পরীক্ষার ফল এসেছে কিন্তু তারা নেই

এইচএসসি পরীক্ষা চলার মধ্যেই শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বহু পরীক্ষার্থী। তাদের কয়েকজন শহীদ হয়েছেন আন্দোলনে। আহত হয়েছেন অনেকে। মঙ্গলবার প্রকাশ হওয়া ফলাফলে শহীদ হওয়া শিক্ষার্থীদের ফলও হাতে পেয়েছেন তাদের স্বজনরা। ফল আসলেও সেই শিক্ষার্থীরা চিরতরে হারিয়ে গেছেন পরিবার থেকে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়া এই শিক্ষার্থীদের ফল হাতে পেয়ে শোকাতুর পরিবারে নতুন শোক চেপেছে। আপ্লুত হয়েছেন সহপাঠী, বন্ধু, স্বজন ও তাদের শিক্ষকরা।

গতকাল প্রকাশ হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শহীদ নাফিসা হোসেন মারওয়া পেয়েছেন ৪.২৫। ঢাকা জেলার সাভারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত হন তিনি। ১৭ বছর বয়সী এই সাহসী কিশোরী ছিলেন আন্দোলনের সম্মুখে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে পালানোর দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন থানা রোডে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি।

তার বাবা আবুল হোসেন চায়ের দোকান চালান। তিনি বলেন, মেয়ে আমাকে না জানিয়ে ১৮ই জুলাই থেকে উত্তরায় যেত আন্দোলনে। সারাদিন দোকানে থাকায় খোঁজ পেতাম না। প্রতিবেশীর কাছে জেনে মেয়েকে ঘরে আটকাই রাখি। আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে খুব রাগ করেছিলাম। তবে মেয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়ে যায়। ৩রা আগস্ট বললো, লেখাপড়া নেই, ঘরে থেকে দমবন্ধ লাগছে। সাভারে মামার বাসায় বেড়াতে যাবে। ভেবেছিলাম, সাভারে গেলে আন্দোলনে যাবে না।

তিনি আরও বলেন, সাভারের বক্তারপুরে মামার বাসায় গিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার আন্দোলনে যায়। ৪ঠা আগস্ট দুপুরে মেয়েকে ফোন করলে গোলাগুলির শব্দ শুনি। মেয়ে তখন স্বীকার করে, আন্দোলনে আছে। আর পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। ৫ই আগস্ট থানা রোডে যায় নাফিসা। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ফোনে বললো, শেখ হাসিনা পলাইছে। আব্বু, আমি গণভবন যামু। আজ আমারে বাধা দিও না। দুপুর ২টার দিকে মেয়ের ফোন থেকে এক ছেলে জানায়, আমার মেয়ের বুকে গুলি লাগছে। মেয়েটা সোয়া ২টার দিকে আমারে ফোন করে বলে, আব্বু আমি মরে যামু। লাশটা নিও। এটাই মেয়ের শেষ কথা ছিল।

আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে নিহত মাহাদী হাসান পান্থ। তিনি পেয়েছেন জিপিএ-৩.১৭। গত ১৯শে জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে সেদিন সন্ধ্যায়ই মৃত্যুবরণ করেন সরকারি তোলারাম কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থী মাহাদী হাসান পান্থ।
লক্ষ্মীপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সাদ আল আফনান পাটওয়ারী। শহীদ আফনান লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের বাঞ্চানগর গ্রামের বাস টার্মিনাল এলাকার মৃত সালেহ আহমেদের ছেলে। তিনি এইচএসসি’তে পেয়েছেন জিপিএ- ৪.১৭। আফনানের মা নাছিমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আফনানের ভালো ফলাফল আমার কাছে খুশির খবর। কিন্তু যাকে নিয়ে আমি খুশি উদ্‌যাপন করবো, সে তো আমার কাছে নেই। গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার কোলশূন্য করে দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ঠা আগস্ট লক্ষ্মীপুরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আফনান। শেরপুরে নিহত শহীদ সবুজ মিয়া এইচএসচি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি মানবিক বিভাগ থেকে তিনি জিপিএ- ৪.৩৩ পেয়েছেন। শহীদ সবুজ মিয়া শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের রুপারপাড়া গ্রামের আজহার আলীর ছেলে। গত ৪ঠা আগস্ট শেরপুর জেলা শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহীদ হন সবুজ মিয়া।

গত ৫ই আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় বিজয় মিছিলে গিয়েছিলেন মো. রায়হান। মিছিলে হঠাৎ মাথায় ও পিঠে গুলি এসে লাগে তার। শহীদ হন গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী রায়হান। রায়হান নোয়াখালীর সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের পূর্ব দুর্গানগর গ্রামের আমজাদ হাজী বাড়ির মো. মোজাম্মেল হোসেন ও আমেনা দম্পতির একমাত্র ছেলে। তিনি রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাণিজ্য বিভাগ থেকে পেয়েছেন ২.৯২। তার বাবা মো. মোজাম্মেল হোসেন বাড্ডায় একটি বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করতেন। রায়হান পাশেই একটা মেসে থাকতেন। তার বোন উর্মি আক্তার বলেন, ফলাফল শোনার পর বাবা-মা কান্না করছেন। মা বলেন, আমার ছেলে বেঁচে নেই, তার এই ফল দিয়ে কী হবে? সে পাস করসে তা দিয়ে এখন কি করবো। বাবা এখনো কান্না করছেন।

শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহ বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়েছেন। তার বাবা মোহাম্মদ আবদুল মতিন গতকাল ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহাদতবরণকারী আমার একমাত্র ছেলে কলিজার টুকরা শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

গত ১৮ই জুলাই বিকালে ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়। শাহরিয়ারের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.