ঈর্ষার আগুন নয় ভালোবাসার শক্তিই হোক আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মূল প্রেরণা by রেজানুর রহমান

এত গেল মঞ্চের অবস্থা। সিনেমা হলের অবস্থা কেমন? এমনিতেই সিনেমার ক্ষেত্রে দুর্দিন চলছে। ১৩শ’ সিনেমা হল ছিল সারা দেশে। এখন সেই সংখ্যা একশ’রও নিচে এসে ঠেকেছে। দেশের অনেক বিভাগীয় শহরেও সিনেমা হল নাই। দেশের প্রতিটি জেলা শহরে সিনেপ্লেক্স করার কথা শোনা গিয়েছিল পতিত সরকারের আমলে। এখন সেই উদ্যোগ বোধকরি থেমে আছে। এফডিসিতে আধুনিক ভবন ও শুটিং ফ্লোর নির্মাণের কাজ চলছে। সে কারণে এফডিসিতে শুটিং বন্ধ রয়েছে। কবীরপুরে সিনেমা পল্লী নির্মাণের কল্প-কাহিনী অনেক বছর থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কার্যত দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও দেখা দিয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। বিগত ১৫/১৬ বছরের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠেছে। এতদিন যারা ছিলেন চরম অবহেলিত, এখন তারা গুরুত্ব পাচ্ছেন।

একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন সেটা বুঝা যায় দেশটির কোনো একটি শহরের রাস্তার পরিবেশ, পরিস্থিতি দেখে। হাঁড়ির একটি ভাত টিপলেই বুঝে নেয়া সম্ভব চাল সেদ্ধ হয়েছে কিনা। তেমনই দেশের কোনো একটি শহরের রাস্তার নিয়মকানুন দেখেও বুঝা যায় দেশটি কতোটা সভ্য? দেশ কী সভ্য হয়? নাকি দেশের মানুষকে সভ্য হতে হয়? প্রথম যেবার সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম রাস্তার নিয়মকানুন দেখে অবাক হয়েছি। ছোট্ট দু’টি শিশু রাস্তা পার হবে। সেজন্য রাস্তার দুই দিকেই চলন্ত সব গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ট্রাফিক পুলিশ পরম যত্ন ও মমতার সঙ্গে শিশু দু’টির হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলেন। এর চেয়ে সভ্য, সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? আমাদের দেশে এই দৃশ্য কল্পনা করাও অমূলক। মাত্র দু’দিন আগে ঢাকার রাস্তায় দু’টি চলন্ত বাস কে আগে যাবে এই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে একজন তরুণীকে পিষে মেরেছে। কী বীভৎস, নির্দয় ও নিষ্ঠুর ঘটনা। এজন্য কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এর থেকে বুঝা যায় দেশের সড়ক ব্যবস্থা কতোটা অমানবিক।

একটি দেশ কতোটা সভ্য সেটা বুঝা যায় দেশটির সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ ও অতীত ঐতিহ্য দেখেও। বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাচ, গান, নাটক, সিনেমা, খেলাধুলা এমনকী খাদ্যও একটি দেশের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। সেজন্য প্রতিটি দেশে বিদেশি কেউ এলে অর্থাৎ বিদেশি অতিথিদের সম্মানার্থে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখা হয়। নাচ, গান, নাটক, সিনেমার আয়োজন থাকে ওই সব জাতীয় অনুষ্ঠানে। কেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে? থাকে এই জন্য যে, দেশটি তার বিদেশি বন্ধুদের বুঝাতে চায় দেখো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমরা কতোটা সভ্য। কতোটা উন্নত। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখো। তার মানে একটি দেশের সংস্কৃতিও দেশটির উন্নয়ন- অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রেরণা শক্তি। সাংস্কৃতিক জাগরণ একটি দেশকে আধুনিক ভাবনায় বিকশিত করে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটা বন্ধ্যত্ব দেখা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র- জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু ব্যতিক্রম দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সিনেমা হল খোলা। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্য নাই। ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকের মঞ্চ খুলেছে। কিন্তু সেটা না খোলার মতোই। শিল্পকলা একাডেমিতে প্রতিদিন ৩টি মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ হয়। সেখানে একটি মাত্র হল খুলে দেয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে অনেক নিয়মকানুনের বেড়াজাল। নাটক, সিনেমা, নাচ, গান, উৎসবমুখর পরিবেশেই বিকশিত হয়। সেখানে কঠোর নিয়ম, নিরাপত্তার আয়োজন কতোটা কাজে দিবে- এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তবে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগের প্রশংসাও হচ্ছে। ৩টি মঞ্চের একটি খুললো। এটা শুভ লক্ষণ। শুভ উদ্যোগ। অচিরেই হয়তো অন্য দু’টি মঞ্চও খুলে যাবে। শিল্পকলার আঙিনায় এখনো সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। কাজেই শিল্পকলার আঙিনা ঠিক কতোদিন পর আবার সংস্কৃতি কর্মীদের সরব উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠবে তা বলা মুশকিল।
বেইলি রোডে মহিলা সমিতির মঞ্চ নাট্যকর্মীদের অনেক আস্থার জায়গা। এতদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৩টি মঞ্চের পাশাপাশি মহিলা সমিতির মঞ্চেও নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু মহিলা সমিতির ভাড়া নিয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা। কিছু দিন আগেও ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় মঞ্চ কর্মীরা এক বেলা মহিলা সমিতির মঞ্চ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন। এখন ভাড়া হয়েছে দ্বিগুণ। কেন দ্বিগুণ হলো? এর ব্যাখ্যা দিয়েছে মহিলা সমিতি। এতদিন মহিলা সমিতির জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা অনুদান দেয়া হতো। সেই অনুদানকে পুঁজি করে মহিলা সমিতি মঞ্চ ভাড়া ৫ হাজার টাকা ধার্য করেছিল। এখন মহিলা সমিতির জন্য ওই সরকারি অনুদান বন্ধ রয়েছে। সে কারণে মহিলা সমিতি বাধ্য হয়ে প্রতিদিনের হল ভাড়া দ্বিগুণ করেছে। ফলে বিপাকে পড়েছে নাট্য সংগঠনগুলো। ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে যেখানে একদিনের মঞ্চ প্রযোজনা কঠিন হয়ে পড়েছিল; সেখানে ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ার পর মঞ্চের সক্রিয় সংগঠনগুলোর অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একটি ছোট্ট হিসাব উল্লেখ করছি। মহিলা সমিতিতে এখন একবেলা নাটক করতে হলে ছোট-বড় সব দলেরই সতের থেকে আঠার হাজার টাকা খরচ হবে। অনেক দলের ক্ষেত্রে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব হবে না। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকলা একাডেমিই মঞ্চকর্মীদের জন্য অন্যতম ভরসা। পাশাপাশি মহিলা সমিতির ক্ষেত্রে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার জোর দাবিও উঠেছে। যাতে করে আবার মঞ্চপাড়া সরব হয়ে ওঠে।

