যে অভিযোগে বরখাস্ত হলেন হাথুরুসিংহে: এই মেয়াদে হাথুরুর অধীনে কেমন ছিল বাংলাদেশ?

২০২৩, ভারতের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স ভয়াবহ খারাপ। ৯ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতে জয়। ওয়ানডেতে দলের এমন পারফরম্যান্সকে বলা হচ্ছিলো দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা। তবে হঠাৎ করে ক্রিকেট থেকে আলোচনা সরে গিয়ে সব চোখ তখন স্পিনার নাসুম আহমেদের দিকে। কারণ শোনা যাচ্ছিলো দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুুরুসিংহে নাকি চড় মেরেছেন। তবে প্রধান কোচ তা অস্বীকার করেন নিজেই। এমনকি নাজমুল হাসান পাপন সভাপতি থাকা অবস্থায় এ নিয়ে তদন্তও হয়। যে রিপোর্টে এমন কিছু পাওয়া যায়নি বলেই তখন জানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয় গেল ২৩শে ডিসেম্বর এই ঘটনায় তদন্ত চেয়ে তৎকালীন বোর্ড সভাপতি বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আশরাফুর রহমান। সেই ঘটনার প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। বিসিবিতে এসেছেন নয়া সভাপতি ফারুক আহমেদ। এবার সেই ঘটনার তদন্ত করে নিলেন ব্যবস্থা। শোকজ নোটিশ দিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছে প্রধান কোচকে। এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বিসিবি’র নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা আমাদের কোচকে (হাথুরুসিংহে) শোকজ নোটিশ দিয়েছি এবং সাময়িক বরখাস্ত করেছি। (তার কর্মকাণ্ডে) এমন কিছু সমস্যা ছিল যা আমি একজন প্রাক্তন খেলোয়াড় হিসেবে সহ্য করতে পারি না। হাথুরুসিংহকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে এবং তার বরখাস্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। এর পরে তার চুক্তি স্থগিত করা হবে।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হওয়ার পরপরই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ছাঁটাই করবেন বলে জানিয়ে এসেছিলেন ফারুক আহমেদ। পাকিস্তান সফরে টাইগারদের দারুণ সাফল্যে টিকে গিয়েছিলেন এই কোচ। ভারত সফরে ভরাডুবির পর শেষ রক্ষা আর হলো না। শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত করা হয়েছে এই লঙ্কান কোচকে। তবে আপাতত সাময়িকভাবে। তার পরিবর্তে ১০০ দিনের জন্য অন্তবর্তীকালীন কোচ হিসেবে ক্যারিবিয়ান ফিল সিমন্সকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ফারুক বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য আমরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিল সিমন্সকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত কাজ করবেন।’ জাতীয় দলে দুই দফা কোচ ছিলেন হাথুরুসিংহে। ২০১৪, জুন থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান। এরপর ২০২৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আবার হাথুরুসিংহকে কোচের পদে ফিরিয়ে আনেন নাজমুল হোসেন পাপনের অধীনে থাকা তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ড। তার সঙ্গে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত চুক্তি করা হয়। কিন্তু সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে বিদায় করা হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রশ্ন হচ্ছে ১২ মাস পর কেন এই শাস্তির মুখোমুখি হলেন হাথুুরু! এ নিয়ে বিসিবি সভাপতি ফারুক কারণটা জানালেও যে ক্রিকেটারকে চড় মেরেছিলেন হাথুরু সেটি প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আসলে আমি তো ২ মাসের কথা বলতে পারবো। দেড় মাসের কাছাকাছি। আগে তো পত্রিকা পড়ে হালকাভাবে জেনেছি। প্রথম দিন থেকেই আমার খারাপ লেগেছে। এরপর মনে হয়েছে এটা আসলে একটা কিছু হলে ভালো হয়। আর আপনারা জানবেন আইসিসি এখন শক্তভাবে রেসিজম, অ্যাবিউজ হ্যান্ডেল করে, আর ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট যদি হয় তাহলে তো আরও করবে, খুব ভালো বলেছেন জাতীয় দলের একজন প্লেয়ার। আমরা সবাই মানুষ। হিট অব দ্য মোমেন্টে কিছু জিনিস হতে পারে তবে ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট আসলে কোনো পর্যায়ে জাতীয় দলের প্লেয়ারকে আপনি করতে পারবেন না। এটার শাস্তি এটাই আরকি যেটা এখন হচ্ছে আরকি, ওইটাই হওয়া উচিত ছিল আগে যেটা। রিপোর্ট নিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি। প্লেয়ারের সঙ্গে ফোন, ফিজিক্যাল মিট করেছি। রিপোর্ট আমি পড়েছি সবকিছু আছে, সব নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করেছি আমি একটা (কিছু করতে)। আপনি জানেন পাকিস্তানে খেলতে গেলাম, এরপর ভারতে চলে গেলাম। এসেই কিন্তু জিনিসটা প্রসেস হয়েছে। আর কার সঙ্গে ঘটনা সেই নামটা না হয় নাই বলি।’ অন্যদিকে পাপনের বোর্ডও তদন্ত করেছিলেন। কিন্তু তখন রিপোর্ট পেয়েও বিসিবি সভাপতি জানিয়েছিলেন এমন কোনো কিছু নেই। এ নিয়ে ফারুক বলেন, ‘আগের তদন্ত রিপোর্টেও এমনটা ছিল। আর এবার আমি নতুন করে তদন্ত করেছি।’ 

