গল্প- হাড়শূন্য পোকার লড়াই by শামস সাইদ
-------১------
হাসপাতালের ছোট্ট বেডে টানটান শুয়ে আছেন কবি। চোখ বন্ধ করে। শ্বাস ছাড়ছেন দীর্ঘ। অনেকটা ভারি। কখনও আবার চোখ খুলছেন। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে সূর্য্য উঁকি দেয়ার মতো। আবার ভেঙে পড়ছে পাতা দুটো। পারছেন না ধরে রাখতে। হাসপাতালের বেডে কেন কবি? তাঁর তো শুয়ে থাকার কথা নয়। শুয়ে থাকতে মন তারও চাচ্ছে না।মন চাচ্ছে উঠে হাঁটা শুরু করতে। হন হনিয়ে ছুটে যাবেনপেছনে ফেলে পথের পর পথ। নাহয় ফেলে আসা পথের হিসেব মেলাতে। চেষ্টা করেন উঠে বসতে। আবার পড়ে যান কাঁপতে কাঁপতে। শরীরটা খুব ভারি। পাহাড়ের মতো। বেশিও হতে পারে। কতটা ওজন হয়েছে তা জানেন না। তবে উল্টাতে পাল্টাতে কষ্ট হচ্ছে। কেউ বুঝবে না এই ছোট্ট শরীরটা এত ভারি! অনেকটা পাতলা হয়ে গেছেন। শীর্ণ হয়ে গেছে হাত পা। শুকনো বাঁশের মতো। জলশূন্য নদীর বালু চরের মতো জেগে উঠেছে শিরা-উপশিরা। খাটের দুপাশে লোহার স্টান। তার সাথে ঝুলছে প্লাস্টিকের ব্যাগ। যার চিকন পাইপ সংযোজন করা কবির শিরায়। সেই পাইপ দিয়ে নামছে লাল পানি। অন্যটা দিয়ে সাদা পানি। ফোঁটায় ফোঁটায় এসে জমা হচ্ছে স্টকে। সেখান থেকে ইরির ক্ষেতের সরু নালার মতো ছুটছে শিরা-উপশিরায়। ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের মহলে। সতেজ করে তুলতে চায় কবির নিস্তেজ দেহ। সেই শরীর নিয়ে দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে কবি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যা রেখা টেনেছে। মনে হচ্ছে সমস্ত আলো এসে লুটিয়ে পড়েছে আকাশের পায়ে। দিনটা কীভাবে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেখছেন তা। কত অসহায়। তখনই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তাঁর। কেন? হয়তো নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন। আবার চোখ বন্ধ করলেন। বুকটা ওঠানামা করছে। বারবার।
চিন্তিত মনে কবির পাশে বসে আছেন মল্লিকা। দীর্ঘদিনের সঙ্গী তাঁর। গভীর দৃষ্টিতে দেখছেন। পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীকে। কত এলোমেলো ছিলো জীবনটা। ছুটতেন পাগলা ঘোড়ার মতো। বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না আলো কিংবা আধার। হঠাৎ করে পাল্টে গেল সেই জীবন। সারাদিন খেলা করতেন শব্দ নিয়ে। রাত পোহালেই ছুটতেন লাঙ্গল হাতে। চাষ করতেন ভাষা। শব্দ ফলাতেন। সে শব্দ দিয়ে রচনা করতেন নতুন পথ। সে পথে হেঁটে যেতেন জীবনের জয়গান গেয়ে। কত কাব্যকলা, শব্দের অক্ষর আর নশ্বর দেহ নিয়ে কবি আজ শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। কষ্ট হচ্ছে মল্লিকার। খুব কষ্ট। পাথর হয়ে গেছেন নিজেও। নড়তে পারছেন না। স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন কবির পাশে।
--------২-------
কবির মধ্যে অনেক যাতনা, যন্ত্রণাও রয়েছে। তা শরীরে নয়। মস্তিষ্কে। কবির মস্তিষ্ক পড়ে আছে অলস। বেশ কয়েক মাস। এই সময় অনেক ভাবনা জমেছে মস্তিষ্কে। অনেক নাটক। অনেক গল্প। অনেক উপন্যাস। অনেক গান। অনেক কবিতা। অনেক প্রবন্ধ। এরা কবির মস্তিষ্কে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে জন্ম নেয়ার। কবি পারছেন না এদের জন্ম দিতে। জন্মক্ষমতা হারিয়েছেন তিনি।তাও তিন মাস আগে। শরীরটা রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। বালুচরের মতো সব রক্ত যেন চলে যাচ্ছে তলদেশে। সতেজতা হারাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে অন্যের রক্তে অসাড় শরীরটাকে সচল করার চেষ্টা চলছে। সে চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভাবনাগুলো, শব্দগুলো থেমে নেই। একের পর এক হানা দিচ্ছে। স্লোগান দিচ্ছে। বেরিয়ে আসতে চায়। ধারণ করতে চায় কালো অক্ষরে নিজের আকৃতি। ছড়িয়ে পড়তে চায় রাজপথ থেকে গলিপথে। মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে। হৃদয়ে হৃদয়ে। মুড়ির ঠোঙা থেকে নিউজ পেপারে। বুক সেলফ থেকে ফুটপাতে বইয়ের দোকানে। শরীরে লাগাতে চায় প্রেসের মেকাপ। আওয়াজ তুলতে চায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন কবি। থামিয়ে দিতে চাইলেন শব্দের আন্দোলন। বললেন, থামাও আন্দোলন। কেন আন্দোলন করছ?
