ইসরাইলের অজানা কথা by ড. ইলিয়াস আকলেহ
একটি
প্রতিষ্ঠিত ও খুব পরিচিত তথ্য হলো, ইসরাইল হচ্ছে গণহত্যাকারী,
সন্ত্রাসবাদী, জনগোষ্ঠী নির্মূলকারী এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। তাদের ওল্ড
টেস্টামেন্টে এক অভিজাততন্ত্রী ‘দেবতা’র কথা আছে, যে গণহত্যার হোতা ও
রক্তপিপাসু। এই অপশক্তির ধর্মটাই বর্ণবাদী, শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও
প্রতিশোধপরায়ণ। আজকের আইএস সন্ত্রাসীদের মতো- ইহুদিদের স্টার্ন, ইরগুন,
পালমাক, হেগানা প্রভৃতি সন্ত্রাসবাদী গ্যাং ১৯৪৬ থেকে ফিলিস্তিনিদের
খাদ্যবিপণি, থানা, হোটেলসহ বেসামরিক বহু টার্গেটে বোমা মেরেছে। ফিলিস্তিন
ভূখণ্ডে অসংখ্য গণহত্যা, গ্রামের জনবসতির ওপর হামলা, নারী ধর্ষণ ও শিশু
নির্যাতন, কোথাও কোথাও ঠাণ্ডা মাথায় সব অধিবাসীর হত্যাযজ্ঞ, গ্রামের পর
গ্রাম ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া, প্রভৃতি অপরাধ এরা ঘটিয়েছে।
ফিলিস্তিনি জনগণের চার শতাধিক গ্রাম পুরোপুরি কিংবা বেশির ভাগই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর বাসিন্দাদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এসব কিছুর উদ্দেশ্য, স্বদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করা। ১৯৪৮ সালে অন্তত আট লাখ ফিলিস্তিনি নর-নারীকে নিজস্ব আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করায় তারা পরিণত হলো উদ্বাস্তুতে।
স্বঘোষিত ‘সভ্য’ বিশ্বশক্তিরা তাদের নতুন হাতিয়ার হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সৃষ্টি করেছিল। তারা কিন্তু ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে কোনো জোট গঠন করেনি। ওরাই বর্তমানে আইএসকে মোকাবেলার জন্য জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। বরঞ্চ জবরদখল করা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী চক্রগুলোকে করেছে পুরস্কৃত।
১৯৪৮-এ যা দখল করে নিয়েছিল, তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না লোভী সম্প্রসারণবাদী ইসরাইলি ইহুদি নেতারা। তাই তারা আরো চেয়েছেন। তারা এখানে-ওখানে আরব গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন। একপর্যায়ে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা ফিলিস্তিনের বাদবাকি অংশও দখল করে নিলেন; সেই সাথে আংশিকভাবে লেবানন, সিরিয়া, মিসরও। এ জন্য আরো যুদ্ধাপরাধ ঘটানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনে আর গোলান মালভূমিতে জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হলো, বহু সিরীয় গ্রাম পর্যবসিত হয় ধ্বংসস্তূপে; ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে এক হাজার মিসরীয় বন্দীকে। ৬৭ সালের লড়াইয়ে ইসরাইল বেআইনি ঘোষিত, নাপাম বোমার ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়েছে আরবদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
কথিত সভ্য জগৎ ইসরাইলকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখতে কিছুই করেনি। তারা কেবল অর্থহীন বিবৃতি প্রদান আর দন্তবিহীন জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব গ্রহণে ব্যস্ত ছিল। এ প্রস্তাবে ইসরাইলি দখলদারিকে বেআইনি বলে ‘সবিনয়ে’ ইসরাইলকে অনুরোধ করা হয় দখলকৃত স্থান থেকে সরে যাওয়ার জন্য।
ইসরাইলের নেতারা বিরত হননি। তারা জাতিসঙ্ঘের যাবতীয় প্রস্তাব লঙ্ঘন করে মিসর, জর্দান ও লেবাননে হামলা চালিয়েছেন। লেবাননের রাজধানী বৈরুতকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হলো। সেখানে সাবরা ও শাতিলার মতো হত্যাযজ্ঞের অনেক নজির ইসরাইল স্থাপন করেছে। এমনকি, জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষণ চৌকিতে বোমা ফেলতেও দ্বিধা করেনি ইসরাইল। যাতে গুচ্ছ বোমাসহ বিভিন্ন প্রকার অবৈধ অস্ত্রবলে ইসরাইলি হামলার প্রমাণ রাখা না যায়, সে জন্যই এ হামলা করা হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ ইসরাইলের গণহত্যাসহ এসব ব্যাপারে কিছুই করেনি, অর্থহীন তদন্ত রিপোর্ট লেখা ছাড়া।
ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পাদিত সব শান্তিচুক্তি নগ্নভাবে লঙ্ঘনপূর্বক ইসরাইল তার অত্যাচার-নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়, যাতে ওদের উৎখাত করে ইহুদিবাদী দখলদারদের বসতি গড়ার সুযোগ করে দেয়া যায়। এ জন্য ফিলিস্তিনিদের কারাবন্দী করা হয়; তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়; বহু ফিলিস্তিনি শিশুকে মধ্যরাতে ইসরাইলের সন্ত্রাসী সেনারা অপহরণ করে জেলে আটকে রাখে; ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস বা দখল করা হয়েছে; উগ্রপন্থী ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দেয়া হয়েছে সেসব বাড়িঘর; ফিলিস্তিনিদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তাতে বেআইনি ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে; শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় এবং ট্যাংক দিয়ে অবরোধ করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত শহরগুলো।
ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত হামলা করে থাকে ফিলিস্তিনি জনপদে। তারা তখন শস্য পুড়িয়ে দেয়; পানির কূপে মিশিয়ে দেয় বিষ; গাছপালা কেটে ফেলে; ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করে; সম্পদ করে ধ্বংস। এ ধরনের আরো অনেক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইহুদিরা করে থাকে। উগ্রবাদী ইহুদিরা নিয়মিতই হামলা চালিয়ে অপবিত্র করছে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো। দৃশ্যত সৈন্যদের পাহারাধীন, আল আকসা মসজিদে তাদের হামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ইসরাইল এ যাবৎকালের বৃহত্তম বন্দিশিবির তৈরি করেছে গাজায়। এই এলাকা ও এর বাসিন্দারা ইসরাইলের নব-উদ্ভাবিত রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার জীবন্ত টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ঘন ঘন ইসরাইল তার সুয়ারেজ লাইনের আবর্জনা গাজার শহরগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। ইসরাইলি সেনারা কয়েক দফায় গাজায় নির্বিচার হামলা করেছে। এ সময়ে সাধারণ লোকজনকে হত্যা এবং বসতবাটি ধ্বংস করা হয়। ইসরাইলের হামলা ও ধ্বংসের টার্গেট ছিল গাজার অফিস আদালত, বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা ও মসজিদ, সব ধরনের যানবাহন এবং মাছ ধরার নৌকা।
গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নির্বিচারে বারবার সাদা ফসফরাস বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করেছে। হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন এটাকে বলেছে ‘অগ্নিবৃষ্টি’। জাতিসঙ্ঘের ত্রাণসংস্থা (UNRWA) পরিচালিত স্কুলগুলোতে বোমা ফেলতেও দ্বিধা করেনি ইসরাইল। অথচ আশ্রয়কেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত এসব স্কুলে যাতে হামলা করা না হয়; এ জন্য এগুলোর জিপিএস অবস্থান আগেই ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনি জনগণ যাতে খাদ্যাভাবে দুর্ভোগের শিকার হয়; সেজন্য জাতিসঙ্ঘের দেয়া খাদ্যের মজুদের ওপর হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করা হয়েছে।
গাজার ফিলিস্তিনিদের বিশ্বসম্প্রদায় ও আরব নেতারা পরিত্যাগ করেছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যাধি আর ইসরাইলি গুলির মুখে এভাবে ঠেলে দেয়ায় গাজাবাসী নিজেরাই ১৯৪৮ সালের জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব নম্বর ১৯৪ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জোর দেয়া হয়েছে ইসরাইলের দখল করা এলাকায় অবস্থিত আসল বাড়িঘরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ফিরে যাওয়ার বৈধ অধিকারের বিষয়ে। গাজার মানুষ প্রতি শুক্রবার ‘প্রত্যাবর্তনের মহান অভিযাত্রা’ দ্বারা ইসরাইলের আরোপিত প্রতিবন্ধক পর্যন্ত অগ্রসর হচ্ছে।
এই প্রতিবন্ধক দিয়ে গাজার ক্ষুদ্র এলাকায় তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। এই অভিযাত্রার সূচনা গত বছর ৩০ মার্চ। এবার এ কর্মসূচির ৭০তম দিবস অতিবাহিত হয়েছে। অভিযাত্রীরা নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল মারাত্মক বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। ইহুদি চোরাগোপ্তা হামলাবাজরা বিষাক্ত গ্যাস এবং রাবার বুলেট ও সত্যিকার গুলি ব্যবহার করেছে। এ পর্যন্ত শিশু, নারী, চিকিৎসাকর্মী ও সাংবাদিকসমেত ৩১০ জন ফিলিস্তিনিকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। বিস্ফোরক বুলেটের আঘাতে আহত অনেকের অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে।
