‘বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াত ছাড়তে হবে’ -অরণ্যে রোদন by আনিসুল হক
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার প্রিয় মানুষদের একজন। কথাটা বলাই বাহুল্য, কারণ তিনি বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের প্রিয়। কথা বলেন সোজাসাপ্টা, যা বোঝেন তা স্পষ্ট করে জোর দিয়ে বলেন, এক কথার মানুষ, কথা দিলে তার নড়চড় হয় না, তিনি বাংলাদেশে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে জনপ্রিয় করেছেন, ছোটদের জন্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে লিখে চলেছেন, পড়ান কম্পিউটার বিজ্ঞান, সুদর্শন, হাসিমুখ—এসব গুণ তাঁর জনপ্রিয়তাকে একটা বিশেষত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদের ওপর তাঁর প্রভাব হ্যামিলিনের বংশীবাদকের মতো। ছোটদের মন বুঝে ফেলার ও পড়ে ফেলার একটা জাদুকরি ক্ষমতা তাঁর আছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেদিন একটা আনুষ্ঠানিক গোলটেবিল বৈঠকে একটা কথা বলেছেন। বৈঠকটা হয়েছে প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয়ে, ২ অক্টোবর ২০০৯। বিষয়টা ছিল, ‘বাংলাদেশকে বদলে দিতে হলে’। আগামী ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর একাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ওই দিন প্রকাশিতব্য বিশেষ সংখ্যায় গোলটেবিল বৈঠকটির পুরো বিবরণ ছাপা হবে। ৩ অক্টোবরের প্রথম আলোয় বৈঠকটার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, জামায়াতে ইসলামী আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি, একাত্তর সালে তারা আলবদর গঠন করেছে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা নিহত হয়েছেন এই আলবদর বাহিনীর হাতে, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি জোট বেঁধেছে, সেই জামায়াতে ইসলামীকে সরকারে বসায়, তখন তাদের ব্যাপারে আমরা নিরপেক্ষতা দেখাই কী করে, এইটা যখন আমরা করি, তখন আমাদের লোকে ভাবে আমরা হয়তো একটা দলের হয়ে কথা বলছি। আসলে তা নয়, আমরা দলনিরপেক্ষই। কিন্তু যত দিন জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আছে, তত দিন আমাদের পক্ষে বিএনপির পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, একটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তারা সংখ্যায় অনেক, তারা শিক্ষা চায়, কাজের পরিবেশ চায়, তার সঙ্গে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তির সঙ্গে থাকতে চায়, যুদ্ধাপরাধীদের তারা মনে-প্রাণে ঘৃণা করে।
এ কথাটা আমরা বেশ কিছুদিন থেকেই উপলব্ধি করছি এবং বলারও চেষ্টা করে আসছি। নতুন প্রজন্ম অন্য রকম। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী আজ সারা দেশে নতুনের স্বপ্নে ও সম্ভাবনায় টগবগ করে ফুটছে। তারাই এ দেশটার ভবিষ্যত্ ঠিক করে দেবে। এরা আধুনিক, এরা দেশপ্রেমিক, এরা দলীয় রাজনীতির ব্যাপারে তেমন সক্রিয় নয়, সরবও নয়। এরাই ভোট দিয়ে সরকার বদলে দেয়। কিন্তু এদের একটা সাধারণ ঐকমত্য আছে, এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। এরা রাজাকার-আলবদরদের অপছন্দ করে। এরা প্রতিক্রিয়াশীলদের ধারে-কাছেও থাকতে চায় না। এরা এগিয়ে যেতে চায়, এগিয়ে নিতে চায়। এরা নিজেরা ভালো থাকতে চায়, দেশটাকেও ভালো রাখতে চায়।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ব্যাচেলর ছবি বা চড়ুইভাতি জনপ্রিয় হয়েছিল এ ধরনের তরুণদের কাছেই। এরপর যখন তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের কুকর্ম উন্মোচিত করে বানালেন ভিডিও ছবি স্পার্টাকাস ৭১, তখন সেটা কি তরুণ প্রজন্মের দর্শক গ্রহণ করতে পারবে! বিস্ময়কর নয় মোটেও, তারা ওই নাটকটিকে গ্রহণ করেছে। দেশে এখন চার কোটি মোবাইল ফোনের গ্রাহক। মোবাইলে মোবাইলে ভোটের আগে এসএমএস চালাচালি হয়েছে, ইন্টারনেটে, ই-মেইলে, ফেইস বুুকে তরুণেরা নিজ দায়িত্বে বার্তা আদান-প্রদান করে জনমত তৈরি করেছে, রাজাকারদের বর্জন করুন। ওদের ভোট দেবেন না!