শব্দরা থামে না। শোনে না কবির কথা। কেনই বা শুনবে! কবি আজ শক্তিশূন্য। রক্তশূন্য। ন্যুব্জ বয়সের ভারে। অনেকগুলো ভাবনার মৃত্যু হয়েছে। অপেক্ষায় থেকে থেকে।
কবি চোখ খুললেন। মৃদু হাসি ফ্যাকাসে মুখে। সে হাসি দেখে চকচক করে উঠল মল্লিকার চেহারা। কবি বললেন, আমি আর পারছি না সহ্য করতে। ওরা আন্দোলন করছে। জন্ম নিতে চায়। জন্মযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছি আমি। অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান জড়ো হয়েছে। কিলবিল করছে। আক্ষরিক রূপ চায়। প্রাণ চায়। কালো কালির অক্ষর ছাড়া তো প্রাণ পাবে না ওরা। একবার কালো অক্ষরে রূপ পেলে কেউ ওদের মারতে পারবে না। অমর হয়ে থাকবে। তাই ওরা আন্দোলন করছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ওদেরকে আক্ষরিক রূপ দেব আমি। প্রাণ দেব। কতটা পারব জানি না। হয়তো কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ব। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও প্রাণ দেব ওদের।
কবির হাত ধরলেন মল্লিকা। শক্ত করে। আপনি কী পারবেন, সবাইকে আক্ষরিক রূপ দিতে? সেতো অনেক সময়ের ব্যাপার। আপনি বলুন। ওদের আক্ষরিক রূপ দিই আমি। প্রাণ পাক ওরা।
হাত তুললেন কবি। অনেকটা শক্তি-সাহস ভর করছে তার ভেতর। বললেন, অতটা ক্লান্ত এখনও হইনি মল্লিকা। তুমি ভেব না, হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। তরঙ্গ অনুভব করছি জীবনের। পারব, আমি পারব ওদের আক্ষরিক রূপ দিতে।
কবির কণ্ঠ দৃঢ়। কথায় বেশ শক্তি রয়েছে। তবু অবিশ্বাসের চোখে তাকান মল্লিকা। কেনই যেন তার সন্দেহ হচ্ছে। কোনোদিন এমনটা হয়নি। কিন্তু আজ হচ্ছে। ভাবছেন, কবি এতোসব শব্দের, ভাবনার আক্ষরিক রূপ কিংবা প্রাণ দিতে পারবেন? পারবেন মস্তিষ্ক থেকে ওদেরকে বের করে আনতে? কবির আত্মবিশ্বাসের সামনে দাঁড়াতে পারছে না তার অবিশ^াস। সেই আত্মবিশ্বাসের দেয়ালটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল আজ। কবিও তার আত্মবিশ্বাস থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন অনেকটা।
-------৩------
গত তিনমাস কবির মস্তিষ্কে লড়াই করেছিল ভাবনা আর শব্দ। জন্ম নেয়ার লড়াই। এখন লড়াই চলছে দুপক্ষের হার-জিতের। দখলের লড়াই। অস্তিত্বের লড়াই। আবাসন রক্ষার লড়াই। সে লড়াইয়ের ময়দান কবির মস্তিষ্কের পুরনো বাড়িটা।
কবির শরীরে বাসা বেঁধেছে একদল পোকা। যাদের শরীরে হাড় নেই। তবে শক্তি আছে।তারা চেষ্টা করছে কবির শরীরের পুরোটা দখলে নিতে। দখল করে আবাসন তৈরি করবে না তারা। এই শরীরটা তাদের খাদ্য। গত তিন মাসে পোকারা অনেকটা খেয়েছে। বাকিটাও খাবে। তাই পুরো শরীরটাকে দখলে নেয়ার চেষ্টা। এই প্ল্যান করেছে গত তিন মাস। তবে দখল করতে পারেনি। অনেকটা কাবু করেছে। পোকারা বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। কবির এত শক্তির উৎস কোথায়? কেনই বা পারছে না তারা দখলে নিতে। সফল হতেই হবে তাদের। একটি পোকা বলল, আমি জানি কবির এই শক্তির উৎস।
কি উৎস? জানতে চাইলেন পোকাদের সেনাপতি। তাকে জানানো হলো কবির শক্তির উৎস তার মস্তিষ্ক।সেনাপতি বললেন, আজই কবির মস্তিষ্কের খবর নিতে হবে। ওখানের পরিস্থিতি কি জানতে হবে আমাদের। তারপর ওখানে অ্যাটাক করা হবে। দায়িত্ব দিল একদল পোকাকে।
মস্তিষ্কের দ্বার অরক্ষিত পেয়ে হাড়শূন্য পোকার দল নাসিকা গহ্বরের গিরিপথ থেকে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। কবি চোখ বন্ধ করে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে গেলেন জীবনের পুরনো খাতায়। তখনই মস্তিষ্কের সবগুলো কলোনি ঘুরে এসে খবর দিল পোকার দল।কবিকে সজীব রাখতে মস্তিষ্কে অসংখ্য শব্দ কাজ করছে। যারা কবিকে শক্তি জোগাচ্ছে। সাহস জোগাচ্ছে। সেই শব্দগুলোকে হারাতে হবে। শব্দগুলো হারলে হেরে যাবেন কবি।পোকারা সিদ্ধান্ত নিল আজই হামলা করবে। একটি শক্তিশালী দল পাঠাল কবির মস্তিষ্কে। যাতে কবির মস্তিষ্ক দখলে নিতে পারে তারা।
আর একদল পোকা নেমে গেল নিচের দিকে। কবির লিভার ও কিডনির নিয়ন্ত্রণ নিতে। এই দুটো যন্ত্রও অচল করতে হবে। তাহলে দ্রুত তাদের সফলতা আসবে। সেখানে পোকারা বাধার মুখে পড়েনি। সহজেই লিভার ও কিডনি দুর্গের দখল নিয়ে নিল। যারা মস্তিষ্কে লড়াই করতে এসেছে তারা ভাবছিল মস্তিষ্কের পুরনো বাড়িটা পতিত। অনেক কাল এখানে কেউ বাস করে না। সহজেই দখল নিতে পারবে। কিন্তু না, সেখানে তারা তীব্র বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। কোনোভাবেই দখলে নিতে পারছে না। পোকার সাথে লড়াই করছে কবির মস্তিষ্কে জমে থাকা অসংখ্য শব্দ। এই শব্দগুলো, এই ভাবনাগুলোই কবির মস্তিষ্কের আদি বাসিন্দা। একাশি বছর তারা মস্তিষ্কের এই বাড়িতে বাস করছে। হাড়শূন্য পোকাগুলোকে দেখে প্রথমে অবাক হয় তারা। এরা কোথা থেকে এলো? এরা তো তাদের গোত্রের কেউ না। এই কলোনির সবাই সবাইকে চেনে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা এরাই তো। সবাই মিলেমিশেই তো আছে একাশি বছর। পোকাগুলোকে তাদের শত্রু মনে হলো। তখনই শুরু হলো লড়াই। হাড় ভাঙা লড়াই চলছে। ঝন ঝন শব্দ হচ্ছে। কেউ ছাড় দেয়ার নয়।শব্দগুলো নিজেদের আবাসন রক্ষায় জীবন-মরণ লড়াই করছে। যে করেই হোক একাশি বছরের পুরনো বসতি রক্ষা করতে হবে। পোকাগুলোও পিছু হটছে না। একের পর এক আঘাত হানছে। সকালে শুরু হওয়া লড়াই থেমে থেমে দুপুরের পরেও চলছে। পোকাগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হৃদয়ের ক্যাম্প থেকে আর একদল পোকা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ক্লান্ত শব্দগুলোর ওপর নতুন করে হামলে পড়ে। দু’পক্ষের আক্রমনে চুন শুরকির গাথুনির পুরনো বিল্ডিংয়ের মতো মস্তিষ্কের একাংশ ঝরে পড়ে। শব্দগুলো চাপা পড়ে ভগ্নাংশের নিচে। মোড়াতে মোড়াতে পোকাগুলো উঠে এসেছে উপরে। শব্দগুলো চাপা পড়ে রয়েছে। বেরিয়ে আসার শক্তি নেই তাদের।
