জনসংখ্যা বৃদ্ধি যখন খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি -খাদ্যসমস্যা by এ জেড এম আবদুল আলী
তখন তিনি মেক্সিকো সিটি শহরের কাছেই একটি গমক্ষেতে গমের ফলন পরীক্ষা করে দেখছিলেন। তাঁর স্ত্রী মার্গারেট গাড়ি চালিয়ে তাঁর কাছে এসে বললেন, তুমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছ। উনি স্ত্রীকে বললেন, কেউ তোমার সঙ্গে মশকরা করেছে, এসব গুজবে কান দিয়ো না। একটু পর তাঁর স্ত্রী আবার তাঁর কাছে এসে বললেন, না, খবরটি সত্যি। সত্যিই তোমাকে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। উনি সেই নোবেলজয়ী নরম্যান বোরল্যগ (Dr. Norman Borlaug), তখন বললেন, দাঁড়াও, উত্সব একটু পরে করা যাবে। এর আগে আমি এই গমের গুণগত মানটি পরীক্ষা করে ফেলি।
নরম্যানের বয়স তখন মাত্র ৫৬। এই বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া মানুষটি ষাটের দশকে তাঁর গবেষণার মাধ্যমে উচ্চফলনশীল গমের আবিষ্কার করে বিশ্বের জনগণকে আসন্ন দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন যাকে আমরা ‘সবুজ বিপ্লব’ বলে থাকি, সেই বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন এই মানুষটিই। জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালে দাদা-দাদির খামারে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যে। তাঁর মা-বাবাও একই সঙ্গে থাকতেন। খুব অবস্থাপন্ন ছিলেন না। তাই লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাঁকেও ক্ষেতে গিয়ে বাবার সঙ্গে কাজ করতে হতো। তখনই তাঁর মনে প্রশ্নের উদয় হয়, কোনো কোনো ক্ষেতে গমের ফসল ভালো হয় কেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেতে ফসল মোটেও ভালো হয় না? দাদা-দাদি, মা-বাবা এবং অন্য কৃষকদের প্রশ্ন করে তিনি কোনো সদুত্তর পাননি। এই সময়েই তাঁর লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা। কেননা সেই সময়ে কৃষকের সন্তানের পক্ষে স্কুল-কলেজে পড়তে যাওয়াটা বিলাসিতা বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু তাঁর দাদা নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি বলে তাঁর মনে একটা দুঃখ ছিল। তাই তিনি তাঁর এই মেধাবী নাতিকে লেখাপড়া ছাড়তে দেননি। তা ছাড়া বরাবর বৃত্তি পাওয়ায় তাঁর পরিবারের কোনো বাড়তি খরচ পড়েনি ওঁর পড়ালেখার কারণে। কাজেই তরতর করে সব পরীক্ষায় পাস করে ফেললেন তিনি। ওই সময় ত্রিশের দশকের সেই মহামন্দা চলছে। এরই মধ্যে তিনি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। পথেঘাটে অজস্র ক্ষুধার্ত মানুষ দেখাটি তাঁর মনে এক চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। কেন ফসল হয় না, কেন মানুষ খেতে পায় না ইত্যাদি প্রশ্ন তাঁকে অস্থির করে তোলে।
প্রথমে তিনি পড়তে শুরু করেছিলেন ফরেস্ট্রি বা বনরক্ষণবিদ্যা। পরে তাঁর একজন অধ্যাপক তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন প্লান্ট প্যাথলজি পড়তে। তিনি সেই বিষয়ে পড়ে একটি ডক্টরেট উপাধি নিয়ে ফেলেন। পাস করে তিনি প্রথমে ১৯৪২ সালে যোগ দেন বিখ্যাত কোম্পানি ডু পন্টে (Du Pont)। সেই কোম্পানি তখন নানা ধরনের রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছিল। আবার তাঁর জীবনে উদয় হন তাঁর অধ্যাপক এলভিন সি স্ট্যাকম্যান (Elvin C. Stakman)। তিনি নরম্যানকে বলেন ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে রকফেলার ফাউন্ডেশনের মেক্সিকান হাঙ্গার প্রকল্পে যোগ দিতে। তিনি তা-ই করেন। তখন রাস্ট ফাঙ্গাস নামের এক ধরনের ছত্রাক মেক্সিকোয় গমের ক্ষেতগুলো নষ্ট করে দিচ্ছিল। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের গমের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটিয়ে অবশেষে এক ধরনের গমের বীজ সৃষ্টি করলেন, যাতে রাস্ট ছত্রাক বাধাপ্রাপ্ত হয় না। তাঁর এই সাফল্যে মেক্সিকোর খাদ্যাভাব তখনকার মতো ঘুচে গেল। কিন্তু তখনো তাঁর সামনে অনেক সমস্যা। তিনি দেখলেন যে গমের চারাগুলো অনেক লম্বা হয়, ফলে গমের ভারে সেগুলো নুয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তখন নানা রকমে কীট এসে সেগুলো খেয়ে ফেলে।