অর্থাত্ বিএনপি এই জামায়াত ও তার জোটসঙ্গীদের কারণে তরুণ ভোটারদের বিবেচনার বাইরে চলে গেছে।
অথচ বিএনপির ভোটব্যাংক ছিল এই তরুণেরা। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দেখেছি, জিনস-কেডস পরা তরুণেরা ছাত্রদলের মিছিলে যোগ দিত। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরপর তরুণদের খুবই প্রিয় ও পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল বিএনপি।
কিন্তু ২৫ বছর পর বিএনপি হয়ে উঠেছে যেন বার্ধক্যের প্রতীক। আর তার কাঁধে জামায়াতে ইসলামীর সিন্দাবাদের ভূত চেপে বসে দলটাকে একটা পেছনপন্থী দলে ঠেলে দিয়েছে।
তরুণদের মনের কথাটা জাফর ইকবালের কথায়ই ফুটে উঠেছে, বিএনপিকে প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ করতে হবে। যুদ্ধবিজয়ী বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরবকে নিজের গৌরব হিসেবে আত্মস্থ করতে পারতে হবে।
বিএনপি দলটা জন্ম থেকেই একটা মহাসংকর দল। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে গড়ে উঠেছিল এ দলটি, ফলে চরম বামপন্থী থেকে শুরু করে চরম ডানপন্থীরা এসে জুটেছিল এই দলে। সূত্রটা ছিল আমরা চীনপন্থী, কাজেই ভারতবিরোধী, কাজেই পাকিস্তানপন্থী, কাজেই আমেরিকাপন্থী। সমপ্রতি প্রথম আলোয় মিজানুর রহমান খান আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র ঘেঁটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর যে প্রতিবেদন রচনা করেছেন, তাতে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান নিজে আমেরিকানদের এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে আমরা আমেরিকাপন্থী, আমরা পাকিস্তানপন্থী।
পাকিস্তানপন্থা এই দেশে চলবে না। বরং আমরা কোনো পন্থী নই, আমরা বাংলাদেশপন্থী, এই বার্তাটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশপন্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করতে হলে প্রথমেই বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করেনি, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরও যারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য তত্পরতা চালিয়েছিল, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপিকে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে।
দল হিসেবে বিএনপি তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাদায় পড়েছে এবার। তবে বিএনপির একটা বিশাল ভোটব্যাংক আছে। এবার নির্বাচনে তারা আসন কম পেয়েছে বটে, কিন্তু তার শতকরা ভোট সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি মোটামুটি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। দেশের মানুষও একবার বিএনপি একবার আওয়ামী লীগ এই দুই ধারার ওপরই ঘুরে-ফিরে আস্থা রেখে আসছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দুই ধারার বাইরে তৃতীয় ধারা তৈরির চেষ্টা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা সফল হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই।
ওই সময় আমি এই কলামে লিখেছিলাম, বাঙালিত্ব এমন একটা জিনিস, যেটা বদলানো যায় না। আমি চাইলেই আমার চামড়ার রং, আমার জন্মের ইতিহাস বদলাতে পারব না। আওয়ামী লীগ আমাদের বাঙালিত্বের প্রতীক। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে এই দল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কাজেই আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যাবে না। তেমনিভাবে একটা আওয়ামী লীগ থাকলে একটা না-আওয়ামী লীগও থাকতে হবে। কাজেই বিএনপি ধারার রাজনীতিও এই দেশে থাকবে। সেটাকেও ধবংস করা যাবে না। এই দুই ধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল দুটোর নাম যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি রয়ে যাবে চিরকাল, তা নাও হতে পারে। তবে দুটো ধারা থাকবে।
আমাদের দেশে দুই প্রধান দলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয় দলই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। উভয় দলই বহু দলীয় গণতন্ত্রকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে মোটেরও পরে আওয়ামী লীগ মধ্যবাম ও বিএনপি মধ্যডান হিসেবে গণ্য হতে পারে। আমেরিকা বা বিলেতেও এ রকমই পরিস্থিতি।