দু’পক্ষের লড়াইয়ে বিপর্যস্ত কবি। চোখ মেলে তাকাতে পারছেন না তিনি। অনেকটা আশাহতও হলেন। মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন পুরনো বাসিন্দারাই থাকুক। ওদের সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এখন মনে হচ্ছে শব্দরা আর থাকতে পারছে না। উদ্বাস্তুর মতো শব্দগুলোকে বিদায় নিতে হবে পুরনো বসতি থেকে।
পোকারা ঢুকে পড়েছে কলোনির ভেতর। দখল দিচ্ছে একের পর এক। এবার নিশ্চিত হলেন কবি, পুরনো বাসিন্দাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছে আবাসন। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। শব্দ ও ভাবনাগুলোর মধ্যে অনেকেই আবাসন ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকে চাপা পড়েছে। মস্তিষ্কে অবস্থান করছে কবিতা। কবিতা কলোনিতে আঘাত হানতে পারে নাই পোকাগুলো। তারা আত্মসমর্পনও করে নাই। পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও করে নাই। এবার পোকারা এই কলোনির চারদিক ঘিরে ধরেছে। আঘাত হানছে। আটকে পড়া শব্দগুলো চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ মনে হলো এখান থেকে তাদের বের হতে হবে। তাই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নাহয় এই অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে থাকতে হবে। কক্ষটি ভাঙতে পারে না। কীভাবে বের হবে? এক সময় মনে হলো কবিই পারেন তাদের মুক্ত করতে। এই কক্ষটির একটি গোপন দরজা আছে। যেটা কবি ছাড়া কেউ জানেন না। যার চাবি কবির হাতে। কবির কাছে শব্দগুলো আবেদন করল, হে কবি উদ্ধার করুন আমাদের।
বিমর্ষ মনে চোখ খুললেন কবি। তাকালেন মল্লিকার দিকে। সে চোখে অসহায়ত্বের ছাপ। মল্লিকার বিশ্বাস ছিল শব্দরা হারবে না। কেননা শক্তিশালী আদি শব্দচাষী কবি। সেই শব্দদের হারানো এতোটা সহজ নয়। কবিকে চিন্তিত দেখে তারও চিন্তা বাড়ছে। একদিন আগেও এতটা বিধ্বস্ত ছিলেন না কবি। স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হঠাৎ। তাহলে কি শব্দগুলোকে প্রাণ দিতে পারছেন না তিনি?
নিচুস্বরে কবি বললেন, শব্দরা হেরে গেছে মল্লিকা। গান, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটককে কবর দিয়ে এসেছে বদমাশ ওই হাড়শূন্য পোকাগুলো। অধিকাংশ ভাবনা বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কিছু চাপা পড়েছে। শুধু কবিতারা আছে। ওরাও আটকে পড়েছে। কলোনির ভেতর। ওরা হেরে গেলে আমিও যে হেরে যাই মল্লিকা। ওদের উদ্ধার করতে হবে। হারতে দিতে পারি না ওদের।
ক্রমশই মল্লিকার ভয়টা বেড়ে চলেছে। বাড়ছে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, কবিতাগুলোও হারিয়ে যাবে। পারবেন না আপনি আক্ষরিক রূপ দিতে। বলুন। ওদের আক্ষরিক রূপ দিই আমি।
মাথা নাড়লেন কবি। ভাবলেন সেটাও ঠিক। বললেন, দ্রুত করো। আমার ভয় হচ্ছে। কবিতাগুলো হারিয়ে যেতে পারে।
সেই সবুজ সন্ধ্যায় মল্লিকার সহায়তায় কয়েকটা কবিতা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করলেন কবি। দিলেন আক্ষরিক রূপ। প্রাণপণ চেষ্টা করলেন আরো কয়েকটাকে উদ্ধার করতে। তা আর পারলেন না। ততক্ষণে কবিতাগুলোর মৃত্যু ঘটেছে।
------৪-----
কবির শরীরের নিচের অংশে তখনও চলছে যুদ্ধ। লিভার ও কিডনির অস্তিত্ব ধ্বংস করে দিচ্ছে পোকারা। লিভার ও কিডনির চারপাশে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। এ অনুভুতি তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে কবিকে। সে যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। শরীরটা কুকড়ে গেছে। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কবির। যেন আটকে পড়া কবিতাগুলোকে উদ্ধার করতে না পারেন। গলা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় শব্দগুলো। আসতে পারে না। আবার ভেতরে চলে যায়। মল্লিকা তাকিয়ে আছেন কবির মুখের দিকে। খুঁজছেন হারানো শব্দটাকে। কবি বললেন, তুমি চিন্তা করো না। আমার বুকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকো। হাত রাখো কানের কাছে। শব্দগুলো যেন বেরিয়ে যেতে না পারে। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।
চোখ বন্ধ করলেন কবি। দেখলেন পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে তার। যেখানে তিনি হাঁটতে পারছেন না। শুধু শরীরটা ছোট হয়নি। জীবনটাও ছোট হয়েছে। এজন্য কবি চিন্তিত নন। কবি কোনো সংকীর্ণ পৃথিবীতে থাকতে পারেন না। এ পৃথিবী ছেড়ে তিনি বৃহৎ একটা পৃথিবীতে চলে যাবেন। যার কোনো সীমানা নেই। এ পৃথিবীতে তিনি রাজা ছিলেন, সে পৃথিবীতেও রাজা হবেন। রাজার বেশেই যাবেন। কবিকে বরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে নতুন পৃথিবী। তবে এই পৃথিবীর জন্য কবির মায়া হচ্ছে। বড্ড মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। এই জনপদে একাশি বছর হেঁটেছেন। কত মানুষের সাথে আলাপচারিতা হয়েছে। জমিয়ে কতো আড্ডা দিয়েছেন। সেসব ছেড়ে চলে যেতে হবে। এখানে এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তখনই এক অচেনা লোক এসে বসলেন কবির পাশে। হাত রাখলেন কপালে। বললেন, এভাবে শুয়ে থাকে নাকি কবিরা? তাহলে কি আপনি হেরে গেছেন ?