এই মেয়াদে হাথুরুর অধীনে কেমন ছিল বাংলাদেশ?

২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩, হাফ প্যান্টের সঙ্গে সাদা রঙের টি-শার্ট আর মাথায় ক্যাপ, চোখে কালো রোদচশমা পরে হোম অফ ক্রিকেটে ঢুকেছিলেন। সেটা ছিল দ্বিতীয় দফায় মিরপুরে তার প্রত্যাবর্তন। ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ অনুশীলন শেষে বের হলেন মাঠ থেকে আর এই দফায় সেটাই শেষবার। নানা অপরাধে গতকাল চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে জাতীয় ক্রিকেট দলের হেড কোচের পদ থেকে বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। দ্বিতীয় মেয়াদে চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কোচ করে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে মজা করে বলেছিলেন, প্রাক্তনকে কখনো ফেরানো উচিত নয়। এ ছাড়া প্রথম মেয়াদের যাদের সঙ্গে ঝামেলা ছিল সবাই তখনও দলেই ছিলেন। যদিও প্রথম সংবাদ সম্মেলনে হাথুরু বলেছিলেন সবার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন তিনি। কারও সঙ্গে তার কোনো সমস্যা নেই। তবে এবারো শেষ পর্যন্ত মাঠের বাইরের নানা ঘটনা ও বিতর্ক কাল হলো তার জন্য। ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকেই হাথুরুর বাংলাদেশে ফেরার গুঞ্জন তৈরি হয়। একপর্যায়ে গত বছরের ৩১শে জানুয়ারি বিসিবি জানায়, আবার কোচের দায়িত্বে ফেরানো হচ্ছে হাথুরুসিংহেকে। দুই বছরের চুক্তিতে কাজ শুরু করেন গত ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই দফায় হাথুরুর কোচিংয়ে ১০ টেস্ট, ৩৫ ওয়ানডে ও ৩৫ টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ দল। টেস্টে জয়-হার সমান ৫টি করে। টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিলেটে জয় এবং পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় এই মেয়াদে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। আবার ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার কাছে বাজেভাবে হার এবং ক’দিন আগে ভারত সফরে বিব্রতকর পরাজয়ও আছে এই মেয়াদে। ওয়ানডেতে ৩৫ ম্যাচের মধ্যে জয় ১৩টি, হার ১৯টি, পরিত্যক্ত হয়েছে তিন ম্যাচ। এই সংস্করণে সবচেয়ে হতাশার অধ্যায় ছিল গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ। নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল যে আসরে, সেখানেই নেদারল্যান্ডসের মতো দলের বিপক্ষেও হারে বাংলাদেশ। ৯ ম্যাচে মাত্র ৩টি ম্যাচ জেতে টাইগাররা। এই বিশ্বকাপের আগে নানা বিতর্কে বাদ পড়েন তামিম ইকবাল। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হলে ঘটনা আরও বিতর্কিত হয়ে ওঠে। তামিম অবসর নেন ফিরে আসেন আবার বিশ্বকাপ স্কোয়ার্ড থেকেও বাদ পড়েন। দুইজনের সম্পর্কের অবনতিতে অনেকেই হাথুরুকে দায়ী করেন। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হাথুরুর অধীনেই প্রথমবার ৩টি ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। কিন্তু পারফর্ম্যান্স কোনো ম্যাচেই সন্তোষজনক ছিল না। শেষ ম্যাচে সুপার এইটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সমীকরণ মেলালেই সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শুরুতেই হাল ছেড়ে দেয় টাইগাররা। এটা নিয়েও সমালোচিত হন হাথুরু। এই সংস্করণে তার অধীনে এই মেয়াদে জয় ১৯টি, হার ১৫টি, পরিত্যক্ত এক ম্যাচ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.