এখন বিএনপি খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলে ঐক্য নেই। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা আগেই অপসৃত। নির্বাচনের ফল যারপরনাই খারাপ। বিএনপি নিজেই ভাসতে পারছে না, তার কাঁধে চেপে বসে আছে জামায়াতে ইসলামী। নিজের জলেই টলমল করে আঁখি, তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি।
কিন্তু গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি যদি তরুণসমাজের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে না পারে, তবে শুধু ভোটার ব্যাংক দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। ২ অক্টোবরের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা ভোটের ফল নির্ধারণে দলীয় ছাউনির বাইরে থাকা স্বাধীন ভোটার ও এই ভোটারদের মধ্যে তরুণদের প্রাধান্যের কথা বারবার বলেছেন। তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে অবশ্যই বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে নিজের গৌরব হিসেবে নিতে পারতে হবে।
আর সংসদে ফিরে যেতে হবে বিএনপিকে। ওই বৈঠকে বিএনপির নেতা সাবেক সেনাপ্রধান মাহাবুবুর রহমান বলেছেন, সংসদে বিএনপির ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি, এখন তো নির্বাচন নিয়েই খোদ আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তারপর তিনি একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আমি সাংসদ হলে সামনের সারিতে জায়গা না পেলে এমনকি বসতে না দিলে পেছনে দাঁড়িয়ে, মাইক্রোফোন না দেওয়া হলে খালি গলায় চিত্কার করে নিজের কথা বলতে থাকতাম।
একদিন এক টেলিভিশন কথাপ্রদর্শনীতে (টক শো) আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ চায় না যে বিরোধী দল সংসদে যাক। তা-ই যদি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের চাওয়া বিএনপি পূর্ণ করছে কেন, তাদের তো তাহলে বেশি বেশি করে সংসদে যাওয়া উচিত।
তবে সংসদকে অর্থবহ করে তুলতে, আমাদের যাতবীয় বিতর্ক ও ঐকমত্যের কেন্দ্রবিন্দু করে গড়ে তুলতে সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি। সরকারকে আন্তরিকভাবে চাইতে হবে বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নিতে।
গণতন্ত্র বাইসাইকেলের মতো। এর দুটো চাকা। সরকারি দল আর বিরোধী দল। দুটো চাকা চললেই গণতন্ত্র চলে। বিএনপিকেও চলতে পারতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার ১১ জানুয়ারির কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। গণতন্ত্র না চললে তার কুফল সরকারি দল বিরোধী দল উভয়কেই ভোগ করতে হয়। সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয় জনগণকে। এই দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই চায় না, ওই দিনের গোলটেবিলে এ কথাটা সবাই স্বীকার করেছিলেন। তবে গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকার, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, দুর্নীতিমুক্তি, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, একলা চলার নীতি পরিহার করে স্বাভাবিক মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদিও যে অবিচ্ছেদ্য, সে কথাগুলোও বিভিন্ন বক্তারা তুলে ধরেছেন বিভিন্নভাবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, তাঁকে দিয়েই শেষ করি। ১৯৯৬-২০০১-এর আওয়ামী লীগের আমলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম আলোয় একটা লেখা লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সেটা হলো শূন্য দিয়ে গুণ করা। আমরা জানি, যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন, শূন্য দিয়ে গুণ করলে সব শূন্য হয়ে যায়। তেমনি ওই আমলে আওয়ামী লীগের বহু ভালো কাজ শূন্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল কয়েকজন দৌর্দণ্ড প্রতাপ সন্ত্রাসীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে। এবারও বলি, যে যা-ই বলি না কেন, সরকারের ভালো-মন্দ, আদর্শ-গণতন্ত্র ইত্যাদি কথার মূল্যায়ন হবে আসলে সরকারের পারফরমেন্স দিয়ে। সরকার দেশটা যদি ভালোভাবে চালায়, তাহলে এক কথা। আর যদি খারাপভাবে চালায়, তাহলে ফলটা দাঁড়াবে শূন্য দিয়ে গুণ করার মতোই। দেশ ভালোভাবে চালানোর কয়েকটা মাপকাঠি আছে জনগণের কাছে। সরকারি দলের লোকেরা সংযত নাকি বেপরোয়া। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কি না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। জিনিসপত্রের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে কি না ইত্যাদি। সাংবাদিকদের ওপর যখন হামলা হয়, তখন বুঝতে হবে সরকারি দলের ক্যাডাররা আর কিছুই মানছে না। এসব দিকে সরকার নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবে।