এবার তাঁর প্রচেষ্টা শুরু হয় নানা রকমের রাসায়নিক ফার্টিলাইজার নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের গমের সংকরের সঙ্গে রাসায়নিক সার যোগ করে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে দিনের পর দিন। ১৯৫৩ সালের দিকে তিনি এক ধরনের গমের চারা সৃষ্টি করলেন, যেগুলো বেশি লম্বা হয় না। খানিকটা বেঁটে-খাটো এই চারাগুলোতে অনেক গমের দানা ফলাতে সক্ষম হলেন তিনি। যেহেতু চারাগুলোর গোড়া বেশ মোটা ও শক্ত, সেই কারণে গমের দানা যত বেশিই হোক, চারাগুলো ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে। এরই ফলে দেখা গেল যে একই জমিতে এই বেঁটে গমের চাষ করে তিনি দ্বিগুণ, ত্রিগুণ এমনকি চার গুণ বেশি ফসল ফলাতে সক্ষম হলেন। চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশকের মধ্যে মেক্সিকোর খাদ্য উত্পাদন ছয় গুণ বেড়ে গেল। তাঁর এই সাফল্যই সবুজ বিপ্লবের সূচনা করল গোটা পৃথিবীতে। এই সময়ে রকফেলার ফাউন্ডেশন তাঁকে ফিলিপাইনের ধান গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বললেন। নরম্যানের প্রযুক্তি ফিলিপাইনের ধানেও অভাবনীয় ফলন ফলাতে সক্ষম হলো। একই প্রযুক্তি ভারতে ধানের ক্ষেতেও প্রয়োগ করে একই ফল পাওয়া গেল। দুটি দেশই অচিরে খাদ্যঘাটতি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল। ১৯৬৮ সালে ভারতে গমের ফসল এত বেশি হয়েছিল যে, সে বছর দেশের অনেক স্কুল বন্ধ করে দিয়ে সেই স্কুলঘরকে গমের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সারা বিশ্ব থেকে বোরল্যগের ডাক আসতে লাগল ধান, গম, ভুট্টা চাষে তাঁর পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য। বোরল্যগও যতটা সম্ভব সেই ডাকে সাড়া দিতে লাগলেন। এক দুনিয়া-কাঁপানো বিপ্লবের সূচনা হলো সর্বত্র। মানুষের প্রাণে এক নতুন ভোরের উদয় হলো। অবশ্য ডক্টর বোরল্যগের কয়েকজন সমালোচকও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এই সময়। তাঁরা বলেছিলেন, নরম্যান এই নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করে শেষ পর্যন্ত মানুষের ক্ষতিই করলেন। কেননা কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতির চাষবাস ভুলে গেলে শেষে ক্ষতিই হবে পৃথিবীর। তাঁর চাষের পদ্ধতি সমাজ ও পরিবেশের ক্ষতি করবে। কৃষকদের অতিমাত্রায় রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। বামপন্থীরা বললেন, তিনি ছোট ছোট কৃষকের সর্বনাশ করে ফেলেছেন। কৃষিকর্মের ওপর বড় বড় করপোরেশনের প্রভাব সৃষ্টি করার ফলে ক্ষুদ্র কৃষকের কর্মসংস্থান বিপন্ন করেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালে তাঁকে দেওয়া হলো নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের বক্তৃতায় তিনি এসব সমালোচনার জবাব দিলেন এই বলে যে, আসল সমস্যাটি হচ্ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি কমানো না যায়, তাহলে কোনো প্রযুক্তি বা কোনো পদ্ধতির চাষবাসই শেষ পর্যন্ত মানুষ ও পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না। অনেক দেশেই আজ খাদ্য যা উত্পাদিত হচ্ছে, এর চেয়ে খাওয়ার লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে খাদ্যসংকট আবার হবে, আবার মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। নরম্যান বোরল্যগ তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতে দেখলেন। ২০০৭ সালে সারা পৃথিবীতে যে খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছিল, এর হাত থেকে পৃথিবীর অনেক দেশই আজ মুক্তি পায়নি। চীন, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো—সব দেশেই আবার খাদ্যসংকট ফিরে এসেছিল সে বছর। প্রকৃতপক্ষে সেই মন্দাবস্থা থেকে পৃথিবী আজও মুক্তি পায়নি।