তাঁর হাত ধরলেন কবি। বললেন, একটা কথা শুনুন। আপনি আমার অচেনা। তবু বলছি। কবিরা কখনো হারে না। হারতে জানে না। একাশি বছরে কখনো হারিনি আমি। আজও হার মানিনি। মানব না। একটু বিশ্রমি নিচ্ছি। তাই বুঝি বলছেন হেরে গেছি। মনে রাখবেন এটা শোয়া নয়। এখনো দাঁড়িয়ে আছি আমি।
অবিশ্বাসের চোখে তাকান আগন্তুক। মুখ বুজে হাসেন।
আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে কবি বলেন, আবারও বলছি আপনাকে, শুয়ে থাকা মানুষ নই আমি। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। একাশি বছর হেঁটে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। কম পথ তো হাঁটিনি। রাজপথ, অগ্নিপথ, গলিপথ, অলিপথ, মাটিরপথ, পিচঢালাপথ, সরুপথ, মরুপথ, নদীপথ, আকাশপথ সব পথ পেরিয়ে আজ আমি এখানে। তাই একটু ক্লান্ত। বিশ্রাম নিচ্ছি দুদ-। এটাকে হেরে যাওয়া মনে করবেন না।
আগন্তুক এবার হাসলেন। বড় করে। শব্দ করে বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কবি। কী হবে দাঁড়িয়ে থেকে? অভিধানে আপনার জন্য আর কোনো শব্দ নেই। কবিতা লিখবেন কি দিয়ে?
কবি নড়ে উঠলেন। চেষ্টা করলেন সব শক্তি দিয়ে উঠে বসার।তা আর পারলেন না। শক্ত কণ্ঠে বললেন, ফেলে দিন আপনার অভিধান। পুরনো শব্দ আমার দরকার নেই। শব্দ সৃষ্টি করব আমি। নতুন শব্দে ভরে উঠবে অভিধান। ওসব ব্যাকরণের নিয়ম মানি না আমি। সৃষ্টি করব নতুন ব্যাকরণ। হয়তো আপনার কাছে মনে হবে এটা কোনো ব্যাকরণ নয়। ব্যাকরণ বিধান চাই না আমি। এজন্যই আমি কবি। ওসব আপনি হয়তো বুঝবেন না।
আড়ষ্ট কণ্ঠে আগন্তুক বললেন, আপনি কোন পথে হাঁটবেন? আপনার পথ শেষ হয়ে গেছে। আজ আপনি জীবনের ফুল স্টপে এসে দাঁড়িয়েছেন। একটি পা ফেলারও জায়গা নেই সামনে।
কবি হাসলেন। বললেন, আপনাকে আমি বুঝাতে পারিনি। আপনি কবি দেখেছেন। কবির জীবন দেখেননি। আমি পশ্চিম আকাশের সূর্য নই। মধ্যগগনের। একটা কথা শুনুন, কবিদের পথ কখনও শেষ হয় না। কেননা কবিরা কারো বানানো পথে হাঁটে না। পথ তৈরি করে। নতুন পথ তৈরি করে হেঁটে যাব আমি। সে পথ কন্টকময় নয়। ফুল বিছানো পথ। শান্তির পথ। যে পথে পৃথিবীর সব মানুষ হাঁটবে। গান গাইবে মুক্তির।
আগন্তুক তাকিয়ে আছেন কবির দিকে।
কবি বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? তাহলে দেখুন। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন কবি। কিন্তু পারছেন না।
কবিকে শুইয়ে দিলেন আগন্তুক। বললেন, আপনি বীর সেটা আমি জানি। আমাকে দেখাতে হবে না। তবে আমি এখন আরো কিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার তৃতীয় একটা চোখ আছে। সে চোখ দিয়ে আপনার হৃদয় দেখেছি আমি। আপনার মস্তিষ্ক দেখেছি।
চুপ হয়ে গেলেন কবি। একটু লজ্জাও পেলেন। তার হৃদয়ের খবরও জানেন। তাহলে আর কি বলার আছে। কীভাবে আড়াল করবেন তার চোখ। খানিকপরে আগন্তুক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কবি আপনি বিব্রত হচ্ছেন। আমি চললাম। তবে আপনাকে বিদায় জানাতে আসিনি আমি। এসেছিলাম নতুন পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে।
আর কিছু বলতে পারলেন না কবি। দু’চোখ বেয়ে তার জল নামছে। চোখ খুললেন তিনি। দেখলেন মল্লিকার হাতে কাগজ কলম। বললেন, রাখো কাগজ কলম। কবিতা লিখব না আর আমি। বর্ণমালা থেকে যাবে, অন্য কেউ যেন লেখে। শাহবাগের পথে হাঁটব না কোনোদিন আর। পথ থাকবে, হাঁটবে অন্যকোনো পথিক। কাঁধে ঝুলিয়ে চটের ব্যাগ। বাংলা একাডেমিতে যাব না। বসব না পকুর পাড়ের সিঁড়িতে। বই মেলায় গিয়ে উল্টাব না নতুন বইয়ের পাতা। কবিতা পড়ব না কোনো আড্ডায় গিয়ে। কারো দরজায় গিয়ে করাঘাত করব না। করব না কবিতার আন্দোলন। বিজুর বইয়ের দোকানে গিয়ে বসব না। খুঁজব না নিজের পছন্দের বই। আসবে অনেক নতুন বই। কখনো স্বাদ নেব না ইলিশের ডিমের। মা ইলিশ ডিম ছেড়ে বাচ্চা জন্মাবে। টসটসা লিচুর রসে ভরে উঠবে না আমার মুখ। আমি আর দেখব না পূর্ণিমার চাঁদ। ¯œান করব না জ্যোৎ¯œা-র রুপালি জলে। শুনব না ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ। প্রেম নিবেদন করব না মল্লিকাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব না কারো জন্য গোলাপ হাতে। আমি আর যাব না শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাব না শহীদদের। কিংবা কারো লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব না শ্রদ্ধা জানাতে। যাব না আমি স্মৃতি সৌধে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে। নূরুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব না কেমন আছিস? আমি কাল বাড়ি আসব। কয়েকটা বাতাবি লেবু পেড়ে রাখিস আমার জন্য। খাব না তোমার হাতের রান্না আর।