অন্যদিকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তেই হবে। কিন্তু আমি কম্বল ছাড়তে চাই বটে, কম্বল তো আমাকে ছাড়ে না। বন্যার জলে কম্বল ভেসে যাচ্ছে দেখে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। তারপর কম্বলসহ লোকটা ভেসে যেতে লাগল। সবাই বলতে লাগল, কম্বল ছেড়ে পাড়ে উঠে আয়। সে বলল, আমি তো কম্বল ছাড়তে চাই, কম্বল তো আমাকে ছাড়ে না। কারণ এটা কম্বল নয়, এটা ভালুক। বিএনপিকে বুঝতে হবে জামায়াত কোনো কম্বল নয়, জামায়াত ভালুক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেদিন একটা আনুষ্ঠানিক গোলটেবিল বৈঠকে একটা কথা বলেছেন। বৈঠকটা হয়েছে প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয়ে, ২ অক্টোবর ২০০৯। বিষয়টা ছিল, ‘বাংলাদেশকে বদলে দিতে হলে’। আগামী ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর একাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ওই দিন প্রকাশিতব্য বিশেষ সংখ্যায় গোলটেবিল বৈঠকটির পুরো বিবরণ ছাপা হবে। ৩ অক্টোবরের প্রথম আলোয় বৈঠকটার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, জামায়াতে ইসলামী আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি, একাত্তর সালে তারা আলবদর গঠন করেছে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা নিহত হয়েছেন এই আলবদর বাহিনীর হাতে, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি জোট বেঁধেছে, সেই জামায়াতে ইসলামীকে সরকারে বসায়, তখন তাদের ব্যাপারে আমরা নিরপেক্ষতা দেখাই কী করে, এইটা যখন আমরা করি, তখন আমাদের লোকে ভাবে আমরা হয়তো একটা দলের হয়ে কথা বলছি। আসলে তা নয়, আমরা দলনিরপেক্ষই। কিন্তু যত দিন জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আছে, তত দিন আমাদের পক্ষে বিএনপির পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, একটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তারা সংখ্যায় অনেক, তারা শিক্ষা চায়, কাজের পরিবেশ চায়, তার সঙ্গে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তির সঙ্গে থাকতে চায়, যুদ্ধাপরাধীদের তারা মনে-প্রাণে ঘৃণা করে।
এ কথাটা আমরা বেশ কিছুদিন থেকেই উপলব্ধি করছি এবং বলারও চেষ্টা করে আসছি। নতুন প্রজন্ম অন্য রকম। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী আজ সারা দেশে নতুনের স্বপ্নে ও সম্ভাবনায় টগবগ করে ফুটছে। তারাই এ দেশটার ভবিষ্যত্ ঠিক করে দেবে। এরা আধুনিক, এরা দেশপ্রেমিক, এরা দলীয় রাজনীতির ব্যাপারে তেমন সক্রিয় নয়, সরবও নয়। এরাই ভোট দিয়ে সরকার বদলে দেয়। কিন্তু এদের একটা সাধারণ ঐকমত্য আছে, এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। এরা রাজাকার-আলবদরদের অপছন্দ করে। এরা প্রতিক্রিয়াশীলদের ধারে-কাছেও থাকতে চায় না। এরা এগিয়ে যেতে চায়, এগিয়ে নিতে চায়। এরা নিজেরা ভালো থাকতে চায়, দেশটাকেও ভালো রাখতে চায়।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ব্যাচেলর ছবি বা চড়ুইভাতি জনপ্রিয় হয়েছিল এ ধরনের তরুণদের কাছেই। এরপর যখন তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের কুকর্ম উন্মোচিত করে বানালেন ভিডিও ছবি স্পার্টাকাস ৭১, তখন সেটা কি তরুণ প্রজন্মের দর্শক গ্রহণ করতে পারবে! বিস্ময়কর নয় মোটেও, তারা ওই নাটকটিকে গ্রহণ করেছে। দেশে এখন চার কোটি মোবাইল ফোনের গ্রাহক। মোবাইলে মোবাইলে ভোটের আগে এসএমএস চালাচালি হয়েছে, ইন্টারনেটে, ই-মেইলে, ফেইস বুুকে তরুণেরা নিজ দায়িত্বে বার্তা আদান-প্রদান করে জনমত তৈরি করেছে, রাজাকারদের বর্জন করুন। ওদের ভোট দেবেন না!