আমাদের বাংলাদেশেও সেই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই সামান্য ভূখণ্ডে এখনই প্রায় ১৬ কোটি মানুষ হয়েছে। এসব মানুষকে খাওয়াতে হলে যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন, কোনো প্রযুক্তিতেই আর তা উত্পাদন করা সম্ভব হবে না। অচিরে জনসংখ্যার গতি রোধ না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সামনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হতে বাধ্য। সৌভাগ্যক্রমে এ কথা এখন সবাই, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার স্বীকার করছে। কাগজে দেখা গেল (প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯), সংসদের ডেপুটি স্পিকার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শওকত আলী বলেছেন, ‘জনসংখ্যাই এক নম্বর সমস্যা বাংলাদেশের।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সবাই একমত হয়েছেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই আমাদের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী। খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে হবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুযায়ী এ মুহূর্তে পৃথিবীতে ১০০ কোটি নিরন্ন মানুষ রয়েছে।
ডক্টর নরম্যান বোরল্যগ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় ঠিকই বলেছেন। এই মহান ব্যক্তিটি দিনকয়েক আগে গত শনিবার ১২ সেপ্টেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্বের মানুষকে জনসংখ্যা সম্পর্কে সচেতন করতে এই ব্যক্তির অবদান অতুলনীয়। অষ্টাদশ শতকে বিশপ ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ে একটি সাবধানবাণী করেছিলেন। তবে তিনি সমস্যাটি সমাধানের কোনো বিশেষ পথ দেখাননি। বিংশ শতকে মনীষী নরম্যান বোরল্যগ এ সমস্যার সমাধান হাতেনাতে করে দেখিয়েছেন। মানবজাতিকে গত শতকের ষাটের দশকে তিনি আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য মানুষকে সেদিন বাঁচালেও মানবজাতি সাবধান না হলে এ বিপদ আবার আসতে পারে—এই সাবধানবাণী তিনি সেই ১৯৭০ সালেই করেছিলেন। আমরা আজ এই প্রয়াত কৃষিবিজ্ঞানীর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
নরম্যানের বয়স তখন মাত্র ৫৬। এই বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া মানুষটি ষাটের দশকে তাঁর গবেষণার মাধ্যমে উচ্চফলনশীল গমের আবিষ্কার করে বিশ্বের জনগণকে আসন্ন দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন যাকে আমরা ‘সবুজ বিপ্লব’ বলে থাকি, সেই বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন এই মানুষটিই। জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালে দাদা-দাদির খামারে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যে। তাঁর মা-বাবাও একই সঙ্গে থাকতেন। খুব অবস্থাপন্ন ছিলেন না। তাই লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাঁকেও ক্ষেতে গিয়ে বাবার সঙ্গে কাজ করতে হতো। তখনই তাঁর মনে প্রশ্নের উদয় হয়, কোনো কোনো ক্ষেতে গমের ফসল ভালো হয় কেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেতে ফসল মোটেও ভালো হয় না? দাদা-দাদি, মা-বাবা এবং অন্য কৃষকদের প্রশ্ন করে তিনি কোনো সদুত্তর পাননি। এই সময়েই তাঁর লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা। কেননা সেই সময়ে কৃষকের সন্তানের পক্ষে স্কুল-কলেজে পড়তে যাওয়াটা বিলাসিতা বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু তাঁর দাদা নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি বলে তাঁর মনে একটা দুঃখ ছিল। তাই তিনি তাঁর এই মেধাবী নাতিকে লেখাপড়া ছাড়তে দেননি। তা ছাড়া বরাবর বৃত্তি পাওয়ায় তাঁর পরিবারের কোনো বাড়তি খরচ পড়েনি ওঁর পড়ালেখার কারণে। কাজেই তরতর করে সব পরীক্ষায় পাস করে ফেললেন তিনি। ওই সময় ত্রিশের দশকের সেই মহামন্দা চলছে। এরই মধ্যে তিনি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। পথেঘাটে অজস্র ক্ষুধার্ত মানুষ দেখাটি তাঁর মনে এক চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। কেন ফসল হয় না, কেন মানুষ খেতে পায় না ইত্যাদি প্রশ্ন তাঁকে অস্থির করে তোলে।