জলে ভরে ওঠে মল্লিকার চোখ। কিছু বলতে পারছেন না তিনি। আঁচলে চোখ মুছলেন।
কবি ভাবছেন লাশ হয়ে যাব আমি। শহীদ মিনারের পাদদেশে শুয়ে থাকব কফিনে। দীর্ঘদিনের এই বন্ধুকে বিদায় জানাতে আসবে তোমরা ফুল হাতে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে আমার কফিন। আমি বলব, বিদায়, হে পৃথিবী। বিদায় বন্ধু।
হাসপাতালের ছোট্ট বেডে টানটান শুয়ে আছেন কবি। চোখ বন্ধ করে। শ্বাস ছাড়ছেন দীর্ঘ। অনেকটা ভারি। কখনও আবার চোখ খুলছেন। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে সূর্য্য উঁকি দেয়ার মতো। আবার ভেঙে পড়ছে পাতা দুটো। পারছেন না ধরে রাখতে। হাসপাতালের বেডে কেন কবি? তাঁর তো শুয়ে থাকার কথা নয়। শুয়ে থাকতে মন তারও চাচ্ছে না।মন চাচ্ছে উঠে হাঁটা শুরু করতে। হন হনিয়ে ছুটে যাবেনপেছনে ফেলে পথের পর পথ। নাহয় ফেলে আসা পথের হিসেব মেলাতে। চেষ্টা করেন উঠে বসতে। আবার পড়ে যান কাঁপতে কাঁপতে। শরীরটা খুব ভারি। পাহাড়ের মতো। বেশিও হতে পারে। কতটা ওজন হয়েছে তা জানেন না। তবে উল্টাতে পাল্টাতে কষ্ট হচ্ছে। কেউ বুঝবে না এই ছোট্ট শরীরটা এত ভারি! অনেকটা পাতলা হয়ে গেছেন। শীর্ণ হয়ে গেছে হাত পা। শুকনো বাঁশের মতো। জলশূন্য নদীর বালু চরের মতো জেগে উঠেছে শিরা-উপশিরা। খাটের দুপাশে লোহার স্টান। তার সাথে ঝুলছে প্লাস্টিকের ব্যাগ। যার চিকন পাইপ সংযোজন করা কবির শিরায়। সেই পাইপ দিয়ে নামছে লাল পানি। অন্যটা দিয়ে সাদা পানি। ফোঁটায় ফোঁটায় এসে জমা হচ্ছে স্টকে। সেখান থেকে ইরির ক্ষেতের সরু নালার মতো ছুটছে শিরা-উপশিরায়। ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের মহলে। সতেজ করে তুলতে চায় কবির নিস্তেজ দেহ। সেই শরীর নিয়ে দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে কবি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যা রেখা টেনেছে। মনে হচ্ছে সমস্ত আলো এসে লুটিয়ে পড়েছে আকাশের পায়ে। দিনটা কীভাবে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেখছেন তা। কত অসহায়। তখনই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তাঁর। কেন? হয়তো নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন। আবার চোখ বন্ধ করলেন। বুকটা ওঠানামা করছে। বারবার।
চিন্তিত মনে কবির পাশে বসে আছেন মল্লিকা। দীর্ঘদিনের সঙ্গী তাঁর। গভীর দৃষ্টিতে দেখছেন। পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীকে। কত এলোমেলো ছিলো জীবনটা। ছুটতেন পাগলা ঘোড়ার মতো। বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না আলো কিংবা আধার। হঠাৎ করে পাল্টে গেল সেই জীবন। সারাদিন খেলা করতেন শব্দ নিয়ে। রাত পোহালেই ছুটতেন লাঙ্গল হাতে। চাষ করতেন ভাষা। শব্দ ফলাতেন। সে শব্দ দিয়ে রচনা করতেন নতুন পথ। সে পথে হেঁটে যেতেন জীবনের জয়গান গেয়ে। কত কাব্যকলা, শব্দের অক্ষর আর নশ্বর দেহ নিয়ে কবি আজ শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। কষ্ট হচ্ছে মল্লিকার। খুব কষ্ট। পাথর হয়ে গেছেন নিজেও। নড়তে পারছেন না। স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন কবির পাশে।
--------২-------
কবির মধ্যে অনেক যাতনা, যন্ত্রণাও রয়েছে। তা শরীরে নয়। মস্তিষ্কে। কবির মস্তিষ্ক পড়ে আছে অলস। বেশ কয়েক মাস। এই সময় অনেক ভাবনা জমেছে মস্তিষ্কে। অনেক নাটক। অনেক গল্প। অনেক উপন্যাস। অনেক গান। অনেক কবিতা। অনেক প্রবন্ধ। এরা কবির মস্তিষ্কে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে জন্ম নেয়ার। কবি পারছেন না এদের জন্ম দিতে। জন্মক্ষমতা হারিয়েছেন তিনি।তাও তিন মাস আগে। শরীরটা রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। বালুচরের মতো সব রক্ত যেন চলে যাচ্ছে তলদেশে। সতেজতা হারাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে অন্যের রক্তে অসাড় শরীরটাকে সচল করার চেষ্টা চলছে। সে চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভাবনাগুলো, শব্দগুলো থেমে নেই। একের পর এক হানা দিচ্ছে। স্লোগান দিচ্ছে। বেরিয়ে আসতে চায়। ধারণ করতে চায় কালো অক্ষরে নিজের আকৃতি। ছড়িয়ে পড়তে চায় রাজপথ থেকে গলিপথে। মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে। হৃদয়ে হৃদয়ে। মুড়ির ঠোঙা থেকে নিউজ পেপারে। বুক সেলফ থেকে ফুটপাতে বইয়ের দোকানে। শরীরে লাগাতে চায় প্রেসের মেকাপ। আওয়াজ তুলতে চায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন কবি। থামিয়ে দিতে চাইলেন শব্দের আন্দোলন। বললেন, থামাও আন্দোলন। কেন আন্দোলন করছ?