ইসরাইলের সন্ত্রাসী হুমকি অধিকৃত ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলো ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বিস্তৃত। এটা ভালোভাবেই জানা যে, ইসরাইলের আছে পরমাণু বোমা। এর প্রযুক্তি ও উপকরণ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চুরি করে আনা হয়েছিল। অনেক দেশের রাজধানীতে এ বোমার হামলা করার হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। তার পরও, দেশটি পরমাণু অস্ত্র বর্জন করবে না; পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের চুক্তিতে সই দেবে না এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে (IAEA) ইসরাইলি পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দেবে না। বরং ইসরাইল তার পরমাণু সমরাস্ত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া একমাত্র ইসরাইলই পরমাণু বোমা ব্যবহার করেছে। ইসরাইল এ বোমার প্রয়োগ ঘটিয়েছে তার নিকটতম মিত্র খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ’৯/১১’-র ভুয়া হামলায়। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধের যৌক্তিকতার আড়ালে আরব বিশ্বকে যেন টার্গেট করা যায়, এ জন্যই ওই হামলার অবতারণা। সিরিয়ার উপরেও ইসরাইল পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছে। ইয়েমেনে ইসরাইল দু’টি নিউট্রন বোমা ফেলার কথা জানা গেছে।
মোসাদ এজেন্টদের ঘটানো হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সন্ত্রাসী হামলা পৌঁছে গেছে দুনিয়ার দেশে দেশে। তা ছাড়া ‘ভুয়া পতাকা’ হামলা চালানো হয় যাতে ভীত হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের ইহুদিরা ‘নিরাপদ’ ইসরাইলে চলে যায়। উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে কেনেডিদের হত্যা, আরব ও ফিলিস্তিনি অ্যাক্টিভিস্টদের খুন করা, মিসর, ইরাক ও ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ড, প্রভৃতি অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ভুয়া হামলা চালানো হয় ইহুদিদের উপাসনালয়, বিদ্যালয় ও গোরস্তানে। সেইসাথে ‘ইসলামপন্থী’দের নামে হামলা চলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন টার্গেটে।
ইসরাইল হচ্ছে এমন দেশ, যে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসে লিপ্ত। তবুও আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তাকে রক্ষা ও সমর্থন করছে। অথচ এ দেশগুলো ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তির বুলি আওড়ায়। লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানকে ‘সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা, বিধ্বংসী অস্ত্র রাখা এবং নিষিদ্ধ ও রাসায়নিক অস্ত্র’ ব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করে এসব দেশ যে আচরণ করে থাকে, তা দেখা যায় না ইসরাইলের বেলায়। সে ক্ষেত্রে নেই অর্থনৈতিক অবরোধ; তীব্র নিন্দা অথবা সামরিক হামলা।
এর বিপরীতে, আমরা দেখে আসছি- জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলকে বাঁচাতে একের পর আরেক মার্কিন প্রশাসন ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। ইসরাইলকে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। এর বাইরে, বিনামূল্যে সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাদের সহায়তা করা তো আছেই। ইসরাইল নাকি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘একমাত্র গণতান্ত্রিক মিত্র।’ আমেরিকার মানুষের আবাসন সঙ্কট বাড়ছে ক্রমশ; অথচ সে দেশের সরকার দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে বেআইনি ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা আজীবন টানছে শিক্ষার্থী ঋণের বোঝা। অথচ মার্কিন প্রশাসন কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত, ইসরাইলি নাগরিকদের বিনা খরচে শিক্ষালাভের জন্য ভর্তুকি ঢালছে। চিকিৎসাবীমার অভাবে অনেক আমেরিকান নাগরিক মারা যায় এবং কষ্ট পায়। অথচ প্রত্যেক ইসরাইলি যাতে সারা জীবন বিনাব্যয়ে চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে, এ জন্য আমেরিকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল হচ্ছে একটি সুরক্ষিত সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। ইসরাইল যে অপরাধই করুক, পাশ্চাত্যজগৎ তাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