প্রথমে তিনি পড়তে শুরু করেছিলেন ফরেস্ট্রি বা বনরক্ষণবিদ্যা। পরে তাঁর একজন অধ্যাপক তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন প্লান্ট প্যাথলজি পড়তে। তিনি সেই বিষয়ে পড়ে একটি ডক্টরেট উপাধি নিয়ে ফেলেন। পাস করে তিনি প্রথমে ১৯৪২ সালে যোগ দেন বিখ্যাত কোম্পানি ডু পন্টে (Du Pont)। সেই কোম্পানি তখন নানা ধরনের রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছিল। আবার তাঁর জীবনে উদয় হন তাঁর অধ্যাপক এলভিন সি স্ট্যাকম্যান (Elvin C. Stakman)। তিনি নরম্যানকে বলেন ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে রকফেলার ফাউন্ডেশনের মেক্সিকান হাঙ্গার প্রকল্পে যোগ দিতে। তিনি তা-ই করেন। তখন রাস্ট ফাঙ্গাস নামের এক ধরনের ছত্রাক মেক্সিকোয় গমের ক্ষেতগুলো নষ্ট করে দিচ্ছিল। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের গমের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটিয়ে অবশেষে এক ধরনের গমের বীজ সৃষ্টি করলেন, যাতে রাস্ট ছত্রাক বাধাপ্রাপ্ত হয় না। তাঁর এই সাফল্যে মেক্সিকোর খাদ্যাভাব তখনকার মতো ঘুচে গেল। কিন্তু তখনো তাঁর সামনে অনেক সমস্যা। তিনি দেখলেন যে গমের চারাগুলো অনেক লম্বা হয়, ফলে গমের ভারে সেগুলো নুয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তখন নানা রকমে কীট এসে সেগুলো খেয়ে ফেলে।
এবার তাঁর প্রচেষ্টা শুরু হয় নানা রকমের রাসায়নিক ফার্টিলাইজার নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের গমের সংকরের সঙ্গে রাসায়নিক সার যোগ করে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে দিনের পর দিন। ১৯৫৩ সালের দিকে তিনি এক ধরনের গমের চারা সৃষ্টি করলেন, যেগুলো বেশি লম্বা হয় না। খানিকটা বেঁটে-খাটো এই চারাগুলোতে অনেক গমের দানা ফলাতে সক্ষম হলেন তিনি। যেহেতু চারাগুলোর গোড়া বেশ মোটা ও শক্ত, সেই কারণে গমের দানা যত বেশিই হোক, চারাগুলো ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে। এরই ফলে দেখা গেল যে একই জমিতে এই বেঁটে গমের চাষ করে তিনি দ্বিগুণ, ত্রিগুণ এমনকি চার গুণ বেশি ফসল ফলাতে সক্ষম হলেন। চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশকের মধ্যে মেক্সিকোর খাদ্য উত্পাদন ছয় গুণ বেড়ে গেল। তাঁর এই সাফল্যই সবুজ বিপ্লবের সূচনা করল গোটা পৃথিবীতে। এই সময়ে রকফেলার ফাউন্ডেশন তাঁকে ফিলিপাইনের ধান গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বললেন। নরম্যানের প্রযুক্তি ফিলিপাইনের ধানেও অভাবনীয় ফলন ফলাতে সক্ষম হলো। একই প্রযুক্তি ভারতে ধানের ক্ষেতেও প্রয়োগ করে একই ফল পাওয়া গেল। দুটি দেশই অচিরে খাদ্যঘাটতি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল। ১৯৬৮ সালে ভারতে গমের ফসল এত বেশি হয়েছিল যে, সে বছর দেশের অনেক স্কুল বন্ধ করে দিয়ে সেই স্কুলঘরকে গমের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সারা বিশ্ব থেকে বোরল্যগের ডাক আসতে লাগল ধান, গম, ভুট্টা চাষে তাঁর পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য। বোরল্যগও যতটা সম্ভব সেই ডাকে সাড়া দিতে লাগলেন। এক দুনিয়া-কাঁপানো বিপ্লবের সূচনা হলো সর্বত্র। মানুষের প্রাণে এক নতুন ভোরের উদয় হলো। অবশ্য ডক্টর বোরল্যগের কয়েকজন সমালোচকও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এই সময়। তাঁরা বলেছিলেন, নরম্যান এই নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করে শেষ পর্যন্ত মানুষের ক্ষতিই করলেন। কেননা কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতির চাষবাস ভুলে গেলে শেষে ক্ষতিই হবে পৃথিবীর। তাঁর চাষের পদ্ধতি সমাজ ও পরিবেশের ক্ষতি করবে। কৃষকদের অতিমাত্রায় রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। বামপন্থীরা বললেন, তিনি ছোট ছোট কৃষকের সর্বনাশ করে ফেলেছেন। কৃষিকর্মের ওপর বড় বড় করপোরেশনের প্রভাব সৃষ্টি করার ফলে ক্ষুদ্র কৃষকের কর্মসংস্থান বিপন্ন করেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালে তাঁকে দেওয়া হলো নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের বক্তৃতায় তিনি এসব সমালোচনার জবাব দিলেন এই বলে যে, আসল সমস্যাটি হচ্ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি কমানো না যায়, তাহলে কোনো প্রযুক্তি বা কোনো পদ্ধতির চাষবাসই শেষ পর্যন্ত মানুষ ও পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবে না। অনেক দেশেই আজ খাদ্য যা উত্পাদিত হচ্ছে, এর চেয়ে খাওয়ার লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে খাদ্যসংকট আবার হবে, আবার মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। নরম্যান বোরল্যগ তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতে দেখলেন। ২০০৭ সালে সারা পৃথিবীতে যে খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছিল, এর হাত থেকে পৃথিবীর অনেক দেশই আজ মুক্তি পায়নি। চীন, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো—সব দেশেই আবার খাদ্যসংকট ফিরে এসেছিল সে বছর। প্রকৃতপক্ষে সেই মন্দাবস্থা থেকে পৃথিবী আজও মুক্তি পায়নি।
আমাদের বাংলাদেশেও সেই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই সামান্য ভূখণ্ডে এখনই প্রায় ১৬ কোটি মানুষ হয়েছে। এসব মানুষকে খাওয়াতে হলে যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন, কোনো প্রযুক্তিতেই আর তা উত্পাদন করা সম্ভব হবে না। অচিরে জনসংখ্যার গতি রোধ না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সামনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হতে বাধ্য। সৌভাগ্যক্রমে এ কথা এখন সবাই, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার স্বীকার করছে। কাগজে দেখা গেল (প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯), সংসদের ডেপুটি স্পিকার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শওকত আলী বলেছেন, ‘জনসংখ্যাই এক নম্বর সমস্যা বাংলাদেশের।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সবাই একমত হয়েছেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই আমাদের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এ সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী। খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে হবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুযায়ী এ মুহূর্তে পৃথিবীতে ১০০ কোটি নিরন্ন মানুষ রয়েছে।
ডক্টর নরম্যান বোরল্যগ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় ঠিকই বলেছেন। এই মহান ব্যক্তিটি দিনকয়েক আগে গত শনিবার ১২ সেপ্টেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্বের মানুষকে জনসংখ্যা সম্পর্কে সচেতন করতে এই ব্যক্তির অবদান অতুলনীয়। অষ্টাদশ শতকে বিশপ ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ে একটি সাবধানবাণী করেছিলেন। তবে তিনি সমস্যাটি সমাধানের কোনো বিশেষ পথ দেখাননি। বিংশ শতকে মনীষী নরম্যান বোরল্যগ এ সমস্যার সমাধান হাতেনাতে করে দেখিয়েছেন। মানবজাতিকে গত শতকের ষাটের দশকে তিনি আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল খাদ্যশস্য মানুষকে সেদিন বাঁচালেও মানবজাতি সাবধান না হলে এ বিপদ আবার আসতে পারে—এই সাবধানবাণী তিনি সেই ১৯৭০ সালেই করেছিলেন। আমরা আজ এই প্রয়াত কৃষিবিজ্ঞানীর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
No comments