শব্দরা থামে না। শোনে না কবির কথা। কেনই বা শুনবে! কবি আজ শক্তিশূন্য। রক্তশূন্য। ন্যুব্জ বয়সের ভারে। অনেকগুলো ভাবনার মৃত্যু হয়েছে। অপেক্ষায় থেকে থেকে।
কবি চোখ খুললেন। মৃদু হাসি ফ্যাকাসে মুখে। সে হাসি দেখে চকচক করে উঠল মল্লিকার চেহারা। কবি বললেন, আমি আর পারছি না সহ্য করতে। ওরা আন্দোলন করছে। জন্ম নিতে চায়। জন্মযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছি আমি। অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান জড়ো হয়েছে। কিলবিল করছে। আক্ষরিক রূপ চায়। প্রাণ চায়। কালো কালির অক্ষর ছাড়া তো প্রাণ পাবে না ওরা। একবার কালো অক্ষরে রূপ পেলে কেউ ওদের মারতে পারবে না। অমর হয়ে থাকবে। তাই ওরা আন্দোলন করছে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ওদেরকে আক্ষরিক রূপ দেব আমি। প্রাণ দেব। কতটা পারব জানি না। হয়তো কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ব। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও প্রাণ দেব ওদের।
কবির হাত ধরলেন মল্লিকা। শক্ত করে। আপনি কী পারবেন, সবাইকে আক্ষরিক রূপ দিতে? সেতো অনেক সময়ের ব্যাপার। আপনি বলুন। ওদের আক্ষরিক রূপ দিই আমি। প্রাণ পাক ওরা।
হাত তুললেন কবি। অনেকটা শক্তি-সাহস ভর করছে তার ভেতর। বললেন, অতটা ক্লান্ত এখনও হইনি মল্লিকা। তুমি ভেব না, হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। তরঙ্গ অনুভব করছি জীবনের। পারব, আমি পারব ওদের আক্ষরিক রূপ দিতে।
কবির কণ্ঠ দৃঢ়। কথায় বেশ শক্তি রয়েছে। তবু অবিশ্বাসের চোখে তাকান মল্লিকা। কেনই যেন তার সন্দেহ হচ্ছে। কোনোদিন এমনটা হয়নি। কিন্তু আজ হচ্ছে। ভাবছেন, কবি এতোসব শব্দের, ভাবনার আক্ষরিক রূপ কিংবা প্রাণ দিতে পারবেন? পারবেন মস্তিষ্ক থেকে ওদেরকে বের করে আনতে? কবির আত্মবিশ্বাসের সামনে দাঁড়াতে পারছে না তার অবিশ^াস। সেই আত্মবিশ্বাসের দেয়ালটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল আজ। কবিও তার আত্মবিশ্বাস থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন অনেকটা।
-------৩------
গত তিনমাস কবির মস্তিষ্কে লড়াই করেছিল ভাবনা আর শব্দ। জন্ম নেয়ার লড়াই। এখন লড়াই চলছে দুপক্ষের হার-জিতের। দখলের লড়াই। অস্তিত্বের লড়াই। আবাসন রক্ষার লড়াই। সে লড়াইয়ের ময়দান কবির মস্তিষ্কের পুরনো বাড়িটা।
কবির শরীরে বাসা বেঁধেছে একদল পোকা। যাদের শরীরে হাড় নেই। তবে শক্তি আছে।তারা চেষ্টা করছে কবির শরীরের পুরোটা দখলে নিতে। দখল করে আবাসন তৈরি করবে না তারা। এই শরীরটা তাদের খাদ্য। গত তিন মাসে পোকারা অনেকটা খেয়েছে। বাকিটাও খাবে। তাই পুরো শরীরটাকে দখলে নেয়ার চেষ্টা। এই প্ল্যান করেছে গত তিন মাস। তবে দখল করতে পারেনি। অনেকটা কাবু করেছে। পোকারা বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। কবির এত শক্তির উৎস কোথায়? কেনই বা পারছে না তারা দখলে নিতে। সফল হতেই হবে তাদের। একটি পোকা বলল, আমি জানি কবির এই শক্তির উৎস।
কি উৎস? জানতে চাইলেন পোকাদের সেনাপতি। তাকে জানানো হলো কবির শক্তির উৎস তার মস্তিষ্ক।সেনাপতি বললেন, আজই কবির মস্তিষ্কের খবর নিতে হবে। ওখানের পরিস্থিতি কি জানতে হবে আমাদের। তারপর ওখানে অ্যাটাক করা হবে। দায়িত্ব দিল একদল পোকাকে।
মস্তিষ্কের দ্বার অরক্ষিত পেয়ে হাড়শূন্য পোকার দল নাসিকা গহ্বরের গিরিপথ থেকে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। কবি চোখ বন্ধ করে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে গেলেন জীবনের পুরনো খাতায়। তখনই মস্তিষ্কের সবগুলো কলোনি ঘুরে এসে খবর দিল পোকার দল।কবিকে সজীব রাখতে মস্তিষ্কে অসংখ্য শব্দ কাজ করছে। যারা কবিকে শক্তি জোগাচ্ছে। সাহস জোগাচ্ছে। সেই শব্দগুলোকে হারাতে হবে। শব্দগুলো হারলে হেরে যাবেন কবি।পোকারা সিদ্ধান্ত নিল আজই হামলা করবে। একটি শক্তিশালী দল পাঠাল কবির মস্তিষ্কে। যাতে কবির মস্তিষ্ক দখলে নিতে পারে তারা।
আর একদল পোকা নেমে গেল নিচের দিকে। কবির লিভার ও কিডনির নিয়ন্ত্রণ নিতে। এই দুটো যন্ত্রও অচল করতে হবে। তাহলে দ্রুত তাদের সফলতা আসবে। সেখানে পোকারা বাধার মুখে পড়েনি। সহজেই লিভার ও কিডনি দুর্গের দখল নিয়ে নিল। যারা মস্তিষ্কে লড়াই করতে এসেছে তারা ভাবছিল মস্তিষ্কের পুরনো বাড়িটা পতিত। অনেক কাল এখানে কেউ বাস করে না। সহজেই দখল নিতে পারবে। কিন্তু না, সেখানে তারা তীব্র বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। কোনোভাবেই দখলে নিতে পারছে না। পোকার সাথে লড়াই করছে কবির মস্তিষ্কে জমে থাকা অসংখ্য শব্দ। এই শব্দগুলো, এই ভাবনাগুলোই কবির মস্তিষ্কের আদি বাসিন্দা। একাশি বছর তারা মস্তিষ্কের এই বাড়িতে বাস করছে। হাড়শূন্য পোকাগুলোকে দেখে প্রথমে অবাক হয় তারা। এরা কোথা থেকে এলো? এরা তো তাদের গোত্রের কেউ না। এই কলোনির সবাই সবাইকে চেনে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা এরাই তো। সবাই মিলেমিশেই তো আছে একাশি বছর। পোকাগুলোকে তাদের শত্রু মনে হলো। তখনই শুরু হলো লড়াই। হাড় ভাঙা লড়াই চলছে। ঝন ঝন শব্দ হচ্ছে। কেউ ছাড় দেয়ার নয়।শব্দগুলো নিজেদের আবাসন রক্ষায় জীবন-মরণ লড়াই করছে। যে করেই হোক একাশি বছরের পুরনো বসতি রক্ষা করতে হবে। পোকাগুলোও পিছু হটছে না। একের পর এক আঘাত হানছে। সকালে শুরু হওয়া লড়াই থেমে থেমে দুপুরের পরেও চলছে। পোকাগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হৃদয়ের ক্যাম্প থেকে আর একদল পোকা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ক্লান্ত শব্দগুলোর ওপর নতুন করে হামলে পড়ে। দু’পক্ষের আক্রমনে চুন শুরকির গাথুনির পুরনো বিল্ডিংয়ের মতো মস্তিষ্কের একাংশ ঝরে পড়ে। শব্দগুলো চাপা পড়ে ভগ্নাংশের নিচে। মোড়াতে মোড়াতে পোকাগুলো উঠে এসেছে উপরে। শব্দগুলো চাপা পড়ে রয়েছে। বেরিয়ে আসার শক্তি নেই তাদের।