এটা বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের যুগের কথা- ১৯০৫ সাল। তখন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। খুবই শক্তিশালী এ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল উপসাগরীয় এলাকা থেকে আটলান্টিক অবধি গোটা আরবজগতে। ১৯০৫ সালেই ইরান ও আরব উপদ্বীপে জ্বালানি তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হেনরি ক্যাম্পবেল-ব্যানারম্যান একটি সম্মেলন ডাকেন, যার পরিচিতি ছিল ‘ঔপনিবেশিক সম্মেলন’ হিসেবেও। কিভাবে অটোম্যান সাম্রাজ্যকে দুর্বল বা ধ্বংস করা যায় এবং পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টীয় উপনিবেশবাদী সভ্যতাকে শক্তিশালী করে তোলা যেতে পারে, তার আর্থ-রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করাই ছিল সম্মেলনটির উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ, বেলজিয়াম, স্পেন ও ইটালি সাম্রাজ্যের কর্মকর্তারা এবং খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ, কৃষিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা এতে অংশ নেন। দু’বছর চলে এ সম্মেলন।
তারা এ উপসংহারে উপনীত হন যে, ‘ভূমধ্যসাগর হলো তিনটি প্রধান মহাদেশের সংযোজনকারী। তাই এ সাগর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে প্রাকৃতিক সেতুবন্ধন। এর পূর্ব ও দক্ষিণ তীর ‘আরব’ নামের একটি জাতির করতলগত। আরবদের রয়েছে অভিন্ন ভাষা ও ইতিহাস এবং বিশেষত একক ধর্ম। ভূকৌশলগত অবস্থান, প্রধান প্রধান বাণিজ্য পথ, তেলসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রচুর জনশক্তির সমভিব্যহারে আরবরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হতে পারে।’ এটা যাতে না হতে পারে, সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছিল ওই সম্মেলন থেকে।
এ অঞ্চলের জন্য সর্বাধিক বিপর্যয়কর বিষয় হলো, আরব জগতের মধ্যখানে একটি বৈরী ‘বাফার স্টেট’ তৈরি করা। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে এটা প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের তাদের উত্তর আফ্রিকান ভাইদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এভাবে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যেই ফিলিস্তিনে ইসরাইলের জন্ম দেয়ার জন্য সমর্থন করা হয়েছে ইহুদিবাদকে।
সে সময়ের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বিচ্ছিন্নতাকামী ধর্ম হিসেবে ইহুদিদের পরিচিতি, তাদের সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা; অ-ইহুদি সবার প্রতি ওদের ঘৃণা; প্রভৃতি কারণে ইহুদিবিরোধী মনোভাব ইউরোপে ছিল প্রবল। ইউরোপের বহু দেশ থেকে তাদের বের করে দেয়া হয় লাথি মেরে। ‘ইহুদিবাদ’ হলো একটি রাজনৈতিক মতবাদ যার লক্ষ্য হচ্ছে শুধু ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইউরোপের ইহুদি ইস্যুর ‘নিরসন’ই ইহুদিবাদের জন্মের কারণ। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে এবং আরব জগতের হৃৎপিণ্ডতুল্য, ফিলিস্তিনে বৈরী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিবাদকে মদদ দিয়ে ‘এক ঢিলে দুটি পাখি’ মারতে চাওয়া হয়েছে।
প্রথমত ইসরাইল হবে আরব বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে একটি বৈরী ‘বাফার স্টেট’। পাশ্চাত্যের সামরিক শিল্পকে জিইয়ে রাখা হবে আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইসরাইল কর্তৃক নিরন্তর যুদ্ধের পরিস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত ইউরোপ তার ইহুদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে ইহুদিরা ইউরোপ থেকে ইসরাইলে চলে গেলে।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফোর ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজেই মনে করতেন, ‘ইহুদিরা বৈরী ও শত্রুভাবাপন্ন জনগোষ্ঠী।’ তৎকালীন অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিকের মতো বালফোরও ব্রিটিশ এলিয়েন্স অ্যাক্ট নামের আইনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আইনটি করা হয়েছিল ব্রিটেনে রুশ ইহুদিদের অভিবাসন বন্ধ করার জন্য। বালফোর ইহুদিবাদকে সমর্থন দেন এ কারণে যে, এর দ্বারা পাশ্চাত্য সমাজ সংখ্যালঘু ইহুদিদের কবল থেকে নিস্তার পাবে, যারা সে সমাজকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।
