংসনীয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগও চলছে। এসব ইতিবাচক কিছু দিক রয়েছে। কিন্তু তিনটি ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী। ১. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ২. আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ৩. দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে না পারা।
প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাত্রলীগ সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে। ভালো কাজ করে নয়, খারাপ কাজ করে। তারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে, অন্যায় আবদারের কাছে নতিস্বীকার না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের বলি হয়েছে ঢাবির মেধাবী ছাত্র আবুবকর। যশোরে তারা গোলাগুলি করে সম্মেলন পণ্ড করেছে। সেখানে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে জীবন দিয়েছেন ছাত্রলীগেরই এক কর্মী। প্রধানমন্ত্রী যদি প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে চান, তাহলে প্রথম অভিযানটি চালাতে হবে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে তার সিকি ভাগ সত্য হলেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। দেখা যাচ্ছে, যেখানে ছাত্রলীগ সেখানেই গোলযোগ, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, ভর্তিবাণিজ্য।
এ কথার অর্থ এই নয় যে বিরোধী দলের কেউ ষড়যন্ত্র করলে, অপরাধ করলে সরকার তাদের ছেড়ে দেবে। অবশ্যই না। আইন সবার প্রতি সমানভাবে চলতে হবে। মানুষ যখন বুঝবে, সরকার দলমত-নির্বিশেষে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী বাজার সিন্ডিকেট খুঁজছেন। এঁরা নিশ্চয়ই বিদেশের কেউ নন, দেশেরই নাগরিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেখেছি, বিদেশে ভোজ্যতেল, আটা, ডাল ও পেঁয়াজের দাম না বাড়তেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু বিদেশের বাজারে দাম কমলে তাঁরা কমাতেন না। যুক্তি দেখিয়েছেন, আগেই এলসি খোলা হয়েছিল। গত রোজার সময়ও চিনি ও ভোজ্যতেল নিয়ে একই তেলেসমাতি কাণ্ড করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে অতি মুনাফাখোরদের জেলে পাঠানোরও হুমকি দিয়েছিলেন। কোনো কাজ হয়নি। কী করে হবে? শর্ষের মধ্যেই তো ভূত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সব দায় বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছেন তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কী ঘটছে সে খবর কি তিনি রাখেন? খুচরা বাজারে ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকায়, অথচ টিসিবি কিনছে ১০০ টাকায়। আর সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রীর আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠানকে। মন্ত্রী বলেছেন, আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠান ডাল সরবরাহ করলে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা হতো না যদি সরকারের কোষাগার থেকে দুই কোটি টাকা বাড়তি খরচ না হতো।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির আমলে দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। তাতে নিশ্চয় সত্যতা রয়েছে। কিন্তু তিনি কি এখন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারবেন, আগে দুর্নীতি হতো, এখন হয় না। দুর্নীতি বিষয়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই বা কী বলেন? দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান (হাসান মশহুদ চৌধুরীকে বাদ দিয়ে যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী) রোববার এক সেমিনারে বলেছেন, দেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়াই দুর্নীতি দমনের সবচেয়ে বড় বাধা। নির্বাচনে বিপুল অর্থ খরচ করতে হয়। টাকা ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ অসম্ভব। দুর্নীতি অথবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে এ টাকা সংগ্রহ করেন রাজনীতিবিদেরা। আর এভাবেই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুনাফা ভাগাভাগির যোগসাজশ তৈরি হয় (প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০১০)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেছেন, দেশের শেয়ারবাজারে এখন যা ঘটছে, তা আর্থিক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রতি কনটেইনারের পরিবহন খরচ ৬০০ ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন তা এক হাজার ২০০ ডলারে উঠেছে। কারা শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করছেন? কারা এক বছরের ব্যবধানে পরিবহন ব্যয় দ্বিগুণ করেছেন তাও খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
প্রধানমন্ত্রী কি বলতে চান ক্ষমতাসীন দলের কেউ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত নন। সবাই বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। সাংসদদের তালিকা কিন্তু সে কথা বলে না। দুর্ভাগ্যজনক যে এই কথিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, সরকার তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। কেউ রাজনৈতিক দলের তহবিলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিলে অধিক মুনাফা করে তা তুলে নেবেই। আমরা এও দেখেছি, বিএনপির আমলে যেসব ব্যবসায়ী ক্ষমতাসীন শীর্ষ ব্যক্তিদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন, আওয়ামী লীগের আমলেও তাঁরা মন্ত্রী-নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠছেন। তাহলে বিরোধী দলের মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজে লাভ কী?
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে নেই। তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সাফল্য সত্ত্বেও শেয়ারবাজার সিন্ডিকেটের কাছে নতিস্বীকার ছিল একটি বড় ব্যর্থতা। সেই সিন্ডিকেট আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অতএব প্রধানমন্ত্রী, অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ না করে দৃশ্যমান ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে দেশ উপকৃত হবে, জনগণও নিরাপদ থাকবে।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.