দু’পক্ষের লড়াইয়ে বিপর্যস্ত কবি। চোখ মেলে তাকাতে পারছেন না তিনি। অনেকটা আশাহতও হলেন। মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন পুরনো বাসিন্দারাই থাকুক। ওদের সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এখন মনে হচ্ছে শব্দরা আর থাকতে পারছে না। উদ্বাস্তুর মতো শব্দগুলোকে বিদায় নিতে হবে পুরনো বসতি থেকে।
পোকারা ঢুকে পড়েছে কলোনির ভেতর। দখল দিচ্ছে একের পর এক। এবার নিশ্চিত হলেন কবি, পুরনো বাসিন্দাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছে আবাসন। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। শব্দ ও ভাবনাগুলোর মধ্যে অনেকেই আবাসন ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকে চাপা পড়েছে। মস্তিষ্কে অবস্থান করছে কবিতা। কবিতা কলোনিতে আঘাত হানতে পারে নাই পোকাগুলো। তারা আত্মসমর্পনও করে নাই। পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও করে নাই। এবার পোকারা এই কলোনির চারদিক ঘিরে ধরেছে। আঘাত হানছে। আটকে পড়া শব্দগুলো চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ মনে হলো এখান থেকে তাদের বের হতে হবে। তাই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নাহয় এই অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে থাকতে হবে। কক্ষটি ভাঙতে পারে না। কীভাবে বের হবে? এক সময় মনে হলো কবিই পারেন তাদের মুক্ত করতে। এই কক্ষটির একটি গোপন দরজা আছে। যেটা কবি ছাড়া কেউ জানেন না। যার চাবি কবির হাতে। কবির কাছে শব্দগুলো আবেদন করল, হে কবি উদ্ধার করুন আমাদের।
বিমর্ষ মনে চোখ খুললেন কবি। তাকালেন মল্লিকার দিকে। সে চোখে অসহায়ত্বের ছাপ। মল্লিকার বিশ্বাস ছিল শব্দরা হারবে না। কেননা শক্তিশালী আদি শব্দচাষী কবি। সেই শব্দদের হারানো এতোটা সহজ নয়। কবিকে চিন্তিত দেখে তারও চিন্তা বাড়ছে। একদিন আগেও এতটা বিধ্বস্ত ছিলেন না কবি। স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হঠাৎ। তাহলে কি শব্দগুলোকে প্রাণ দিতে পারছেন না তিনি?
নিচুস্বরে কবি বললেন, শব্দরা হেরে গেছে মল্লিকা। গান, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটককে কবর দিয়ে এসেছে বদমাশ ওই হাড়শূন্য পোকাগুলো। অধিকাংশ ভাবনা বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কিছু চাপা পড়েছে। শুধু কবিতারা আছে। ওরাও আটকে পড়েছে। কলোনির ভেতর। ওরা হেরে গেলে আমিও যে হেরে যাই মল্লিকা। ওদের উদ্ধার করতে হবে। হারতে দিতে পারি না ওদের।
ক্রমশই মল্লিকার ভয়টা বেড়ে চলেছে। বাড়ছে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, কবিতাগুলোও হারিয়ে যাবে। পারবেন না আপনি আক্ষরিক রূপ দিতে। বলুন। ওদের আক্ষরিক রূপ দিই আমি।
মাথা নাড়লেন কবি। ভাবলেন সেটাও ঠিক। বললেন, দ্রুত করো। আমার ভয় হচ্ছে। কবিতাগুলো হারিয়ে যেতে পারে।
সেই সবুজ সন্ধ্যায় মল্লিকার সহায়তায় কয়েকটা কবিতা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করলেন কবি। দিলেন আক্ষরিক রূপ। প্রাণপণ চেষ্টা করলেন আরো কয়েকটাকে উদ্ধার করতে। তা আর পারলেন না। ততক্ষণে কবিতাগুলোর মৃত্যু ঘটেছে।
------৪-----
কবির শরীরের নিচের অংশে তখনও চলছে যুদ্ধ। লিভার ও কিডনির অস্তিত্ব ধ্বংস করে দিচ্ছে পোকারা। লিভার ও কিডনির চারপাশে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। এ অনুভুতি তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে কবিকে। সে যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। শরীরটা কুকড়ে গেছে। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কবির। যেন আটকে পড়া কবিতাগুলোকে উদ্ধার করতে না পারেন। গলা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় শব্দগুলো। আসতে পারে না। আবার ভেতরে চলে যায়। মল্লিকা তাকিয়ে আছেন কবির মুখের দিকে। খুঁজছেন হারানো শব্দটাকে। কবি বললেন, তুমি চিন্তা করো না। আমার বুকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকো। হাত রাখো কানের কাছে। শব্দগুলো যেন বেরিয়ে যেতে না পারে। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।
চোখ বন্ধ করলেন কবি। দেখলেন পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে তার। যেখানে তিনি হাঁটতে পারছেন না। শুধু শরীরটা ছোট হয়নি। জীবনটাও ছোট হয়েছে। এজন্য কবি চিন্তিত নন। কবি কোনো সংকীর্ণ পৃথিবীতে থাকতে পারেন না। এ পৃথিবী ছেড়ে তিনি বৃহৎ একটা পৃথিবীতে চলে যাবেন। যার কোনো সীমানা নেই। এ পৃথিবীতে তিনি রাজা ছিলেন, সে পৃথিবীতেও রাজা হবেন। রাজার বেশেই যাবেন। কবিকে বরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে নতুন পৃথিবী। তবে এই পৃথিবীর জন্য কবির মায়া হচ্ছে। বড্ড মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। এই জনপদে একাশি বছর হেঁটেছেন। কত মানুষের সাথে আলাপচারিতা হয়েছে। জমিয়ে কতো আড্ডা দিয়েছেন। সেসব ছেড়ে চলে যেতে হবে। এখানে এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তখনই এক অচেনা লোক এসে বসলেন কবির পাশে। হাত রাখলেন কপালে। বললেন, এভাবে শুয়ে থাকে নাকি কবিরা? তাহলে কি আপনি হেরে গেছেন ?