[কাউন্টারকারেন্টস ডট ওআরজি, ২০ আগস্ট ২০১৯ সংখ্যার সৌজন্যে।
>>>লেখক : ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আরব-আমেরিকান। ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র সময়ে ইহুদিরা হাইফাতে তার পারিবারিক সম্পত্তি দখল করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের বাকিটাও দখল করে নিলে তার পরিবারকে পশ্চিম তীর থেকে বিতাড়িত করা হয়।]
>>>ভাষান্তর- মীযানুল করীম
ফিলিস্তিনি জনগণের চার শতাধিক গ্রাম পুরোপুরি কিংবা বেশির ভাগই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর বাসিন্দাদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এসব কিছুর উদ্দেশ্য, স্বদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করা। ১৯৪৮ সালে অন্তত আট লাখ ফিলিস্তিনি নর-নারীকে নিজস্ব আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করায় তারা পরিণত হলো উদ্বাস্তুতে।
স্বঘোষিত ‘সভ্য’ বিশ্বশক্তিরা তাদের নতুন হাতিয়ার হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সৃষ্টি করেছিল। তারা কিন্তু ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে কোনো জোট গঠন করেনি। ওরাই বর্তমানে আইএসকে মোকাবেলার জন্য জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। বরঞ্চ জবরদখল করা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী চক্রগুলোকে করেছে পুরস্কৃত।
১৯৪৮-এ যা দখল করে নিয়েছিল, তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না লোভী সম্প্রসারণবাদী ইসরাইলি ইহুদি নেতারা। তাই তারা আরো চেয়েছেন। তারা এখানে-ওখানে আরব গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন। একপর্যায়ে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা ফিলিস্তিনের বাদবাকি অংশও দখল করে নিলেন; সেই সাথে আংশিকভাবে লেবানন, সিরিয়া, মিসরও। এ জন্য আরো যুদ্ধাপরাধ ঘটানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনে আর গোলান মালভূমিতে জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হলো, বহু সিরীয় গ্রাম পর্যবসিত হয় ধ্বংসস্তূপে; ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে এক হাজার মিসরীয় বন্দীকে। ৬৭ সালের লড়াইয়ে ইসরাইল বেআইনি ঘোষিত, নাপাম বোমার ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়েছে আরবদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
কথিত সভ্য জগৎ ইসরাইলকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখতে কিছুই করেনি। তারা কেবল অর্থহীন বিবৃতি প্রদান আর দন্তবিহীন জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব গ্রহণে ব্যস্ত ছিল। এ প্রস্তাবে ইসরাইলি দখলদারিকে বেআইনি বলে ‘সবিনয়ে’ ইসরাইলকে অনুরোধ করা হয় দখলকৃত স্থান থেকে সরে যাওয়ার জন্য।
ইসরাইলের নেতারা বিরত হননি। তারা জাতিসঙ্ঘের যাবতীয় প্রস্তাব লঙ্ঘন করে মিসর, জর্দান ও লেবাননে হামলা চালিয়েছেন। লেবাননের রাজধানী বৈরুতকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হলো। সেখানে সাবরা ও শাতিলার মতো হত্যাযজ্ঞের অনেক নজির ইসরাইল স্থাপন করেছে। এমনকি, জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষণ চৌকিতে বোমা ফেলতেও দ্বিধা করেনি ইসরাইল। যাতে গুচ্ছ বোমাসহ বিভিন্ন প্রকার অবৈধ অস্ত্রবলে ইসরাইলি হামলার প্রমাণ রাখা না যায়, সে জন্যই এ হামলা করা হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ ইসরাইলের গণহত্যাসহ এসব ব্যাপারে কিছুই করেনি, অর্থহীন তদন্ত রিপোর্ট লেখা ছাড়া।
ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পাদিত সব শান্তিচুক্তি নগ্নভাবে লঙ্ঘনপূর্বক ইসরাইল তার অত্যাচার-নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়, যাতে ওদের উৎখাত করে ইহুদিবাদী দখলদারদের বসতি গড়ার সুযোগ করে দেয়া যায়। এ জন্য ফিলিস্তিনিদের কারাবন্দী করা হয়; তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়; বহু ফিলিস্তিনি শিশুকে মধ্যরাতে ইসরাইলের সন্ত্রাসী সেনারা অপহরণ করে জেলে আটকে রাখে; ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস বা দখল করা হয়েছে; উগ্রপন্থী ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দেয়া হয়েছে সেসব বাড়িঘর; ফিলিস্তিনিদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তাতে বেআইনি ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে; শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় এবং ট্যাংক দিয়ে অবরোধ করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত শহরগুলো।
ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত হামলা করে থাকে ফিলিস্তিনি জনপদে। তারা তখন শস্য পুড়িয়ে দেয়; পানির কূপে মিশিয়ে দেয় বিষ; গাছপালা কেটে ফেলে; ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করে; সম্পদ করে ধ্বংস। এ ধরনের আরো অনেক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইহুদিরা করে থাকে। উগ্রবাদী ইহুদিরা নিয়মিতই হামলা চালিয়ে অপবিত্র করছে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো। দৃশ্যত সৈন্যদের পাহারাধীন, আল আকসা মসজিদে তাদের হামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ইসরাইল এ যাবৎকালের বৃহত্তম বন্দিশিবির তৈরি করেছে গাজায়। এই এলাকা ও এর বাসিন্দারা ইসরাইলের নব-উদ্ভাবিত রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার জীবন্ত টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ঘন ঘন ইসরাইল তার সুয়ারেজ লাইনের আবর্জনা গাজার শহরগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। ইসরাইলি সেনারা কয়েক দফায় গাজায় নির্বিচার হামলা করেছে। এ সময়ে সাধারণ লোকজনকে হত্যা এবং বসতবাটি ধ্বংস করা হয়। ইসরাইলের হামলা ও ধ্বংসের টার্গেট ছিল গাজার অফিস আদালত, বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা ও মসজিদ, সব ধরনের যানবাহন এবং মাছ ধরার নৌকা।
গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নির্বিচারে বারবার সাদা ফসফরাস বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করেছে। হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন এটাকে বলেছে ‘অগ্নিবৃষ্টি’। জাতিসঙ্ঘের ত্রাণসংস্থা (UNRWA) পরিচালিত স্কুলগুলোতে বোমা ফেলতেও দ্বিধা করেনি ইসরাইল। অথচ আশ্রয়কেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত এসব স্কুলে যাতে হামলা করা না হয়; এ জন্য এগুলোর জিপিএস অবস্থান আগেই ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনি জনগণ যাতে খাদ্যাভাবে দুর্ভোগের শিকার হয়; সেজন্য জাতিসঙ্ঘের দেয়া খাদ্যের মজুদের ওপর হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করা হয়েছে।
গাজার ফিলিস্তিনিদের বিশ্বসম্প্রদায় ও আরব নেতারা পরিত্যাগ করেছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যাধি আর ইসরাইলি গুলির মুখে এভাবে ঠেলে দেয়ায় গাজাবাসী নিজেরাই ১৯৪৮ সালের জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব নম্বর ১৯৪ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জোর দেয়া হয়েছে ইসরাইলের দখল করা এলাকায় অবস্থিত আসল বাড়িঘরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ফিরে যাওয়ার বৈধ অধিকারের বিষয়ে। গাজার মানুষ প্রতি শুক্রবার ‘প্রত্যাবর্তনের মহান অভিযাত্রা’ দ্বারা ইসরাইলের আরোপিত প্রতিবন্ধক পর্যন্ত অগ্রসর হচ্ছে।
এই প্রতিবন্ধক দিয়ে গাজার ক্ষুদ্র এলাকায় তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। এই অভিযাত্রার সূচনা গত বছর ৩০ মার্চ। এবার এ কর্মসূচির ৭০তম দিবস অতিবাহিত হয়েছে। অভিযাত্রীরা নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল মারাত্মক বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। ইহুদি চোরাগোপ্তা হামলাবাজরা বিষাক্ত গ্যাস এবং রাবার বুলেট ও সত্যিকার গুলি ব্যবহার করেছে। এ পর্যন্ত শিশু, নারী, চিকিৎসাকর্মী ও সাংবাদিকসমেত ৩১০ জন ফিলিস্তিনিকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। বিস্ফোরক বুলেটের আঘাতে আহত অনেকের অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে।