এত গেল মঞ্চের অবস্থা। সিনেমা হলের অবস্থা কেমন? এমনিতেই সিনেমার ক্ষেত্রে দুর্দিন চলছে। ১৩শ’ সিনেমা হল ছিল সারা দেশে। এখন সেই সংখ্যা একশ’রও নিচে এসে ঠেকেছে। দেশের অনেক বিভাগীয় শহরেও সিনেমা হল নাই। দেশের প্রতিটি জেলা শহরে সিনেপ্লেক্স করার কথা শোনা গিয়েছিল পতিত সরকারের আমলে। এখন সেই উদ্যোগ বোধকরি থেমে আছে। এফডিসিতে আধুনিক ভবন ও শুটিং ফ্লোর নির্মাণের কাজ চলছে। সে কারণে এফডিসিতে শুটিং বন্ধ রয়েছে। কবীরপুরে সিনেমা পল্লী নির্মাণের কল্প-কাহিনী অনেক বছর থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কার্যত দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও দেখা দিয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। বিগত ১৫/১৬ বছরের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠেছে। এতদিন যারা ছিলেন চরম অবহেলিত, এখন তারা গুরুত্ব পাচ্ছেন। এটাই তো হওয়ার কথা। বৈষম্য দূর না হলে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু বৈষম্যের কথা তুলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিহিংসার মানসিকতা এতটাই গুরুত্ব পাচ্ছে যে, সংস্কৃতির বিকাশ ভাবনা দিনে দিনে শক্তি হারাচ্ছে। একথা সত্য, বিগত সরকারের আমলে সংস্কৃতির বিকাশ ভাবনায় দলীয় দৃষ্টিকোণকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে ভিন্ন মতের সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল চরম অবহেলিত। ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটায় অন্যান্য সেক্টরের মতো দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একটি পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এটাই স্বাভাবিক। পরিবর্তনের কথা বলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চেয়ারের মানুষ বদল হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বৈষম্য দূর হচ্ছে না। ‘ক’-এর জায়গায় ‘খ’ আসছেন। শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের চিত্র মোটেও পাল্টাচ্ছে না।
অতীতকালে দেখা গেছে যে, কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা বেশ জোরালো ছিল। কিন্তু এবার ছাত্র গণআন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের সেভাবে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ আছে। সে কারণে দেশবরেণ্য অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও বর্তমান সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছেন না। বরং তাদেরকে উপেক্ষা করার প্রবণতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এর ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ঐক্য ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে।
আবারো বলি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিও বটে। ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ও বৈষম্যকে গুরুত্ব দিয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া বেশ কঠিন কাজ। নষ্ট মানুষ, নষ্ট সহকর্মী কারও বন্ধু নয়। তবে বিরুদ্ধ মতের অভিযোগ তুলে কাউকে নষ্ট মানুষ, নষ্ট সহকর্মীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাও সমীচীন নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশকে একটি নতুন ভোরের সন্ধান দিয়েছে। আলোকিত ভোর। এখন সময় ভোরের এই ঝলমলে আলোকে পরম যত্নে ছড়িয়ে দিয়ে পুরো দিনটাকে অনিন্দ্য সুন্দর করে তোলা। এজন্য ঐক্যের বিকল্প নাই। ঐক্যই শক্তি। ঐক্যেই মুক্তি। ঈর্ষার আগুন নয়, ভালোবাসার শক্তি হোক আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মূল প্রেরণা। শুভ কামনা সবার জন্য।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.