তাঁর হাত ধরলেন কবি। বললেন, একটা কথা শুনুন। আপনি আমার অচেনা। তবু বলছি। কবিরা কখনো হারে না। হারতে জানে না। একাশি বছরে কখনো হারিনি আমি। আজও হার মানিনি। মানব না। একটু বিশ্রমি নিচ্ছি। তাই বুঝি বলছেন হেরে গেছি। মনে রাখবেন এটা শোয়া নয়। এখনো দাঁড়িয়ে আছি আমি।
অবিশ্বাসের চোখে তাকান আগন্তুক। মুখ বুজে হাসেন।
আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে কবি বলেন, আবারও বলছি আপনাকে, শুয়ে থাকা মানুষ নই আমি। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। একাশি বছর হেঁটে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। কম পথ তো হাঁটিনি। রাজপথ, অগ্নিপথ, গলিপথ, অলিপথ, মাটিরপথ, পিচঢালাপথ, সরুপথ, মরুপথ, নদীপথ, আকাশপথ সব পথ পেরিয়ে আজ আমি এখানে। তাই একটু ক্লান্ত। বিশ্রাম নিচ্ছি দুদ-। এটাকে হেরে যাওয়া মনে করবেন না।
আগন্তুক এবার হাসলেন। বড় করে। শব্দ করে বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কবি। কী হবে দাঁড়িয়ে থেকে? অভিধানে আপনার জন্য আর কোনো শব্দ নেই। কবিতা লিখবেন কি দিয়ে?
কবি নড়ে উঠলেন। চেষ্টা করলেন সব শক্তি দিয়ে উঠে বসার।তা আর পারলেন না। শক্ত কণ্ঠে বললেন, ফেলে দিন আপনার অভিধান। পুরনো শব্দ আমার দরকার নেই। শব্দ সৃষ্টি করব আমি। নতুন শব্দে ভরে উঠবে অভিধান। ওসব ব্যাকরণের নিয়ম মানি না আমি। সৃষ্টি করব নতুন ব্যাকরণ। হয়তো আপনার কাছে মনে হবে এটা কোনো ব্যাকরণ নয়। ব্যাকরণ বিধান চাই না আমি। এজন্যই আমি কবি। ওসব আপনি হয়তো বুঝবেন না।
আড়ষ্ট কণ্ঠে আগন্তুক বললেন, আপনি কোন পথে হাঁটবেন? আপনার পথ শেষ হয়ে গেছে। আজ আপনি জীবনের ফুল স্টপে এসে দাঁড়িয়েছেন। একটি পা ফেলারও জায়গা নেই সামনে।
কবি হাসলেন। বললেন, আপনাকে আমি বুঝাতে পারিনি। আপনি কবি দেখেছেন। কবির জীবন দেখেননি। আমি পশ্চিম আকাশের সূর্য নই। মধ্যগগনের। একটা কথা শুনুন, কবিদের পথ কখনও শেষ হয় না। কেননা কবিরা কারো বানানো পথে হাঁটে না। পথ তৈরি করে। নতুন পথ তৈরি করে হেঁটে যাব আমি। সে পথ কন্টকময় নয়। ফুল বিছানো পথ। শান্তির পথ। যে পথে পৃথিবীর সব মানুষ হাঁটবে। গান গাইবে মুক্তির।
আগন্তুক তাকিয়ে আছেন কবির দিকে।
কবি বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? তাহলে দেখুন। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন কবি। কিন্তু পারছেন না।
কবিকে শুইয়ে দিলেন আগন্তুক। বললেন, আপনি বীর সেটা আমি জানি। আমাকে দেখাতে হবে না। তবে আমি এখন আরো কিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার তৃতীয় একটা চোখ আছে। সে চোখ দিয়ে আপনার হৃদয় দেখেছি আমি। আপনার মস্তিষ্ক দেখেছি।
চুপ হয়ে গেলেন কবি। একটু লজ্জাও পেলেন। তার হৃদয়ের খবরও জানেন। তাহলে আর কি বলার আছে। কীভাবে আড়াল করবেন তার চোখ। খানিকপরে আগন্তুক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কবি আপনি বিব্রত হচ্ছেন। আমি চললাম। তবে আপনাকে বিদায় জানাতে আসিনি আমি। এসেছিলাম নতুন পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে।
আর কিছু বলতে পারলেন না কবি। দু’চোখ বেয়ে তার জল নামছে। চোখ খুললেন তিনি। দেখলেন মল্লিকার হাতে কাগজ কলম। বললেন, রাখো কাগজ কলম। কবিতা লিখব না আর আমি। বর্ণমালা থেকে যাবে, অন্য কেউ যেন লেখে। শাহবাগের পথে হাঁটব না কোনোদিন আর। পথ থাকবে, হাঁটবে অন্যকোনো পথিক। কাঁধে ঝুলিয়ে চটের ব্যাগ। বাংলা একাডেমিতে যাব না। বসব না পকুর পাড়ের সিঁড়িতে। বই মেলায় গিয়ে উল্টাব না নতুন বইয়ের পাতা। কবিতা পড়ব না কোনো আড্ডায় গিয়ে। কারো দরজায় গিয়ে করাঘাত করব না। করব না কবিতার আন্দোলন। বিজুর বইয়ের দোকানে গিয়ে বসব না। খুঁজব না নিজের পছন্দের বই। আসবে অনেক নতুন বই। কখনো স্বাদ নেব না ইলিশের ডিমের। মা ইলিশ ডিম ছেড়ে বাচ্চা জন্মাবে। টসটসা লিচুর রসে ভরে উঠবে না আমার মুখ। আমি আর দেখব না পূর্ণিমার চাঁদ। ¯œান করব না জ্যোৎ¯œা-র রুপালি জলে। শুনব না ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ। প্রেম নিবেদন করব না মল্লিকাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব না কারো জন্য গোলাপ হাতে। আমি আর যাব না শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাব না শহীদদের। কিংবা কারো লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব না শ্রদ্ধা জানাতে। যাব না আমি স্মৃতি সৌধে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে। নূরুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব না কেমন আছিস? আমি কাল বাড়ি আসব। কয়েকটা বাতাবি লেবু পেড়ে রাখিস আমার জন্য। খাব না তোমার হাতের রান্না আর।
জলে ভরে ওঠে মল্লিকার চোখ। কিছু বলতে পারছেন না তিনি। আঁচলে চোখ মুছলেন।
কবি ভাবছেন লাশ হয়ে যাব আমি। শহীদ মিনারের পাদদেশে শুয়ে থাকব কফিনে। দীর্ঘদিনের এই বন্ধুকে বিদায় জানাতে আসবে তোমরা ফুল হাতে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে আমার কফিন। আমি বলব, বিদায়, হে পৃথিবী। বিদায় বন্ধু।
No comments