ইসরাইলের সন্ত্রাসী হুমকি অধিকৃত ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলো ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বিস্তৃত। এটা ভালোভাবেই জানা যে, ইসরাইলের আছে পরমাণু বোমা। এর প্রযুক্তি ও উপকরণ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চুরি করে আনা হয়েছিল। অনেক দেশের রাজধানীতে এ বোমার হামলা করার হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। তার পরও, দেশটি পরমাণু অস্ত্র বর্জন করবে না; পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের চুক্তিতে সই দেবে না এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে (IAEA) ইসরাইলি পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দেবে না। বরং ইসরাইল তার পরমাণু সমরাস্ত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া একমাত্র ইসরাইলই পরমাণু বোমা ব্যবহার করেছে। ইসরাইল এ বোমার প্রয়োগ ঘটিয়েছে তার নিকটতম মিত্র খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ’৯/১১’-র ভুয়া হামলায়। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধের যৌক্তিকতার আড়ালে আরব বিশ্বকে যেন টার্গেট করা যায়, এ জন্যই ওই হামলার অবতারণা। সিরিয়ার উপরেও ইসরাইল পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছে। ইয়েমেনে ইসরাইল দু’টি নিউট্রন বোমা ফেলার কথা জানা গেছে।
মোসাদ এজেন্টদের ঘটানো হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সন্ত্রাসী হামলা পৌঁছে গেছে দুনিয়ার দেশে দেশে। তা ছাড়া ‘ভুয়া পতাকা’ হামলা চালানো হয় যাতে ভীত হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের ইহুদিরা ‘নিরাপদ’ ইসরাইলে চলে যায়। উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে কেনেডিদের হত্যা, আরব ও ফিলিস্তিনি অ্যাক্টিভিস্টদের খুন করা, মিসর, ইরাক ও ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ড, প্রভৃতি অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ভুয়া হামলা চালানো হয় ইহুদিদের উপাসনালয়, বিদ্যালয় ও গোরস্তানে। সেইসাথে ‘ইসলামপন্থী’দের নামে হামলা চলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন টার্গেটে।
ইসরাইল হচ্ছে এমন দেশ, যে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসে লিপ্ত। তবুও আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তাকে রক্ষা ও সমর্থন করছে। অথচ এ দেশগুলো ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তির বুলি আওড়ায়। লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানকে ‘সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা, বিধ্বংসী অস্ত্র রাখা এবং নিষিদ্ধ ও রাসায়নিক অস্ত্র’ ব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করে এসব দেশ যে আচরণ করে থাকে, তা দেখা যায় না ইসরাইলের বেলায়। সে ক্ষেত্রে নেই অর্থনৈতিক অবরোধ; তীব্র নিন্দা অথবা সামরিক হামলা।
এর বিপরীতে, আমরা দেখে আসছি- জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলকে বাঁচাতে একের পর আরেক মার্কিন প্রশাসন ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। ইসরাইলকে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। এর বাইরে, বিনামূল্যে সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাদের সহায়তা করা তো আছেই। ইসরাইল নাকি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘একমাত্র গণতান্ত্রিক মিত্র।’ আমেরিকার মানুষের আবাসন সঙ্কট বাড়ছে ক্রমশ; অথচ সে দেশের সরকার দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে বেআইনি ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা আজীবন টানছে শিক্ষার্থী ঋণের বোঝা। অথচ মার্কিন প্রশাসন কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত, ইসরাইলি নাগরিকদের বিনা খরচে শিক্ষালাভের জন্য ভর্তুকি ঢালছে। চিকিৎসাবীমার অভাবে অনেক আমেরিকান নাগরিক মারা যায় এবং কষ্ট পায়। অথচ প্রত্যেক ইসরাইলি যাতে সারা জীবন বিনাব্যয়ে চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে, এ জন্য আমেরিকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল হচ্ছে একটি সুরক্ষিত সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। ইসরাইল যে অপরাধই করুক, পাশ্চাত্যজগৎ তাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
