দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেও তিনি বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী by মুনির হোসেন

প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা। কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য একটি ৩০০ কেভিএ জেনারেটর ক্রয়ের কথা বলে অর্থ তুলে নেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজ। কিন্তু জেনারেটর না কিনে সেই অর্থ পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন তিনি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এ ঘটনায় পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যে মামলায় তিনি জেলও খাটেন। সাময়িক বরখাস্ত হন চাকরি থেকে। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ ও দুর্নীতি পরায়ণতার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তে তার দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তার সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। ‘মানবিক দিক’- বিবেচনা করে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে করা হয় প্রধান প্রকৌশলী (আর.সি)। কিন্তু আদালতের বারান্দা দৌড়ানো বন্ধ হয়নি তার। এখনো নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয় বেবিচক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজকে। গত ১লা অক্টোবরও তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে হাজিরা দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও একজন ফৌজদারি মামলার আসামি যিনি বেআইনি সুপারিশে চাকরি ফিরে পেয়েছেন তিনি এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। সাবেক আইনমন্ত্রীর বেআইনি সুপারিশে চাকরিতে বহাল ও প্রধান প্রকৌশলী বনে যাওয়া শহীদুল আফরোজকে নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে বেবিচকে। সেখানকার অনেকে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।

বেবিচকের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি অবগত রয়েছেন। তবে এ মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। জানা গেছে, জেনারেটর কেনার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বেবিচকের তৎকালীন তত্ত্বাবধায় প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজসহ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনিসহ অন্য আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে বেবিচক কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা-১৯৮৮ এর ৪৫(৫) প্রবিধি মোতাবেক শহীদুল আফরোজকে ওইদিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ ও দুর্নীতি পরায়ণতার অভিযোগ আনয়ন করে ৪ঠা মার্চ ২০২০ সালে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তে তার দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদানপূর্বক বিভাগীয় মামলাটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ১১ই মে ২০২১ সালে নিষ্পত্তি করা হয় এবং তিনি ফৌজদারি অপরাধে ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হওয়ায় ও মামলা চলমান থাকায় তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ বলবৎ রাখা হয়। বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির পর শহীদুল আফরোজ ২০২১ সালের ১৫ই জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে সাময়িক বরখাস্ত চলমান রাখার আদেশের বিরুদ্ধে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এর কর্মচারী প্রবিধানমালা-২০২১ এর ৫৮ প্রবিধি অনুযায়ী আপিল দায়ের করেন।

সেই অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৪শে মার্চ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় শহীদুল আফরোজের বিভাগীয় মামলা ও সাময়িক বরখাস্ত আদেশ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেয়। যেখানে বেবিচকের চাকরির বিভিন্ন প্রবিধি উল্লেখ করে বলা হয়, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি ও বিভাগীয় মামলায় সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার হলেও তাকে তাৎক্ষণিকভাবে পুনরায় সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। তাই প্রকৃতপক্ষে সাময়িক বরখাস্তকৃত মো. শহীদুল আফরোজের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের এ স্মারকে স্বাক্ষর করেন উপ-সচিব (রুটিন দায়িত্ব) রোকসিন্দা ফারহানা। এরপর ২০২২ সালের ১৬ই মার্চ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায়। তার প্রেক্ষিতে ১৭ই মে মো. শহীদুল আফরোজের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার বিষয়ে মতামত দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক স্মারকে জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে সাময়িক বরখাস্ত করায় এবং উক্ত মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-এর কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা-২০২১ এর অনুচ্ছেদ-৬৭ এবং সরকারি কর্মচারী চাকরি আইন-২০১৮ অনুসারে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। এতে স্বাক্ষর করেন উপ-সচিব মো. মশিউর রহমান তালুকদার। অন্যদিকে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে একাদশ জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গত ৬ই মার্চ ২০২৩ সালের অনুষ্ঠিত ৩৪তম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগকে মতামত প্রদানের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আইন ও বিচার বিভাগ ১৩ই জুন ২০২৩ সালে ‘মানবিক দিক’ বিবেচনা করে পুনারায় স্বপদে বহালের বিষয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি করার সুপারিশ করে।

উপ-সচিব (মতামত-২) এর এ মতামতে ২০২৩ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহের বিভিন্ন তারিখে স্বাক্ষর করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সচিব মো. গোলাম সরওয়ারসহ সাত কর্মকর্তা। যেটি সিনিয়র সহকারী সচিব তৈয়াবুল হাসানের ১৩ই জুন ২০২৩ এর স্বাক্ষরে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ২৬শে জুন বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শহীদুল আফরোজের সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৫ই ফেব্রুয়ারি তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে শহীদুল আফরোজের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। যেটি করতে বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান কয়েকবার অপরাগতাও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী ফারুক খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করতে হয়। শহীদুল আফরোজের বিরুদ্ধে চলা ফৌজদারি মামলাটি এখন হিয়ারিং অবস্থায় আছে।

গত ১লা অক্টোবরও চট্টগ্রামে গিয়ে আদালতে হাজির হতে হয়েছিল তাকে। পরবর্তী তারিখ নভেম্বরে নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে মো. শহীদুল আফরোজ মুঠোফোনে কথা বলতে অপরাগতা জানান। অন্যদিকে বেবিচকের বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, আমরা বিষয়টি অবগত আছি। এ বিষয়ে এখনই কথা বলতে চাচ্ছি না। আগামী ২০ তারিখের পর কথা বলবো। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু নতুনভাবে সাজাবো। কিছুদিনের মধ্যেই পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এ বিষয়ে সাবেক জজ (কোর্ট অব আপিল, জাতিসংঘ) ড. শাজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, ফৌজদারি মামলায় জেল খাটা, বিভাগীয় তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়া ও চার্জশিট হওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেয়া ভাষ্য অনুযায়ী মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। অন্যদিকে এটি নৈতিকারও প্রশ্ন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.