অর্থাত্ বিএনপি এই জামায়াত ও তার জোটসঙ্গীদের কারণে তরুণ ভোটারদের বিবেচনার বাইরে চলে গেছে।
অথচ বিএনপির ভোটব্যাংক ছিল এই তরুণেরা। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দেখেছি, জিনস-কেডস পরা তরুণেরা ছাত্রদলের মিছিলে যোগ দিত। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরপর তরুণদের খুবই প্রিয় ও পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল বিএনপি।
কিন্তু ২৫ বছর পর বিএনপি হয়ে উঠেছে যেন বার্ধক্যের প্রতীক। আর তার কাঁধে জামায়াতে ইসলামীর সিন্দাবাদের ভূত চেপে বসে দলটাকে একটা পেছনপন্থী দলে ঠেলে দিয়েছে।
তরুণদের মনের কথাটা জাফর ইকবালের কথায়ই ফুটে উঠেছে, বিএনপিকে প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ করতে হবে। যুদ্ধবিজয়ী বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরবকে নিজের গৌরব হিসেবে আত্মস্থ করতে পারতে হবে।
বিএনপি দলটা জন্ম থেকেই একটা মহাসংকর দল। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে গড়ে উঠেছিল এ দলটি, ফলে চরম বামপন্থী থেকে শুরু করে চরম ডানপন্থীরা এসে জুটেছিল এই দলে। সূত্রটা ছিল আমরা চীনপন্থী, কাজেই ভারতবিরোধী, কাজেই পাকিস্তানপন্থী, কাজেই আমেরিকাপন্থী। সমপ্রতি প্রথম আলোয় মিজানুর রহমান খান আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র ঘেঁটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর যে প্রতিবেদন রচনা করেছেন, তাতে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান নিজে আমেরিকানদের এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে আমরা আমেরিকাপন্থী, আমরা পাকিস্তানপন্থী।
পাকিস্তানপন্থা এই দেশে চলবে না। বরং আমরা কোনো পন্থী নই, আমরা বাংলাদেশপন্থী, এই বার্তাটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশপন্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করতে হলে প্রথমেই বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করেনি, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরও যারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য তত্পরতা চালিয়েছিল, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপিকে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে।
দল হিসেবে বিএনপি তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাদায় পড়েছে এবার। তবে বিএনপির একটা বিশাল ভোটব্যাংক আছে। এবার নির্বাচনে তারা আসন কম পেয়েছে বটে, কিন্তু তার শতকরা ভোট সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি মোটামুটি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। দেশের মানুষও একবার বিএনপি একবার আওয়ামী লীগ এই দুই ধারার ওপরই ঘুরে-ফিরে আস্থা রেখে আসছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দুই ধারার বাইরে তৃতীয় ধারা তৈরির চেষ্টা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা সফল হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই।
ওই সময় আমি এই কলামে লিখেছিলাম, বাঙালিত্ব এমন একটা জিনিস, যেটা বদলানো যায় না। আমি চাইলেই আমার চামড়ার রং, আমার জন্মের ইতিহাস বদলাতে পারব না। আওয়ামী লীগ আমাদের বাঙালিত্বের প্রতীক। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে এই দল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কাজেই আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যাবে না। তেমনিভাবে একটা আওয়ামী লীগ থাকলে একটা না-আওয়ামী লীগও থাকতে হবে। কাজেই বিএনপি ধারার রাজনীতিও এই দেশে থাকবে। সেটাকেও ধবংস করা যাবে না। এই দুই ধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল দুটোর নাম যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি রয়ে যাবে চিরকাল, তা নাও হতে পারে। তবে দুটো ধারা থাকবে।
আমাদের দেশে দুই প্রধান দলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয় দলই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। উভয় দলই বহু দলীয় গণতন্ত্রকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে মোটেরও পরে আওয়ামী লীগ মধ্যবাম ও বিএনপি মধ্যডান হিসেবে গণ্য হতে পারে। আমেরিকা বা বিলেতেও এ রকমই পরিস্থিতি।
এখন বিএনপি খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলে ঐক্য নেই। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা আগেই অপসৃত। নির্বাচনের ফল যারপরনাই খারাপ। বিএনপি নিজেই ভাসতে পারছে না, তার কাঁধে চেপে বসে আছে জামায়াতে ইসলামী। নিজের জলেই টলমল করে আঁখি, তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি।
