নবীন আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি by প্রণব সাহা |

সরকারি যেকোনো তথ্য জনগণের জানার অধিকার আছে—এই বিবৃতি সম্পর্কে আপনার অবস্থান কী? এটা জানতে চাওয়া হয়েছিল সরকারের প্রশাসনে যোগ দেওয়া নবীন কর্মকর্তাদের কাছে। বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এটি একটি আশার ব্যাপার এ জন্য যে, দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা তৈরি করার মূল কেন্দ্র বিপিএটিসি তথ্য অধিকার আইনটি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া বিপিএটিসি তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে প্রশাসনে সদ্য যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বিপিএটিসিতে চার মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে তথ্য অধিকার আইনসম্পর্কিত প্রশিক্ষণকে। তিন দিনের একটি কোর্স মডিউল তৈরির লক্ষ্যে আয়োজিত কর্মশালায় যোগ দিয়ে জানা গেল জনগণের জানার অধিকার সম্পর্কে প্রশাসনে সদ্য যোগদানকারীদের অভিমত।
তথ্য কমিশন গঠনের মাত্র ছয় মাসের মাথায় প্রধান তথ্য কমিশনারের পদ শূন্য হওয়ার বিষয়টি হতাশাজনক। সেদিক থেকে বিপিএটিসির এই উদ্যোগ একটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা। তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য বিপিএটিসি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। কর্মশালায় উপস্থাপিত তথ্য থেকে জানা গেল, তথ্য অধিকার আইন নিয়ে বিপিএটিসির পক্ষ থেকে একটি ছোট আকারের জরিপও করা হয়েছে। ওই জরিপের ফলাফলেই তথ্য অধিকার আইন নিয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণের সুপারিশ এসেছে। পাওয়া গেছে সরকারি কর্মকর্তাদের অভিমত। এমন মতামতও এসেছে যে, এই আইন শুধু সাংবাদিকদের জন্য উপকারী হবে। আর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। জরিপের তথ্য উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন জানালেন, তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে যে প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তারা খুব বেশি জানেন না, তা পরিষ্কার। ‘ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কর্মকর্তারা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন’— এমন মন্তব্য এমডিএসের। তবে খুবই উৎসাহজনক তথ্যও পাওয়া গেল তাঁর কাছ থেকে। যেমন সেবাদানকারী হিসেবে তথ্য অধিকার আইনের উপযোগিতাকে নিজের জন্য ভীতিকর বলে উল্লেখ করলেও একই কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে একজন সেবা গ্রহণকারীর জন্য এই আইনের উপযোগিতা অনেক বেশি। সরকারি কর্মকর্তাদের এমন দ্বিমুখী অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে তথ্য অধিকার আইনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্যই বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা এ কথাও জানিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক আমলের পুরোনো আইন ছাড়াও ‘তথ্য গোপনের সংস্কৃতিও’ আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এ ছাড়া তথ্য সংরক্ষণ ও সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলেও তথ্য অধিকারের সুফল পাওয়া যাবে না বলেও তাঁরা সঠিকভাবে মত দিয়েছেন বলেই মনে হয়েছে।
তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ যেমন ভালো, তেমনি এখনো এই আইনের আওতায় বিধিমালা তৈরির কাজ শেষ করতে না পারাটাও হতাশাজনক। আরও হতাশার বিষয় হচ্ছে, তথ্য কমিশনের প্রধানের পদটি শূন্য থাকার তথ্য। সাবেক সচিব আজিজুর রহমানকে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রধান তথ্য কমিশনার হিসেবে। দপ্তর গুছিয়ে ওঠার আগেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে বয়সের কারণে। তথ্য কমিশন আইনের ১৫(২) ধারায় স্পষ্ট করেই বলা আছে, ‘৬৭ বৎসর অপেক্ষা অধিক বয়স্ক কোনো ব্যক্তি প্রধান তথ্য কমিশনার বা তথ্য কমিশনার পদে নিয়োগ লাভের বা অধিষ্ঠিত থাকিবার যোগ্য হইবেন না।’ স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন আজিজুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়ার আগে দেখা হলো না যে কবে তাঁর বয়স ৬৭ হবে। যখন আজিজুর রহমানের নামটি আলোচিত হচ্ছিল বাছাই কমিটিতে, তখন বয়সের বিষয়টি বাছাই কমিটির নজরে আনা হয়নি কেন?
প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সভাপতিত্বে বাছাই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে তথ্য কমিশনের তিনটি পদের বিপরীতে ছয়টি নাম পাঠাবে, আইনে এমন বিধান আছে। এই বাছাই কমিটিতে সরকার ও বিরোধী দলের দুজন সাংসদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সম্পাদকের যোগ্যতাসম্পন্ন একজন সদস্য থাকেন। আমাদের প্রত্যাশা, পরবর্তী প্রধান তথ্য কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য নাম পাঠানোর সময় বয়সসীমাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে, যাতে করে তথ্য কমিশনের পথ চলার শুরুতেই প্রতিষ্ঠানটিকে অভিভাবকত্বহীনতায় ভুগতে না হয়।
এখন পর্যন্ত তথ্য কমিশনের পূর্ণাঙ্গ জনবল নিয়োগ হয়নি। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের জনবলকাঠামো নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে চাই না। তখন এ নিয়ে এত প্রতিবেদন লিখতে হয়েছে যে এক সময় বিরক্তি প্রকাশ করতেন আমাদের সংবাদ ব্যবস্থাপকেরা। তথ্য কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নের বিষয়টিও ঘুরপাক খাচ্ছে আমলাতন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে। তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে প্রশাসনে যোগ দেওয়া নতুন আমলাদের মনোভাব লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। শত বছরের পুরোনো আমলাতন্ত্র ‘লালফিতার’ রং বদলে ‘ধূসর’ করেছে। কিন্তু এখনো তথ্য গোপন করার মানসিকতা ধূসর হয়নি।
গত ১১ জানুয়ারি থেকে প্রধান তথ্য কমিশনারের পদটি শূন্য আছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাছাই কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে, তাই খুব দ্রুতই আমরা প্রধান তথ্য কমিশনার পদে নতুন মুখ চাই। তথ্য কমিশনের বিধিমালা ও জনবলকাঠামো দ্রুত অনুমোদন এবং কার্যকর হওয়া জরুরি। বিধিমালার একটি প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর তাতে ত্রুটি ধরা পড়ায় তা কমিশনে ফেরত পাঠানো হয়। কমিশন বিধিমালা সংশোধন করে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনে আট হাজার বর্গফুটের যে দপ্তর ভাড়া নেওয়া হয় তথ্য কমিশনের জন্য, সেই দপ্তরে এখন বসেন দুজন কমিশনার ছাড়া শুধু সচিব, একজন পরিচালক ও কয়েকজন কর্মচারী। কমিশনের জনবলকাঠামো সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তথ্য কমিশনের জনবলকাঠামো সচিব কমিটিতে অনুমোদিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রেও সরকারি প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ের ইতিবাচক মনোভাব দরকার।
তথ্য কমিশন আইনের বিষয়টি লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা। দেশের আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম ও নাগরিক অধিকার নিয়ে উদ্যোগী নাগরিকসমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখন মনযোগী হতে হবে আইনটিকে সুষুম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োগ করার কাজে সাহায্য করার জন্য।
প্রণব সাহা: এডিটর, এটিএন নিউজ লিমিটেড।
pranab67@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.