এটা বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের যুগের কথা- ১৯০৫ সাল। তখন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। খুবই শক্তিশালী এ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল উপসাগরীয় এলাকা থেকে আটলান্টিক অবধি গোটা আরবজগতে। ১৯০৫ সালেই ইরান ও আরব উপদ্বীপে জ্বালানি তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হেনরি ক্যাম্পবেল-ব্যানারম্যান একটি সম্মেলন ডাকেন, যার পরিচিতি ছিল ‘ঔপনিবেশিক সম্মেলন’ হিসেবেও। কিভাবে অটোম্যান সাম্রাজ্যকে দুর্বল বা ধ্বংস করা যায় এবং পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টীয় উপনিবেশবাদী সভ্যতাকে শক্তিশালী করে তোলা যেতে পারে, তার আর্থ-রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করাই ছিল সম্মেলনটির উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ, বেলজিয়াম, স্পেন ও ইটালি সাম্রাজ্যের কর্মকর্তারা এবং খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ, কৃষিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা এতে অংশ নেন। দু’বছর চলে এ সম্মেলন।
তারা এ উপসংহারে উপনীত হন যে, ‘ভূমধ্যসাগর হলো তিনটি প্রধান মহাদেশের সংযোজনকারী। তাই এ সাগর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে প্রাকৃতিক সেতুবন্ধন। এর পূর্ব ও দক্ষিণ তীর ‘আরব’ নামের একটি জাতির করতলগত। আরবদের রয়েছে অভিন্ন ভাষা ও ইতিহাস এবং বিশেষত একক ধর্ম। ভূকৌশলগত অবস্থান, প্রধান প্রধান বাণিজ্য পথ, তেলসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রচুর জনশক্তির সমভিব্যহারে আরবরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হতে পারে।’ এটা যাতে না হতে পারে, সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছিল ওই সম্মেলন থেকে।
এ অঞ্চলের জন্য সর্বাধিক বিপর্যয়কর বিষয় হলো, আরব জগতের মধ্যখানে একটি বৈরী ‘বাফার স্টেট’ তৈরি করা। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে এটা প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের তাদের উত্তর আফ্রিকান ভাইদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এভাবে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যেই ফিলিস্তিনে ইসরাইলের জন্ম দেয়ার জন্য সমর্থন করা হয়েছে ইহুদিবাদকে।
সে সময়ের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বিচ্ছিন্নতাকামী ধর্ম হিসেবে ইহুদিদের পরিচিতি, তাদের সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা; অ-ইহুদি সবার প্রতি ওদের ঘৃণা; প্রভৃতি কারণে ইহুদিবিরোধী মনোভাব ইউরোপে ছিল প্রবল। ইউরোপের বহু দেশ থেকে তাদের বের করে দেয়া হয় লাথি মেরে। ‘ইহুদিবাদ’ হলো একটি রাজনৈতিক মতবাদ যার লক্ষ্য হচ্ছে শুধু ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইউরোপের ইহুদি ইস্যুর ‘নিরসন’ই ইহুদিবাদের জন্মের কারণ। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে এবং আরব জগতের হৃৎপিণ্ডতুল্য, ফিলিস্তিনে বৈরী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিবাদকে মদদ দিয়ে ‘এক ঢিলে দুটি পাখি’ মারতে চাওয়া হয়েছে।
প্রথমত ইসরাইল হবে আরব বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে একটি বৈরী ‘বাফার স্টেট’। পাশ্চাত্যের সামরিক শিল্পকে জিইয়ে রাখা হবে আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইসরাইল কর্তৃক নিরন্তর যুদ্ধের পরিস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত ইউরোপ তার ইহুদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে ইহুদিরা ইউরোপ থেকে ইসরাইলে চলে গেলে।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফোর ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজেই মনে করতেন, ‘ইহুদিরা বৈরী ও শত্রুভাবাপন্ন জনগোষ্ঠী।’ তৎকালীন অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিকের মতো বালফোরও ব্রিটিশ এলিয়েন্স অ্যাক্ট নামের আইনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আইনটি করা হয়েছিল ব্রিটেনে রুশ ইহুদিদের অভিবাসন বন্ধ করার জন্য। বালফোর ইহুদিবাদকে সমর্থন দেন এ কারণে যে, এর দ্বারা পাশ্চাত্য সমাজ সংখ্যালঘু ইহুদিদের কবল থেকে নিস্তার পাবে, যারা সে সমাজকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।
[কাউন্টারকারেন্টস ডট ওআরজি, ২০ আগস্ট ২০১৯ সংখ্যার সৌজন্যে।
>>>লেখক : ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আরব-আমেরিকান। ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র সময়ে ইহুদিরা হাইফাতে তার পারিবারিক সম্পত্তি দখল করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের বাকিটাও দখল করে নিলে তার পরিবারকে পশ্চিম তীর থেকে বিতাড়িত করা হয়।]
>>>ভাষান্তর- মীযানুল করীম
No comments