কিন্তু গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি যদি তরুণসমাজের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে না পারে, তবে শুধু ভোটার ব্যাংক দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। ২ অক্টোবরের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা ভোটের ফল নির্ধারণে দলীয় ছাউনির বাইরে থাকা স্বাধীন ভোটার ও এই ভোটারদের মধ্যে তরুণদের প্রাধান্যের কথা বারবার বলেছেন। তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে অবশ্যই বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে নিজের গৌরব হিসেবে নিতে পারতে হবে।
আর সংসদে ফিরে যেতে হবে বিএনপিকে। ওই বৈঠকে বিএনপির নেতা সাবেক সেনাপ্রধান মাহাবুবুর রহমান বলেছেন, সংসদে বিএনপির ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি, এখন তো নির্বাচন নিয়েই খোদ আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তারপর তিনি একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আমি সাংসদ হলে সামনের সারিতে জায়গা না পেলে এমনকি বসতে না দিলে পেছনে দাঁড়িয়ে, মাইক্রোফোন না দেওয়া হলে খালি গলায় চিত্কার করে নিজের কথা বলতে থাকতাম।
একদিন এক টেলিভিশন কথাপ্রদর্শনীতে (টক শো) আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ চায় না যে বিরোধী দল সংসদে যাক। তা-ই যদি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের চাওয়া বিএনপি পূর্ণ করছে কেন, তাদের তো তাহলে বেশি বেশি করে সংসদে যাওয়া উচিত।
তবে সংসদকে অর্থবহ করে তুলতে, আমাদের যাতবীয় বিতর্ক ও ঐকমত্যের কেন্দ্রবিন্দু করে গড়ে তুলতে সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি। সরকারকে আন্তরিকভাবে চাইতে হবে বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নিতে।
গণতন্ত্র বাইসাইকেলের মতো। এর দুটো চাকা। সরকারি দল আর বিরোধী দল। দুটো চাকা চললেই গণতন্ত্র চলে। বিএনপিকেও চলতে পারতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার ১১ জানুয়ারির কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। গণতন্ত্র না চললে তার কুফল সরকারি দল বিরোধী দল উভয়কেই ভোগ করতে হয়। সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হয় জনগণকে। এই দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই চায় না, ওই দিনের গোলটেবিলে এ কথাটা সবাই স্বীকার করেছিলেন। তবে গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকার, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, দুর্নীতিমুক্তি, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, একলা চলার নীতি পরিহার করে স্বাভাবিক মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদিও যে অবিচ্ছেদ্য, সে কথাগুলোও বিভিন্ন বক্তারা তুলে ধরেছেন বিভিন্নভাবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, তাঁকে দিয়েই শেষ করি। ১৯৯৬-২০০১-এর আওয়ামী লীগের আমলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম আলোয় একটা লেখা লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সেটা হলো শূন্য দিয়ে গুণ করা। আমরা জানি, যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন, শূন্য দিয়ে গুণ করলে সব শূন্য হয়ে যায়। তেমনি ওই আমলে আওয়ামী লীগের বহু ভালো কাজ শূন্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল কয়েকজন দৌর্দণ্ড প্রতাপ সন্ত্রাসীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে। এবারও বলি, যে যা-ই বলি না কেন, সরকারের ভালো-মন্দ, আদর্শ-গণতন্ত্র ইত্যাদি কথার মূল্যায়ন হবে আসলে সরকারের পারফরমেন্স দিয়ে। সরকার দেশটা যদি ভালোভাবে চালায়, তাহলে এক কথা। আর যদি খারাপভাবে চালায়, তাহলে ফলটা দাঁড়াবে শূন্য দিয়ে গুণ করার মতোই। দেশ ভালোভাবে চালানোর কয়েকটা মাপকাঠি আছে জনগণের কাছে। সরকারি দলের লোকেরা সংযত নাকি বেপরোয়া। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কি না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। জিনিসপত্রের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে কি না ইত্যাদি। সাংবাদিকদের ওপর যখন হামলা হয়, তখন বুঝতে হবে সরকারি দলের ক্যাডাররা আর কিছুই মানছে না। এসব দিকে সরকার নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবে।
অন্যদিকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তেই হবে। কিন্তু আমি কম্বল ছাড়তে চাই বটে, কম্বল তো আমাকে ছাড়ে না। বন্যার জলে কম্বল ভেসে যাচ্ছে দেখে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। তারপর কম্বলসহ লোকটা ভেসে যেতে লাগল। সবাই বলতে লাগল, কম্বল ছেড়ে পাড়ে উঠে আয়। সে বলল, আমি তো কম্বল ছাড়তে চাই, কম্বল তো আমাকে ছাড়ে না। কারণ এটা কম্বল নয়, এটা ভালুক। বিএনপিকে বুঝতে হবে জামায়াত কোনো কম্বল নয়, জামায়াত ভালুক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments